- বইয়ের নামঃ হিমুর বাবার কথামালা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ অন্বেষা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ কল্পকাহিনী
উৎসর্গ ও ভূমিকা
হিমুর বাবার কথামালা
হুমায়ূন আহমেদ
উৎসর্গ
মধ্যরাতে যাদের সঙ্গে হিমুর দেখা হয়,
বইটি তাদের জন্যে।
ভূমিকা
বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি গ্রহণ করা যায়। বিচিটা নাকি আড়াআড়ি থাকে। পনেরো হাত বিচি গ্রহণ করার কোনোই কারণ নেই। হিমুর বাবার কথামালা চল্লিশ পৃষ্ঠার একটি বই। এখানে দুই পৃষ্ঠার ভূমিকার অর্থ বারো হাত কাঁকুড়ের পনেরো হাত বিচি।
এ ধরনের বইয়ের ধারণা অমির মাখায় আসে নি। কবি বাপ্পির মাথায় এসেছে। সে প্রায় জবরদস্তি করেই হিমুর বাবাকে নিয়ে আমাকে লিখিয়েছে। হিমুর বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে কাজটা করিয়েছে আমার তা মনে হয় না। তার মধ্যে বাণিজ্য বিষয়টা কাজ করেছে বলে আমার ধারণা। কবি সাহেব কিন্তু আবার একজন প্রকাশকও। আমি নিশ্চিত বাপ্পি কল্পনায় দেখছে- বইমেলা শুরু হয়েছে। পাঠকরা লাইন বেঁধে কিনছে হিমুর বাবার কথামালা।
স্বপ্ন দেখতে সবাই ভালবাসে। কবিরা একটু বেশি ভালবাসেন। এটাই স্বাভাবিক। মানব সম্প্রদায়ের স্বপ্ন দেখে না হিমুরা। তারা অন্যদের স্বপ্ন দেখায়।
হিমুর বাবার কথামালা বইটি শুধুমাত্র হিমুরা পড়লেই ভাল হয়। অন্যরা (বিশেষ করে কিশোর কিশোরীরা) যেন না পড়ে। তাদের মাথায় ভ্ৰান্তি ঢুকে যেতে পারে। ভ্রান্তি একবার ঢুকে গেলে তাকে বের করা বেশ কঠিন। আমি ভ্রান্তির চাষ করতে চাই না।
এখন কথা হচ্ছে হিমু কে? আমি নিজে কি পরিষ্কার জানি? মনে তো হয় না। প্রায়ই যে সব চিঠি পাই তার একটা বড় অংশে এই জাতীয় লেখা থাকে।
১.
স্যার, হিমু হইবার নিয়মাবলি দয়া করিয়া জানাইবেন। আনি একটি সিল্কের পাঞ্জাবী খরিদ করিয়াছি। আমার এক বন্ধু বলিয়াছে হিমুদের পাঞ্জাবী সুতি হইতে হইবে। এই বিষয়ে আপনার মূল্যবান মতামত জানাইয়া বাধিত করিবেন।
২.
আংকেল, আমার নাম নাসিমী। আমি নবম শ্রেণীর ছাত্রী। আমার খুব ইচ্ছা আমি হিমু হব। মেয়েদের হিমু পোশাক কি? হলুদ পাঞ্জাবীর সঙ্গে কি ওড়না পরব? না-কি হলুদ শাড়ি পরব? হলুদ শাড়ি পরলে মনে হবে গায়ে হলুদে যাচ্ছি।
৩.
হুমায়ূন সাহেব! আমার বড় ছেলে সম্প্রতি হিমু হয়েছে। সে হলুদ পাঞ্জাবী পরে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটাহাটি শুরু করেছে। গতকাল পা কেটে বাসায় ফিরেছে। তাকে টিটেনাস ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। আমার বক্তব্য আপনি লেখার মাধ্যমে কোমলমতিদের বিভ্রান্ত করে আনন্দ পান। একজন পিতা হিসেবে আপনার প্রতি অনুরোধ এই কাজটি করবেন না।
আমার অবস্থা হচ্ছে ভিক্ষা চাই না হলুদ চিতাবাঘ সামলাও।
জগতের সমস্ত হিমুরা ভাল থাকুক।
এই শুভ কামনা।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশ পত্রী, গাজীপুর।
হিমুর বাবার নাম কি
হিমুর বাবার নাম কি?
