- বইয়ের নামঃ হিমুর বাবার কথামালা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ অন্বেষা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ কল্পকাহিনী
উৎসর্গ ও ভূমিকা
হিমুর বাবার কথামালা
হুমায়ূন আহমেদ
উৎসর্গ
মধ্যরাতে যাদের সঙ্গে হিমুর দেখা হয়,
বইটি তাদের জন্যে।
ভূমিকা
বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি গ্রহণ করা যায়। বিচিটা নাকি আড়াআড়ি থাকে। পনেরো হাত বিচি গ্রহণ করার কোনোই কারণ নেই। হিমুর বাবার কথামালা চল্লিশ পৃষ্ঠার একটি বই। এখানে দুই পৃষ্ঠার ভূমিকার অর্থ বারো হাত কাঁকুড়ের পনেরো হাত বিচি।
এ ধরনের বইয়ের ধারণা অমির মাখায় আসে নি। কবি বাপ্পির মাথায় এসেছে। সে প্রায় জবরদস্তি করেই হিমুর বাবাকে নিয়ে আমাকে লিখিয়েছে। হিমুর বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে কাজটা করিয়েছে আমার তা মনে হয় না। তার মধ্যে বাণিজ্য বিষয়টা কাজ করেছে বলে আমার ধারণা। কবি সাহেব কিন্তু আবার একজন প্রকাশকও। আমি নিশ্চিত বাপ্পি কল্পনায় দেখছে- বইমেলা শুরু হয়েছে। পাঠকরা লাইন বেঁধে কিনছে হিমুর বাবার কথামালা।
স্বপ্ন দেখতে সবাই ভালবাসে। কবিরা একটু বেশি ভালবাসেন। এটাই স্বাভাবিক। মানব সম্প্রদায়ের স্বপ্ন দেখে না হিমুরা। তারা অন্যদের স্বপ্ন দেখায়।
হিমুর বাবার কথামালা বইটি শুধুমাত্র হিমুরা পড়লেই ভাল হয়। অন্যরা (বিশেষ করে কিশোর কিশোরীরা) যেন না পড়ে। তাদের মাথায় ভ্ৰান্তি ঢুকে যেতে পারে। ভ্রান্তি একবার ঢুকে গেলে তাকে বের করা বেশ কঠিন। আমি ভ্রান্তির চাষ করতে চাই না।
এখন কথা হচ্ছে হিমু কে? আমি নিজে কি পরিষ্কার জানি? মনে তো হয় না। প্রায়ই যে সব চিঠি পাই তার একটা বড় অংশে এই জাতীয় লেখা থাকে।
১.
স্যার, হিমু হইবার নিয়মাবলি দয়া করিয়া জানাইবেন। আনি একটি সিল্কের পাঞ্জাবী খরিদ করিয়াছি। আমার এক বন্ধু বলিয়াছে হিমুদের পাঞ্জাবী সুতি হইতে হইবে। এই বিষয়ে আপনার মূল্যবান মতামত জানাইয়া বাধিত করিবেন।
২.
আংকেল, আমার নাম নাসিমী। আমি নবম শ্রেণীর ছাত্রী। আমার খুব ইচ্ছা আমি হিমু হব। মেয়েদের হিমু পোশাক কি? হলুদ পাঞ্জাবীর সঙ্গে কি ওড়না পরব? না-কি হলুদ শাড়ি পরব? হলুদ শাড়ি পরলে মনে হবে গায়ে হলুদে যাচ্ছি।
৩.
হুমায়ূন সাহেব! আমার বড় ছেলে সম্প্রতি হিমু হয়েছে। সে হলুদ পাঞ্জাবী পরে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটাহাটি শুরু করেছে। গতকাল পা কেটে বাসায় ফিরেছে। তাকে টিটেনাস ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। আমার বক্তব্য আপনি লেখার মাধ্যমে কোমলমতিদের বিভ্রান্ত করে আনন্দ পান। একজন পিতা হিসেবে আপনার প্রতি অনুরোধ এই কাজটি করবেন না।
আমার অবস্থা হচ্ছে ভিক্ষা চাই না হলুদ চিতাবাঘ সামলাও।
জগতের সমস্ত হিমুরা ভাল থাকুক।
এই শুভ কামনা।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশ পত্রী, গাজীপুর।
হিমুর বাবার নাম কি
হিমুর বাবার নাম কি?
আমি কি হিমু বিষয়ক কোন বইয়ে তাঁর নাম বলেছি?
মনে করতে পারছি না। ভদ্রলোক দেখতে কেমন তাও বলতে পারছি না। তার চেহারার বর্ণনা কি কোথাও করেছি? মনে হয় না। চরিত্রের চেহারা বর্ণনা সাধারণত আমি করি না। দায়িত্ব পাঠকের উপর ছেড়ে দেই, তাদেরকেই চেহারা কল্পনা করে নিতে দেই। আমার উপন্যাসের চরিত্ররা দেখতে কেমন তা জোর করে পাঠকের উপর চাপিয়ে দেই না।
এই পৃথিবীর মহান লেখকদের একজন দস্তয়ভস্কি তার তৈরি চরিত্রগুলির ডিটেল বর্ণনা এমনভাবে দেন যে পাঠক চোখের সামনে চরিত্র দেখতে পান। ঔপন্যাসিক চালর্স ডিকেন্স এই কাজটি ভাল করেন। তার চরিত্র বর্ণনা—
লোকটির মুখ লম্বাটে। জোড়া ভুরু। কানে প্রচুর লোম। নাকের ঠিক নিচেই পেনি আকৃতির একটি লাল আঁচিল। আঁচিলে বড় বড় কয়েকটা কালো চুল আছে। এর মধ্যে একটার রঙ বাদামি। সেই চুল ঠোটের উপর ঝুলে থাকে। মুখের চামড়া কুঁচকানো। কালো তিলে ভর্তি। দাঁত নোংরা। একটি দাঁত সামান্য বড় বলে বের হয়ে থাকে। চোখ ব্রাউন। একটি চোখ অন্যটির চেয়ে সামান্য বড়। তিনি যখন কথা বলেন না তখনো অস্পষ্ট এক ধরনের শব্দ তার মুখ থেকে বের হয়।
চরিত্র বর্ণনায় লেখক কোন টেকনিক ব্যবহার করবেন সেটা তার ব্যাপার। আমার টেকনিকের কারণ কি এই যে আমি চেহারা কেমন তা নিয়ে মাথা ঘামাই না? চরিত্রের মানসিকতাই প্রধান হয়ে দাড়ায়? হতে পারে। রূপবতী মেয়েদের রূপ বর্ণনা এক কথায় সেরে ফেলি— মেয়েটি অসাধারণ রূপবতী। অসাধারণ কোন অর্থে তা ব্যাখ্যা করা হয় না। রূপ বর্ণনা ব্যাখ্যা না করা বা ব্যাখ্যা করতে না পারা কি একটি বড় ধরনের ত্রুটি না?
নায়িকাদের রূপ বর্ণনার নির্ধারিত নিয়ম (Set rules) আছে। যেমন, পটলচেরা চোখ, বাঁশির মত নাক ইত্যাদি। আমি পটল চিরে তাকিয়ে দেখে ধাক্কার মত খেয়েছি। কেন চোখের বর্ণনায় এই সবজি চলে এসেছে আল্লাহপাকই জানেন।
হরিণের মত চোখের কথাও উপমায় ব্যবহার হয়। নুহাশ পল্লীতে এক সময় প্রচুর হরিণ ছিল। তাদের চোখের শেষ অংশ বড়শির মত বাঁকানো। সেখানে কোনো সৌন্দর্য নেই। গরুর বড় বড় চোখে তাও কিছুটা সৌন্দর্য আছে। তবে মেয়েদের চোখের তুলনা মেয়েদের চোখের সঙ্গেই হওয়া বাঞ্ছনীয় ! ঐ যে সুনীলের কবিতা—
একটি গোলাপ ফুটেছিল
গোলাপের মত।
প্রস্তাবনা বন্ধ থাকুক, হিমুর বাবার কাছে ফিরে যাই। পাঠক আসুন আমরা সবাই মিলে তার অবয়ব দাঁড়া করাই। প্রসেস অফ এলিমিনেশনের মাধ্যমে চেহারা দাঁড় করানো। অনেক না অতিক্রমের পর হ্যাঁ তে পৌছনো।
ভদ্রলোকটি কি বেঁটে?
অবশ্যই না।
ভদ্রলোক কি থলথলে মোটা?
