- বইয়ের নামঃ হিমুর নীল জোছনা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
ঝুম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল
উৎসর্গ
বাষট্টি বছর বয়েসী কঠিন হিমু কেউ কি দেখেছেন? আমি দেখেছি। তার নাম সেহেরী। অবসরপ্রাপ্ত প্ৰধান প্রকৌশলী, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। তিনি শুধু যে হলুদ পাঞ্জাবি পরেন তা-না, তিনি নিজের চুল-দাড়ি সবই মেহেদি দিয়ে হলুদ করে রাখেন। পূর্ণিমার রাতে আয়োজন করে জোছনা দেখতে গাজীপুরের জঙ্গলে যান।
সৈয়দ আমিনুল হক সেহেরী (হিমু, ফার্স্টক্লাস)
ভূমিকা
(না পড়লেও চলবে)
প্রফেশনাল হাজার্ড বলে একটা কথা ইংরেজিতে প্রচলিত আছে। বাংলায় হবেপেশাগত বিপদ। যে দরজি ছাতা সেলাই করে তার বিপদ হলো, আঙুলে সুই ঢুকে যাওয়া। লেদ মেশিন যে চালায় তার বিপদ মেশিনে হাত কাটা পড়া। লেখকদের বিপদ অনেক বেশি। লেখালেখির জন্যে মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা আছে। দেশান্তরি হওয়ার ঘটনা তো বাংলাদেশেই আছে।
হিমু নিয়ে যখন লেখি এক ধরনের শঙ্কা কাজ করে—না জানি কোন ঝামেলায় পড়ি! বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্টই সহনশীল। শুধু ক্ষমতাধর মানুষরা না। তারা আমজনতাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা উপভোগ করেন, তাদের নিয়ে রঙ্গ-রসিকতা সহ্য করেন না। ক্ষমতাবানরা নিজেদের সবকিছুর উর্ধে ভাবেন।
আমি এই বইতে কিছু কঠিন রসিকতা করেছি। সরি, আমি না, হিমু করেছে। সমস্যা হলে হিমুর হবে। একটা ভরসা আছে, হিমু চাঁদের আলো ছাড়া কোনো কিছুই গায়ে মাখে না।
ঘুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী
০১.
ঝুম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। এই বৃষ্টির আরেক নাম আউলা ঝাউলা বৃষ্টি। কিছুক্ষণ দক্ষিণ দিক থেকে ফোঁটা পড়ছে, কিছুক্ষণ উত্তর দিক থেকে। মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপ্টা। সামান্য বিরতি, আবার শুরু। মেসবাড়ির একটা অংশে টিনের ছাদ। সেখানে শিলাবৃষ্টির ঝনঝন শব্দও হলো। ব্যাপারটা কী?
নভেম্বর মাস বৃষ্টি-বাদলার মাস না। আকাশে অতিরিক্ত কার্বন-ডাইঅক্সাইডের জন্যে নিশ্চয়ই কোনো গড়বড় হয়েছে। আষাঢ়-শ্রাবণে বৃষ্টি নেই। নভেম্বর-ডিসেম্বরে বৃষ্টি। হিমালয়ের বরফ গলে যাচ্ছে। হিমবাহ দক্ষিণ মেরু ছেড়ে সাগরে ভাসতে শুরু করেছে। পেঙ্গুইন পাখিরা ডিম দিচ্ছে না। সিল মাছরা পানি ছেড়ে গভীর ভঙ্গিতে ডাঙায় বসে আছে। পৃথিবীর চৌম্বকশক্তিতেও নাকি কী সব হচ্ছে। উত্তর মেরু হয়ে যাবে দক্ষিণ মেরু। আমাদের কাছের মালদ্বীপ সমুদ্রে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে মালদ্বীপ ফুটবল টিমের সঙ্গে বাংলাদেশ হয়তো আর সেমিফাইন্যাল খেলবে না—এমন দুশ্চিন্তা নিয়ে বিছানায় উঠে বসতেই শুনলাম, ভাইজান, ঘুম ভাঙছে? গুড মর্নিং ডিয়ার স্যার।
মাথা ঘোরালেই প্রশ্ন কর্তকে দেখতে পাব। মাথা না ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখা থাক। এই বৃষ্টি বেশিদিন দেখা যাবে না। পত্রিকায় পড়েছি—জলবায়ু যেভাবে বদলাচ্ছে তাতে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে বৃষ্টি হবে না। বৃষ্টি হবে আরবে। উটের বদলে তারা কোষা নৌকায় চলাচল করবে। বাংলাদেশ হবে মরুভূমি। আমরা উটের পিঠে চড়বা। ভাত-মাছের বদলে ডিনার করব খেজুর দিয়ে।
ভাইজান কি একটু আমার দিকে তাকবেন? সিম্পল রিকোয়েষ্ট।
আমি তাকালাম এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো আসলে আমার ঘুম ভঙে নি।
এখনো ঘুমুচ্ছি এবং স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্ন ছাড়া এই দৃশ্য দেখা সম্ভব না।
দেখলাম, বিছানার পাশে হাতলভাঙা চেয়ারে স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসে আছেন। গায়ে আলখাল্লা। তিনি কলা দিয়ে পাউরুটি খাচ্ছেন। বেশ আগ্ৰহ তার পাইখানা ক্লিয়ার হয় না। কী ভয়ঙ্কর! আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ছামাদ, আপনি কি আমাকে চেনেন?
জি-না। আপনার দরজা খোলা ছিল, ঢুকে পড়েছি। গুস্তাকি মাফ হয়। আর আমারে আপনি বলবেন না। তুমি। স্রেফ তুমি। আপনার দিল যদি চায় তুইও বলতে পারেন।
তুমি কি মেসের অন্য কাউকে চেনো?
