- বইয়ের নামঃ এই গৃহ এই সন্ন্যাস
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আজীবন একই চিঠি
নখরে জ্বালিয়ে রাখি লক্ষ্যের দীপ্র ধনুক
যেন এক শব্দের নিষাদ এই নির্মল নিসর্গে বসে কাঁদি, তবু
সেই নির্মম শব্দাবলী ছিঁড়ে আনতে পারি না বলে
সুতীক্ষ্ণ অনুযোগ হতে অব্যাহতি দিন; এই
শোকের শহরে আমি যার কাছে চাই ফুল, কিছু মনোরম
শোভা, যেসবের বিসতৃত বর্ণনা আমি আপনাকে লিখতে পারি, সে
আমার হাতে শুধু তুলে দেয় দুঃখের বিভিন্ন টিকিট।
আমি চাই প্রত্যহ আপনাকে লিখতে চিঠি, আমি চাই প্রতিদিন
লিখতে এই রক্তের গভীর ইচ্ছে, মর্তান্তিক অনুভবগুলি
আমার সবুজ সুখ, কোমল আনন্দ, নির্জন কান্নার স্বর
একাকী হাঁটতে পথে যেসব দুঃখ দিয়ে ভরে নিই যমজ পকেট
ঢাকার এইসব রঙিন দোকান হতে কিনতে পারিনে আমি
একেকটি সুখের সংসার, কাঠের ঘোড়া, সোনালি
চাবুক, তাই কাঁদি শৈশবের শ্যামল নদীর উপাখ্যান
ভেবে, যে স্বরে কাঁদি আমি সঙ্গিহীন মধ্যরাতে সরকারী গোরস্থানে কিংবা
আমার গোপন ঘরে ফিরে এসে জ্বালাই
দিব্যমোম, শোকের গর্তে শুয়ে কাঁদি, কিংবা যখন
পার্কের বেঞ্চে বসে ফেরেববাজ আড্ডা দিই, ফালতু ফক্কর
মিলে অনেকক্ষণ অযথা হাসি, টিটকিরি দিই, অনগৃল বিদ্রূপের
থুথু ছুঁড়ে উল্লসিত হই, তবু কিছুতেই
পারিনে আমি এইসব সুখদুঃখে আপনাকে লিখতে
চিঠি ; শুনুন জনক, আমি চিরদিন শব্দের কাঙাল।
আজীবন তাই আপনাকে লিখি শুধু একই চিঠি, ভালো
আছি, ইত্যাকার
কুশল সংবাদ অথচ প্রতিদিন ভুগি শিরপীড়া,
বুকে কাশি, অবিরাম জ্বর- আমার রুক্ষ চুলে বিলি কাটে
দুঃস্বপ্নের হাত, এসব খবর কি দৈনন্দিন
লেখা যায়! কী করে লিখবো বলুন, ঘরে একা
দুঃসংবাদে কাঁদবে জননী। আজীবন লিখেছি তাই
একই চিঠি, সেই মিথ্যে মর্মহীন একই চিঠি!
হে জনক, সেই নির্র্মম শব্দ নেই এখানে, যা দিয়ে
বাজাতে পারি কান্নার করুণ কণ্ঠ, নক্ষত্রবীথির সুদূর
নীলিমা হতে আমি
তুলে আনতে পারিনে অমল শব্দের বিভা, অন-রঙ্গ ধ্বনি
আত্মার নিঃসঙ্গ স্বর তাই আমি বোঝাতে পারিনে,
হে জনক, পূজনীয় জনক আমার, ইচ্ছের একটি চিঠি
আজো আমি লিখতে পারিনি।
আমার এ-ভয় অন্যরকম
তোমরা সবাই ভয় পাও এই বাইরে যেতে
দুয়ার খুলে বাইরে যেতে
পথ পেরোতে
গাড়ির ভিড়ে বড়ো রাস্তা পার হতে যেই পা বাড়ালে
ভয় পাও এই আগুন দেখে
বারুদ দেখে
দোজখ দেখে ভীষণ রকম গজব দেখে খোদাতালার
তোমরা সবাই ভয় পাও এই দাঙ্গা দেখে
মড়ক লাগলে মহামারী এমনি কিছুর
ভয় পাও ঠিক রাত-বিরেতে অন্ধকারে
যাকে তাকে দেখলে হঠাৎ
হয় পাও এই সাপের বাঘের
চোর-ডাকাতের দৈত্যদানা জলপুলিশের
অনেক কিছুর ভয় তোমাদের
ভয় তোমাদের বাইরে কেবল চেখের ওপার,
আমার এ-ভয় অন্যরকম
অন্য কিছুর
আমার কিছুর
আমার এ-ভয় বাইরে তো নয়
ঘরের ভিতর নিজের ভিতর
আমার এ-ভয় নিজেকে ভয়
আমার এ-ভয় শোবার ঘরে বাথরুমটির
ঠাণ্ডা জলের টবের ভিতর
দাড়ি কাটার লম্বা ক্ষুরে
চায়ের কাপে কাঁটা-চামচে
আমার এ-ভয় আলমারিতে
বইয়ের তাকে ফুলদানিতে
মুখ দেখবার আয়না খুলে ড্রয়ার খুলে
আমার এ-ভয়
আমার এ-ভয় শত্রুকে নয় প্রিয়ার চোখে
নরম ঠোঁটে
নিজের দুটি করে মাঝে নখের ভিতর
আমার এ-ভয় অন্যরকম অন্যরকম।
কোনো বাস নেয় না আমাকে
আজীবন শুধু হাঁটছি আমি
নারী, তার দেয়া সংসারের
ব্যস্ততা নিয়ে দ্রত দৌড়চ্ছি কেবল
সে আমার ইন্দ্রিয়ে জন্ম দিয়ে গেছে কাজ
ভালোবাসা, প্রলোভন মানবিক ব্যবহার
নারী তার দিয়ে গেছে দুচোখের গুপ্ত ঠিকানা
তার সঙসারের সন্তানের অভিলাষ নিয়ে
তার সে চোখের ইমেজ হাতে
আমি দৌড়চ্ছি কেবল ;
স্টপেজে স্টপেজে যাই হাত তুলি,
ডেকে বলি, শুনুন আমাকে পৌঁছতে হবে, বড়ো তাড়া
দেরি হলে বন্ধ হয়ে যাবে তার নিয়মিত গেট,
বাসভর্তি লোক হাত নাড়ে, রুক্ষ ড্রাইভার