অবশ্যই না।
ভদ্রলোকের মাথায় কি টাক?
অবশ্যই না।
কুৎসিত দর্শন?
না।
গায়ের রঙ কুচকুচে কালো।
না।
পান খাওয়ার কারণে দাত কি লাল হয়ে থাকে?
না।
তাহলে চেহারা কি দাঁড়াচ্ছে? লম্বা ফর্সা একজন মানুষ। রোগা। মাথা ভর্তি চুল।
এই ভদ্রলোকের চেহারা কল্পনায় হিমুর প্রতি আমাদের যে মমতা, সেই মমতা কাজ করেছে। ভদ্রলোক পাগল ধরনের একজন মানুষ। এই পাগল কিন্তু নেংটো হয়ে ট্রাফিক কনট্রোল করা পাগল না। মমতার পাগল। সে পাগলের স্বপ্ন ছেলেকে মহাপুরুষ বানানো। তার যুক্তি ইঞ্জিনিয়ার বানানোর জন্যে যদি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থাকতে পারে, ডাক্তার বানানোর জন্যে মেডিকেল কলেজ থাকতে পারে তাহলে মহাপুরুষ বানানোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন থাকতে পারে না।
কাজেই তিনি নিজেই একটা স্কুল খুললেন। সেই স্কুলের একজনই ছাত্র। তার পুত্র হিমু এবং তিনিই একমাত্র শিক্ষক।
ভদ্রলোকের চিন্তা ভাবনা কি খুবই হাস্যকর?
না, খুব হাস্যকর না। কারণ সাধু সন্ত বানানোর স্কুল কলেজ কিন্তু আছে। মনটাসিয়ারি, মঠ, আশ্রম। হিমালয়ের গুহায় বাস করা সন্ন্যাসী। ঈশ্বরের আরাধনা শেখানোই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য না। শুদ্ধ মানুষ হবার প্রক্রিয়া শেখানোও তাদের ট্রেনিং-এর অংশ। মহাপুরুষতে শুদ্ধ মানুষ ছাড়া আর কিছু না।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যে মহাপুরুষ হবার ট্রেনিং-এ কিছু কাল ছিলেন তা-কি পাঠকরা জানেন? সাধনার জন্যে তিনি গিয়েছিলেন হিমালয়ের গুহায় সন্ন্যাসীদের কাছে। এই সাধনায় তিনি আধ্যাত্মিক সিদ্ধি লাভ করেছিলেন এমন মনে হয় না। তার শিক্ষক প্রফেসর ওটেনকে তিনি নিজে কলেজ কম্পাউন্ডে প্রহার করেছিলেন। তারচে আশ্চর্য ব্যাপার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রহার সমর্থন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন–বিদেশি অধ্যাপকের কাছ থেকে দেশ, জাতি ও ধর্মের অপমানের কথা শুনলে ছাত্ররা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করবেই। না করলেই বরঞ্চ লজ্জা ও দুঃখের কথা।
সুভাষ বসুর আত্মজীবনীতে কিন্তু ওটেন সাহেব দেশ জাতি ও ধর্মের অবমাননা করেছেন এমন কথা লেখা নেই। ছাত্রদের সঙ্গে তার ধারাবাহিক দুর্ব্যবহারের কথা বলা আছে।
অধ্যাপক ওটেন সুভাষ বসুর উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লিখেছিলেন, তাতে তিনি লিখেন সুভাষ তাঁর প্রতি সুবিচার করেন নি। তিনি ছাত্রদের দেশপ্রেমকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন (অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অনুকরণীয়। ঈদ সংখ্যা ২০০৮, সাপ্তাহিক)।
গুরুগম্ভীর এই অংশে আমি আসলে কি বলতে চাচ্ছি? বলতে চাচ্ছি মহাপুরুষ আমাদের মধ্যে নেই। নেই বলেই মহাপুরুষদের প্রতি আমাদের দুর্নিবার আকর্ষণ। ভিন্নভাবে বলতে গেলে দুর্বলতা মানবজাতি ঘেন্না করে কারণ দুর্বলতা আছে তার মধ্যেই। Mankind abhors timidity, because he is timid.
মহাপুরুষ বিষয়ে আমার প্রবল আগ্রহের কারণ সম্ভবত একটাই আমার মধ্যে মহাপুরুষ বিষয়ক কিছু নেই। আমি নিতান্তই আমজনতার একজন। ভুলে যাবার আগে বলে রাখি আমার লেখা প্রথম মঞ্চ নাটকের নাম— মহাপুরুষ।
মহাপুরুষ গড়ার কারিগর হিমুর বাবার পোশাক কি হবে? হিমু হলুদ পাঞ্জাবী পরে। তিনি কি পরবেন? পোশাক খুব তুচ্ছ করে দেখার বিষয় না। স্বয়ং শেক্সপিয়ার বলেছেন, মানুষের প্রথম পরিচয় তার পোশাকে। বাংলা প্রবচনেও আছে—
পহেলা দর্শনধারি
তারপরে গুণবিচারি।
দর্শনধারি হতে হলে সে রকম পোষাক লাগবে। গামছা পরে দর্শনধারি হওয়া যাবে না।
পরিধেয় বস্ত্র নিয়ে শেখ সাদীর বিখ্যাত শায়েরও আছে। পোশাক যথাযথ না হওয়ায় রাজসভাতে শেষের দিকে তাকে বসতে দেয়া হয়েছিল। কবি অভিমান থেকে লিখলেন–
রাজসভাতে এসেছিলেম
বসতে দিলে পিছে
সাগর জলে সুক্তো ভাসে
মুক্তো থাকে নীচে।
পোশাকের গুরুত্ব
আমি আমার জীবনে পোশাককে কখনই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি নি। ইস্ত্রিবিহীন কুঁচকানো শার্ট তার সঙ্গে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে বড় কোনো অনুষ্ঠানে যেতে কখনই সমস্যা বোধ করি নি। তবে একবার মহাবিপদে পড়েছিলাম। সেই বিপদ নিয়ে ঢাকা ক্লাবের ম্যাগাজিনের রমনা সুবর্ণ জয়ন্তী সংখ্যায় একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখাটি আমি আমার অনুমতিক্রমে আবার ছাপছি। কারণ মহাপুরুষ গড়ার কারিগরের পোশাক নির্বাচনের আগে লেখাটা পড়া থাকলে ভাল হবে।
বাঙালের ঢাকা ক্লাব দর্শন
আমার দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধুদের একজনের নাম জুয়েল আইচ। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আমার ব্যবহার একটু অদ্ভুত। আমি কখনই তাদের টেলিফোন করি না। বাসায় আসতে বলি না। রোগে শোকে খবর নেই না। ব্যাপারটা ভাইস ভার্সা। তারাও নেন না।
একদিন হঠাৎ জুয়েল আইচের টেলিফোন। তিনি বললেন, আপনাকে একটা জায়গায় নিমন্ত্রণ করতে চাচ্ছি। আপনি কি আসবেন?
আমি বললাম, অবশ্যই। জায়গাটা কোথায়?
ঢাকা ক্লাবে।
ভাই আমি তো ঢাকা ক্লাবের মেম্বার না। আমাকে ঢুকতে দেবে।
জুয়েল আইচ বললেন, ক্লাবে আলাদা আলাদা ঘর আছে। এসব ঘর ভাড়া নেয়া যায়। সেখানে অতিথিরা যেতে পারেন।
আমি বললাম, দিনক্ষণ বলুন। যথাসময়ে উপস্থিত থাকব। কোনো উপলক্ষ কি আছে?
উপলক্ষ আছে।
জুয়েল আইচ উপলক্ষ ব্যাখ্যা করলেন। তার এক বন্ধু এসেছেন কোলকাতা থেকে, নাম রঞ্জন সেনগুপ্ত। ভদ্রলোক একজন শিল্পপতি। তিনি লেখক হুমায়ূন আহমেদের কিছু রচনা পাঠ করেছেন। তার শখ লেখকের সঙ্গে কথা বলবেন।
আমি নির্দিষ্ট দিনে ঢাকা ক্লাবের রিসিপশন রুমে উপস্থিত হলাম। জুয়েল আইচ তার বন্ধুকে নিয়ে আগেই উপস্থিত। রিসিপশনের যিনি প্রধান, তিনি কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছেন। প্রথমে মনে হলো লেখককে চিনতে পারার আনন্দের জন্যেই তার চোখের দৃষ্টি অদ্ভুত লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ভুল ভাঙল। রিসিপশনিস্ট বিনয়ের সঙ্গেই বললেন, স্যার আপনাকে ক্লাবে ঢুকতে দেয়া যাবে না। সরি।
আমি বললাম, কেন?
