- বইয়ের নামঃ আমি ছিন্নভিন্ন
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য ভবন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমার সজল চোখ বুঝলে না
তোমরা কেউ আমার সজল চোখ বুঝলে না, বুঝলে পেরেক
বুঝলে ডলার-পাউণ্ড, বিমানবন্দুর, যুদ্ধজাহাজ
তোমরা কেউ একটি খোঁপা-খোলা মেঘ বুঝলে না, বুঝলে রক্ত
বুঝলে ছুরি, বুঝলে দংশন,
তোমরা কেউ বন্ধুর পবিত্র মুখ বুঝলে না, বুঝলে হিংসা
বুঝলে রাত্রি, বুঝলে অন্ধকার, বুঝলে ছোবল;
তোমরা কেউ আমার সজল চোখ বুঝলে না, বুঝলে আঘাত
তোমরা কেউ বন্ধুর কোমল বুক বুঝলে না, বুকে মাটির
ঘ্রাণ বুঝলে না, বুঝলে অস্ত্র;
তোমরা কেউ বুঝলে না, বুঝলে না, বুঝলে না।
তোমরা একটি বকুলফুল বুঝলে না, কেনইবা কাঁদবে?
তোমরা একটি শস্যক্ষেত্র বুঝলে না, কেনইবা দাঁড়াবে?
তোমরা একটি মানুষ বুঝলে না, কেনইবা নত হবে?
তোমরা বুঝলে না মায়ের চোখের অশ্রু, পিতার বুকের দুঃখ
বুঝলে না শেশব, বাউল, ভাটিয়ালি
তোমরা বুঝলে না, এসব কিছুই বুঝলে না।
গ্রামের মেঠো পথ, ফুলের গন্ধ, ঝিঁঝির ডাক
তোমরা কোনোদিন বুঝলে না, বুঝলে না নদরি গান, পাতার শব্দ
বুঝলে না সজনে ডাঁটা, পুঁইশাক, কুমড়োলতা
তোমরা হৃদয় বুঝলে না, বুঝলে লোহার আড়ত,
তোমরা কিছু বুঝলে না, কিছু বুঝলে না, কিছু বুঝলে না
শুধু বুঝলে চোরাগোপ্তা, বুঝলে রক্তপাত।
আমি ছিন্নভিন্ন
আমি ছিন্নভিন্ন-বিগত বছরের এটাই সর্বাপেক্ষা
প্রধান সংবাদ
বিশ্বের সমস্ত প্রচার মাধ্যম থেকে একযোগে প্রচারযোগ্য
এই একটাই বিশ্বসংবাদ, আমি ছিন্নভিন্ন
যদিও একান্ত ব্যক্তিগত এই শোকবার্তা কারো মনে
জাগাবে না সামান্য করুণা
তবু মনে হয় এই শতাব্দীর এটাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ
একটি সংবাদ-শিরোনাম : আমি ছিন্নভিন্ন ;
এই কবিতার মদ্যে আমি এই একান্ত জরুরী খবরটাই শুধু
উদ্ধৃত করেছি
শিম্ভের সমস্ত সংবাদ উৎস হতে এই একটাই বার্তা শুধু
প্রচারিত হচ্ছে একটি শতাব্দী ধরে-
মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখো, তার বুকের কাছে মুখ নিয়ে
জিজ্ঞেস করো সে বলবে, আমি ছিন্নভিন্ন
গোলাপের দিকে তাকাও সে বলবে, আমি ছিন্নভিন্ন
বন কিংবা উদ্ভিদের কছে যাও সেও এই একই কথাই বলবে,
অনন্ত নীলিমার দিক চোখ ফেরাও তার কন্ঠে শুনতে পাবে
এই একই ভয়াবহ বার্তা ; আমি ছিনইভন্ন
পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে ফিরে তাকাও
সেও ক্রমাগত আর্তনাদ করে উঠবে, আমি ছিন্নভিন্ন
সৌন্দর্যকে জিজ্ঞেস করো সেও এই একই উত্তর দেবে,
মানুষের শুদ্ধতাকে প্রশ্ন করো সেও নিঃসঙ্কোচে
বলবে, আমি ছিন্নভিন্ন
প্রকৃতি ও শস্যক্ষেত্রের কাছে যাও অন্য কিচুই শুনতে পাবে না,
এমন যে শান্ত জলধারা তার কাছেও যাও
আহত কন্ঠে বলবে সেও দলিত-মথিত, ছিন্নভিন্ন
গোলাপের কৌমার্য, ফুলের শুদ্ধতা আর হৃদয়ের বিশুদ্ধ আবেগ
তারাও এই একই কথা বলবে ;
দেশ ছিন্নভিন্ন, মানুষ ছিন্নভিন্ন,মানুষের সত্তা ছিন্নভিন্ন
যতোই লুকোতে চাই তবুও প্রকৃত সত্য হচ্ছে
আমি ছিন্নভিন্ন,কাঁটায় কাঁটায় বিদ্ধ ও বিক্ষত
ট্রাজিডির করুণ নয়ক যেন চোখের সম্মুখে দেখে
একে একে নিভিছে দেউটি, অগ্নিদগ্ধ স্বর্ণলঙ্কাপুরী
মুহূর্তে বিরান এই সমগ্র জীবন,
হয়তো সম্মুখ যুদ্ধে হইনি আক্রান্ক
ভূমিকম্প কিংবা ঘূর্ণিঝড় তছনছ করেনি উদ্যান,
তবুও তাকিয়ে দেখি আমি যেন ধ্বংসস্তপ
এর ব্যক্তিগত শোকবর্তা যদিও কারোই মনে
বিশেষ চাঞ্চল্য কিছু জাগাবে না ঠিক
তবুও যেমন একটি গোলাপ বলে, একটি উদ্ভিদ বলে,
এই দেশ বলে, মানুষের সত্তার শুদ্ধতা বলে
আমিও তেমনি বলি সব চেয়ে সত্য আর মর্মান্তিক একটি সংবাদ ;
আমি ছিন্নভিন্ন-
আমার সমস্ত সত্তা ছিন্নভিন্ন, ছিন্নভিন্ন আমার শরীর
ছিন্নভিন্ন, তবুও দাঁড়িয়ে আছি।
আমিও তো অটোগ্রাফ চাই
আমিও তো অটোগ্রাফ চাই, আমিও তো লিখতে চাই
তোমাদেরই নাম হৃদয়ের গভীর খাতায়
তোমাদের একেকটি স্বাক্ষর আমিও খোদাই করতে চাই
স্মৃতিতে, সত্তায়।
শুধু এই মানুষের অনবদ্য নাম জুঁই, চাঁপা, শিউলির মতো
আমিও তো চাই মর্মে ফোটাতে আমার;
ভালেবেসে কেউ যদি লেখে নাম, কেউ যদি
একটিও অটোগ্রাফ এঁকে দেয় এই মলিন কাগজে
তাকে আমি করে তুলি অনন্ত নক্ষত্রময় রাত্রির আকাশ;
আমার তেমন নেই অটোগ্রাফ সংগ্রহের মনোরম খাতা
নীল প্যাড, সুদৃশ্য মলাট
কিন্তু আমি দিতে পারি নীলিমার চেয়েও বিসতৃত
সমুদ্রের চেয়েও গভীর
যে-কোনো সবুজ বনভূমি থেকে অধিক সবুজ
এই আমার হৃদয়-
এর চেয়ে অধিক লেখার যোগ্য আর কোনো পত্র বা
প্রস্তরখণ্ড নেই;
তবু আমিই লিখেছি নাম কাগজে, শিলায়, পত্রে
কখনোবা পাহাড়ের গায়ে
দয়ার্দ্র অনেক প্যডে, সুদৃশ্য খাতায়
কিন্তু আজ মনে হয় ঝরা বকুলেল মতো
আমার নশ্বর নাম করে গেছে তৎক্ষণাৎই সামান্য হাওয়ায়
