এই কবিতার জন্যে
এই কবিতার জন্যে কতোবার বদ্ধ উন্মাদের মতো ঘুরলাম
রাস্তায় রাস্তায়
কতোবার আগুনে দিলাম হাত, প্রবল তুষারপাত নিলাম মাথায়;
এই কবিতার জন্যে পঞ্চপাণ্ডবের মতো আবদ্ধ হলাম জতুগৃহে
শুধু এই কবিতাকে ভালোবেসে কতোবার দাঁড়ালাম
পরমানু বোমার বিরুদ্ধে
কতোবার একা বুক পেতে দাঁড়ালাম আণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের সম্মুখে,
কবিতাকে ভালোবেসে এই পৃথিবীকে কতোবার বাঁচালাম
যুদ্ধ ও ধ্বংসের হাত থেকে।
কবিতার প্রতি এই তীব্র ভালোবাসা ছাড়া
এমন বিরূপ আবহাওয়া ও জলবায়ুতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
কখনো সম্ভব নয় বাঁচা;
এই কবিতার জন্রে কতোবার দাঁড়ালাম বিপদের মুখোমুখি
ট্রাফিক সঙ্কেত ভুলে পথের ওপরে,
কতোবার প্রমত্ত ঝঞ্ঝার মুখে, স্রোতের আবর্তে
এই কবিতার জন্যে খোয়ালাম পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি
যা কিচু সম্বল কানাকড়ি।
এই কবিতার জন্রে আমিও রিলকের মতো গোলাপের দংশনেই
হলাম আহত
আমও বুদ্ধের মতো জরামৃত্যুব্যাধি দেখে হলাম ব্যাকুল;
কতোবার এই কবিতার জন্যে সেই কৈশোর থেকেই
তছনছ করেছি জীবন
এই কবিতার জন্যে আমি আপাদমস্তক ছিন্নভিন্ন এমন ফতুর
ভাঙা শিরদাঁড়া, পোড়-খাওয়া একটি মানুষ
এই কবিতার জন্যে যীশুর মতোই আমি ক্রুশবিদ্ধ।
এই কবিতার জন্যেখনো শিশুর মতো কাঁদি, দুঃখ পাই
এখনো আগের মতোই ঠিক কবিতার জন্যে হই
গভীর ব্যথিত, মণঃক্ষুণ্ন কিংবা উত্তেজিত;
এই কবিতার জন্যে এখনো দাঁড়াই এসে অনায়াসে
সকল ঝুঁকির মুখে আমি
এই কবিতার জন্যে জীবনকে এখনো আমি
এতো ভালোবাসি, এতো ঘৃণা করি।
কবি ও কৃষ্ণচুড়া
চৈত্রে হয়তো ফোটেনি কৃষ্ণচুড়া
তাতে ক্ষতি নেই; তোমার ঠোঁটেই দেখি
এসেছে আবার কৃষ্ণচুড়ার ঋতু
তুমি আছে তাই অভাব বুঝিনি তার;
না হলে চৈত্রে কোথায়ইবা পাবো বলো
কৃষ্ণচুড়ার অযাচিত উপহার,
বর্ষায় সেই ফুটবে কদম ফুল
তোমার খোঁপায় চৈত্রেই আনাগোনা।
তাই সন্দেহে চোখ মেলে কেউ কেউ
তাকায় কোথায় ফুটেছে কৃষ্ণচুড়া,
কেউ খোঁজে এই নিরিবিলি ফুলদানি;
চৈত্রে কোথাও ফোটেনি কৃষ্ণচুড়া
কিন্তু ফুটেছে তোমার দুইটি ঠোঁটে,
কবির দুচোখ এড়াতে পারেনি, তাই
ধরা পড়ে গেছে কবিতার পঙ্খক্তিতে।
কোনো ফুলের বাগান নেই
আমাদের কোনো ফুলের বাগান নেই, তবু
পৃথিবীর এই দুঃসময়ে নীলা তার টবটিতে
ফুটিয়েছে রজনীগন্ধার কটি কলি,
বারান্দার সঙ্কীর্ণ আলোক আর অপ্রচুর বাতাস সত্ত্বেও
কেমন ফুটেছে তার হাসি, সজীব ডালটি যেন
মনেহয় স্বচ্ছেন্দে উঠেছে বেড়ে হৃদয়ের উর্বর মাটিতে;
দুবেলা আমাকে সে দেখায় তার রজনীগন্ধার এই চারা,
বলে-আলো ও বাতাসহীন প্রতিকূল পরিবেশেও দেখো
কেমন ফুটেছে এই প্রকৃতির ফুল!
প্রত্যুত্তরে আমি আজো বলিনি কিছুই শুধু নীরবে তাকিয়ে
থাকা ছাড়া;
তাই আমার মুখের দিকে চেয়ে রজনীগন্ধার ভীরু ডালটির মতো
সেও যেন হয়ে পড়ে খুবই সঙ্কুচিত,
কেননা নীলা তো জানে আমার ফুলের প্রতি চিরকালই
সীমাহীন দুর্বলতা আছে
তবু রজনীগন্ধার দিকে চেয়ে আমার মুখে একটিও কেন প্রশংসা
ফুটলো না?