তার করতলে নিষেধের ঝুলানো সাইনবোর্ড
আমাকে নেয় না বাস আবার দৌড়ই
সামনে স্টপেজ ডবল ডেকার থাকে
লোকজন ওঠানামা করে, ছেড়ে যায় বাস
নারী তার গুপ্ত ঠিকানা বুঝি
আমার নাগাল থেকে দূরে ;
শহরে এখন এতো বাস, ছোটো বড়ো গাড়ি
যানবাহনের ভিড়ে চলা দায়
তবু নেই জায়গা কোথাও, সব বাস ভর্তি লোক
স্টপেজ এলেই ড্রাইভার হাত নাড়ে
যেন তার হাত সিনেমা হলের
সামনে হাউসফুল টাঙানো পোস্টার,
যতোই বলি না কেন আমাকে যেতেই হবে
তোমার দূরত্বে যেতে আর কোনো বাস খোলা নেই ;
আমাকে পৌঁছতে হবে নারী আর সংসারের কাছে
আমাকে রেখেই তবু যায় লোকভর্তি বারোটার শেষ বাস,
তোমার দূরত্বে যাবো
কোনো বাস নেয় না আমাকে।
জলসত্র
শহরের চৌদিকে ওরা খুলে দেয় সুবিখ্যাত জলসত্র সব
তবু কানে আসে কলরব
ভীষণ পিপাসা এইখানে, জলচাই
মানুষের পিপাসার জল নাই
মিউনিসিপ্যালিটির এই বড়ো বড়ো ট্যাঙ্কের তলায়
বালি আর কঠিন কাঁকর সব জমে আছে। আমাদের বিশুষ্ক গলায়
একবিন্দু শীতল জলের স্বাদ দিতে পারে এমন প্রকৃত কোনো হ্রদ নেই
কাছে কিংবা যেখনেই
তাকাই কেবল আজ চোখে পড়ে ধোঁয়ার কফিন
সগর আর নদীর জল প্রতিদিন
বাষ্পীয় জাহাজে চড়ে চলে যায় দূরবর্তী চাঁদের শহরে
সেইসব প্রাণশূন্য ঘরে
বসে পৃথিবীর শ্যামল জলের বাজার
থরে থরে গজায় বৃক্ষবাড়ি, লোকালয় এখানে হাজার
মরে পিপাসায়, জল নেই শহরে কোথাও
শহরে কোথাও আজ শান্তি নেই, যদিও অনর্গল শান্তির ডঙ্কা পেটাও
খুলে দাও জলসত্র, তবু হায়
এ শহরে মরে লোক ভয়ে জলশূন্যতায় আর
পিপাসায়।
জ্যাকুলিনের দ্বিতীয় বিবাহের পর
তুমি বড়ো জীবনকে ভালোবাসতে, জ্যাকুলিন
সুখ কোথায় থাকে, ভালোবাসা কোথায় তার
ক্যাম্পখাট বিছিয়ে ঘুমায়
তোমার চেখের নিচে ভালোবাসার সবুজ ঠিকানা
তোমার গুপ্ত বুকে দক্ষিণ আমেরিকার সমস্ত সোনার খনি
ঐশ্বর্যে তোমার বড়ো সাধ
তুমি চাও জুয়েলারী, টয়লেট,
ছিমছাম সোনালি মোজেক ;
দুঃখকে তোমার বড়ো ভয় জ্যাকুলিন,
দুঃখকে তোমার বড়ো ভয়
দুঃখ কি দেখেছো খুলে তার কালো বাক্স থেকে দেখতে কেমন
তার সারা মুখে ব্রণের দাগ, নিগ্রোদের মতো ভাঙা গলার স্বর
দুঃখ বড়ো ভয়ঙ্কর, দুঃখকে পাশে নিয়ে তুমি কিছুতেই ঘুমোতে
পারবে না
বড়ো শকাত দুঃখের সাথে রাত জাগা
বিশেষত তোমার অভ্যাস নেই,
জ্যাকুলিন, তোমার চাই ভালোবাসার বাসস্থান,
সম্পদ, দম্পতির সুখভোগ
তোমার চোখের নীল সমুদ্রে চাই ওনাসীদের সমসন্ত জাহাজের মালিকানা
জাঁকজমক, যা কিছু ইচ্ছে খরচবরাদ্দ,
তোমার যৌবনে চাই ভুলচুক, প্রকৃতির রক্তমাংস
সন্মৃতির ঝাপসা আংনায় তুমি কারো ফ্যাকাসে মুখ দেখে
এক থাকতে পারো না,
কেনেডীর মৃত্যু যতো করুণই হোক, জ্যাকি, তুমি এক
থাকতে পারো না।
জ্যাকুলিন, তুমি দেখবে সমুদ্র ভ্রমণে গিয়ে
ব্যালকনি দেখে কেমন বাঁচতে আচ্ছে করে
যেঘ দেখতে দেখতে হায় যায় লতাপাতার মতো কাছাকাছি
তুমি কখনো পিকনিকে গেলে দেখবে নারীপুরুষের
পাশাপাশি সুখ ও ভালোবাসার অবস্থান
টকিহল, মন্ত্রীদের বসভবন কিংবা হোয়াইট হাউসের
পাশ দিয়ে যেতে যেতে
তুমি এসব দেখে অযথা দুঃখ পাবে
তোমার অনেক কিছু আচ্ছে করবে জ্যাকুলিন,
ভালোবাসা, সুখ, চুম্বন এরকম আরো কতো কি
ও তুমি সইতে পারবে না ;
তোমার চোখের নিচে ভালোবাসার ধারালো রেজার
তোমার বুকের মধ্যে সুখী দম্পতির সবুজ ভূস্বর্গ
তোমার কোনো দোষ নেই জ্যাকুলিন, তোমার কোনো দোষ নেই
তুমি তো নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে
পারো না।
তার বুকে আছে
তার বুকে আছে স্বর্ণচাঁপার গাছ, আকাশের মতো বড়ো নীল
পোষ্টাপিস
সব যোগাযোগ, নিরুদ্দেশ মানুষের তারবার্তা, জরুরী খবর
বৃষ্টির কালো জামা পরে সেখানে লুকিয়ে থাকে তাড়িত ফেরারী
তার বুকে ট্যুরিষ্টের নিশ্চিত শেল্টার আছে, অসুখী লোকের