আর যেটুকুও বাকি ছিলো মুছে গেছে শিশিরে বৃষ্টিতে।
অনেক লিখেছি তবু নাম, তবুও এঁকেছি এই বারবার
ব্যর্থ আমার স্বাক্ষর
আজ বুঝ কোথাও পায়নি সে এতোটুকু শ্যামল অঞ্চল
এতোটুকু স্নিগ্ধ ছায়া, এতোটুকু নিবিড় শুশ্রূষা
আজ তার দিকে সবাই তাকিয়ে দেখ
অজ্ঞাত ও নাম;
কোন প্রাগৈতিহাসিক কালের যেন ভাষা
আমার এ ব্যর্থ হস্তাক্ষর আজ প্রাচীন কালের দুর্বোধ্য শিলালিপির
মতোই ধূসর
মনে হয় কেউ তার চেনে না কোনোই বর্ণমালা।
কিন্তু আমার হৃদয় আজো ধারণ করতে পারে মানুষের
গুচ্ছ গুচ্ছ নাম
সেখানে সবুজ অঞ্চলের কোনোই অভাব নেই
তাই তাতে এখনো সে খোদাই করতে পারে মানুষের প্রিয়
নামগুলি।
প্রকৃতই মানুষের নাম ছাড়া আমি আজো
ফুল, পাখি কিংবা বৃক্ষ এসবের পৃথক পৃথক কোনো নাম
তেমন জানি না,
কিন্তু এখনো সমান আমি রাত জেগে মানুষের নামের বানান
মুখস্ত করতে ভালোবাসি
তাই অটোগ্রাফ আমারই নেয়ার কথা, আমিও তো
অটোগ্রাফ চাই।
এই কবিতার জন্যে
এই কবিতার জন্যে কতোবার বদ্ধ উন্মাদের মতো ঘুরলাম
রাস্তায় রাস্তায়
কতোবার আগুনে দিলাম হাত, প্রবল তুষারপাত নিলাম মাথায়;
এই কবিতার জন্যে পঞ্চপাণ্ডবের মতো আবদ্ধ হলাম জতুগৃহে
শুধু এই কবিতাকে ভালোবেসে কতোবার দাঁড়ালাম
পরমানু বোমার বিরুদ্ধে
কতোবার একা বুক পেতে দাঁড়ালাম আণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের সম্মুখে,
কবিতাকে ভালোবেসে এই পৃথিবীকে কতোবার বাঁচালাম
যুদ্ধ ও ধ্বংসের হাত থেকে।
কবিতার প্রতি এই তীব্র ভালোবাসা ছাড়া
এমন বিরূপ আবহাওয়া ও জলবায়ুতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
কখনো সম্ভব নয় বাঁচা;
এই কবিতার জন্রে কতোবার দাঁড়ালাম বিপদের মুখোমুখি
ট্রাফিক সঙ্কেত ভুলে পথের ওপরে,
কতোবার প্রমত্ত ঝঞ্ঝার মুখে, স্রোতের আবর্তে
এই কবিতার জন্যে খোয়ালাম পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি
যা কিচু সম্বল কানাকড়ি।
এই কবিতার জন্রে আমিও রিলকের মতো গোলাপের দংশনেই
হলাম আহত
আমও বুদ্ধের মতো জরামৃত্যুব্যাধি দেখে হলাম ব্যাকুল;
কতোবার এই কবিতার জন্যে সেই কৈশোর থেকেই
তছনছ করেছি জীবন
এই কবিতার জন্যে আমি আপাদমস্তক ছিন্নভিন্ন এমন ফতুর
ভাঙা শিরদাঁড়া, পোড়-খাওয়া একটি মানুষ
এই কবিতার জন্যে যীশুর মতোই আমি ক্রুশবিদ্ধ।
এই কবিতার জন্যেখনো শিশুর মতো কাঁদি, দুঃখ পাই