আপনার ড্রেসকোড ঠিক নেই। আপনার পায়ে স্যান্ডেল। শার্ট যেটা পরেছেন সেখানেও সমস্যা।
জুয়েল আইচ নানা চেষ্টা চরিত্র করছেন। ক্লাবের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন, কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি বুঝতে পারছি, আমাকে দেখাচ্ছে লেবেনডিসের মতো। গায়ে ইস্ত্রিবিহীন কুঁচকানো শার্ট। পায়ে স্যান্ডেল। স্যান্ডেলের আয়ুও শেষ পর্যায়ে। যে-কোনো সময় চামড়ার ফিতা খুলে সে রিটায়ারমেন্টে চলে যাবে।
আমার সামনে রিসিপশনের একজন একজোড়া জুতা এনে রাখল। সেই জুতা গামা পালোয়ানের পায়েরও তিন চার সাইজ বড়। আমাকে বলা হলো– এই জুতা পরে ঢুকে যান।
আমি বললাম, অন্যের জুতা পরে কেন ঢুকব? খালি পায়ে কি ঢুকতে পারি? আমার খালি পায়ে ঢুকতে আপত্তি নেই। আমার উপন্যাসের এক চরিত্র হিমু, খালি পায়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
রিসিপশনিস্ট বলল, জ্বি-না স্যার। খালি পায়ে ঢুকতে পারবেন না।
আমি বললাম, আচ্ছা মহাত্মা গান্ধী তো আধা নেংটা থাকেন। ছাগলের দড়ি হাতে ঘুরে বেড়ান। ছাগলটা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে থাকে। মহাত্মা গান্ধী যদি ইচ্ছা প্রকাশ করেন ঢাকা ক্লাবের লাউঞ্জে বসে এক কাপ গরম দুধ খাবেন। তিনি কি পারবেন?
না। তাকে ঢুকতে দেয়া হবে না।।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তো আপনাদের ক্লাবে অনেক অনুষ্ঠান হয়। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী। রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান। হয় না?
জি স্যার হয়।
রবীন্দ্রনাথ যদি ক্লাবে আসতে চান, তাঁকে কি ঢুকতে দেয়া হবে? তিনি জোকাটাইপ পোশাক পরেন। পায়ে থাকে চপ্পল।
না উনাকেও ঢুকতে দেয়া হবে না।
আলবার্ট আইনস্টাইনকে কি ঢুকতে দেয়া হবে? ঢাকা ক্লাবের ড্রেসকোডের ধার কিন্তু তিনি ধারেন না।
স্যার, উনাকেও ঢুকতে দেয়া হবে না।
এতক্ষণে আমি কিছু স্বস্তি ফিরে পেয়েছি। এই গ্রহের সেরা তিনজনই যদি ক্লাবে ঢুকতে না পারেন, আমি কোথাকার হরিদাস পাল? আমাকে যে এরা কানে ধরে উঠবোস করায় নি এতেই আমি খুশি।
.
এই ঘটনার মাস ছয়েক পর আমি ঢাকা ক্লাব থেকে একটা চিঠি পেলাম। চিঠিতে লেখা, আমাকে ঢাকা ক্লাবের অনারারি মেম্বারশিপ দেয়া হয়েছে। এই খবর শুনে আমার বন্ধুরা এমন ভাব করতে লাগল যেন চব্বিশ ক্যারেট সোনার একটা হরিণছানা আমার ঘরে ঢুকে গেছে। ঢাকা ক্লাবের মেম্বারশিপের যে এত গুরুত্ব তা তো জানতাম না। আমি ক্লাব টাইপ মানুষ না। গুরুত্ব ধরতে পারার কথাও আমার না। আমি আমার নিজের ক্লাব সঙ্গে নিয়ে ঘুরি। যেখানে যাই ক্লাব সাথে নিয়েই যাই।।
যাই হোক, একদিন ঠিক করলাম মেম্বারশিপের শুভ উদ্বোধন করব। আমি আমার আরেক বন্ধু আর্কিটেক্ট করিমকে খবর দিলাম। সে ঢাকা ক্লাবের পুরনো মেম্বার। ক্লাবের নিয়মকানুন ভালো জানে। করিমকে সঙ্গে নিয়ে চামড়ার জুতা কিনলাম, ফুলহাতা শার্ট কিনলাম। ইন করে শার্ট পরব, কাজেই একটা বেল্টও কেনা হলো। আয়নায় তাকিয়ে দেখি নিজেকে সং-এর মতো লাগছে। সবাইকে সব কিছুতে মানায় না।
ক্লাবে ঢুকলাম। নতুন জুতার কারণে মেঝে অতিরিক্ত পিচ্ছিল লাগছিল। মনে হচ্ছিল যে-কোনো সময় আমি পিছলে গুরুত্বপূর্ণ কারো ঘাড়ে পড়ে যাব। একটা কেলেঙ্কারি হবে।
ইংরেজ সাহেবদের বানানো ক্লাব দেখে মুগ্ধ হলাম। চমৎকার মার্গারিটা পরপর কয়েকটা খেয়ে ফেললাম। সাহেবদের প্রতি একধরনের কৃতজ্ঞতাও বোধ করলাম। ভাগ্যিস তারা ক্লাব প্রজাতির ছিলেন।
পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে। সাহেরা চলে গেছেন ফেলে রেখে গেছেন তাদের ছায়া। আমরা ক্লাবের মেম্বাররা সেই ছায়া গায়ে মেখে ক্লাবে ঢুকি। আড্ডা দেই। নিজেদের কেমন যেন ব্রিটিশ ব্রিটিশ লাগে। আমার মতো ভেতো বাঙালের জন্যে এও তো কম প্রাপ্তি না। আসুন এখন হিমুর বাবার পোশাক নিয়ে পুরনো নিয়মে প্রসেস অফ এলিমিনেশনের ভেতর দিয়ে যাই।
তিনি কি ছেলের মত হলুদ পাঞ্জাবী প্রবেন?
না।
তিনি কি থ্রি পিস স্যুট টাই পরবেন?
না।
লুঙ্গী গামছা?
না।
হাফপ্যান্ট, টি-শার্ট?
না।
মাওলানাদের পাঞ্জাবী, পায়জামা?
না। তিনি কি নগ্ন থাকবেন?