কী করে বোঝাই আমি অন্তহীন নীরবতা ছাড়া এর যোগ্য কী
প্রশংসা হতে পারে,
কী করে বোঝাই তাকে এই ফুল ফোটানো সাফল্য কতোটা!
যখন সে বারান্দায় তার মাটির টবটি জুড়ে ফুটিয়েছে এই হার্দ্য,
অনবদ্য ফুল
তখন পৃথিবী জুড়ে তৈরি হচ্ছে মানুষ বিধ্বংসী বোমা,
ক্ষেপনাস্ত্র, ভয়াল বারুদ
এই রজনীগন্ধার পাশাপাশি একই সাথে পৃথিবীতে
অঙ্কুরিত হচ্ছে মারণাস্ত্রের ভীষণ নখর,
রজনীগন্ধার চেয়ে আরো দ্রুত চোখের নিমিষে ছেয়ে যাচ্ছে
পৃথিবীর অস্ত্রশালা দাঁত, নখ ও হিংস্র থাবায়
সেজন্যই এমন ফুলের দিকে চেয়ে একটিও প্রশংসার বাক্য
স্ফোটে না,
শুধু মনে হয় সমস্ত পৃথিবীময় মানুষের হৃদয়ে যদি জন্ম নিতো
রজনীগন্ধার এই কলি!
তাই নীলাকে বলিনি
পৃথিবীর এই দুঃসময়ে আজ এরূপ একটি ফুল
ফোটানো যে কতোটা কঠিন
আর তার সার্থকতা বিজ্ঞান ও মেধার কৃতিত্বের
চেয়েও মহৎ!
গোলাপ, তোমার মর্ম
গোলাপ বিষয়ে কোনো সূক্ষ্ম অনুভূতি
প্রেমিকের মতো কোনো গভীর মুগ্ধতা-
আমার তেমন কিছু নেই;
গোলাপের কাছে আমি পর্যটক, বিদেশী পথিক
বড়ো জোর এমন সম্পর্ক হে বন্ধু বিদুয়, দেখা হবে।
আমি তাই গোলপকে গোলাপ বলি না
বলি মহিমার ফুল, বলি মৃত্যু, বলি মর্মান্তিক।
সম্পূর্ণ নির্দোষ নগ্ন, আঙুলে কাঁটার কালো ক্ষত
কালো বিষ, কালো অন্ধ প্যারিসের পতের ভিক্ষুক, পাপী
ঘোর গৃহত্যাগী। গোলাপ সম্পকে ঠিক নদীর মতন সম্পূর্ণ
ধারণা কিছু নেই
গোলাপ বিষয়ৈ জ্ঞান বড়ো অসম্পূর্ণ,
গোলাপ, তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি না।
হয়তো নদী সম্পর্কে আমার এক ধরনের দুর্বলতা আছে
কোথাও কোনোভাবে নদীর কাছে বাঁধা পড়েছি,
তাই বলে গোলপবিরোধী আমি নই
এখনো বহু রাত আমি গোলাপের স্বপ্নে ঘুমাতে পারি না
দৃঢ়বন্ধে জপটে ধরি গোলাপ, গোলাপ ভেবে ঘুম ও মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা
গোলাপ বস্তুত এই ঘুমের মঘ্যে স্বপ্ন;
জেগে উঠেই গোলাপ দেখি রক্তমাখা, গোলাপ দেখি কলুষকালো
গোলাপ দেখি গভীর গোপন অসুস্থতায় অবসন্ন, মর্মে ভীষণ বিষের ফণা।
সেই একবার বাল্যে আমি গোলপ ছুঁয়ে সংজ্ঞা হারিয়েছিলাম
আরো একবার কৈশোরে গোলাপ দেখে আতঙ্কিত,
তারপর পর্যটনে নেমে একে একে গোলাপ বিষয়ৈ
এই অভিজ্ঞতা।
এখন গোলাপ বিষয়ে আমার তেমন কোনো সূক্ষ্ম অনুভূতি নেই
গোলাপ বিষয়ে আমার জ্ঞান বড়ো অস্বচ্ছ, বড়ো অগভীর
তাকে যতোটা জানি সে মাত্রই একজন পর্যটকের মতো
কিংবা একজন কৃষকের মতো।
এক সময় গোলাপের মধ্যে আমি নদীর কুলুকুলু কান্না শুনেছিলাম
মানুষের বিশুদ্ধ আত্মপ্রকাশের শিল্প দেখেছিলাম
গোলাপের সৌন্দর্যে।
সেই মুগ্ধতা এখন আমার নেই, সত্যি বলছি গোলাপ বিষয়ে
এখন আমি সাধারণ একজন কৃষক মাত্র;
ঠিক গোলাপ নয় আমি অরণ্য-উদ্ভিদ খুঁজতে এসেছি
হয়তো পাথর তুলতে এসেছি
তবু আমি গোলাপকে গোলাপ বলি না
বলি স্বপ্ন, বলি মৃত্যু, বলি মর্মান্তিক।