জি-না।
আমার এখানে উদয় হলে কীভাবে বলবে?
ছামাদ বিড়ি ধরাতে ধরাতে বলল, সকালে নাশতা করার জন্যে একটা পাউরুটি আর দুটা কলা কিনেছি। পার্কে যাব। বেঞ্চে বসে নাশতা করব। মাথায় এই চিন্তা। শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। সঙ্গে নাই ছাতা। কী করি কী করি? দেখি মেসের দরজা খোলা। ঢুকে পড়লাম। দারোয়ান আমাকে দেখল। কিন্তু কিছু বলল না। মনে হয় পোশাক দেখে টাসকি খেয়েছে। এই হচ্ছে ঘটনা। আর কিছু জানতে চান?
রবি ঠাকুর, নজরুল, গান্ধিজি—এদের ভেক ধরার প্রয়োজন কী?
ভিক্ষার সুবিধা হয়। ধরেন রবি ঠাকুর সাজিলাম, যারা রবি ঠাকুররে চিনে তারা খুশি হয়ে পাঁচ-দশ টাকা দেয়। একবার পাঁচশ টাকা পেয়েছিলাম। এক আপা দিয়েছিলেন। উনার মোবাইল নাম্বারা আছে আমার কাছে। অনেকে ঘাড়ে হাত দিয়ে ছবি তুলে। সবার হাতে মোবাইল, ছবি তুলতে অসুবিধা নাই। খটখট পিকচার।
চুল দাড়ি সব নকল?
জি। তবে টাইট ফিটিং, টানাটানি করলেও ছুটবে না। দাড়ি ধরে টান দিয়া দেখেন।
ছামাদ মুখ এগিয়ে দিল।
ভাইজান, শক্ত করে টান দেন। কোনো অসুবিধা নাই। ছুটে গেলে গাম দিয়ে লাগায়ে ফেলব। আমার কাছে গাম সাথে আছে।
আমি দাড়ি ধরে টানলাম। দাড়ি মুখ থেকে খুলে এল না। ছামাদ আনন্দিত গলায় বলল, রবি ঠাকুর সাজা আমার জন্যে সহজ। আমার চেহারাটা উনার মতো। উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। আগে পীচ ফুট এগারো ইঞ্চি ছিল। অভাবে অনটনে উচ্চতা এক ইঞ্চি কমেছে।
আলখাল্লা পেয়েছ কোথায়?
আমার এক চাচাতো ভাই আছে, নাম সামছু। এফডিসিতে কাজ করে। ডাইরেক্টর এমদাদ সাহেবের থার্ড এসিসটেন্ট। সে বানায়ে দিয়েছে। এফডিসির দরজি বিরাট এক্সপার্ট। যা বলবেন বানায়ে দেবে। রবি ঠাকুরের ড্রেস ঠিক আছে না।
আমি বললাম, সবই ঠিক আছে। পায়ের স্পঞ্জের স্যান্ডেল ঠিক নাই। চটিজুতা! দরকার। উনি চটজুতা পরতেন।
জানি। টাকার অভাবে কিনতে পারি না। দুইবেলা খাওয়া জুটে না, আর চটিজুতা। শুনেছি। রবি ঠাকুর ছিলেন জমিদারের ছেলে, আর আমার বাবা ছিলেন মোটর মেকানিক। কাৰ্বরেটরের কাজ উনার মতো কেউ জানত না। মারা গেলেন। ক্যানসারে। মৃত্যুর আগে আমারে বললেন, বাবা ছামাদ, যা করতে মন চায় করবি। একটাই উপদেশ, কার্বুরেটর ঠিক রাখবি। গাড়ির যেমন কাৰ্বরেটর ঠিক থাকলে সব ঠিক, মানুষেরও একই ঘটনা।
তোমার কার্বুরেটর কীভাবে ঠিক রাখছ?
দুষ্ট কাজ কখনো করি না। খাওয়া জুটলে খাই, না জুটলে নাই। রবি ঠাকুর সাইজ মানুষরে আনন্দ দেই। মানুষরে আনন্দ দেওয়া বিরাট সোয়াবের কাজ।
টেবিলে পাউরুটির কিছু গুড়া পড়ে ছিল। ছামাদ আঙুলে করে পাউরুটির গুড়া মুখে দিয়ে দিল। আমি বললাম, চলো তোমাকে চটিজুতা কিনে দেই। রবি ঠাকুর স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে ঘুরছেন এই দৃশ্য সহ্য হচ্ছে না।
আগে চা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সকালে চা না খেলে অস্থির লাগে। একটা বিষয় বুঝলাম না, রবি ঠাকুর সাজলে অল্পতেই অস্থির লাগে। ভাইজান, উনি কি अश्न्नि छिब्लन?
মনে হয় না। তিনি অস্থির প্রকৃতির হলে বাংলা সাহিত্যে অস্থিরতা চলে আসত। তুমি উনার লেখা কিছু পড়েছ? ইস্কুলে তালগাছের লেখাটা পড়েছিলাম। তালগাছ একপায় দাঁড়িয়ে—ঐটা। লেখাটায় ভুল আছে।
কী ভুল?
উনি লিখেছেন উঁকি মারে আকাশে। গাছের কি চউখ আছে? আসমানের দিকে ক্যামনে উঁকি মারবে। বিরাট ভুল না?