না।
পাঠক দেখছেন– তার পোশাক নির্বাচন কতটা জটিল হয়ে গেছে? তাকে সাধারণ হাওয়াই শার্ট এবং প্যান্ট পরানো ছাড়া গতি দেখছি না। পোশাকে তিনি হবেন সাধারণ। আইনস্টাইন টাইপ। আইনস্টাইনের পোশাক নিয়ে একটা গল্প কোথায় যে পড়েছিলাম। গল্পটা বলি। সুইডেনের রানীর সঙ্গে তার বৈঠক। রানী হঠাৎ লক্ষ্য করলেন আইনস্টাইনের শার্টের বোতাম ঠিকমত লাগানো নেই। দ্বিতীয় বোতামটি লাগানো হয়েছে তৃতীয় বোতাম ঘরে। রানী এই ত্রুটি থেকে কিছুতেই নিজের চোখ সরাতে পারছেন না। এক পর্যায়ে আইনস্টাইনের বিষয়টা চোখে পড়ল। তিনি লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, রানী দুমিনিট সময় দিন আমি বাথরুমে যাব এবং পোশাকের ত্রুটি দূর করে আসব।
আইনস্টাইন বাথরুমে গেলেন এবং পোশাকে আরো বড় ধরনের ত্রুটি নিয়ে ফিরে এলেন। এখন তৃতীয় বোতামটি লাগানো হয়েছে প্রথম বোতাম ঘরে। দ্বিতীয় বোতাম তৃতীয় বোতাম ঘরে পুরো বেড়াছেড়া।
আমার ধারণা গল্পটা বানানো। মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষদের নিয়ে আমরা গল্প বানানো পছন্দ করি। বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির গল্পের কথাই ধরি। গল্পটা এক সময় পাঠ্যও ছিল। মায়ের অসুখের সংবাদ শুনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চাকরি থেকে ছুটি চাইলেন মাকে দেখতে যাবেন। ছুটি দেয়া হলো না। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে রওনা হলেন।
বাড়িতে যাবার জন্যে উত্তাল দামোদর নদী পার হতে হবে। ঘাটে কোনো নৌকা নেই। তিনি সাঁতরে নদী পার হলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছোট ভাইয়ের নাম শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ব। তাঁর লেখা থেকে জানা যায় এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি।
আমাদের সমাজের মহাপুরুষ নেই বলেই আমাদের মধ্যে ক্লান্তিবিহীন চেষ্টা— মহাপুরুষ বানাতে হবে। যেসব গুণ একজনের আছে তাতে চলবে না, আরো গুণ ঢেলে দিতে হবে।
মহাপুরুষ অনুসন্ধানের এই ব্যাকুলতার পেছনে জেনেটিক কারণ আছে বলে আমার ধারণা। মানুষ এক সময় বনে জঙ্গলে বাস করত। মহাবিপদের জীবন চর্যা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত সেইসব মানব সম্প্রদায়ের জন্যে প্রয়োজন ছিল বিচক্ষণ, জ্ঞানী, বুদ্ধিমান এবং সাহসী নেতা। যারা তাদেরকে বিপদ থেকে বাঁচার পরামর্শ দেবে এবং তারা টিকে থাকবে। জেনেটিক কারণে অতীতের সেই স্মৃতি অমিরা নিয়ে এসেছি। এখনো আমাদের নেতা দরকার, আওয়ামী লীগ, বিএনপি দরকার। নেতা ছাড়া আমরা অসহায়।
মহাপুরুষরা, নেতার চেয়েও বড়। নেতারা নিজের স্বার্থ খুব ভালমত দেখেন। মহাপুরুষরা তা দেখেন না। কিংবা হয়তো দেখেন আমরা যারা সাধারণ পাবলিক তারা তা বুঝতে পারি না।
খ্রিস্টান ধর্মে সেইন্ট ঘোষণা করার একটি প্রক্রিয়া আছে। Saint অর্থ মহাসাধক, মহাপুরুষ। আমাদের পরিচিত মাদার তেরেসাকে তার মৃত্যুর পর Saint ঘোষণা করা হয়েছে। পাঠক কি জানেন শেষ বয়সে মাদার তেরেসার গভীর ঈশ্বর বিশ্বাসে চিড় ধরেছিল? তিনি অসহায় বোধ করছিলেন। সেই সময় তিনি পোপ বেনেডিক্টকে বেশ কিছু চিঠি দিয়েছিলেন। চিঠির বিষয়বস্তু ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দেহ। তিনি চিঠিগুলি নষ্ট করে দেয়ার নির্দেশও দিয়েছিলেন। সেপ্টেম্বর ৭ তারিখ ২০০৭-এ তার কিছু চিঠি প্রকাশিত হয়। একটিতে তিনি লিখেছেন–
Where is my faith? Even deep down there is nothing but emptiness. If there be a God–please forgive me.
অন্য আরেকটি চিঠিতে লিখলেন–
I feel just that terrible pain of loss, of God not wanting me, of god not being god, of God not really existing.
একজন স্বীকৃত মহাপুরুষে (না-কি মহামানবী?)-র যদি এই সমস্যা থাকে তাহলে সাধারণ আমজনতা যাবে কোথায়?
জটিল তথ্য আলোচনা থাকুক। আসুন আমরা আবার প্রসেস অফ এলিমিনেশন টেকনিকে বের করি মহাপুরুষ কেমন হবেন।
একজন মহাপুরুষ কি আপনার বাড়িতে বসে হিদল শুঁটকি দিয়ে ভাত খাবেন?
না।
তিনি কি ঈদের হাসির নাটক দেখার জন্যে আগ্রহ নিয়ে টিভির সামনে বসে থাকবেন?
না।
তিনি এক সেট সস্তা গ্লাস রঙিন কাগজে মুড়ে বিয়ের দাওয়াত খেতে যাবেন?
না।
তিনি কি যথাসময়ে একটি তরুণী বিয়ে করবেন এবং বাসর রাতের কর্মকাণ্ডে অংশ নেবেন?
না।
তাহলে কি এই দাঁড়াচ্ছে না যে মহাপুরুষ আমাদের মত কেউ না। সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। সেই ভিন্নটা কি তাও পরিষ্কার না। যে বস্তুর অস্তিত্বই নেই সেই বস্তু সম্পর্কে ধারণা করাও তো অসম্ভব।
আমরা যখন ভূতের বা রাক্ষসের ছবি আঁকি সেই ভূতটা দেখতে হয় মানুষের কাছাকাছি কিংবা আমাদের দেখা পশুর কাছাকাছি।
তার শিং থাকতে পারে (আমরা অনেক শিংওয়ালা পশু দেখেছি)। গা ভর্তি কাটা থাকতে পারে (সজারু)। ভয়ঙ্কর দাঁত থাকতে পারে (বাঘ, সিংহ) কানা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু আঁকা মুরালিয়েলিস্টিক চিত্রকর সালভাদর দালির পক্ষেও সম্ভব হয় নি।
হিমুকে মহাপুরুষ বানানো এই কারণেই আমার জন্যে সহজ একটা কাজ হয়েছে। কারণ একটাই মহাপুরুষের কোনো ধারণা আমাদের নেই। হিমু নিতান্তই ঘরোয়া এক ছেলে। যে শুটকির সঙ্গে বেগুনের তরকারি দিয়ে আগ্রহের সঙ্গে পেট ভর্তি করে ভাত খাবে। ভাত খাবার পর তর্জনিতে চুন লাগিয়ে পান খাবে। পানের পিক ফেলবে।
সম্প্রতি হিমুকে নিয়ে ছোট্ট একটা ঝামেলায় পড়েছি। ঝামেলাটা তৈরি করেছেন আমার মা। তাঁর বয়স প্রায় আশি। কিডনি অকেজো। ওষুধপত্র দিয়ে কোনো রকমে সচল রাখা হয়েছে। হার্টের অবস্থাও দুর্বল। বাই পাস করানো হয়েছে। প্রায়ই ফুসফুসে পানি আসে। হাসপাতালে পাঠিয়ে ঠিক করে আনা হয়।
এক সকালে তাকে নিয়ে নাশতা খাচ্ছি। তিনি হঠাৎ বললেন, হিমুকে ভাল মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দে।
আমি নাশতা খাওয়া বন্ধ করে বললাম, হিমুকে বিয়ে দিয়ে দিতে বলছেন?
মা বললেন, হ্যাঁ। বেচারা কতদিন একা একা ঘুরবে? আমার নিজেরও বয়স হয়েছে। হিমুর বিয়ে খেয়ে যাই।
পাঠক কি সমস্যাটা বুঝতে পারছেন? হিমু রিয়েলিটির অংশ হয়ে যাচ্ছে। একদিন হয়তো আমি নিজেই হলুদ রঙের একটা কার্ড পাব। হিমুর বিয়ের কার্ড। বিডিআর এর দরবার হলে আয়োজন করে বিয়ে। কে জানে আমার মা হিমু পত্নীর জন্যে হলুদ সিল্কের শাড়ি নিয়ে বিয়ে খেতে চলে যেতেও পারেন।
থাকুক হিমু প্রসঙ্গ
থাকুক হিমু প্রসঙ্গ। তার বাবা-মার কাছে ফিরে যাই। হিমুর মার তেমন কোনো উল্লেখ কোনো বইতেই নেই।
ভদ্রমহিলা রূপবতী ছিলেন। (আমার উপন্যাসের সব নারী চরিত্রই রূপবতী। মেয়েদের রূপ দেয়ার ব্যাপারে আমার কোনো কার্পণ্য নেই।) এই মহিলা হিমুর জন্মের পর পরই মারা যান। তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তার স্বামী কিছু কলকাঠি নেড়েছেন।
হিমুর বাবা একা হিমুকে মানুষ করতে চেয়েছেন। নিজের পরিকল্পনায় পুত্রকে বড় করতে চেয়েছেন। মা বেঁচে থাকলে এটা কখনো সম্ভব হতো না। কাজেই হত্যাকাণ্ড।
হিমুর বাবাকে আমরা কি ভয়ঙ্কর ক্রিমিনাল বলব? না-কি একজন হিমু তৈরির জন্যে তার অপরাধ ক্ষমা করব?
বিচারের দায়িত্ব পাঠকদের। হিমুর বাবার কথামালা সংকলিত করা হলো। হিমুর প্রতি তার উপদেশের সংকলন। এই উপদেশ সার্বজনীন নয়। শুধু হিমুর প্রতিই প্রযোজ্য।
.
