- বইয়ের নামঃ হিমুর নীল জোছনা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
ঝুম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল
উৎসর্গ
বাষট্টি বছর বয়েসী কঠিন হিমু কেউ কি দেখেছেন? আমি দেখেছি। তার নাম সেহেরী। অবসরপ্রাপ্ত প্ৰধান প্রকৌশলী, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। তিনি শুধু যে হলুদ পাঞ্জাবি পরেন তা-না, তিনি নিজের চুল-দাড়ি সবই মেহেদি দিয়ে হলুদ করে রাখেন। পূর্ণিমার রাতে আয়োজন করে জোছনা দেখতে গাজীপুরের জঙ্গলে যান।
সৈয়দ আমিনুল হক সেহেরী (হিমু, ফার্স্টক্লাস)
ভূমিকা
(না পড়লেও চলবে)
প্রফেশনাল হাজার্ড বলে একটা কথা ইংরেজিতে প্রচলিত আছে। বাংলায় হবেপেশাগত বিপদ। যে দরজি ছাতা সেলাই করে তার বিপদ হলো, আঙুলে সুই ঢুকে যাওয়া। লেদ মেশিন যে চালায় তার বিপদ মেশিনে হাত কাটা পড়া। লেখকদের বিপদ অনেক বেশি। লেখালেখির জন্যে মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা আছে। দেশান্তরি হওয়ার ঘটনা তো বাংলাদেশেই আছে।
হিমু নিয়ে যখন লেখি এক ধরনের শঙ্কা কাজ করে—না জানি কোন ঝামেলায় পড়ি! বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্টই সহনশীল। শুধু ক্ষমতাধর মানুষরা না। তারা আমজনতাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা উপভোগ করেন, তাদের নিয়ে রঙ্গ-রসিকতা সহ্য করেন না। ক্ষমতাবানরা নিজেদের সবকিছুর উর্ধে ভাবেন।
আমি এই বইতে কিছু কঠিন রসিকতা করেছি। সরি, আমি না, হিমু করেছে। সমস্যা হলে হিমুর হবে। একটা ভরসা আছে, হিমু চাঁদের আলো ছাড়া কোনো কিছুই গায়ে মাখে না।
ঘুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী
০১.
ঝুম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। এই বৃষ্টির আরেক নাম আউলা ঝাউলা বৃষ্টি। কিছুক্ষণ দক্ষিণ দিক থেকে ফোঁটা পড়ছে, কিছুক্ষণ উত্তর দিক থেকে। মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপ্টা। সামান্য বিরতি, আবার শুরু। মেসবাড়ির একটা অংশে টিনের ছাদ। সেখানে শিলাবৃষ্টির ঝনঝন শব্দও হলো। ব্যাপারটা কী?
নভেম্বর মাস বৃষ্টি-বাদলার মাস না। আকাশে অতিরিক্ত কার্বন-ডাইঅক্সাইডের জন্যে নিশ্চয়ই কোনো গড়বড় হয়েছে। আষাঢ়-শ্রাবণে বৃষ্টি নেই। নভেম্বর-ডিসেম্বরে বৃষ্টি। হিমালয়ের বরফ গলে যাচ্ছে। হিমবাহ দক্ষিণ মেরু ছেড়ে সাগরে ভাসতে শুরু করেছে। পেঙ্গুইন পাখিরা ডিম দিচ্ছে না। সিল মাছরা পানি ছেড়ে গভীর ভঙ্গিতে ডাঙায় বসে আছে। পৃথিবীর চৌম্বকশক্তিতেও নাকি কী সব হচ্ছে। উত্তর মেরু হয়ে যাবে দক্ষিণ মেরু। আমাদের কাছের মালদ্বীপ সমুদ্রে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে মালদ্বীপ ফুটবল টিমের সঙ্গে বাংলাদেশ হয়তো আর সেমিফাইন্যাল খেলবে না—এমন দুশ্চিন্তা নিয়ে বিছানায় উঠে বসতেই শুনলাম, ভাইজান, ঘুম ভাঙছে? গুড মর্নিং ডিয়ার স্যার।