আছে সবুজ শুশ্রূষা
বনের চোখের নিচে যারা পাখির পারক খোঁজে, আসে
বনবিভাগের লোকজন জেনে নিতে গাছের বয়স, উদ্ভদ কীভাবে বাড়ে-
অথচ সবাই তারা ফির যায় প্রকৃতির জড় ব্যবহার দেখে
এইসব হন্যে মানুষ এসে তার বুকে খুঁজে পায় সমস্ত পাখির বাসা,
নিসর্গের নীল টেলিফোন শোনে
দেখে উদ্ভিদের নিজস্ব হস্তাক্ষরে লেখা চিঠি, পাখির পালক দিয়ে
নির্মিত গার্মেন্ট
তার বুকে আছে
অরণ্যের চিত্রকলা, গোপন স্টুডিও ;
তার বুকে আছে দেরি করে ঘরে ফিরে ডাক দিলে যে দেয়
দুয়ার খুলে
সেই ভালোবাসা,
যে এসে ভীষণ জ্বরে মাথায় কোমল হাত রাখে সেই দুঃখবোধ
তার বুকের মধ্যে বাস করে রাজদম্পতির সুখ, দুঃখী
বালকের কান্নার সঙ্গী
যখন শহরে বাধে গোলযোগ, ধর্মঘট হরতাল চলে
যানবাহন বন্ধ থাকে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়
ঝাঁপ-ফেলা দোকানপাট দেখে মনে হয় সমস্ত শহর যেন
মৃত রবিবার
তখনো দাঁড়িয়ে দেখি তার বুকে খোলা জুয়েলারী শপ,
ফুলের দোকান,
আকশের মতো সেই বড়ো নীল পোস্টাপিস,
তার বুকে আছে
গোপনীয় খাম হাতে সোনালি পিয়ন।
তোমাকে ছাড়া
তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন গাছের কাছে গেলে আমার ভীষণ আনন্দ বোধ হতো
লতাপাতার উৎসাহ দেখে আমি সারাদিন তার কাছে ঘুরে বেড়াতাম
কোনো কোনো দেন পাখিদের
বাষভূমিতে আমার অনেক উপাখ্যান শোনা হতো
তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন প্রত্যহ সূর্যোদয় দেখতে যেতাম তোমাদের বাড়ির পুরনো ছাদে
তোমার সেই যে দজ্জাল ভাই সারারাত তাস খেলে এসে
পড়ে পড়ে তখনো ঘুমাতো,
তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন আমার রোজ ভোরবেলা ঘুম ভাঙতো, যেতাম
প্রকৃতির কাছে মানবিক অনুভূতি নিয়ে
মানুষের দুঃখ দেখে আমার তখন ভীষণ কান্না পেতো
এখন আমার আর সেই অনুভব ক্ষমতা নেই
মানুষের নিষ্ঠুরতা ও পাপ দেখেও আমি দিব্যি চায়ের দোকানে
বসে হাসতে হাসতে চা খাই
সেলূনে চুল কাটার সময় পাশেই অবৈধ কতো কী ঘটে যায়
তুমি কাছে না থাকলে আমি দিন দিন অমানুষ হয়ে উঠি
আশেপাশে সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করি
মানুষ ও প্রকৃতির দিকে চেয়ে আমার হিংসা বোধ হয়
তুমি না থাকলে মেয়েদের রূপ কিংবা ফাহমিদা খাতুনের
রবীন্দ্রসঙ্গীত কিছুই আমাকে আকর্ষণ করে না
শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ জাগে না আমার
একে একে সকাল দুপুর সারাদিন নষ্ট হয়
কোনোকিছুই করতে পারিনে আমি
তুমি না থাকলে বড়ো দুঃসময় যায়, সর্বত্র বন্ধুবিহীনভাবে
বাস করি
এই ঢাকা শহর ভীষণ রুক্ষ মনে হয়
কাউকি ডাকলে সাড়া দেয় না, সবাই আমার বিরুদ্ধাচরণ করে
তুমি না থাকলে এই বাড়িঘর শহরের লোকজন
সম্পূর্ণ আমার অপরিচিত মনে হয়
নিজেকেই নিজের অচেনা লাগে
মনে হয় দীর্ঘ দিন থেকে আমি যেন কোনো অজ্ঞাত অসুখে ভুগছি
তুমি না থাকলে বাস্তবিক আমি বড়ো কষ্টে পড়ি
বড়োই কষ্ট হয়।
দুঃখ আছে কতো রকম
হায় আমাদের দুঃখ আছে কতো রকম
বুকের ক্ষত, মনের বারো গাঢ় জখম
মা যেমন দুঃখ করেন হলো না তার ঘটিবাটি সোনার বাসন
ন্যায্য আসন
ছেলেরা তার দিলো না কেউ
রইলো পড়ে বাইরে যেমন উড়োনচন্ডী
জোয়ারে ঢেউ ;
ঘর হলো না, নিজের কোনো ঠাঁই হলো না পায়ে দাঁড়াবার
হত বাড়াবার
বিপদ আপদ কতোই আছে
মা রাখলেন মনেই চেপে মনের দুঃখ
মনের কাছে,
আমি যেমন দুঃখ করি
দুঃখ করি
অনেক কিছু
ঠিক য়ে আমি চুটলি কখন কিসের পিছু
তাই জানি না
শীতের দিনে হাত বাড়িয়েও ঘরে একটু রোদ আনি না
কেন যে ঠিক দুঃখ করি তাই জানি না ;
এই তো আমি ইচ্ছে করলে খেতে পারি, ঘুমোতে পাই যখন তখন
অসুখ হলে কিনতে পারি অ্যাসপ্রো কিংবা চোখের জন্যে
দামী লোশন