ময়ূরাক্ষী
আমার বাবা তার খাতায় আমার জন্যে যেসব উপদেশ লিখে রেখে গেছেন তার মধ্যে একটার শিরোনাম হচ্ছে নির্লিপ্ততা। তিনি লিখেছেন :
নির্লিপ্ততা
পৃথিবীর সকল মহাপুরুষ এবং মহাজ্ঞানীরা এই জগৎকে মায়া বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। আমি আমার ক্ষুদ্র চিন্তা ও ক্ষুদ্র বিবেচনায় দেখিয়াছি আসলেই মায়া। স্বামী ও স্ত্রীর প্রেম যেমন মায়া বই কিছুই নয়, ভ্রাতা ও ভগ্নির স্নেহ-সম্পর্কও তাই। যে কারণে স্বার্থে আঘাত লাগিবামাত্র স্বামী-স্ত্রীর প্রেম বা ভ্রাতা-ভগ্নির ভালোবাসা কপূরের মতো উড়িয়া যায়। কাজেই তোমাকে পৃথিবীর সর্ব বিষয়ে পুরোপুরি নির্লিপ্ত হইতে হইবে। কোনোকিছুর প্রতিই তুমি যেমন আগ্রহ বোধ করিবে না আবার অনাগ্রহও বোধ করিবে না। মানুষ মায়ার দাস। সেই দাসত্ব-শৃখল তোমাকে ভাঙিতে হইবে। মানুষের অসাধ্য কিছুই নাই। চেষ্টা করিলে তুমি তা পারিবে। তোমার ভিতরে সেই ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা বিকাশের চেষ্টা আমি তোমায় শৈশবেই করিয়াছি। একই সঙ্গে তোমাকে আদর এবং অনাদর করা হইয়াছে। মাতার প্রবল ভালোবাসা হইতেও তুমি বঞ্চিত হইয়াছ। এই সমস্তই একটি বড় পরীক্ষার অংশ। এই পরীক্ষায় সফলকাম হইতে পারিলে প্রমাণ হইবে যে, ইচ্ছা করিলে মহাপুরুষদের এই পৃথিবীতে তৈরি করা যায়।
যদি একটি সাধারণ কুকুরকেও যথাযখ প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, সেই কুকুর শিকারি কুকুরে পরিণত হয়। একজন ভালোমানুষ পরিবেশের চাপে ভয়াবহ খুনীতে রূপান্তরিত হয়। যদি তাই হয়, তবে কেন আমরা আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী মানব সম্প্রদায় তৈরি করিতে পারিব না?
উপদেশ নম্বর এগারো
সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান
সৃষ্টিকর্তার অনুসন্ধান করিবে। ইহাতে আত্মার উন্নতি হইবে। সৃষ্টিকর্তাকে জানা এবং আত্মাকে জানা একই ব্যাপার। স্বামী বিবেকানন্দের একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে স্মরণ রাখিও
বহুরূপে সম্মুখে তোমার,
ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
.
দরজার ওপাশে
ঘুমাইয়া রাত নষ্ট করিও না। দিনে নিদ্রা যাইবে। রাত কাটাইবে অনিদ্রায়। কারণ রাত্রি আত্ম-অনুসন্ধানের জন্য উত্তম। জগতের সকল পশু নিশিযাপন করে। পশুমাত্রই নিশাচর। মানুষ এক অর্থে পশু। নিশিযাপন তার অবশ্য কর্তব্যের একটি।
.
হিমু
হে মানবসন্তান, তুমি তোমার ভালোবাসা লুকাইয়া রাখিও। তোমার পছন্দের মানুষদের সহিত তুমি রূঢ় আচরণ করিও, যেন সে তোমার স্বরূপ কখনো বুঝিতে না পারে। মধুর আচরণ করিবে দুর্জনের সঙ্গে। নিজেকে প্রকাশ্য রাখার ইহাই প্রথম পাঠ।
.
পারাপার
তোর ঘুমুলে চলবে না। মহাপুরুষদের সবকিছু জয় করতে হয়। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুম। ঘুম হচ্ছে দ্বিতীয় মৃত্যু। সাধারণ মানুষ ঘুমায় অসাধারণরা জেগে থাকে।…
.
হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম
হিমালয়,
তুমি অষ্টাদশ বর্ষে পদার্পণ করিয়াছ। আমার অভিনন্দন। অষ্টাদশ বর্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। এই বয়সে নারী ও পুরুষ যৌবনপ্রাপ্ত হয়। তাহাদের চিন্তা-চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনের ফল শুভ যেমন হয়— মাঝে মাঝে অশুভও হয়।
প্রিয় পুত্র, তোমাকে আজ আমি তরুণ-তরুণীর আকর্ষণের বিষয়ে আমার দীর্ঘদিনের চিন্তার ফসল বলিতে চাই। মন দিয়া পাঠ করো। তরুণ-তরুণীর আকর্ষণের সমগ্র বিষয়টাই পুরাপুরি জৈবিক। ইহা পশুধর্ম। এই আকর্ষণের ব্যাপারটিকে আমরা নানানভাবে মহিমান্বিত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। প্রেম নিয়া কবি সাহিত্যিকরা মাতামাতি করিয়াছেন। চিত্রকররা প্রেমিক-প্রেমিকার ছবি অঙ্কন করিয়াছেন। গীতিকাররা গান রচনা করিয়াছেন। গায়করা সেই গান নানান ভঙ্গিমায় গাহিয়াছেন।
প্রিয় পুত্র, প্রেম বলিয়া জগতে কিছু নাই। ইহা শরীরের প্রতি শরীরের আকর্ষণ। এই আকর্ষণ প্রকৃতি তৈরি করিয়াছেন যাহাতে তঁাহার সৃষ্টি বজায় থাকে। নর-নারীর মিলনে শিশু জনুগ্রহণ করিবে- প্রকৃতির সৃষ্টি বজায় থাকিবে।
একই আকর্ষণ প্রকৃতি তাঁহার সমস্ত জীবজগতে তৈরি করিয়াছেন। আশ্বিন মাসে কুকুরীর শরীর দুই দিনের জন্য উত্তপ্ত হয়। সে তখন কুকুরের সঙ্গের জন্য প্রায় উন্মত্ত আচরণ করে। ইহাকে কি আমরা প্রেম বলিব?
প্রিয় পুত্র, মানুষ ভান করিতে জানে, পশু জানে না এই একটি বিষয় ছাড়া মানুষের সঙ্গে পশুর কোনো তফতি নাই। যদি কখনো কোনো তরুণীর প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ কর, তখন অবশ্যই তুমি সেই আকর্ষণের স্বরূপ অনুসন্ধান করিবে। দেখিবে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু তুচ্ছ শরীর। শরীর যেহেতু নশ্বর, সেহেতু প্রেমও নশ্বর।।
প্রিয় পুত্র, তোমাকে অনেক দূর যাইতে হইবে। ইহা স্মরণ রাখিয়া অগ্রসর হইও। প্রকৃতি তোমার সহায় হউক— এই শুভ কামনা।
প্রিয় পুত্র,
মানুষ মায়াবদ্ধ জীব। মায়ায় আবদ্ধ হওয়াই তাহার নিয়তি। তোমাকে আমি মায়ামুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়া বড় করিয়াছি। তারপরেও আমার ভয়— একদিন ভয়ঙ্কর কোনো মায়ায় তোমার সমস্ত বোধ, সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন হইবে। মায়া কূপবিশেষ, সে-কূপের গভীরতা মায়ায় য়ে আবদ্ধ হইবে তাহার মনের গভীরতার উপর নির্ভরশীল। আমি তোমার মনের গভীরতা সম্পর্কে জানি। কাজেই ভয় পাইতেছি— কখন-না তুমি মায়া নামক অর্থহীন কূপে আটকা পড়িয়া যাও। যখনই এইরূপ কোনো সম্ভাবনা দেখিবে তখনই মুক্তির জন্য চেষ্টা করিবে। মায়া নামক রঙিন কূপে পড়িয়া জীবন কাটানোর জন্যে তোমার জন্ম হয় নাই। তুমি আমার সমগ্র জীবনের সাধনাকে নষ্ট করিও না।…
আমি আমার অপ্রকৃতিস্থ পিতার সমগ্র জীবনের সাধনাকে নষ্ট করি নি। আমি যখনই মায়ার কূপ দেখেছি তখনই দূরে সরে গেছি। দূরে সরার প্রক্রিয়াটি কত যে কঠিন তা কি আমার অপ্রকৃতিস্থ দার্শনিক পিতা জানতেন? মনে হয় জানতেন না। জানলে মায়ামুক্তির কঠিন বিধান রাখতেন না।
.