আমি চুপ করে রইলাম। ছামাদ উৎসাহের সঙ্গে বলল, বড় মানুষ ভুল করেছে এইজন্যে পাবলিক কিছু বলে না। আপনে আমি ভুল করলে খবর ছিল। বিড়ি একটা খাবেন? খালিপেটে বিড়ির আলাদা মজা। ধোয়া ব্রেইনের মধ্যে গিয়া লাগবে।
আমি খালিপেটে বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ব্ৰেইনে লাগানোর ব্যবস্থা করলাম। ব্রেইনের চেয়ে ফুসফুসে বেশি লাগছে। কাশতে কাশতে জীবন বের হওয়ার উপক্রম।
ছামাদ বলল, কেমন বুঝতেছেন?
আমি কাশতে কাশতে বললাম, ভালো বুঝতেছি।
ঠ্যাং উপরে মাথা নিচে—এই অবস্থায় বিড়ি কখনো খেয়েছেন?
বিরাট মজা। প্রথমে মাথার মধ্যে একটা চক্কর দেয়। তারপরে.
তারপরে কী?
এখন বলব না। প্র্যাকটিক্যালে দেখবেন। যদি অনুমতি দেন। আজ সারা দিন আছি আপনার সাথে।
সারা দিন তোমাকে নিয়ে আমি করব কী?
ছামাদ হাই তুলতে তুলতে বলল, আত্মীয়-বান্ধবের বাড়িতে নিয়া যাবেন। বলবেন, রবি ঠাকুর নিয়া আসছি। অটোগ্রাফ নিতে চাইলে নাও। ছবি তুলতে চাইলে তোলো। দশজনের মধ্যে আটজন বিশ্বাস করবে না। কিন্তু দুইজন বিশ্বাস করবে। তখনই মজা। ভাইজান, চায়ের ব্যবস্থা কিন্তু এখনো করেন নাই।
আমি বিছানা থেকে নামতে নামতে বললাম, চলো মাজেদা খালার ফ্ল্যাটে যাই। চা-নাশতা সেখানেই হবে।
মাজেদা খালা চোখ কপালে তুলে বললেন, বসার ঘরে কে বসে আছে?
আমি বললাম, অনুমান করো কে?
রবি ঠাকুর নাকি?
হুঁ।
বলিস কী? উনি মারা গেছেন না?
তার ক্লোন। বিজ্ঞানের আবিষ্কার।
বলিস কী? উনার ক্লোন হয়েছে? জানতাম না তো; একটা ভেড়ার ক্লোন হয়েছে জানি, নাম ডলি।
নিজের চোখেই তো দেখলে। পত্রিকা পড়ো না, জানবে কীভাবে? আজকের পত্রিকা পড়েছ? শুরুদেব সম্পর্কে নিউজ থাকার কথা।
খালা বললেন, আমার তো মনে হয় ড্রেস অ্যাজ ইউ লাইক। কেউ রবি ঠাকুর সেজেছে।
আমি বললাম, তুমি জীবনে কখনো ড্রেস অ্যাজ ইউ লাইকে কাউকে রবি ঠাকুর সাজতে দেখেছি? মূর্তি সাজে, মুক্তিযোদ্ধা সাজে। চুড়িওয়ালা, বাদামওয়ালা সাজে। রবীন্দ্ৰনাথ সাজে না।
খালা ফাঁপরে পড়ে গেলেন। আমি বললাম, চা-নাশতার ব্যবস্থা করো খালা। বিখ্যাত মানুষ। চিরতার পানি আছে?
চিরতার পানি দিয়ে কী হবে?
রবি ঠাকুর সকালে নাশতার আগে এক গ্লাস চিরতার পানি খেতেন। ইনিও খান। তবে এক গ্রাস খান না। এক চামচ।
চিরতার পানি এখন কোথায় পাব?
তিতা করলা চিপে রস বের করে এক চামচ দাও। এতেই হবে।
নাশতা কী দেব?
গোশত-পরোটা, ডিমের ওমলেট।
উনি কি গরুর মাংস খান?
অবশ্যই। গরুই এখন উনার প্রধান খাদ্য।
তুই কি কাউকে রবি ঠাকুর সাজিয়ে নিয়ে এসেছিস?
এই কাজটা আমি কেন করব? আমার স্বাৰ্থ কী?
সেটাও একটা কথা।
খালা চিন্তিত মুখে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খালু সাহেবের ঘরে আমার ডাক পড়ল। খালু সাহেব খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাঁর চোখমুখ কঠিন। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। এটা নতুন কিছু না। সবসময় এরকমই থাকে। শুধু যখন কঠিন ডায়েরিয়া হয় তখনই তাঁর চোখমুখ স্বাভাবিক দেখায়। মনে হচ্ছে আজ তিনি ডায়েরিয়ামুক্ত। খালু সাহেবের সামনে একটা ইংরেজি খবরের কাগজ। যেসব বঙ্গভাষী ইংরেজি খবরের কাগজ পড়েন তাদের জাত আলাদা। আমি খালু সাহেবের বাঁ-পাশে রাখা সাইড টেবিলে বসতে বসতে বললাম, কেমন আছেন। খালু সাহেব? ওরস্যালাইন চলছে নাকি চলছে না?
তিনি আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, চেয়ারে বসো। সাইড টেবিল বসার জন্যে না। আর শোনো, ডোন্ট ট্রাই টু বি ফানি। তুমি চার্লি চ্যাপলিন না।
আমি জায়গা বদল করলাম। খালু সাহেব শান্ত গলায় বললেন, তুমি নানাবিধ যন্ত্রণা তৈরি করেছি। বর্তমান যন্ত্রণাটির নাম কী?
আমি বললাম, কোন যন্ত্রণার কথা বলছেন?