বাসে চড়ে ঘুরতে পারি এখান থেকে অনেক খানি,
কিংবা যেমন কারো কারো প্রেমের জন্য প্যানপ্যানানি
প্রেম হলো না, হলো না ঠিক আলাপ কোনো মেয়ের সাথে
দিনেরাতে
বাদশাজাদীর তসবী নিয়ে নরম বিলাস
ও-সব ছাই নেই কিছুরই কোনো আভাস
আমার মধ্যে, তবু আমি দুঃখ করি
কিসের জন্যে দুঃখ করি তাই জানি না
গাই বিয়োবার আশায় ঘরে ধান ভানি না
সবাই আমরা দুঃখ করি একটা কিছুর দুঃখ করি
ঘটিবাটি, বসতবাড়ি, ফুলদানি বা সোনার বাসন
নিজের জন্য হলো না ঠিক যোগ্য আসন
হাত বাড়াবার শক্ত লাঠি
পরিপাটি সোনার জীবন
হলো না ঠিক যেমনটি চাই দুঃখ করি
সবাই আমরা একটা কিছু দুঃখ করি
কেন যে ঠিক দুঃখ করি তাই জানি না
কেবল বুঝি বুকের নিচে সুনীল জখম।
নিসর্গের খুন
এই প্রকৃতি একদিন আমাদের গ্রাস করবে
জিরাফের মতো গ্রীবা বড়িয়ে অকস্মাৎ,
কাঁঠালিচাপার বন, এই জ্যোৎস্নারাত
অমলিন নিসর্গের শোভা হানাদার দস্যুর মতো
ভয়ঙ্করভাবে ছুটে আসবে
আমাদের দিকে,অবরোধ করবে ঘরবাড়ি, শস্যের গোলা
খাদ্যভান্ডার লুট করে নিয়ে যাবে আমাদের মুখের গ্রাস
ভেঙে ফেলবে যাতায়াতযোগ্য স্থলপথ,
এই শান্ত চুপচাপ জলরাশি একদিন ধেয়ে আসবে আমাদের দিকে
নিশিডাকাতের মতো ডাক ছেড়ে হামলা করবে
চারদিক থেকে ঘিরে হত্যা করবে আমাদের ,
কেড়ে নেবে নগরকোটালের হাতের বাঁশি, বর্ম,
মাথার টুপি, শাদা পোশাক
সরল চাষার লণ্ডভণ্ড করবে খামার, শস্যক্ষেত
নিশিরাতে গোয়াল থেকে খেদিয়ে নেবে গরুর পাল
কালো খোঁয়াড়ে
বন্দী করবে একে একে,
লুটপাট করবে স্থানীয় মুদির দোকান, সারাগ্রাম
কাঠমিন্ত্রির সাজসরঞ্জাম তছনঝ করবে,
জলের স্বেচ্ছাচার ছিনিয়ে নেবে গৃহবাসী ভালোবাসা
গোঁয়ার ট্রাকচালকদের মতো নিসর্গ আমাদের
একদিন ফেলে দেবে গভীর খাদে
যেখানে ধসে পড়বে আমাদের এই দিনরাত্রি
শক্ত প্রাচীর, বড়ো বড়ো অট্টপালিকা
মহেঞ্জোদাড়োর মতো ধ্বংস হবে আমাদের নগরসভ্যতা
শাদা হাসপাতাল, পৌরসভা,
পার্ক ও খেলার মাঠ
বাঁধ ও সেতু ভেঙে আমাদের ভসিয়ে নেবে দুর্ধর্ষ প্লাবন,
আকাশ আমাদের বিরুদ্ধে একদিন ষড়যন্ত্র করবে
এই কাঁঠালিচাঁপার বন, জ্যোৎস্নারাত, পাখিডাকা নিসর্গ
সমুদ্রের বেলাভূমি সবাই,
এই আক্রমণকারী প্রকৃতির হাতে
একে একে ধ্বংস হবো আমরা
শিশু, বৃদ্ধ, যুবা
নিসর্গের প্লানে ভাসবো অন্তহীন লাশ!
ফিরে দাও রাজবংশ
দূতাবাসে উড়ছে পতাকা
অর্থাৎ স্বাধীন আমরা এ-কথা মানতেই
হয়, রাষ্ট্রীয় সনদ আছে দেশে
দেশে আমরা স্বাধীন;
তবু মনে হয় এ যুগে কোথাও কোনো স্বাধীনতা
নেই, বরং এ যুগে মানুষ যেন
পোষমানা দুর্বল মহিষ, নিজের যৌবন
আজ তার কাছে সবচেয়ে বড়ো অপরাধ, নিজের
বিরেক আজ তার সবচেয়ে
বিদগ্ধ কসাই;
যেখানেই বলো না কেন আমাদের
আজ কোনো স্বাধীনতা নেই,
না কথা বলার, না হাসার, কাঁদার
সবখানে সব দেশে মানুষ আজ স্বাধীনতাহীন
ভীষণ নির্জীব, বিষণ্ন বস্তিতে কিংবা বুর্জোয়া বিলেতে
এখনো প্রত্যহ দেখি গ্রেফতারী
পরোয়ানা হাতে ফেরে নগরপুলিশ;
মানুষ কি পারে তার যৌবনকে ভালোবেসে
বাগানে বেড়াতে
মানুষ কি পারে তার নিজের মনের
শব্দ টেলিগ্রামে ভরে ভরে দূরত্বে পাঠাতে?
মানুষ কি পারে তার নিজের আকৃতি
খুলে স্বচক্ষে দেখতে কখনো?
মানুষ কি আঁকতে পারে নিজের আদলে কোনো
জ্যান্ত বাঘের মুখ? এ যুগে
মানুষ বুঝি বড়ো বেশি কিছুই পারে না
কেবল আইনের হাত ধরে কিছুটা রাস্তা হাঁটা ছাড়া
এ যুগে মানুষ বুঝি
কিছুই পারে না;
অথচ এখথন কোনো রাজা নেই, রাজ্য নেই
কেবল আছে রাজ্যশাসন
আমরা এখন কারো প্রজা নই
প্রজাস্বত্ব সর্বত্র প্রবল
তাই কি আমরা এই প্রজাতন্ত্রে এমন বন্দী স্বাধীন?
তাহলে কি আমরা সবাই আজ বাস
করি পাথরের ঘরে
মানুষ কি কোনোদিনই পারবে না
জন্ম দিতে নিজের যৌবন?
নিজের বুকের মধ্যে পারবে না পুষতে
সে বিশ্বাসের বিশুদ্ধ মৌচাক?
