- বইয়ের নামঃ হিমুর মধ্যদুপুর
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ অন্বেষা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, দর্শন
একটা কিডনী দিতে পারবি
হিমু, তুই আমাকে একটা কিডনী দিতে পারবি? আমার একটা কিডনী দরকার।
মানুষজনের কথায় হকচাকিয়ে যাওয়া কিংবা বিভ্ৰান্ত হওয়া আমার স্বভাবে নেই। তারপরেও মাজেদা খালার কথায় হকচকিয়ে গেলাম। ধানমন্ডি ২৭ নাম্বার রোডে গাড়ি থামিয়ে তিনি আমাকে ধরেছেন। এখন কিডনী চাচ্ছেন। তাঁর কথার ভঙ্গিতে বিরাট তাড়াহুড়া। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তেই কিডনী দরকার।
কথা বলছিস না কেন? একটা কিডনী দিবি?
কেন দেব না।
থ্যাংকস, গাড়িতে উঠ। ড্রাইভারের পাশে বোস। চল বাসায় যাই।
কিডনী কি বাসায় নিয়েই কেটে কুটে রেখে দেবে? ডাক্তার কাটবে না-কি তুমি নিজেই কাটবে? ধারালো স্টেরিলাইজড ছুরি-কাঁচি আছে তো?।
অকারণে কথা বলিস কেন? গাড়িতে উঠ।
আমি গাড়িতে উঠলাম। গাড়িতে AC চলছে। আরামদায়ক শীতলতা। বাইরে বৈশাখ মাসের ঝাঁঝালো রোদ। শহর পুড়ে যাচ্ছে এমন অবস্থা। এই রোদের একটা নাম আছে – কাকমারা রোদ। কাকের মতো কষ্টসহিষ্ণু পাখিও এই রোদে হিট স্ট্রেীকে মায়া যায়। আমি আজ দুটা কাককে মরে থাকতে দেখেছি। মৃত্যুর পর কাকরা কোথায় যায় কে জানে। তাদেরও কি স্বৰ্গ-নরক আছে? কাকদের স্বৰ্গ কেমন হবে? আমার ধারণা তাদের স্বৰ্গে একটু পরপর থাকবে ডাস্টবিন। ডাস্টবিন ভর্তি ময়লা-আবর্জনা। ফেলে ছড়িয়ে আবর্জনা খাও। কেউ কিছু বলবে না।
খালা বললেন, কিডনী দিতে হবে শুনে তুই দেখি ভ্যাবদা মেরে গেছিস। দুটা কিডনী মানুষের কোনো দরকার নেই। একটাতেই হেসেখেলে দিন চলে।
আমি বললাম, দুটা কিডনীতেও তো অনেকের চলে না। অন্যদেরটা নিতে হয়।
খালা বললেন, বাজে তর্ক আমার সঙ্গে করবি না। এই গরমে তর্ক শুনতে ভালো লাগে না।
আমি বললাম, আচ্ছা, আর তর্ক করব না। শীত আসুক। নগর শীতল হোক। তখন তর্ক।
আখের রস খাবি? গরমের সময় আখের রস শরীরের জন্যে ভাল। অনেক এন্টি ওক্সিডেন্ট আছে। খাবি?
খাব।
দুটা আখ থেকে এক গ্লাস রস পাওয়া যায়। হালকা সবুজ কালার। এর মধ্যে লেবুর রস আর সামান্য বিট লবণ দেয়, বরফের কুচি দেয়। খেতে অসাধারণ। আমি রোজ এক গ্রাস করে খাচ্ছি।
জন্ডিস এখনো হয় নাই?