সোফাতে শুয়ে সকালবেলা যে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে সে কে?
তার ভালো নাম রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুর। ডাকনাম ছামাদ। ছামাদ মিয়া!
আমার সঙ্গে ফাজলামি করবে না। speak out.
ছামাদ মিয়া রবীন্দ্ৰনাথ সেজেছে। সে আগে একটা চায়ের দোকানের ক্যাশিয়ার ছিল। টাকা চুরির অপরাধে চাকরি গেছে। তবে সে রবীন্দ্রনাথের কসম খেয়ে বলেছে যে, টাকা চুরি করে নি। ছামাদ বাবার উপদেশ মতো তার কাৰ্বরেটর ঠিক রেখেছে। যাদের কার্বুরেটর ঠিক তারা চুরি চামারি করে না। ছামাদের বাবা মোটর মেকানিক। তাঁর মটো হলো—কার্বুরেটর ঠিক থাকলেই সব ঠিক। হে মানব সম্প্রদায়, তোমরা কার্বুরেটর ঠিক রাখে।
অকারণ কথা বলবে না। বদটা রবীন্দ্ৰনাথ সেজেছে কেন?
অল্পকথায় বলব, না ব্যাখ্যা করে বলব?
অল্পকথায় বলো।
সারা পৃথিবীতেই বিখ্যাত ব্যক্তির মতো সাজার প্রবণতা আছে। চার্লি চ্যাপলিনের জীবদ্দশাতেই চার্লি চ্যাপলিন সেজে পাঁচজন ঘুরে বেড়াত। এদের আলাদা করা মুশকিল হতো। আইনস্টাইনের সময়ে তিনজন আইষ্টাইনের ভেক ধরেছিল। এক নকল আইনস্টাইন বিজ্ঞানী নীলস বোরের সঙ্গে দেখা করে বলেছিল—থিওরি অব রিলেটিভিটি বোগাস!। আইনস্টাইনের কথা শুনে নীলস বোরের মাইল্ড স্ট্রোকের মতো হয়েছিল। তিনি বুঝতেই পারেন নি যে নকল আইনষ্টাইনের সঙ্গে কথা হচ্ছে। আমাদের ছামাদও একই পথের পথিক।
খালু সাহেব ইংরেজি খবরের কাগজ চোখের সামনে ধরতে ধরতে বললেন, তোমাকে তিন মিনিট সময় দিলাম। এই তিন মিনিটের মধ্যে তুমি ঐ বস্তু নিয়ে বিদায় হবে। আর কোনোদিন যেন তোমাকে এবং ঐ বস্তুকে আমার ফ্ল্যাটে না দেখি।
আমি বললাম, তিন মিনিটের মধ্যে তো খালু সাহেব বিদায় হতে পারব না। শুরুদেব নাশতা করবেন। দুকাপ চা খাবেন। চা খাবার পর তার পাইখানা ক্লিয়ার হবে। তারপর তিনি যাবেন। উনি আপনার ফ্ল্যাটে এসেছেন পাইখানা ক্লিয়ার করার জন্যে।
খালু সাহেবের হাত থেকে পত্রিকা পড়ে গেল। তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তার চোখে আগুন দাউদাউ করছে। খালু সাহেব সাধু-সন্ন্যাসী পর্যায়ের কেউ হলে তার চোখের আগুনে আমি ভষ্ম হয়ে যেতাম। ভাগ্যিস তিনি সাধু সন্নাসী না। ইংরেজি খবর পড়া বাঙালি সন্তান, যার মাসে দুবার সিরিয়াস ডায়েরিয়া হয়।
You get lost.
আমি মধুর ভঙ্গিতে হেসে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।
টেবিলে নাশতা দেওয়া হয়েছে। মাজেদা খালা এবং তাঁর নতুন কাজের মেয়ে হামিদ পাশেই দাঁড়িয়ে। মাজেদা খালার চোখে কৌতূহল। হামিদার চোখে ভয়। কাজের মেয়েরা কী কারণে জানি ভয় পেতে পছন্দ করে।
গুরুদেব টেবিলে বসে খাবারের উপর ঝাপিয়ে পড়লেন। মাজেদা খালা বললেন, চায়ের কাপে করলার রস। আগে করলার রস খান। গুরুদেব বললেন, করলার রুসের আমি কেঁথা পুড়ি।
মাজেদা খালা এবং হামিদা মুখ চাওয়া-চাওয়ি পর্কের ভেতর দিয়ে গেল। কেঁথা পুড়ি রাবীন্দ্রিক ভাষার মধ্যে পড়ে না।
ছামাদ কাজের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বুয়া?
বুয়া এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, জে স্যার।
চুরি করুবা না খবরদার। কার্বুরেটর ঠিক রাখবা।
বুয়া চিন্তিত গলায় বলল, জে আচ্ছা রাখুম নে।
ঘরে পান আছে না?