আমি কি হিমু বিষয়ক কোন বইয়ে তাঁর নাম বলেছি?
মনে করতে পারছি না। ভদ্রলোক দেখতে কেমন তাও বলতে পারছি না। তার চেহারার বর্ণনা কি কোথাও করেছি? মনে হয় না। চরিত্রের চেহারা বর্ণনা সাধারণত আমি করি না। দায়িত্ব পাঠকের উপর ছেড়ে দেই, তাদেরকেই চেহারা কল্পনা করে নিতে দেই। আমার উপন্যাসের চরিত্ররা দেখতে কেমন তা জোর করে পাঠকের উপর চাপিয়ে দেই না।
এই পৃথিবীর মহান লেখকদের একজন দস্তয়ভস্কি তার তৈরি চরিত্রগুলির ডিটেল বর্ণনা এমনভাবে দেন যে পাঠক চোখের সামনে চরিত্র দেখতে পান। ঔপন্যাসিক চালর্স ডিকেন্স এই কাজটি ভাল করেন। তার চরিত্র বর্ণনা—
লোকটির মুখ লম্বাটে। জোড়া ভুরু। কানে প্রচুর লোম। নাকের ঠিক নিচেই পেনি আকৃতির একটি লাল আঁচিল। আঁচিলে বড় বড় কয়েকটা কালো চুল আছে। এর মধ্যে একটার রঙ বাদামি। সেই চুল ঠোটের উপর ঝুলে থাকে। মুখের চামড়া কুঁচকানো। কালো তিলে ভর্তি। দাঁত নোংরা। একটি দাঁত সামান্য বড় বলে বের হয়ে থাকে। চোখ ব্রাউন। একটি চোখ অন্যটির চেয়ে সামান্য বড়। তিনি যখন কথা বলেন না তখনো অস্পষ্ট এক ধরনের শব্দ তার মুখ থেকে বের হয়।
চরিত্র বর্ণনায় লেখক কোন টেকনিক ব্যবহার করবেন সেটা তার ব্যাপার। আমার টেকনিকের কারণ কি এই যে আমি চেহারা কেমন তা নিয়ে মাথা ঘামাই না? চরিত্রের মানসিকতাই প্রধান হয়ে দাড়ায়? হতে পারে। রূপবতী মেয়েদের রূপ বর্ণনা এক কথায় সেরে ফেলি— মেয়েটি অসাধারণ রূপবতী। অসাধারণ কোন অর্থে তা ব্যাখ্যা করা হয় না। রূপ বর্ণনা ব্যাখ্যা না করা বা ব্যাখ্যা করতে না পারা কি একটি বড় ধরনের ত্রুটি না?
নায়িকাদের রূপ বর্ণনার নির্ধারিত নিয়ম (Set rules) আছে। যেমন, পটলচেরা চোখ, বাঁশির মত নাক ইত্যাদি। আমি পটল চিরে তাকিয়ে দেখে ধাক্কার মত খেয়েছি। কেন চোখের বর্ণনায় এই সবজি চলে এসেছে আল্লাহপাকই জানেন।
হরিণের মত চোখের কথাও উপমায় ব্যবহার হয়। নুহাশ পল্লীতে এক সময় প্রচুর হরিণ ছিল। তাদের চোখের শেষ অংশ বড়শির মত বাঁকানো। সেখানে কোনো সৌন্দর্য নেই। গরুর বড় বড় চোখে তাও কিছুটা সৌন্দর্য আছে। তবে মেয়েদের চোখের তুলনা মেয়েদের চোখের সঙ্গেই হওয়া বাঞ্ছনীয় ! ঐ যে সুনীলের কবিতা—
একটি গোলাপ ফুটেছিল
গোলাপের মত।