জন্ডিস হবে কোন দুঃখে? আখওয়ালা আমার পরিচিত লোক। নাম সুলেমান। নরসিংদি বাড়ি। সে আমার সামনে মিনারেল ওয়াটার দিয়ে আখ মাড়াইয়ের যন্ত্র ধুবে। আখও ধোয়া হবে মিনারেল ওয়াটার দিয়ে। তার কাছ থেকে অনেক ফরেনারও আখের রস খায়।
কোন দেশী ফারেনার সেটা হিসাবে রাখতে হবে। ইউরোপীয়ান ফরেনার না সোমালিয়ান ফরেনার।
হিমু! একবার না বলছি, আবারো বলছি, তুই বাজে তর্ক আমার সঙ্গে করবি না। আমাকে ফরেনায় শিখাবি না। আগামী আধাঘণ্টা একটা শব্দ উচ্চারণ করবি না। আমি যা বলব শুধু শুনে যাবি।
ওকে।
ওকে ফোকেও বলবি না।
আমি নিঃশব্দে মাজেদা খালার সঙ্গে আখের রস খেলাম (জিনিসটা ভাল)। পাশেই ক্ষিরা কেটে বিক্রি করছে। খালা ক্ষিপ্পা খেলেন। একজন কাসুন্দি দিয়ে কাচা আম মাখিয়ে বিক্রি করছিল। পাঁচ টাকা প্লেট। আমরা তাও খেলাম। সবশেষে তরমুজ।
খালা বললেন, গরমের সব ওষুধ শরীরে নিয়ে নিলাম। শরীরের ডিহাইড্রেশন বন্ধ করার ব্যবস্থা হল। বুঝলি?
আমার কথা বলা নিষেধ। কাজেই হ্যা-সূচক মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম যে— বুঝেছি। মাজেদা খালা, খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কিডনী প্রসঙ্গও খোলাসা করলেন। তাঁর পরিচিত এক ভদ্রলোকের দুটা কিডনীই নষ্ট। ডায়ালাইসিস করে দিন কাটছে। তাকে কিডনী দিতে হবে। তিনি সিঙ্গাপুরে যাবেন কিডনী ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে।
হিমু! তুইও উনার সঙ্গে সিঙ্গাপুরে যাবি। ফাঁকতালে তোর বিদেশ ভ্ৰমণ হয়ে যাবে। ভাল না?
ভাল।
পত্রিকায় প্রায়ই এ্যাড দেখি কিডনী বিক্রি করতে চায়। ওরা ফকিরমিসকিন। ওদের কিডনী কেনার মানে হয় না।
ফকির মিসকিনের কিডনী আর প্রেসিডেন্ট বুশের কিডনীতো একই।
আবার কথা বলা শুরু করেছিস? তোকে না বললাম আধাঘণ্টা কথা বলবি না।
সরি।
যাকে কিডনী দিবি তার সঙ্গে যখন পরিচয় হবে তখন তোর মনে হবে। একটা কেন? দুটা কিডনীই দিয়ে দেই। এমন অসাধারণ মানুষ। বুঝেছিস?
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম।
খালা বললেন, আমরা ছোটবেলায় তাঁকে ডাকতাম, মুরগি। উনি বই পড়ার সময় নিজের অজান্তেই মুরগির মতো কক কক করেন এই জন্যে মুরগি নাম। তোকে গাড়ি দিয়ে তার কাছে পাঠাব। ঠিকানা দিয়ে পাঠালে তুই যাবি না। আমাকে বলবি— ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছিস। তোকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি; যাকে কিডনী দিবি তাঁর নাম পন্টু। অসাধারণ মানুষ। পরিচয় হলেই বুঝবি। উনার দশটা কথা শুনলেই তুই তার কেনা গোলাম হয়ে যাবি। তুই তাঁকে বলবি, আপনি আমার কিডনী, হাট, লিভার সব নিয়ে নিন।
শুধু চামড়াটা নিয়ে আমি বঁচিব কীভাবে?
কথার কথা বলছি রে গাধা।
যার নাম পল্টু এবং যাকে ডাকা হতো মুরগি; তার বিষয়ে আগ্রহী হওয়ার কারণ নেই। বিশেষ করে মাজেদা খালা যাকে অসাধারণ বলেন তার বোকা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বলা হয়ে থাকে, বুদ্ধিমানের কাছ থেকে দশ হাত দূরে থাকবে। আর বোকাদের কাছ থেকে একশ হাত দূরে থাকবে। দূরে থাকা সম্ভব হল না। খালা গাড়ি করে সেইদিনই পন্টু সাহেবের কাছে পাঠালেন। খালা হচ্ছেন ধর তক্তা মার পেরেক টাইপ মহিলা। দেরি সহ্য করার মেয়ে না।