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর
ভয় বিষয়ক উপদেশ একজন মানুষ তার এক জীবনে অসংখ্যবার তীব্র ভয়ের মুখোমুখি হয়। তুমিও হইবে। ইহাই স্বাভাবিক। ভয়কে পাশ কাটাইয়া যাইবার প্রবণতাও স্বাভাবিক প্রবণতা। তুমি অবশ্যই তা করিবে না। ভয় পাশ কাটাইবার বিষয় নহে। ভয় অনুসন্ধানের বিষয়। ঠিকমতো এই অনুসন্ধান করিতে পারিলে জগতের অনেক অজানা রহস্য সম্পর্কে অবগত হইবে। তোমার জন্য ইহার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে তোমাকে বলিয়া রাখি, এই জগতের রহস্য পেয়াজের খোসার মতো! একটি খোসা ছাড়াইয়া দেখিবে আরেকটি খোসী। এমনভাবে চলিতে থাকিবে— সবশেষে দেখিবে কিছুই নাই। আমরা শূন্য হইতে আসিয়াছি, আবার শূন্যে ফিরিয়া যাইব। দুই শূন্যের মধ্যবর্তী স্থানে আমরা বাস করি। ভয় বাস করে দুই শূন্যে। এর বেশি এই মুহূর্তে তোমাকে বলিতে ইচ্ছা করি না।।
নিদ্রা ও জাগরণের যে বাঁধাধরা নিয়ম আছে, যেমন দিবসে জাগরণ নিশাকালে দ্বিা— এসব নিয়ম মানিয়া চলার কোনো আবশ্যকতা নাই। কোনোরকম বন্ধনে নিজেকে বাঁধিও না। খোলা মাঠ বা প্রান্তরে নিদ্রা দিতে চেষ্টা করিবে। কোনো প্রকোষ্ঠে শয়ন করিলে সেই প্রকোষ্ঠের দরজা-জানালা সবই খুলিয়া রাখিবে যেন নিদ্রাকালে খোলা প্রান্তরের সহিত তোমার দ্ৰিীকক্ষের যোগ সাধিত হয়।
নিদ্রাকালে তঙ্কর বা ডাকাত আসিয়া তোমার মালামাল নিয়া পলায়ন করিবে— এই চিন্তা মাথায় রাখিও না, কারণ তঙ্কর আকর্ষণ করিবার মতো কিছু তোমার কখনই থাকিবে না। যদি থাকে তবে তাহা তঙ্কর কর্তৃক নিয়া যাওয়াই শ্রেয়।
.
জগতের কর্মকাণ্ড চক্ষু মেলিয়া দেখিয়া যাইবে। কোনোক্রমেই বিচলিত হইবে না। আনন্দে বিচলিত হইবে না, দুঃখেও বিচলিত হইবে না। সুখ-দুঃখ এইসব নিতান্তই তুচ্ছ মায়া। তুচ্ছ মায়ায় আবদ্ধ থাকলে জগতের প্রধান মায়ার স্বরূপ বুঝিতে পারিবে না।
যখনই সময় পাইবে তখনই বনভূমিতে যাইবার চেষ্টা করিবে। বৃক্ষের সঙ্গে মানবশ্রেণীর বন্ধন অতি প্রাচীন। আমার ধারণা আদি মানব একপর্যায়ে বৃক্ষের সহিত কথোপকথন করিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এই ক্ষমতা নষ্ট হইয়াছে। তবে সাধনায় ফল হয়। মন কেন্দ্রীভূত করিতে যদি সক্ষম হও তবে বৃক্ষের সহিত যোগাযোগেও সক্ষম হইবে। বৃক্ষরাজ তোমাকে এমন অনেক জ্ঞান দিতে সক্ষম হইবে যে-জ্ঞান এম্নিতে তুমি কখনো পাইবে না।
কণ্টক
কাঁটা, কণ্টক, শলা, তরুনখ, সূচী, চোঁচ
বাবা হিমালয়, শৈশবে কইমাছের ঝোল খাইতে গিয়া একবার তোমার গলায় কই মাছের কাঁটা বিঁধিল। তুমি বড়ই অস্থির হইলে। মাছের কাটার যন্ত্রণা তেমন অসহনীয় নয়, তবে বড়ই অস্বস্তিকর। কণ্টক নীরবেই থাকে, তবে প্রতিনিয়তই সে তার অস্তিত্ব স্মরণ করাইয়া দেয়। কণ্টকের এই স্বভাব তোমাকে জানাইবার জন্যই আমি তোমার গলার কাঁটা তুলিবার কোনো ব্যবস্থা করি নাই। তুমি কিছুদিন গলায় কাঁটা নিয়া ঘুরিয়া বেড়াইলে। বাবা হিমালয়, তুমি কি জান যে মানুষের মনেও পরম করুণাময় কিছু কাঁটা বিধাইয়া দেন? একটি কাটার নাম,— মন্দ কাঁটা। তুমি যখনই কোনো মন্দ কাজ করিবে তখনই এই কাঁটা তোমাকে স্মরণ করাইয়া দিবে। তুমি অস্বস্তি বোধ করিতে থাকিবে। ব্যথা বোধ না— অস্বস্তিবোধ।।
সাধারণ মানুষদের জন্য এইসব কার্টার প্রয়োজন আছে। সিদ্ধপুরুষদের জন্য প্রয়োজন নাই। কাজেই কন্টকমুক্তির একটা চেষ্টা অবশ্যই তোমার মধ্যে থাকা উচিত। যেদিন নিজেকে সম্পূর্ণ কন্টকমুক্ত করিতে পারিবে সেই দিন তোমার মুক্তি। বাবা হিমালয়, প্রসঙ্গক্রমে তোমাকে একটা কথা বলি, মহাপাষণ্ডরাও কণ্টকমুক্ত। এই অর্থে মহাপুরুষ এবং মহাপাষত্রে ভিতরে তেমন কোনো প্রভেদ নাই।
.
হিমুর রূপালী রাত্রি
বাবা হিমালয়,
হিন্দুনারী সম্পর্কে একটি বহু প্রচলিত লোক-শ্লোক আছে—
পুড়ল কন্যা
উড়ল ছাই
তবেই কন্যার
গুণ গাই।
অর্থাৎ কন্যার দাহকার্য সম্পন্ন না-হাওয়া পর্যন্ত তার গুণকীর্তন করা যাবে না। মৃত্যুর আগমুহূর্তেও তার পা পিছলাতে পারে। সে ধরা দিতে পারে প্রলোভনের ফাঁদে। পা রাখতে পারে চোরাবালিতে।
এটা শুধু হিন্দু মেয়ে না, সবার জন্যে প্রযোজ্য। এবং তোমার জন্যে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। মায়া যখন হাতছানি দিবে তখন তোমাকে রক্ষা করার জন্যে কেউ থাকবে না। মায়ার্কে মায়া বলে চিনতে হবে। এই চেনাই আসল চেনা।
প্রসঙ্গক্রমে তোমাকে আরেকটি শ্লোক বলি। শ্লোকটি রচনা করেছেন চাণক্য মুনির পুত্র। তার জন্মস্থান তক্ষশিলা। তিনি ছিলেন মহারাজা চন্দ্রগুপ্তের পরামর্শদাতা। যাই হোক, শ্লোকটা এ রকম—
আহার নিদ্রা ভয় মৈথুনানি
সমানি চৈতাদি নৃনাং পশুনাম।
জ্ঞানী নরানামধিকো বিশেষ্যে।
আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুন— পশু এবং মানুষদের ভেতর সমভাবেই বিদ্যমান। কিন্তু মানুষ জ্ঞানী–আর এখানেই তার বিশিষ্টতা।
চাণক্যের এই শ্লোক সব মানুষের জন্যে প্রযোজ্য কিন্তু তোমার জন্যে নয়। পশু এবং মানুষের ভেতর যা সমভাবে বিদ্যমান তোমাকে তা থেকে আলাদা করার চেষ্টা আমি করেছি। কতটুকু সফল হয়েছি আমি জানি না। তবে আমার ধারণা– আমার সারাৰ্জীবনের সাধনা বিফলে যাবে না। তুমি সন্ধান পাবে পরম আরাধ্যের।
দুঃখী মানুষের কাছে থাকিও।
শোকগ্রস্ত মানুষের কাছে থাকিও।
রাগে-অন্ধ মানুষের কাছে থাকিও।
আনন্দিত মানুষের কাছে থাকিও।
দুঃখ-শোক, রাগ-আনন্দ তোমার ভিতরে আসিতে পারিবে না।
কিন্তু কদাচ বিরক্ত মানুষের কাছে খাকিও না।
বিরক্ত মানুষ ভয়ঙ্কর।
.