তার চেয়ে আমাদের ফিরে দাও রাজবংশ, রাজকীয়
অলীক বিশ্বাস
রাজকুমার তোমার রক্তে জন্ম নিক
জান্তব যৌবন, যুদ্ধ করে মরি।
ফ্লাড
সীতা, তুমি এখন কলকাতায় বসে বসে
আমাদের বন্যার খবর পড়ছো
প্রতিদিন খবরের কগজের পাতায় দেখছো সেইসব
প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতায় দেখছো সেইসব
বন্যাদুর্গত মানুষের দুঃস্থ ফটোগ্রাফ
বন্যায় যাদের ঘরদোর ভেসে যাচ্ছে
প্রকৃতি যাদের সাথে করছে ভীষণ শত্রুতা
জলদস্যুদের মতো বন্যা এসে যাদের ঘরে অকস্মাৎ হানা দিচ্ছে
লুটে নিচ্ছে ঘরের আসবাব, ভাঙা বেঞ্চ, পৈতৃক পিঁড়ি,
পুরনো আমলের খাতাপত্র,
বন্যায় ভেসে যাচ্ছে বড়ো বড়ো কাঠের গুঁড়ি,
চালাঘর, ভেড়ে পড়ছে ভীষণ জলের তোড়ে কড়িবর্গা,
ভেসে যাচ্ছে শিশুর খেলনা হাতি, বুড়োদের সারাদিন
বসে থাকার হাতলভাঙা মলিন চেয়ার।
বন্যায় ধসে পড়ছে গ্রামের পোস্টাপিস, স্কুলঘর,
মানুষের সাজানো সংসার
এই ভয়ঙ্কর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে বাংলার ভবিষ্যৎ
নিঃস্ব বাংলা আজ কোথায় দাঁড়াবে তার কিছুই জানে না,
এমন সময় হয়তো একদল সমাজকর্মী এসে
তাদের লাল সালুতে লেখা কোনো এক ত্রাণশিবিরে নিয়ে যাবে
দুর্গত বাংলা আজ আশ্রয়শিবিরে করবে
সারারাত অজ্ঞাতবাস;
গতকাল আমরা যখন পল্টন থেকে ফিরছিলাম
কয়েকজন তরুণ আমাদের দিকে এগেয়ে এসে
তাদের চাঁদা তোলার কাপড়খানা মেলে ধরেছিলো
আমার সঙ্গী ওদের হতে দিয়েছিলো একটি আধুলি
আমার পকেটে কোনো পয়সা ছিলো না
আমি তইি ওদের দলে মিশে গিয়েছিলাম।
সীতা, সেবার তুমি ছিলে পূর্ববাংলার এক মফস্বল শহরে
সে-বছর ভীষণ বন্যার খবর দিয়ে তার পাঠিয়েছিলো ইদ্রিস
বন্যায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে অসংখ্য পরিবার
তোমার বোধহয় মনে আছে সীতা,
দুর্গাদা তখণ সদ্য জেল থেকে বেরিয়েছে
আমরা শহরে কতো বড়ো ভিক্ষা মিছিল বের করেছিলাম
তোমার হতে ছিলো সেই লাল ব্যানারেরা একটা অংশ
সে-মিছিল ছিলো
এই বন্যার বিসতৃতির চেয়ে অনেক বড়ো
বন্যা সেদিন আমাদের সীমানা বাড়িয়ে দিয়েছিলো।
সীতা, আজো তো তোমাদের বিহারে বন্যা
তুমি কি সেদিনের মতোই আজো মিছিলে নেমেছো
কলকাতার রাস্তায়
তাই ঢাকাতেও বেরিয়েছে এতো বড়ো মিছিল;
সীতা, এই ভয়ঙ্কর বন্যায় আমাদের সব
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে,
উল্টে গেরেছ টেলিগ্রাফের তারসুদ্ধ খুঁটি
রেললাইন, মালভর্তি ওয়াগন পড়ে আছে স্টেশনে
তবু আমার মনে হয় এই বন্যা বড়িয়ে দিয়েছে
আমাদের সীমানা
স্তলভাগের চেয়ে জলের দূরত্ব বোধ হয় অনেক কম
জলের ওপর দিয়ে মানুষের কন্ঠ অনেক দূর যায়
কিংবা দুর্যোগে দুর্বিপাকে মানুষে মানুষে কোনো ব্যবধান
থাকে না
খুলে পড়ে টুকরো টুকরো মানুষের অন্তর্গত
অসংখ্য লেবাস
তাই আমি যখন ঢকার রাজপথে
বন্যাত্রাণ মিছিলের পাশাপাশি
তুমি তখন কলকাতার রাস্তায়।
বন্ধুর জন্য বিজ্ঞাপন
আমি একটি বন্ধু খুঁজছিলাম যে আমার
পিতৃশোক ভাগ করে নেবে, নেবে
আমার ফুসফূস থেকে দুষিত বাতাস ;
বেড়ে গেলে শহরময় শীতের প্রকোপ
তার মুখ মনে হবে সবুজ চয়ের প্যাকেট, এখানে
ওখানে দেখা দিলে সংক্রামক রোগ,
ক্ষয়কাশ উইয়ে-খাওয়া কারেন্সি নোটের মতো আমার ফুসফুসটিকে
তীক্ষ্ণ দাঁতে ছিদ্র করে দিলে, সন্দেহজনকভাবে পুলিশ ঘুরলে
পিছে, ডবল ডেকার থেকে সে আমাকে
ফেলে দেবে কোমল ব্যান্ডেজ, সে আমাকে ফেলে দেবে
ট্রান্সপেরেন্ট পাদুর রুমাল, আমি যাবো পাথি হয়ে পুলিশ-স্কোয়াড
থেকে
জেনেভায় নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে, বলবো-
আমি প্রেমিকার পলাতক গুপ্তচর ;
সে এসে অন্ধকারে চতুর চেরের মতো
আমার পকেট থেকে নেবে সব স্তলপদ্মগুলি
বলবে কনের কাছে চুপিচুপি অসম্ভব বদমাশ সে,
-চল্ ঘুরে আসি রাতের শো থেকে
তারপর নিয়ে যাবে ক্রমাগত ভুল ঠিকানায়