জে আছে।
জর্দা দিয়ে পান রেডি রাখো।
মাজেদা খালা ফিসফিস করে বললেন, উনি কি দুপুরে খাবেন? দুপুরে খেলে উনার পছন্দোর খাবার তৈরি করতাম।
আমি বললাম, অন্য কোনো দুপুরে এসে খেয়ে যাব। আজ উনি অনেক জায়গায় যাবেন। খালু সাহেবের গাড়িটা পাওয়া গেলে ভালো হতো। উনার মতো মানুষকে নিয়ে তো রিকশায় করে যাওয়া যায় না। দেখি কী করা যায়।
খালু সাহেব নতুন গাড়ি কিনেছেন—টয়োটা আলাফার্ডে না কী যেন নাম। নিশ্চয়ই দামি গাড়ি। কারণ এই গাড়ি বের করা হয় না। গ্যারেজে জামা গায়ে দিয়ে রাখা হয়। ড্রাইভার মজিদ সপ্তাহে দুইদিন গাড়ির গায়ে কী সব ক্রিম ঘষাঘষি করে।
গুরুদেবকে নিয়ে আমি নিচে নামতেই খালু সাহেবের ড্রাইভার মজিদের সঙ্গে দেখা। আমি বললাম, মজিদ! উনাকে চিনেছ? মজিদ বলল, উনারে চিনব না!! কী বলেন হিমু ভাই। উনার গানের সিডিতে আমার গাড়ি ভর্তি।
মজিদ এগিয়ে এসে পা ছুয়ে কদমবুসি করল। আমি বললাম, নতুন গাড়িটা বের করো। আজ উনাকে নিয়ে ঘুরব। পত্রিকার অফিসে যেতে হবে। ইন্টারভিউএর কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখা দরকার। টিভি চ্যানেলগুলির সঙ্গে কথা বলতে হবে। একটা টকশোর ব্যবস্থা যদি হয়ে যায়। চ্যানেলগুলিতে রান্নারও নানান অনুষ্ঠান হয়; সেখানে উনাকে সেলিব্রেটি হিসাবে উপস্থিত করার চেষ্টা করা যেতে পারে। রান্নার একটা অনুষ্ঠান বাংলার ভর্তা। সেখানে উনি একটা রেসিপি দিতে পারেন—কাঁচকলার খোসার ভর্তা } রান্নার ফাঁকে ফাঁকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে কথা বললেন।
খালু সাহেবের দামি গাড়ি চলছে! আমি বসেছি। ড্রাইভারের পাশে। ছামাদ পেছনের সিটে আয়েসি ভঙ্গিতে বসা। গাড়িতে গান বাজছে। গুরুদেবের গান—
আহা আজি এ বসন্তে
ছামাদ বলল, ভাইজান, বিমানি গান না। হিন্দি ছাড়েন। শামসাদ বেগমের সিডি আছে? উনার একটা গান সঁইয়া দিলমে আনা রে নোবেল প্ৰাইজের যোগ্য। আজেবাজে জিনিস নোবেল পায়। ভালোটা পায় না; আফসোস।
হিন্দি গানের ক্যাসেট খুঁজে পাওয়া গেল না। ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ুয়া বঙ্গসন্তানরা হিন্দি গান শোনেন না। তাঁরা রবীন্দ্ৰ, অতুলপ্ৰসাদ, দ্বিজেন্দ্ৰ গীতিতে নিজেদের আটকে রাখেন।
ভাইজান, আমরা কই রওনা দিলাম?
বুঝতে পারছি না। প্রথম যাচ্ছি কোনো একটা টিভি চ্যানেলের অফিসে। দেখি কিছু করা যায় কি না।
আপনার মতলব তো বুঝতেছি না। মতলব খোলাসা করেন।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, মতলব আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। দেখি কী হয়; প্রথম চেষ্টা টকশো।
ছামাদ বলল, জিনিসটা কী?
কথা বলার অনুষ্ঠান। কথা বলতে পারো তো?
এক বছর বয়স থাইকা কথা বলা ধরেছি। প্রথম কথা কী বলি শুনতে চান?
চাই।
বাপজানের কাছে শুনেছি। আমার প্রথম কথা—ঘাউ।
ঘাউ কী?
ছামাদ দুঃখিত গলায় বলল, জানি না কী। শিশুবয়সে কী ভাইব্যা বলেছি কে জানে। এখনো মাঝে মধ্যে চিন্তা করি–ঘাউ কেন বলতাম। ঘেউ বললেও বুঝতাম। কুকুরের ভাষা। ঘাউটা কী?
ছামাদ চোখ বন্ধ করল। মনে হয় ঘাউ কেন বলত তা-ই ভাবছে। আমি নিজেও চোখ বন্ধ করলাম। আমারও শৈশবে ফেরার চেষ্টা ।
শৈশবে আমার প্রিয় বই ছিল মোহন সিরিজ। দস্যু মোহনের রোমাঞ্চকর কাণ্ডকারখানা। তার মানবসেবা। একটা বইতে পড়লাম দস্যু মোহনকে পদ্মার বুকে লঞ্চের ডেকে ধরা হলো। তাকে বস্তায় ভরে, বস্তার মুখ সেলাই করে পদ্মায় ফেলে লঞ্চ চলে গেল।
এর পরপরই লেখক লিখলেন, তাহার পরে কীভাবে কী ঘটিল কে জানে, দস্যু মোহনকে দেখা গেল পদ্মার পাড়ে বসিয়া হাসিমুখে চুরুট টানিতেছে।
লেখক সম্ভবত দস্যু মোহনকে বস্তার ভেতর থেকে উদ্ধারের কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে কীভাবে কী ঘটিল কে জানের আশ্রয় নিয়েছেন।
ছামাদের বিষয়েও আমি লিখতে পারি–কীভাবে কী ঘটিল কে জানে, ছামাদকে দেখা গেল পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর সঙ্গে একটি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতেছে।
এখনকার পাঠকরা অনেক সচেতন। কাজেই কীভাবে কী ঘটিল কে জানে-তে যাওয়া যাচ্ছে না। কীভাবে ঘটেছে তার ব্যাখ্যায় যেতেই হবে।
ছামাদকে নিয়ে আমি একটি টিভি চ্যানেলের অফিসে ঢুকলাম। চ্যানেলের নাম দিচ্ছি না। তারা মামলা-মোকদ্দমা করে দিতে পারে। ধরা যাক টিভি চ্যানেলের নাম চ্যানেল আঁখি ।
রিসিপশনে এক ট্যারা সুন্দরী বসে আছে। চ্যানেলের মালিকরা তাদের সব আত্মীয়স্বজনকে চ্যানেলে চাকরি দেন। এই রূপসী ট্যারার অন্য কোথাও কিছু হচ্ছিল না বলেই মনে হয় এখানে কাজ পেয়েছে।
ট্যারার কার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে বােঝা কঠিন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তার সময় জটিল অস্বস্তিতে থাকতে হয়। তরুণী আমাকে কিংবা ছামাদকে বিরক্ত মুখে বলল,আলাপচারিতা অনুষ্ঠানে এসেছেন?