এখনো আগের মতোই ঠিক কবিতার জন্যে হই
গভীর ব্যথিত, মণঃক্ষুণ্ন কিংবা উত্তেজিত;
এই কবিতার জন্যে এখনো দাঁড়াই এসে অনায়াসে
সকল ঝুঁকির মুখে আমি
এই কবিতার জন্যে জীবনকে এখনো আমি
এতো ভালোবাসি, এতো ঘৃণা করি।
কবি ও কৃষ্ণচুড়া
চৈত্রে হয়তো ফোটেনি কৃষ্ণচুড়া
তাতে ক্ষতি নেই; তোমার ঠোঁটেই দেখি
এসেছে আবার কৃষ্ণচুড়ার ঋতু
তুমি আছে তাই অভাব বুঝিনি তার;
না হলে চৈত্রে কোথায়ইবা পাবো বলো
কৃষ্ণচুড়ার অযাচিত উপহার,
বর্ষায় সেই ফুটবে কদম ফুল
তোমার খোঁপায় চৈত্রেই আনাগোনা।
তাই সন্দেহে চোখ মেলে কেউ কেউ
তাকায় কোথায় ফুটেছে কৃষ্ণচুড়া,
কেউ খোঁজে এই নিরিবিলি ফুলদানি;
চৈত্রে কোথাও ফোটেনি কৃষ্ণচুড়া
কিন্তু ফুটেছে তোমার দুইটি ঠোঁটে,
কবির দুচোখ এড়াতে পারেনি, তাই
ধরা পড়ে গেছে কবিতার পঙ্খক্তিতে।
কোনো ফুলের বাগান নেই
আমাদের কোনো ফুলের বাগান নেই, তবু
পৃথিবীর এই দুঃসময়ে নীলা তার টবটিতে
ফুটিয়েছে রজনীগন্ধার কটি কলি,
বারান্দার সঙ্কীর্ণ আলোক আর অপ্রচুর বাতাস সত্ত্বেও
কেমন ফুটেছে তার হাসি, সজীব ডালটি যেন
মনেহয় স্বচ্ছেন্দে উঠেছে বেড়ে হৃদয়ের উর্বর মাটিতে;
দুবেলা আমাকে সে দেখায় তার রজনীগন্ধার এই চারা,
বলে-আলো ও বাতাসহীন প্রতিকূল পরিবেশেও দেখো
কেমন ফুটেছে এই প্রকৃতির ফুল!
প্রত্যুত্তরে আমি আজো বলিনি কিছুই শুধু নীরবে তাকিয়ে
থাকা ছাড়া;
তাই আমার মুখের দিকে চেয়ে রজনীগন্ধার ভীরু ডালটির মতো
সেও যেন হয়ে পড়ে খুবই সঙ্কুচিত,
কেননা নীলা তো জানে আমার ফুলের প্রতি চিরকালই
সীমাহীন দুর্বলতা আছে
তবু রজনীগন্ধার দিকে চেয়ে আমার মুখে একটিও কেন প্রশংসা
ফুটলো না?
কী করে বোঝাই আমি অন্তহীন নীরবতা ছাড়া এর যোগ্য কী
প্রশংসা হতে পারে,
কী করে বোঝাই তাকে এই ফুল ফোটানো সাফল্য কতোটা!
যখন সে বারান্দায় তার মাটির টবটি জুড়ে ফুটিয়েছে এই হার্দ্য,
অনবদ্য ফুল
তখন পৃথিবী জুড়ে তৈরি হচ্ছে মানুষ বিধ্বংসী বোমা,
ক্ষেপনাস্ত্র, ভয়াল বারুদ
এই রজনীগন্ধার পাশাপাশি একই সাথে পৃথিবীতে
অঙ্কুরিত হচ্ছে মারণাস্ত্রের ভীষণ নখর,
রজনীগন্ধার চেয়ে আরো দ্রুত চোখের নিমিষে ছেয়ে যাচ্ছে
পৃথিবীর অস্ত্রশালা দাঁত, নখ ও হিংস্র থাবায়
সেজন্যই এমন ফুলের দিকে চেয়ে একটিও প্রশংসার বাক্য
স্ফোটে না,
শুধু মনে হয় সমস্ত পৃথিবীময় মানুষের হৃদয়ে যদি জন্ম নিতো
রজনীগন্ধার এই কলি!
