তুমি
আমার মাথায় জলভরা একটি আকাশ
তার নাম তুমি,
খর গ্রীষ্মে আমার উঠোনে অঝোর বর্ষণ
তুমি তার নাম;
ভীষণ তৃষ্ণার্ত এই পথিকের ক্লান্ত চোখে সুশীতল মেঘ
একমাত্র তুমি-
দুপুরের খরতাপ শেষে আমার জীবনে এই শান্ত সন্ধ্যা
তুমি, তুমি, তুমি;
মরুময় এই ভূপ্রকৃতি জুড়ে ঘন প্রেইরীর সবুজ উদ্যান
তুমি তার নাম,
আমার ধূসর দুই চোখে চিরসবুজের গাঢ় হাতছানি
তার নাম তুমি;
আমার স্মৃতির অববাহিকায় একটি স্বপ্নের প্রিয় নদী
তুমি নিরবধি।
তোমাকে দেখার পর থেকে
তোমাকে দেখার পর থেকে কীরকম গণ্ডগোল
হয়ে গেলো সমস্ত জীবন,
ওলটপালট হয়ে গেলো সবকিছু-
সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললাম বুঝ খেই, চিন্তাসূত্র হয়ে গেলো
বিশৃঙ্খল, এলোমেলো;
কেবল তোমারই মুখ দেখি বৃক্ষপত্রে, জ্যোতিস্কমণ্ডলে
উচ্ছল ঝর্নার জলে, বুকশেলফে, পড়ার টেবিলে,
টেলিভিশনের উজ্জ্বল পর্দায়-
এমনকি ডিশ অ্যান্টেনাও ঢেকে দিতে পারেনি তোমার মুখ
রেডিও বা ক্যাসেট খুলেই শুনি তোমার নিবিড় কণ্ঠস্বর।
তোমাকে দেখার পর থেকে কীরকম পাল্টে গেলো
আমার আকাশ
সেখানে এখন শুধু চাঁদের বদলে তুমি ওঠো,
আর একটাই ওঠে সন্ধ্যাতারা, সেও তুমি।
বইগুলো খুলে দেখি সব গ্রন’ জুড়ে শুধু
এই একটাই শব্দ তাতে লেখা-
তোমাকে দেখার পর থেকে অসম্ভব বদলে গেছে
আমার ভূবন
বদলে গেছে জলবায়ু, দিনরাত্রি, ঋতু
তোমার সলজ্জ টেলিফোন
সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে হঠাৎ উঠলো বেজে
আমার নিথর টেলিফোন
রিসিভার তুলে শুনলাম খুব মৃদু স্বরে যখন একটি ছোটো নাম…
মনে হলো এই সূর্যাস্ত উঠলো ভরে ফের ভোরের আলোয়
প্রায় অস্তমিত আমি পুনরায় হয়ে উঠলাম যেন উদিত সকাল;
কতোকাল নিথর নীরব পড়ে থাকা এই ব্যর্থ টেলিফোন
কানায় কানায় বরে গেলো, হয়ে উঠলো মুহূর্তে যেন চঞ্চল হরিণ;
মনে হলো এই টেলিফোনে একসঙ্গে বেজে ওঠে হাজার তারের বীণা
বিসমিল্লা খাঁর স্পন্দিত সানাই,
হেমন্তের সব অপূর্ব লাবণ্যময গান্ত
সহসা আমার মাথার ওপরে মনে হলো এক দিব্য চায়াময়
স্নিগ্ধ নীলাকাশ।
বুঝি আর কখনো আমার বুকে ওঠেনি এমন তোলপাড় করা ঝড়
চারদিক ঢেকে অঝোর ধারায় নামেনি বর্ষণ।
টেলিফোন তুলে শুনি এ যে স্বপ্নপুরীর রহস্যবার্তা একে একে
কবিতার অপরূপ শব্দরাজি সদ্যফোটা শিউলির মতো
টেলিফোন বেয়ে টুপটাপ শুধু ঝরে পড়ে-
কিংবা বর্ষার অজস্র কদমফুলের মতো মনে হয়
দূর থেকে ভেসে আসা সেই শব্দগুলি;
এইখানে টেলিফোনের সামনে বসে আমি তাই
কেবলই আড়ষ্ট হয়ে পড়ি
পাই না মোটেও খুঁজে একটিও যোগ্য শব্দ
বলি খুব সাধারণ দু’একটি কুশল সংবাদ-
অসহায় তোতলার মতো দুটি জড় ঠোঁটে কেবল আটকে যায় কথা
মনে হয় জীবনে কখনো আর ধরিনি কারুর টেলিফোন।
টেলিফোন হাতে নিয়ে হঠাৎ আমার মনে হলো বুষি
নিঃশ্বাস এক্ষুনি বন্ধ হয়ে যাবে
আর একটিও শব্দ বেরুবে না এই নির্বাক নিস্পন্দ কণ্ঠ দিয়ে
আমি বুঝি চিরতরে বোবা হয়ে যাবো;
আর কেবল আমার বুকের ভেতর বেজে যাবে
অন্তহীন এই গাঢ় টেলিফোন।
আমি তাই টেলিফোনে কী বলতে কী যে বলেছি
কিংবা যা বলা উচিত ছিলো তার কিছুই বলিনি
হায় বোকা, টেলিফোনে কেউ কি কখনো এমন সুখের কথা বলে,
এমন দুঃখের কথা বলে!