একজন হিমু কয়েকটি ঝিঝিপোকা
হাস্যমুখী মানুষের দিকে ভালোমতো তাকাইও। অনেক কিছু শিখিতে পারিবে। মানুষের মনের ভাব কখনই মুখে প্রতিফলিত হয় না। মুখের উপর সর্বদা পর্দা থাকে। শুধু মানুষ যখন হাসে তখন পর্দা দূরীভূত হয়। হাস্যরত একজন মানুষের মুখে তার মনের ছায়া দেখা যায়।
কখনো কোনো অবস্থাতে অস্থির হইবে না। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘূর্ণায়মান। এই ঘূর্ণিতে তুমি কখনো অস্থিরতা পাইবে না। তুমি পৃথিবীর স্বভাব ধারণ করিবে। মানুষ বাদ্যযন্ত্রের মতো। সেই বাদ্যযন্ত্র নিয়ত সংগীত তৈরি করে। অস্থির বাদ্যযন্ত্র সংগীত সৃষ্টিতে অক্ষম। কাজেই তোমার জন্যে অস্থিরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হইল। আমি জানি ইহা জগতের কঠিনতম কর্মসমূহের একটি। বাবা হিমু, কাউকে কাউকে তো কঠিনতম কর্মগুলি করিতে হইবে।
বাবা হিমালয়,
তোমাকে বাস করিতে হইবে অনেকের মধ্যে। লক্ষ রাখিও সেই অনেকের কেউই যেন তোমাকে কখনো চালাক বা বুদ্ধিমান মনে না করে। মহাপুরুষরা চালাক হন না, বুদ্ধিমান হন না, আবার তারা বোকাও হন না। পৃথিবীর এই অনিত্য জগতে বুদ্ধির স্থান নাই। বুদ্ধি দ্বারা এই জগৎ বুঝিবার চেষ্টা করিবে না–চেতনা দ্বারা বুঝিবার চেষ্টা করিবে। বুদ্ধি চেতনাকে নষ্ট করে…
.
তোমাদের এই নগরে
মিথ্যা সম্পর্কে তিনি বলেছেন—
হে আমার প্রিয় পুত্র, মিথ্যার কিছু কিছু উপকার আছে। কিছু মিথ্যা সমাজের এবং ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে কল্যাণকর ভূমিকা নেয়। কিন্তু মিথ্যা মিথ্যাই। সত্য আলো, মিথ্যা অন্ধকার। তোমার যাত্রা আলোর দিকে। মিথ্যা ছলনাময়ী, নানান ছলনায় তোমাকে ভুলাইবে। তুমি ভুলিও না। কখনো না, কোনো অবস্থাতেই না। ইহা আমার আদেশ।
.
সে আসে ধীরে
মৃত্যুপথযাত্রী কখনো দেখিয়াছ? কখনো কি তাহার শয্যাপার্শ্বে রাত্রি যাপন করিয়াছ? কখনো কি দেখিয়াছি কি রূপে দুটফট করিতে করিতে জীবনের ইতি হয়? জীবনের প্রতি মানুষের কি বিপুল তৃষ্ণা! আর কিছুই চাই না শুধু বাঁচিবার জন্যেই বাচিতে চাই।।
বাবা হিমালয়, তুমি অবশ্যই তোমার জীবনের কিছু সময় মৃত্যুপথযাত্রীদের জন্যে আলাদা করিয়া রাখিবে। তাহাদের শয্যাপার্শ্বে রাত্রি যাপন করিবে। যে হাহাকার নিয়া তাহারা যাত্রা করিতেছে সেই হাহাকার অনুভব করিবার চেষ্টা করিবে।
.
আঙুল কাটা জগলু
হে পুত্র। তুমি কঠিন অবস্থায় আছি। অক্সিজেন নামক অতি ক্ষুদ্র কিছু অণুর জন্যে তোমার সমস্ত শরীর এখন ঝনঝন করছে। মানুষের মস্তিষ্ক অক্সিজেন সবচেয়ে বেশি বেশি ব্যবহার করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার মস্তিষ্কের অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবে। তখন মস্তিষ্ক স্বরূপে আবির্ভূত হবে। মস্তিষ্ক তোমাকে অদ্ভুত সব অনুভূতি দেখাবে, দৃশ্য দেখাবে। ভয় পেও না।
তিনি বলে গিয়েছেন, হিমালয়, কাউকে কিছু দিবি না, কারো কাছ থেকে কিছু নিবিও না। নিজেকে সবরকম দেয়া-নেয়ার বাইরে রাখবি। উপহার দেয়া-নেয়া, প্রেম দেয়া-নেয়া কিংবা স্নেহ-মমতা দেয়া-নেয়া কোনোকিছুর মধ্যেই থাকবি না।
.
আজ হিমুর বিয়ে
একজন মহান দার্শনিক বলেছেন— তুমি নিজেকে যা মনে করো তুমি তাই। তুমি যদি নিজেকে মহাপুরুষ ভাব তুমি মহাপুরুষ। আর তুমি যদি নিজেকে পিশাচ ভাব তুমি পিশাচ।
যে, মহান দার্শনিক এই কথা বলেছেন তার নাম জানতে পারি?
তিনি আমার বাবা। মহাপুরুষ বানাবার তিনি একটি স্কুল খুলেছিলেন। তিনি একটি স্কুল চালাতেন। আমি সেই স্কুলের ছাত্র। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে গ্রাজুয়েশনের আগেই বাবা মারা গেলেন।
.
হিমু রিমান্ডে
আমার বাবা (মহাপুরুষ গড়ার কারিগর তার উপদেশমালায় মৃত্যুবিষয়ক অনেক কথাবার্তা লিখে গেছেন। সেখানে অতি নিম্নশ্রেণীর প্রাণ জীবাণুর মৃত্যু বিষয়েও লেখা আছে—
জীবাণুর জন্ম মৃত্যু
জীবাণু অতি নিম্নপর্যায়ের প্রাণ। যেহেতু প্রাণ আছে কাজেই মৃত্যুও আছে। মুহূর্তেই লক্ষ কোটি জীবাণুর জন্ম হয়, আবার মুহূর্তেই মৃত্যু। অতি ক্ষণস্থায়ী জীবনকালে তাহারা কী ভাবে? তাহাদের চেতনায় চারপাশের জগৎ কী? এই বিষয়ে বাবা হিমু, তুমি কি কখনো চিন্তা-চেতনা করিয়াছ? আপাতদৃষ্টিতে মনে হইতে পারে জীবাণুর চিন্তা-চেতনা অর্থহীন। তাহাদের ক্ষণিক জীবনে চিন্তা চেতনার স্থান নাই। এই যুক্তি মানিয়া মানব সম্প্রদায় সম্পর্কে কিছু বলি। মহাকাল এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কাছে মানব সম্প্রদায়ের ক্ষণিক জীবনও তুচ্ছ। সেই বিবেচনায় তাহাদের চিন্তা-চেতনাও অর্থহীন। মানব সম্প্রদায়ের উচিত নিজেদেরকে জীবাণুর মতোই চিন্তা করা। কিন্তু অহংবোধের কারণে তাহারা তা করে না। বরং অমরত্বের কথা ভাবে। পাবলো নেরুদার বিখ্যাত কবিতা Fin del mundo-র প্রতি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি
তাব, মোৎসার্ট কি-না লম্বাঝুল তোফা ফ্রকফোটে আমাদের শতকেও নাছোড়বান্দার মতো টিকে আছেন, এখনো বাহারি সাজে জমকালো, পরিপাটি পূর্ণাঙ্গ সংগীতে; বিগত শতক জুড়ে, মনে হয়, আর কোনো আওয়াজও বুঝি বা কানে আসে নি।
.