তাই নীলাকে বলিনি
পৃথিবীর এই দুঃসময়ে আজ এরূপ একটি ফুল
ফোটানো যে কতোটা কঠিন
আর তার সার্থকতা বিজ্ঞান ও মেধার কৃতিত্বের
চেয়েও মহৎ!
গোলাপ, তোমার মর্ম
গোলাপ বিষয়ে কোনো সূক্ষ্ম অনুভূতি
প্রেমিকের মতো কোনো গভীর মুগ্ধতা-
আমার তেমন কিছু নেই;
গোলাপের কাছে আমি পর্যটক, বিদেশী পথিক
বড়ো জোর এমন সম্পর্ক হে বন্ধু বিদুয়, দেখা হবে।
আমি তাই গোলপকে গোলাপ বলি না
বলি মহিমার ফুল, বলি মৃত্যু, বলি মর্মান্তিক।
সম্পূর্ণ নির্দোষ নগ্ন, আঙুলে কাঁটার কালো ক্ষত
কালো বিষ, কালো অন্ধ প্যারিসের পতের ভিক্ষুক, পাপী
ঘোর গৃহত্যাগী। গোলাপ সম্পকে ঠিক নদীর মতন সম্পূর্ণ
ধারণা কিছু নেই
গোলাপ বিষয়ৈ জ্ঞান বড়ো অসম্পূর্ণ,
গোলাপ, তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি না।
হয়তো নদী সম্পর্কে আমার এক ধরনের দুর্বলতা আছে
কোথাও কোনোভাবে নদীর কাছে বাঁধা পড়েছি,
তাই বলে গোলপবিরোধী আমি নই
এখনো বহু রাত আমি গোলাপের স্বপ্নে ঘুমাতে পারি না
দৃঢ়বন্ধে জপটে ধরি গোলাপ, গোলাপ ভেবে ঘুম ও মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা
গোলাপ বস্তুত এই ঘুমের মঘ্যে স্বপ্ন;
জেগে উঠেই গোলাপ দেখি রক্তমাখা, গোলাপ দেখি কলুষকালো
গোলাপ দেখি গভীর গোপন অসুস্থতায় অবসন্ন, মর্মে ভীষণ বিষের ফণা।
সেই একবার বাল্যে আমি গোলপ ছুঁয়ে সংজ্ঞা হারিয়েছিলাম
আরো একবার কৈশোরে গোলাপ দেখে আতঙ্কিত,
তারপর পর্যটনে নেমে একে একে গোলাপ বিষয়ৈ
এই অভিজ্ঞতা।
এখন গোলাপ বিষয়ে আমার তেমন কোনো সূক্ষ্ম অনুভূতি নেই
গোলাপ বিষয়ে আমার জ্ঞান বড়ো অস্বচ্ছ, বড়ো অগভীর
তাকে যতোটা জানি সে মাত্রই একজন পর্যটকের মতো
কিংবা একজন কৃষকের মতো।
এক সময় গোলাপের মধ্যে আমি নদীর কুলুকুলু কান্না শুনেছিলাম
মানুষের বিশুদ্ধ আত্মপ্রকাশের শিল্প দেখেছিলাম
গোলাপের সৌন্দর্যে।
সেই মুগ্ধতা এখন আমার নেই, সত্যি বলছি গোলাপ বিষয়ে
এখন আমি সাধারণ একজন কৃষক মাত্র;
ঠিক গোলাপ নয় আমি অরণ্য-উদ্ভিদ খুঁজতে এসেছি
হয়তো পাথর তুলতে এসেছি
তবু আমি গোলাপকে গোলাপ বলি না
বলি স্বপ্ন, বলি মৃত্যু, বলি মর্মান্তিক।
তোমার দুইটি হাতে পৃথিবীর মৌলিক কবিতা
তোমার দুহাত মেলে দেখিনি কখনো
এখানে যে ফুটে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোলাপ,
তোমার দুহাত মেলে দেখিনি কখনো
এখানে যে লেখা আছে হৃদয়ের গঢ় পঙক্তিগুলি।