নীতিশিক্ষা
আমাকে এখন শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়
শহরের বখাটে মাস্তান,
আধুনিকতার পাঠ নিতে হয় প্রস্তরযুগের
সব মানুষের কাছে;
মাতালের কাছে প্রত্যহ শুনতে হয় সংযমের কথা
বধ্যভূমির জল্লাদেরা মানবিক মূল্যবোধ সতত শেখায়,
জলদস্যুদের কাছে আমাকে শুনতে হয়
সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-
মানবপ্রেমের শিক্ষা নিতে হয় শিশুহত্যাকারীদের কাছে।
কিন্তু আমার শেখার কথা নদী ও বৃক্ষের কাছে
ধৈর্য্য-সহিষ্ণুতা,
বিবেক, বিনয়, বিদ্যা আমাকে শেখাবে এই উদার আকাশ
জুঁই আর গোলাপের কাছ থেকে সৌহার্দের মানবিক রীতি,
অথচ এখন প্রতিদিন ঘাতকের কাছে
আমাকে শুনতে হয় মহত্ত্বের কথা;
মূর্খ ইতরের কাছে নিতে হয় বিনয়ের পাঠ
দেশপ্রেম শিক্ষা দেয় বিশ্বাসঘাতক বর্বরেরা,
ক্ষমা আর উদারতা শিক্ষা দেয় হিংস্র
নখদাঁতবিশিষ্ট প্রাণীরা
স্নেহ ও প্রীতির সুমধুর গান গায় সব ধূর্ত কাক।
ভুলে-ভরা আমার জীবন
ভুলে-ভরা আমার জীবন, প্রতিটি পৃষ্ঠায় তার
অসংখ্য বানান ভুল
এলোমেলো যতিচিহ্ন; কোথাও পড়েনি ঠিক
শুদ্ধ অনুচ্ছেদ
আমার জীবন সেই ভুলে-ভরা বই, প্রুফ দেখ
হয়নি কখনো।
প্রতিটি পাতায় তাই রাশি রাশি ভুল, ভুল
কাজ, ভুল পদক্ষেপ
আমার জীবন এ আগাগোড়া ভুলের গণিত,
এই ভুল অঙ্ক আমি সারাটি জীবন ধরে কষে কষে
মেলাতে পারিনি
ফল তার শুধু শূন্য, শুধু শূন্য, শুধু শূন্য।
আমি সব মানুষেল মতো মুখস্ত করিনি এই জীবনের
সংজ্ঞা, সূত্র আর ব্যাকরণ
রচনা বইয়ে পড়া মহৎ জীবনী দেখে আমি
কোনোদিন শুরু করিনি জীবন,
দেখেছি প্রত্যহ আমি সকালের কাজ বিকেলে
কীভাবে পুরোপুরি ভুল হয়ে যায়
বিকেলের কাজ রাতের আগেই মনে হয়
ভুলের ধুলোতে ছেয়ে গেছে।
আমার জীবন এই ভুলে-ভরা দিনরাত্রির কবিতা
অসংখ্যা ভুলের নুড়ি ও পাথর
হয়েছে থলিতে তার জমা
আমার জীবন একখানি স্বরচিত ভুলের আকাশ
আমি তার কাছ থেকে কুড়াই দুহাত ভরে
কেবল স্বপ্নের হাড়গোড়।