তবু সেই ভীষণ বদমাশটা আমার সমস্ত ভুল ভাগ করে নেবে,
ওর সমস্ত পাপ লিখে যাবে আমার ডায়েরিতে
আমার পাপ হাতে নিয়ে ধর্মযাজকের মতো অহঙ্কারে ঢুকবে গির্জায়
আমি এই ঢাকা শহরের সর্বত্র, প্রেসক্লাবে, রেস্তরাঁয়, ঘোড়দৌড়ের
মাঠে এমন একজন বন্ধু খঁজে বেড়াই যাকে আমি
মৃত্যৃর প্রাক্কালে উইল করে যাবো এইসব অবৈধ সম্পত্তি, কুৎসা
আমার লাম্পট্য, পরিবর্তে সে আমার চিরদিন যোযাবে ঘুমের ওষুধ
আমার অপরাধের ছুরি রেখে দেবে তার বুকের তলায়, আমার
পিতার কাছে
চিঠি দেবে এই বলে-ওর কথা ভাববেন না, ও বড়ো ভালো ছেলে
নিয়মিত অফিস করে দশ টা পাঁচটা ; অথচ সে জানবে আমার
সব বদঅভ্যাস, স্বভাবের যাবতীয় দোষ
তবু সে যাবে আমার সাথে ক্যামেরায় ফিল্ম ভর্তি করে
নিয়ে আত্মহত্যাকারী এক যুবকের ছবি তুলে নিতে, অবশেষে
মফস্বল শহরগামী কোনো এক ট্রেন চড়ে নেমে যাবে
আমার সাথে ভুল ইস্টিশনে;
এখনে ওখানে সর্বত্র আমি একটি বন্ধু খুঁজছিলাম
যে আমাকে নিয়ে যাবে সুন্দরবনে হরিণ শিকারে, হরণের শিং থেকে
তার স্বচ্ছ খুর থেকে খুঁটে নেবে দামী অংশগুলি যেন ও গাভীর
খুর থেকে বানাবে বোতাম, সে
আমাকে প্রতিদিন ধার দেবে লোভ, এখনে
সেখানে শহরের পরিচিত অঞ্চলগুলিতে আমি সেই করল সাঙাতটিকে
খুঁজি, আমি শুধু সারাজীবন একটি বন্ধুর জন্য প্রত্যহ বিজ্ঞাপন দিই
কিন্তু হায়, আমার ব্লাডগ্রুপের সাথে
কারো রক্ত মেলে না কখনো।
বৈশাখে নিজস্ব সংবাদ
মা আমাকে বলেছিলো- যেখানেই থাকিস তুই
বাড়ি আসবি পয়লা বোশেখে। পয়লা বোশেখ বড়ো ভালো দিন
এ দিন ঘরের ছেলে বাইরে থাকতে নেই কভু, বছরের এই একটি দিনে
আমি সিদ্ধিদাতা গণেশের পায়ে দিই
ফুলজল, কে বলবে কী করে কার বছর কাটবে,
বন্যা, ঝড় কিংবা অগ্নিকান্ড কতো কি ঘটতে পারে, তোর তো কথাই নেই
মাসে মাসে সর্দিজ্বর, বুকব্যাথা লেগেই আছে, বত্রিশ বছর বয়েস
নাগাদ এইসব চলবে তোর, জানিস খোকা, রাশিচক্র তোর ভীষণ খারপ,
যেখানেই থাকিস তুই বাড়ি আসবি পয়লা বোশেখে। সেদিন সকালে
উঠবি ঘুম থেকে, সময়মতো খাবি দাবি, ভালোয় ভালোয় কাটাবি দিনটা
যেন এমনি মঙ্গলমতো সারাটা বছর কাটে, তোকে না ছোঁয় কোনো
ঝড়ি-ঝাপটা, বিপদ-আপদ
আমি নিজ হাতে একশো-একটি বাতি জ্বলিয়ে পোড়াবো তোর
সমস্ত বালাই ।
মা তোমার এসব কথাই মনে আছে, এমনকি মনে আছে
বছরের শেষে ছুটিছাটায় বাড়ি গেলে পয়লা বোশেখ না কাটিয়ে তুমি
কিছুতেই আসতে দিতে না, বাড়ি থেকে বেরুবার সময়
আমার বুকের মধ্যে পুরে দিতে ভালো থাক তুই শুধু এইটুকু
বিশেষ সংবাদ, আমার
গন্তব্যে তুমি ছড়িয়ে দিতে দুর্ঘটনা, রোগ, শত্রুর উৎপাত থেকে
নিরাপত্তা, হায় এই
সংসার যদি মায়ের বুকের মতো স্বাস্ত্যবান হতো,
তখন আমার বৈশাখগুলি
প্রাকৃতিক দুর্যেগে কাটতো না এমন বিষণ্ন ;
এখন আমার বৈশাখ কাটে ধূলিঝড়ে জানালা দরোজা সব
বন্ধ ঘরে অন্ধকার শবাধারে শুয়ে, মাথার সমস্ত চু্ল
কেটে নেয় ভয়ের বিশাল কাঁচি, সকালে খুলিতে বুলায় হাত মেসের
গাড়ল বাবুর্চি এসে
দেয়ালে তাকিয়ে দেখি এমনি করে বছর বছর ক্যালেন্ডরে পাল্টে যায়
আমার বয়স, গোঁফদাড়ি পুষ্ট হয়, কিছু কিছু পরিচয় ঘটে
তথ্যকেন্দ্রে বসে জেনে নিই দুচারটে নতুন খবর, আবার ঘসে মেজে
উজ্জ্বল করি আমার নেমপ্লেট;
শোনো মা, তোমার সমস্ত কথা মনে আছে, বৈশাখে দোকানে হালখাতা
মহরৎ হতো, বাড়ির উঠোন ভরে খেতে দিতে কলাপাতায় ঘরের
মিষ্টান্ন, আমার জন্যে বানিয়ে রাখতে স্বসি-ক, মা তোমার হাতের দেয়া
স্বসি-ক আমি এমন লোভী দেখো নিঃশেষে খেয়ে বসে আছি, আমার মনের
সসি- আমি আজ খেয়ে বসে আছি;
এখন আমার বছর কাটে বিদেশ বিভুঁয়ে
নানাস্থানে, বেশির ভাগ হোটেলের ভাড়াটে কামরায়, স্টেশনের
ওয়েটিং রুমে, বছরে দুএকবার হাসপাতালে, কখনো কখনো পুলিশ-
ফাঁড়িতেও যাই
ইতস্ত ভবঘুরের মতো ঘুরি, ইদানীং সংবাদ সংগ্রহে