আমি বললাম, জি ম্যাডাম। উনি এসেছেন, আমি স্যারের পিএ।
এত লেট করেছেন! অনুষ্ঠান। মন্ত্রী মহােদয় বসে আছেন। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। দর্শকরা সরাসরি টেলিফোন করছেন। এক্ষুনি চলে যান চার নম্বর স্টুডিওতে।
আমি বললাম, চার নম্বর স্টুডিও তো চিনি না।
রিসিপশনিস্ট বলল, আসুন আমার সঙ্গে।
মহিলা ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে, আমরাও তার পেছনে ছুটছি।
এর মধ্যে মহিলা মোবাইল টেলিফোনে কাকে যেন বলল, সমুদ্র স্যার। উনি চলে এসেছেন। আমি নিয়ে যাচ্ছি। সিচুয়েশন আন্ডায় কনট্রোল।
স্টুডিওতে আমি ঢুকতে পারলাম না। বাইরে বসে রইলাম। যেখানে বসে আছি সেখানে এক বিশাল ফ্ল্যাটস্ক্রিন টিভি। টিভিতে দেখছি রূপবতী হাস্যমুখী এক উপস্থাপিকা। শুধু তার ঠোঁট কুচকুচে কালো। আজকাল কালো লিপষ্টিকের চল হয়েছে। দেখেই মনে হয় বিড়ি খাওয়া মহিলা। উপস্থাপিকার পাশে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়। উনি বেঁটে এবং স্থূলকায়। পায়জামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে মুজিবকোট পরেছেন। মুজিবকোট বঙ্গবন্ধুকেই মানায়। এই কোট বেঁটে এবং মোটারা পরলে তাদের লাগে পেঙ্গুইন পাখির মতো। মন্ত্রী মহোদয়ের পাশে হাস্যমুখী ছামাদ। বাকি ঘটনা নিম্নরূপ।
উপস্থাপিকা : যানজটের কারণে আমাদের একজন অতিথির অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে সামান্য বিলম্ব হয়েছে। তার জন্যে দর্শকমণ্ডলির কাছে আমরা ক্ষমা প্রার্থনা করছি। অতিথির পরিচয় দিচ্ছি, তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশ বিজ্ঞানী ডা. সালাত হোসেন খান। কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত পরিবেশ।..
ছামাদ : ম্যাডাম, সামান্য মিসটেক হয়েছে। আমার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে রবিদা বলতে পারেন।
[মন্ত্রী মহোদয় এবং উপস্থাপিকার মুখ চাওয়াচাওয়ি। উপস্থাপিকার মুখের হাসি নিভে গিয়েছিল, তিনি অতিন্দ্রকৃত সেই হাসি নিয়ে এলেন।]
উপস্থাপিকা : আপনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানে! কোন রবীন্দ্রনাথ?
ছামাদ : তালগাছ রবীন্দ্ৰনাথ। তালগাছ উঁকি মারে আকাশে। যদিও ইহা সম্ভব নহে। তালগাছের চক্ষু নাই। আপু, ঐ গানটা কি শুনেছেন—ও আমার চক্ষু নাই রে?
মন্ত্রী মহোদয় : What is happening? Who is this person?
ছামাদ : (মুখভর্তি হাসি। পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করতে করতে) আপু, এখানে কি বিড়ি খাওয়া যাবে? (মন্ত্রী মহোদয়ের দিকে বিড়ির প্যাকেট বাড়িয়ে) স্যার, একটা টান দিয়া দেখেন মাথায় কেমুন চক্কর দেয়।
(রিং বাজছে)
উপস্থাপিকা : (এখনো মুখভর্তি হাসি) দর্শকদের একজন টেলিফোন করেছেন। ভাই, আপনি আপনার বাসার টিভি সেটের সাউন্ড কমিয়ে দিন। এখন বলুন আপনার নাম কী?
দর্শক : নূরে আলম।
উপস্থাপিকা : আপনি কোত্থেকে টেলিফোন করেছেন?
দর্শক : মগবাজার।
উপস্থাপিকা : মগবাজার থেকে জনাব নূরে আলম টেলিফোন করেছেন। আপনি কার সঙ্গে কথা বলতে চান?
দর্শক : গুরুদেবের সঙ্গে।
রবিদা, ভালো আছেন?
ছামাদ : ভালো আছি।
দর্শক : আপনি রিয়েল না ফলস?
ছামাদ : (বিড়ি ধরানোর চেষ্টা করছেন বলে জবাব দিতে পারছেন না।)
মন্ত্রী মহোদয় : প্রচার বন্ধ হচ্ছে না কেন?
দর্শক : রবিদা, আপনার পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল কেন?