মাথা ঘোরালেই প্রশ্ন কর্তকে দেখতে পাব। মাথা না ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখা থাক। এই বৃষ্টি বেশিদিন দেখা যাবে না। পত্রিকায় পড়েছি—জলবায়ু যেভাবে বদলাচ্ছে তাতে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে বৃষ্টি হবে না। বৃষ্টি হবে আরবে। উটের বদলে তারা কোষা নৌকায় চলাচল করবে। বাংলাদেশ হবে মরুভূমি। আমরা উটের পিঠে চড়বা। ভাত-মাছের বদলে ডিনার করব খেজুর দিয়ে।
ভাইজান কি একটু আমার দিকে তাকবেন? সিম্পল রিকোয়েষ্ট।
আমি তাকালাম এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো আসলে আমার ঘুম ভঙে নি।
এখনো ঘুমুচ্ছি এবং স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্ন ছাড়া এই দৃশ্য দেখা সম্ভব না।
দেখলাম, বিছানার পাশে হাতলভাঙা চেয়ারে স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসে আছেন। গায়ে আলখাল্লা। তিনি কলা দিয়ে পাউরুটি খাচ্ছেন। বেশ আগ্ৰহ তার পাইখানা ক্লিয়ার হয় না। কী ভয়ঙ্কর! আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ছামাদ, আপনি কি আমাকে চেনেন?
জি-না। আপনার দরজা খোলা ছিল, ঢুকে পড়েছি। গুস্তাকি মাফ হয়। আর আমারে আপনি বলবেন না। তুমি। স্রেফ তুমি। আপনার দিল যদি চায় তুইও বলতে পারেন।
তুমি কি মেসের অন্য কাউকে চেনো?
জি-না।
আমার এখানে উদয় হলে কীভাবে বলবে?
ছামাদ বিড়ি ধরাতে ধরাতে বলল, সকালে নাশতা করার জন্যে একটা পাউরুটি আর দুটা কলা কিনেছি। পার্কে যাব। বেঞ্চে বসে নাশতা করব। মাথায় এই চিন্তা। শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। সঙ্গে নাই ছাতা। কী করি কী করি? দেখি মেসের দরজা খোলা। ঢুকে পড়লাম। দারোয়ান আমাকে দেখল। কিন্তু কিছু বলল না। মনে হয় পোশাক দেখে টাসকি খেয়েছে। এই হচ্ছে ঘটনা। আর কিছু জানতে চান?
রবি ঠাকুর, নজরুল, গান্ধিজি—এদের ভেক ধরার প্রয়োজন কী?
ভিক্ষার সুবিধা হয়। ধরেন রবি ঠাকুর সাজিলাম, যারা রবি ঠাকুররে চিনে তারা খুশি হয়ে পাঁচ-দশ টাকা দেয়। একবার পাঁচশ টাকা পেয়েছিলাম। এক আপা দিয়েছিলেন। উনার মোবাইল নাম্বারা আছে আমার কাছে। অনেকে ঘাড়ে হাত দিয়ে ছবি তুলে। সবার হাতে মোবাইল, ছবি তুলতে অসুবিধা নাই। খটখট পিকচার।
চুল দাড়ি সব নকল?
জি। তবে টাইট ফিটিং, টানাটানি করলেও ছুটবে না। দাড়ি ধরে টান দিয়া দেখেন।
ছামাদ মুখ এগিয়ে দিল।
ভাইজান, শক্ত করে টান দেন। কোনো অসুবিধা নাই। ছুটে গেলে গাম দিয়ে লাগায়ে ফেলব। আমার কাছে গাম সাথে আছে।
আমি দাড়ি ধরে টানলাম। দাড়ি মুখ থেকে খুলে এল না। ছামাদ আনন্দিত গলায় বলল, রবি ঠাকুর সাজা আমার জন্যে সহজ। আমার চেহারাটা উনার মতো। উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। আগে পীচ ফুট এগারো ইঞ্চি ছিল। অভাবে অনটনে উচ্চতা এক ইঞ্চি কমেছে।