ফুল ভালোবাসি বলে অহঙ্কাল করেছি বৃথাই
শিল্প ভালোবাসি বলে অনর্থক বড়োই করেছি,
মূর্খ আমি বুঝি নাই তোমার দুখানি হাত
কতো বেশি মানবিক ফুল-
বুঝি নাই কতো বেশি অনুভূতিময়
এই দুটি হাতের আঙুল।
তোমার দুখানি হাত খুলে আমি কেন যে দেখিনি,
কেন যে করিনি পাঠ এই শুদ্ধ প্রেমের কবিত।
গোলাপ দেখেছি বলে এতোকাল আমি ভুল করেছি কেবল
তোমার দুইটি হাত মেলে ধরে লজ্জায় এবার ঞাকি মুখ।
তোমার দুইটি হতে
ফুটে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধ গোলাপ,
তোমার দুইটি হতে
পৃথিবীর একমাত্র মৌলিক কবিতা।
তোমার হাতের জল
তোমার হাতের জল পেলে শুধু এই তৃষ্ণা যাবে
না হলে যাবার নয় এই তৃষ্ণা, এই গ্রীষ্মকাল।
তোমার হাতের জল ছাড়া ভিজবে না পোড়া জমি
এই পোড়ামাটির মানুষ; তোমার হাতের জল
পেলে তাই ফিরে পাবো এ জীবনে ফের সুসময়
সমস্ত অসুখ থেকে আবার উঠবো হয়ে ভলো।
তোমার হতের জল ছাড়া এই চারা কিসে বাঁচে,
কিসে পল্লবিত হয় বলো এই শষ্ক ডালপালা?
তোমার হাতের জল পেলে মেলে অপর্থিব সুখ
মুহূর্তেই হয়ে উঠি পরিপূর্ণ সবুজ, সতেজ।
এমন বর্ষণে তবু ভেজৈ নাই দেখো এই বুক
সমুদ্র সামান্য যেন তোমার হাতের জল ছাড়া;
তোমার হাতের জল একফোঁটা শুধু যদি পাই,
কাঁটার বিরুদ্ধে আমি অনায়াসে বুনে যাবো ফুল।
বাউল
ভালোবাসা যদি এ-রকমই হয় রক্তমাংস, কাম
লালনেও মিছে লজ্জা পাবো কি, সঙ্কোচে লিখি নাম?
মানুষ লিখেই কতোবার কাটি, মানুষের বেশি নই
কামে-প্রেমে তাই এতো ভার বহি, এমন যাতনা সই!
মানুষে যদি বা মাহাত্ম্য নেই পাষাণেই দেখা হবে
তোমাতে আমাতে আজকাল বাদে এটুকু তো সম্ভবে।
প্রেমের মূল্যে আমাকে ছেড়েছো ঘৃণার মূল্যে দিও
তুমিও জানো না আমিও জানি না কোনখানে স্মরণীয়
প্রিয়ায় আসেনি হিয়ায় এসেছো, কন্যায় কামনায়
চাইনা বলেও যতোবার ভাবি না চাওয়াও কিছু চায়।
বড়ো সুসময় কখনো পাবো না
ফুলের পাশেই আছে অজস্র কাঁটার পথ, এই তো জীবন
নিখুঁত নিটোল কোনো মুহূর্ত পাবো না,
এখন বুঝেছি আমি
এভাবেই সাজাতে হবে অপূর্ণ সুন্দর;
একেবারে মনোরম জলবায়ু পাবো না কখনো
থাকবে কুয়াশা-মেঘ, ঝড়েরআভাস
কখনো দুলবে ভেলা
কখনো বিরুদ্ধ স্রোতে দিতে হবে
সুদীর্ঘ সাঁতার,
কুয়াশা ও ঝড়ের মাঝেই
শীতগ্রীষ্মে বেয়ে যেতে হবে এই তরী;
যতোই ভাবি না কেন
সম্পূর্ণ উজ্জল কোনো সুসময় পেলে
ফলাবো সোনালি ধান্য,
সম্পন্ন করবো বসে শ্রেষ্ঠ কাজগুলি-
কিন্তু এমন নিটোল কোনো জীবন পাবো না।