হিমুর মধ্য দুপুর
গৃহভৃত্য বিষয়ে আমার বাবার কিছু উপদেশবাণী ছিল। উপদেশবাণীর সার অংশ হচ্ছে— মহাপুরুষদের কিছুকাল গৃহভৃত্য হিসেবে থাকতে হবে। তিনি ডায়েরিতে কি লিখে গেছেন হুবহু তুলে দিচ্ছি। এই অংশটি তিনি মৃত্যুর আগে হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে লিখেছেন। হাতের লেখা জড়ানো এবং অস্পষ্ট। মানুষের মানসিক অবস্থার ছাপ পড়ে হাতের লেখায়। আমার ধারণা তখন তার মানসিক অবস্থাও ছিল এলোমেলো। লেখার শিরোনাম হিজ মাস্টার্স ভয়েস। তিনি সব লেখাই সাধু ভাষায় লেখেন। এই প্রথম সাধু বাদ দিয়ে চলিত ভাষা ব্যবহার করেছেন।
হিজ মাস্টার্স ভয়েস হিমু, তুমি নিশ্চয় রেকর্ড কোম্পানি হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রেকর্ড দেখেছ। তাদের মনোগ্রামে একটি কুকুরের ছবি আছে। কুকুরটা থাবা গেঁড়ে তার মনিবের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে প্রভুর প্রতি আনুগত্য ঝরে ঝরে পড়ছে।
সব মহাপুরুষদের কিছু দিন কুকুর জীবন যাপন করা বাধ্যতামূলক। সে একজন প্রভুর অধীনে থাকবে। প্রভুর কথাই হবে তার কথা। প্রভুর আদেশ পালনেই তার জীবনের সার্থকতা। প্রভুর ভাবনাই হবে তার ভাবনা। প্রভু মিথ্যা বললে সেই মিথ্যাই সে সত্য বলে ধরে নিবে।
কুকুর ট্রেনিং-এ উপকার যা হবে তা নিম্নরূপ :
ক. জীবনে বিনয় আসবে। বিনয় নামক এই মহৎ গুণটি আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব। আমি অতি বিনয়ী মানুষকেও দেখেছি অহংকারের গুদাম। সেই গুদাম তালাবদ্ধ থাকে বলে কেউ তার অহংকার প্রত্যক্ষ করতে পারে না।
খ. আনুগত্য কি তা শেখা যাবে। প্রতিটি মানুষ নিজের প্রতিই শুধু অনুগত। অন্যের প্রতি নয়। নিজের প্রতি আনুগত্য যে সর্বজনে ছড়িয়ে দিতে পারবে সেই তো মহামানব।
গ. মানুষকে সেবা করার প্রথম পাঠের শুরু।
কুকুর ট্রেনিং কিংবা গৃহভৃত্য ট্রেনিং তোমাকে সেবা নামক আরেকটি মহৎ গুণের সংস্পর্শে আনবে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল না, তোমাকে সত্যি সেবা শিখতে হবে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অসুস্থ মানুষদের সেবা করতেন। তারা এমনিতেই সেবার দাবিদার। তোমাকে সুস্থ মানুষকে সেবা করতে হবে।
আমি নিজে এখন অসুস্থ। সময় ঘনিয়ে আসছে এইরূপ মনে হয়। তোমাকে পূর্ণাঙ্গ ট্রেনিং দিয়ে যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। যেসব শিক্ষা দিয়ে যেতে পারব না, আমার আদেশ, সেসব শিক্ষা নিজে নিজে গ্রহণ করবে।
এখন অন্য বিষয়ে কিছু কথা বলি— গত শু দুপুরে আমি তোমার মাকে স্বপ্নে দেখেছি। স্বপ্ন মোটেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। মানুষ যখন নিদ্রা যায় তখন মস্তিষ্ক তার স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করে। যাচাই-বাছাই করে, কিছু পুনর্বিন্যাস করে, তারপর স্মৃতির ফাইলে যত্ন করে রেখে দেয়। এই কাজটা সে করে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন। মস্তিষ্কের এই কাজ-কর্মই আমাদের কাছে ধরা দেয় স্বপ্ন হিসেবে। ফ্রয়েড সাহেব বলেছেন, সব স্বপ্নের মূলে আছে যৌনতা। এই ধারণা যে কতটা ভুল তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।
যাই হোক, এখন স্বপ্নের কথা বলি। আমি তোমার কিশোরী মাকে স্বপ্নে দেখলাম। এটা কীভাবে সম্ভব হলো জানি না। কারণ তাকে আমি কিশোরী অবস্থায় কখনো দেখি নাই। যখন তাকে বিবাহ করি তখন তার বয়স বাইশ। সে একজন তরুণী।
আমি দেখলাম সে তার গ্রামের বাড়িতে। কুয়ার পাড়ে বসে। আছে। তার সামনে এক বালতি পানি। সে চোখেমুখে পানি দিচ্ছে। তোমার মা অতি রূপবতীদের একজন এই তথ্য মনে হয় তুমি জান না। কারণ, তার মৃত্যুর পর আমি তার সমস্ত ফটোগ্রাফ নষ্ট করে দিয়েছি। তার স্মৃতিজড়িত সব কিছুই ফেলে দেয়া হয়েছে। কারণ স্মৃতি মানুষকে পিছনে টেনে ধরে। মহাপুরুষদের পিছুটান থেকে মুক্ত থাকতে হয়।
স্বপ্নের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। তোমার মা চোখেমুখে পানি দিয়ে উঠে দাঁড়ানো মাত্র আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। তোমার মা অত্যন্ত আনন্দিত গলায় বলল, তুমি একা এসেছ, আমার ছেলে কই?
আমি বললাম, তাকে ঢাকা শহরে রেখে এসেছি।
সে করুণ গলায় বলল, আহার, কত দিন তাকে দেখি না! সে। -কি হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে। এটা কি সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
তুমি তাকে সুন্দর একটা শার্ট কিনে দিও। একটা প্যান্ট কিনে দিও। এক জোড়া জুতা কিনে দিও।
আচ্ছা দিব।
তোমার মা তখন কাদতে শুরু করে এবং কাদতে কাদতে বলল, ওর কি কোনো মেয়ের সঙ্গে ভাব হয়েছে? কোনো মেয়ে কি ভালোবেসে তার হাত ধরেছে?
আমিবললাম, না। সে মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করছে। তার জন্যে নারীসঙ্গ নিষিদ্ধ।
তোমার মা চোখের পানি মুছে রাগী রাগী গলায় বলল, সে মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করছে, না কচু করছে। তাকে তুমি আমার কাছে নিয়ে আস। আমি থাবড়ায়ে তার মহাপুরুষগিরি ছুটায়ে দিব।
স্বপ্নের এই জায়গায় আমাৱ ঘুম ভেঙে গেল।
স্বপ্ন যে এক ধরনের ভ্রান্তি তা আমি জানি। তারপরেও স্বপ্নদর্শনের পর পর আমার মধ্যে কিছু আচ্ছন্ন ভাব দেখা দিল। আমার চক্ষু সজল হলো। মনে মনে বললাম,
মাতা যস্য গৃহেনাস্তি
অরণ্যং তেন গন্তব্যং
যথারণ্যং তথা গৃহস।
বাবা হিমু, এখন তোমাকে একটি বিশেষ কথা বলি— তোমার মায়ের একটি আট ইঞ্চি বাই বারো ইঞ্চি ছবি এবং তার লেখা ডায়েরি আকারে একটা খাতাআমি গোপনে রেখে দিয়েছি। একটা খামে সিলগালা করে রাখা। যে তোষকে আমি ঘুমাই সেই তোষকের ভেতরে সিলাই করে রাখা আছে। তুমি খামটি সংগ্রহ করবে। যে দিন কোনো কারণে তোমার হৃদয় সত্যিকার অর্থেই আনন্দে পূর্ণ হবে সেদিন খামটা খুলবে। তবে একবার খাম খুলে ফেলার পর ছবি, খাতা এবং খাম আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
যেহেতু একবার দেখার পর সব পুড়িয়ে ফেলতে হবে সেই কারণেই তুমি কোনোদিন খামটা খুলতে পারবে না বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। হা হা হা। একে কি বলে জান? একে বলে থেকেও নাই।
তোমার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তুমি কিছু মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষের সাক্ষাত পাইবে। অতি অবশ্যই তুমি তাহাদের নিকট হইতে সহস্র হাত দূরে থাকিবে। কারণ মহাপুরুষদের আকর্ষণী ক্ষমতা প্রবল। একবার তাহাদের আকর্ষণী ক্ষমতার ভিতর পড়িলে আর বাহির হইতে পারিবে না। তাহাদের বলয়ের ভিতর থাকিয়া তোমাকে চক্রাকার ঘুরিতে হইবে। ইহা আমার কাম্য নয়।
পাদটীকা : হিমুর বাবা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তার মৃত স্ত্রীর প্রতি গভীর মমতা অনুভব করেছেন। আমি মানুষটিকে ক্ষমা করেছি।