ছামাদ : ভাই, চটিজুতা খরিদ করতে পারি নাই। এখান থেকে বের হয়ে খরিদ করব ইনশাল্লাহ।
মন্ত্রী মহোদয় : অনুষ্ঠান এক্ষুনি বন্ধ করা প্রয়োজন। সমুদ্র কোথায়? সমুদ্র।
ছামাদ : স্যার সমুদ্র কক্সবাজারে। এখানে সমুদ্র কই পাবেন!
উপস্থাপিকা : (মুখের হাসি আরো বিস্তৃত) কারিগরি ত্রুটির কারণে আলাপচারিতা অনুষ্ঠানটি এখন প্রচার করা যাচ্ছে না বলে আমরা দুঃখিত। দর্শকদের জানাচ্ছি শুভেচ্ছা।
অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হলো ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠানের ফিলার। কাকতালীয়ভাবে সেই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে নাচ হচ্ছে। বর্ষার গান—আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে। নাচছেন অভিনেত্রী তানিয়া। ছবির নাম নয় নম্বর বিপদ সংকেত।
আমি মুগ্ধ হয়ে নাচ দেখছি। ঘরে পাঞ্জাবি পরা এক লোক ঢুকেছেন। তিনি ক্ষুব্ধ গলায় বলছেন, রবীন্দ্রনাথকে কে নিয়ে এসেছে খুঁজে বের করো। স্যাবোটাজ হয়েছে। বিরাট স্যাবোটাজ। পুলিশে কি খবর দেওয়া হয়েছে?
চারদিকে ছোটাছুটি হচ্ছে। এখন আর চ্যানেলের অফিসে থাকা সমীচীন নয় বলে কেটে পড়ার প্রস্তুতি নিলাম। য পলায়তি স জিবতী।
কেটে পড়া সম্ভব হলো না। রিসিপশনের মেয়েটি বলল, আপনি রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুরের পিএ না?
জি।
আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
ম্যাডাম চলে যাচ্ছি। গুরুদেবকে রেখে গেলাম। টকশোতে সামান্য ঝামেলা হয়েছে। তাতে সমস্যা নেই, অন্য যে-কোনো অনুষ্ঠানে তাকে ঢুকিয়ে দিতে পারেন। আপনাদের একটা অনুষ্ঠান আছে না— জাপানি রান্না? শুরুদেব জাপানি রান্নায় আগ্ৰহী। তাঁর একটা বই আছে জাপান যাত্রীর পত্র, সেখানে…
কথা বলবেন না। এবং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। পুলিশ আসছে। আপনারা দুজনই থানায় যাবেন।
আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ম্যাডাম কাজটা কি ভালো হবে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রেফতার—শুনতেও খারাপ। আপনাদের চ্যানেলে গ্রেফতার হয়েছেন এটা আপনাদের জন্যে ব্যাড় পাবলিসিটি।
কথা শেষ হওয়ার আগেই পুলিশ চলে এল। আমাদের তিনজনের স্থান হলো ধানমণ্ডি থানার হাজতে। আমি, ছামাদ এবং খালু সাহেবের ড্রাইভার মজিদ। মজিদ হতভম্ব। এটাই নাকি তার প্রথম হাজত খাটা।
মজিদ বারবার বলছে, আমারে কেন পুলিশ ধরল! আমি করেছি। কী? আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার বাবা ভুরুঙ্গামারীতে যুদ্ধ করেছেন।
ছামাদ বলল, ভুরুঙ্গামারী জায়গাটা কোথায়?
মজিদ বিরক্ত গলায় বলল, আমি জানব কীভাবে? যুদ্ধ তো আমি করি নাই। আমার বাবা করেছেন।
আপনার বাবা যেখানে যুদ্ধ করেছেন সেখানে আপনি যাবেন না? দেখে আসবেন না? আপনার তো কার্বুরেটর ঠিক নাই।
আমার আবার কার্বুরেটর কী? আমি গাড়ি নাকি? আপনি রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন বলে যা মন চায় বলবেন?
আমি যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি। এই গুণটি আমি ছামাদের মধ্যেও দেখলাম। দেয়ালে হেলান দিয়ে সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বিড়ি টানছে। মজিদ অস্থির। সে হাঁটাহাঁটি করছে। একটু পরপর বলছে, কী করি কন তো?
পুলিশ কনস্টেবলদের একজন পুরোপুরি বিভ্রান্ত। লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। চলে যায় আবার আসে। এক পর্যায়ে সে নিজের কৌতূহল সামলাতে না পেরে আমাকে বলল, দাড়িওয়ালা উনার পরিচয় কী?
আমি বললাম, উনার নাম রবীন্দ্ৰনাথ।
বিশ্বকবি?
হুঁ।
উনার মতো মানুষ হাজতে। কী অবস্থা! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একবার দেখলাম সব বিশিষ্টজন গ্রেফতার। হাসিনা আপা, খালেদা ম্যাডাম। এখন বিশ্বকবি হাজতে। উনি করেছেন কী?
অভিযোগ এখনো তৈরি হয় নাই। টিভি চ্যানেলে হামলা জাতীয় কিছু হবে।
উনি বিড়ি টানতেছেন দেখে মনটা দেওয়ানা হয়েছে। সাধারণ কেউ তো না। বিশ্বকবি। জিজ্ঞেস করেন তো উনি চা খাবেন কি না।
আপনি নিজেই জিজ্ঞেস করুন।
পুলিশ কনস্টেবল বিনীত গলায় বলল, কবি সাব, চা খাবেন? চা এনে দেই?