বড়ো বেশি ব্যস্ত থাকি, কেবল আমার সংবাদ আজ আমার
কাছে নিতান্ত অজ্ঞাত;
আমার বছর কাটে ধার-ঋণে, প্রত্যহ কিনি একেকটি দেশলাইর বাক্স
আমিই বুঝি না কেন আজকাল এতা বেশি দেশলাই কিনি আমি
হামেশাই বৈদ্যুতিক গোলযোগে জ্বালাতে হয় নিজের বারুদ
আমার এখন বুঝি ভালো লাগে প্রতিদিন নিজের করতলের গাঢ় অন্ধকারে
জ্বালাতে আগুন, কেননা এখন আমাকে বড়ো বেশি কষ্ট দেয় আমার
নিজের আঙুলগুলি, আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ভীষণ আঁধার;
এখন প্রায়শই মতবিরোধ, ঝগড়াঝাঁটি
করে কাটে আমার সময়, কোনো কিচুতেই দুঃখও পাইনে বড়ো, বুকের
ব্যথাটাও বোধ হয় না আজকাল আর, আমার বুকের ওপর দিয়ে প্রমাগত
তুষারঝড় হয়ে গেছে, বুঝি ভূমিকম্পে মরে গেছে
বুকের সমস্ত শহরতলী;
মা তুমি বলেছিলে পয়লা বোশেখে
বাড়ি আসবি তুই, আমার মনে আছে- আমারও
ইচ্ছে করে পয়লা বোশেখ কাটাই বাড়িতে প্রতি বছর মনে
করে রাখি সমনের বছর পয়লা বোশেখটা বাড়িতেই কাটিয়ে
আসবো, খুব সকলে উঠে দেখবো পয়লা বোশেখের সূর্যোদয়
দেখতে কেমন, কিন্তু মা সারাটা বছর কাটে, ক্যালেন্ডার পাল্টে যায়, আমার
জীবনে আর আসে না যে পয়লা বোশেখ।
মানবিক বৃক্ষ
তোমার মতন কোনো গাছ নেই স্বয়ংসম্পূর্ণ
এই উদার বৃক্ষমূলে নতজানু নবীন তাপস
ক্ষমায় স্নেহে ও প্রেমে কখনো হিংসায়
তুমি বাঁধো বিপুল মজ্জায় তাকে
রক্তে রক্তে তুমি তার লাল তরু, কিংশুক-অশোক
তোমার ছায়ায়, করতলে আভূমি আকাশ নত,
নীল গঢ় নিসর্গসম্ভার
তোমার মতন কোনো পরিপূর্ণ গাছ নেই,
কখনো গভীর রাতে দুঃস্বপ্নে সন্ত্রস্ত যুবা
খোঁজে যে-স্নিগ্ধ গাছ
মনে হয় যদি পাই ডালে ডালে জ্যোৎ্লারাত আলোকিত
ক্রিসমাস বৃক্ষের বিক্রম
কিংবা ফেরারী মানুষ অকস্মাৎ ঘরে ফিরে যার নিচে দাঁড়ায়
স্বস্তিতে
রাস্তায়, পার্কে, গহন অরণ্যে তেমন গাছ কোথায়?
বনজ বৃক্ষরাজি বড়ো ম্লান, একা, নির্জন
ভয়াবহভাবে নীরব, নিরপরাধ, সহানুভূতিহীন
সে শুধু দাঁড়িয়ে আছে যেন হৃতরাজ্য দণ্ডিত সুলতন,
অধোবধনে দেখছে সব, তার করণীয় কিছু নেই,
এই অক্ষম গাছের নিচে আমাদের এতোচটুকু বয়স কমে না
দুঃখে-সন্তাপে হৃদয়ে হৃদয়ে ওঠে বিস্তীর্ণ মৈনাক
কাঁদি, চিৎকারে বলি
অধঃপতিত যুবার এই শাসি-ভোগের আগে
তুমি তাকে উদ্ধার করো, গাছ
তোমার জন্মগত অদৃশ্য পোশাক খুলে ফেলো গাছ,
দাঁড়াও সম্মুখে
উজ্জ্বল নীল বাহু মেলে আলোড়নে আজন্ম জড়াও
গাছ তবু চিবরদিন নিঃশব্দ ও অমানবিক।
তোমার মতন কোনো গাছ নেই,
সীতা, তুমি গাছ, জীবনের পরিপূর্ণ তরু
অরণ্যে, প্রকৃতিতে দাঁড়ালেই বুঝি
সীতা, তোমার মতন কোনো গাছ নেই
এমন সম্পূর্ণ, মানবিক।
রবীন্দ্রোত্তর আমারা কজন যুবা
শুনুন রবীন্দ্রনাথ এ যুগে ভীষণ দায় বাঁচা, বড়ো অসহায়
আমারা কজন যাবা আপনার শান্তিনিকেতনে প্রত্যহ প্রার্থনা
করি হে ঈশ্বর, আমাদের
শান্তি দাও, প্রত্যহ প্রার্থনা করি মঠে ও গির্জায়
আমাদের শান্তি দাও, দাও মহান ঈশ্বর, তবু
সর্বত্র আজ অনাবৃষ্টি, রৌদ্রে
পোড়ে মাঠ, বোমায় শহর পোড়ে, লোকালয় উচ্ছন্নে যায়
মারী ও মড়কে কাঁপে দেশ, শুনুন রবীন্দ্রনাথ এ যুগে আমরা বড়ো
অসহায় কজন যুবকও বিশেষত আমরা কজন যুবা
ব্যক্তিযত নিখোঁজ সংবাদ যারা ঢেকে রাখি সর্বক্ষণ আস্তিনের
পুরু ভাঁজে, বড়োই রুগ্ন আমরা
এ যুগে নিঃশ্বাস নেবো প্রকৃতিতে বৃষ্টিতে বা উদার অনণ্যে দাঁড়াবো
এমন জো নেই কোনো,
আমাদের সন্নিকটে বনভূমি নেই।
এখণ ভীষণ রুগ্ন আমরা, সারা গায়ে কালোশিরা, চোখ ভর্তি
নিঃশেব্দ আঁধার, যেখনে যাই আমরা কজন যুবা
যেন বড়ো বেশি ম্লাম ফ্যাকাশে বৃদ্ধ, চোখমুখে
স্পষ্ট হয়ে লেগে থাকে যাবতীয় অনাচার, নিজের কাছেও
আজ নিজেদের লুকাবার রাস্তা খোলা নেই, এ যুগে আমরা
কড়ো অসহায় কজন যুবক ; শুনান রবীন্দ্রনাথ তবু আমরা
কজন যুবা আজো ভালোবাসি গান, তবু
আমরা কজন যুবক
বড়ো ভালোবাসি মাধবীকে, ভালোবাসি মাধবীর বাংলাদেশ
তার নিজস্ব বর্ণমালা রবীন্দ্রসঙ্গীত।
শুনুন রবীন্দ্রনাথ আমরা কজন যুবা, বড়ো বেশি অসহায় কজন
যুবা, তখন তাকিয়ে দেখি সূর্যাস্ত অস্তিত্বে রৌদ্র
ওঠে, পাখি নাচে, আমরা কজন এই ভয়ানক রুগ্ন যুবা পুনরায়
মাঠে যাই আমরা নিঃশ্বাস নিই সঙ্গীতের উদার নিসর্গে, আমরা
যেন ধীরে ধীরে বেঁচে উঠি
তখন মনে হয় এমনি করেই বুঝি এদেশে
বিপ্লব আসে, একুশে ফেব্রুয়ারি আসে, নববর্ষ আসে;
আমরা কতিপয় যুবা
তাই আর সব পরিচয় যখন ভুলে যাই এমনকি ভুলে
যাই নিজেদের নাম, তখনো মনে রাখি
রবীন্দ্রনাথ আমাদের আবহমান বাংলাদেশ
আমাদের প্রদীপ্ত বিপ্লব,
রবীন্দ্রনাথ আমাদের চিরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি।
শহরে, এই বৃষ্টিতে
ঢাকার আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন, মাধবী এখন তুমি বাইরে যেও না
এই করুণ বৃষ্টিতে তুমি ভিজে গেলে বড়ো ম্লান হয়ে যাবে তোমার শরীর
এই বৃষ্টিতে ঝরে যদি কারো হিমে তোমার কোমল দেহের আদল
মাধবী বৃষ্টিতে তুমি বাইরে গেও না। মাধবী তুষারপাতে
বাইরে যেও না।
এ শহরে বৃষ্টি এলে আমি ভেসে যাই কান্নার করুণ ভেলায়
হাতে নিয়ে তোমার একদা দেয়া উপহারের গোপন অ্যালবাম
এই তুষর বৃষ্টিতে যদি সব ছবি মুছে গিয়ে লেগে থাকে জলের গভীর চিহ্ন
শুধু জল, আমার কান্নার মতো করুণ কোমল সেই জল,
সেই তুষারের দাগ
আমি যদি ভেসে যাই এমনি অথই তুষারজলে তুমি তবু নিরাপদে থাবো
সেই হৃদয়ের হৃতরাজ্যে কোনোদিন আর ফিরে যাবো না, যাবো না
সেখানে প্রত্যহ এক আততায়ী যুবকের বহুবিধ কঠিন শসন ;
শহরে বৃষ্টি এলে গলে গলে পড়ে সব ময়লা কফ বিভিন্ন অসুখ
শোকের তুষার জলে বড়ো ভয়, মাধবী তুমি তাই বাইরে এসো না
সেই ভালো আমার জীবনে তুমি সুবিখ্যাত কিংবদন্তী হয়ে থাকো আজ।
সবাই মেলায় যায়
দুপুর গড়িয়ে গেলো আমাদের মেলা দেখতে যাওয়া
হলো না তো, দুপুর গড়িয়ে গেলে মেলার শৌখিন সব
খেলনা ফুরিয়ে গায়, একে একে ফুরিয়ে যায় মেলার জৌলুস
ধনীর দুলাল এসে ফি বছর আগেভাগে আমাদের
মেলা থেকে নিয়ে যায় মজার খেলনাগুলো, নিয়ে যায় দামী সব
কাঠের আসবাব, সারা মেলা থেকে তন্নতন্ন করে
খুঁজে নিয়ে যায় মেলার যা কিছু রম্য দর্শনীয় শৌখিন দ্রব্যাদি
অথচ আমরা মেলায় যাই দুপুর গড়িয়ে গেলে
শেষবেলা করে, যা কিছু না কিনলে নয় নেহাৎ সেটুকু
কেনাকাটা করে ঘরে ফিরি, কিন্তু আমার বড়োই ইচ্ছে
মেলা থেকে ঘর সাজাবার কিছু ছবি কিনে নেবো;
প্রতি বঠর আমাদের বাড়ির লাগানো মাঠে মেলা বসে
দিব্যি সবাই সময়মতো মেলায় যায়
ছেলেমেয়েদের হতে দেয় এটাসেটা লজেন্স বা মেলার মিঠাই
বউঝির জন্যে নিয়ে আসে ডুড়ে শাড়ি, পছন্দমতো
নানান মাপের চুড়ি, মেলার আনন্দ তারা লুটে ঘরে নিয়ে
আসে, মেলা থেকে ফিরে এসে ঘরে তারা মেলাই
বসায়, আমাদের এই বাড়ির লাগোয়া মেলা বসে
তবু মেলায় পা বাড়ালে দেখি দুপুর গড়িয়ে গেছে
সেই তো কখন ;
আমরা মেলায় গাবো কথা ছিলো ঘুরে ঘুরে
দেখবো মেলায় কোথায় বসেছে সারি সারি
ছবির দোকান, কোথায় নাগরদোলায় ঘুরছে
ঘর সাজাবার কিছু ছবি কিনে নেবো, এই মেলা
থেকে আমি নিয়ে আসবো ঘরে কিছু
আনন্দ-সম্ভার;
অথচ মেলায় গেলে
দেখি মেলা থেকে ঘরে ফিরছে লোকজন, কারো
হাতে প্রসাধনী, কারো ফুলতোলা মাটির কলস হাতে,
নানান পণ্য নিয়ে দেখি ঘরমুখো মেলা-ফিরতি লোক, মেলায়
মানুষ নেই, দেকানপাট একে একে উঠে
গেছে, সারা মেলা ভর খাঁখাঁ শূন্যতা চাদ্দিকে
ভাঙএচারা, ছেঁড়া মোড়কের অংশ, খোসা,
এই শূন্য মেলা থেকে আমি কী করে
কিনবো বলো ঘর সাজাবার ছবি, আনন্দের
কিছুটা আশ্বাস, কথা ছিলো মেলায় যাবো
সময়মতো ডাকবে আমায়, দুপুর গড়িয়ে গেলো,
বিকেল গড়িয়ে গেলো, আমাদের
মেলা দেখতে যাওয়া হলো না তো, আমরা মেলায় যাবো
আমাদের কোনোদিন হলো না সময়।