ছামাদ তার দিকে তাকিয়ে বলল, ঘাউ।
পুলিশ কনস্টেবল লাফ দিয়ে সরে গেল।
শুরু হলে আমাদের হাজত বাস।
ওসি সাহেবের খাস কামরায়
আমরা তিনজন ওসি সাহেবের খাস কামরায়, তার মুখোমুখি বসেছি। ওসি সাহেবের চেয়ারটা মনে হয় নতুন কেনা হয়েছে। গদির সঙ্গে লাগানো পলিথিনের ঢাকনা এখনো খোলা হয় নি। চেয়ারটা রিভলভিং। ওসি সাহেব অস্থির প্রকৃতির। সারাক্ষণই চেয়ার ঘোরাচ্ছেন। একবার এদিকে তাকাচ্ছেন, পরমুহূর্তেই সাঁই শব্দে চেয়ার ঘুরে যাচ্ছে।
ওসি সাহেবের বাঁ পাশে সিভিল ড্রেসে একজন বসে আছেন। তার হাতে ওয়াকিটকি। এতে বোঝা যাচ্ছে তিনিও পুলিশের একজন। তার মুখভর্তি বসন্তের দাগ। এই ধরনের খাবলা খাবলা মুখ আজকাল আর দেখা যায় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে অনেক ইস্টারেস্টিং বিষয় থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।
ওসি সাহেবের হাতেও ওয়াকিটকি। তিনি বিরক্তমুখে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। এর মধ্যে মজিদ বলল, স্যার আমি একজন জেনুইন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার পিতা ভুরুঙ্গামারিতে ফাইট করেছেন। উনার সাখীরা সবাই মারা পড়েছেন। আমার পিতাও মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন।
ওসি সাহেব হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, আমি একজনের সঙ্গে কথা বলছি দেখস না বদমাইশ? থাপ্পড় খেতে চাস? পুলিশের থাপ্পড় কখনো খেয়েছিস?
জি-না স্যার।
বিড়বিড় করছিস কী জন্যে?
দোয়া পড়তেছি স্যার। দোয়ায়ে ইউনুস। ইউনুস নবী মাছের পেটে এই দেয়া পড়ে খালাস পেয়েছিলেন।
মনে মনে পড়, ঠোঁট নাড়বি না। ঠোঁট নড়লে সুই দিয়ে ঠোঁট সিলাই করে দেব।
ঠোঁট আর নড়বে না স্যার। I Promise.
ওসি সাহেব ওয়াকিটকি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার গলা দিয়ে বুলন্দ আওয়াজ বের হচ্ছে। তিনি মাঝে মাঝে চেয়ারটা পুরোপুরি ঘোরাচ্ছেন। ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেল পূর্ণ করছেন। তিনি যে মজা পাচ্ছেন তা বোঝা যাচ্ছে। উনার নাম নাজমুল হুদ। প্লাষ্টিকের লেখা নাম। পকেটের উপর লাগানো। হুদ কারও নাম হতে পারে না। আরবের এক পাখির নাম হুদ। মনে হয় হুদা নাম। আকার পড়ে গেছে।
নাজমুল হুদ ওয়াকিটকি মুখের কাছে নিয়ে বললেন, স্যার এখন আপনি ডিসিশান দিন—এই তিনটাকে নিয়ে আমি কী করি। মন্ত্রী মহোদয়ের টেলিফোন পেয়ে ছুটে গেছি। তিনটাকে ধরে নিয়ে এসেছি। এখন কী? চ্যানেল আঁখির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা কোনো মামলা করবে না বলে জানিয়েছে।
মন্ত্রী মহোদয়ের পিএস-এর সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন, স্যার কিছুই বলবেন না। উনি কোনো দায়িত্বও নিবেন না। প্রথমবার মন্ত্রী হয়েছেন তো, কোনো ঝামেলা চান না। তিনি মিডিয়ার ভয়ে অস্থির। তাঁর সংবর্ধনার জন্যে অঞ্চলে ১৮৩টি তোরণ করা হয়েছিল। মিডিয়ায় সেই খবর চলে আসার পর থেকে তিনি মিডিয়া ভয় পান। এখন স্যার আপনি একটা ডিসিশান দিন। জি স্যার, আপনার কথা বুঝতে পারছি। Over.
বসন্তের দাগওয়ালা বিরক্ত মুখে বললেন, আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন বুঝলাম না। হাজতে থাকুক, সকালে কোর্টে চালান করে দিব। এখন পর্যন্ত তো ডলাও খায় নাই। পুলিশের হাতে ধরা খেয়েও ডিলা ছাড়া পার হবে এটা ঠিক না। পুলিশের উপর থেকে পাবলিকের ভয় চলে যাবে। রাতে আমার হাতে ছেড়ে দেন, পাকিস্তানি ডলা দিয়ে সকালবেলা কেটে চালান করে দেব।
কোটে যে চালান করবেন চার্জ কী?
একটা কিছু দিলেই হয়। উলফা কানেকশন, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা। উলফায় যেতে না চান, উদীচী বোমা হামলা আছে। আমাদের হাতে জিনিসের তো অভাব নাই।
নাজমুল হুদ বললেন, এদের সামনে এই আলোচনাটা না করলে ভালো হয়।
বসন্তওয়ালা বিরস মুখে বললেন, ডলা ঠিকমতো পড়লে আলোচনা কিছুই মনে থাকবে না।
পাকিস্তানি ডলা, পাকিস্তানি ডলা বলছেন। জিনিসটা কী?
সেভেনটিওয়ানে অনেকে এই ডলা খেয়েছে। উপরের চামড়া টাইট থাকে, ভিতরের হাড্ডি ছাতু হয়ে যায়।
না না, আমার থানায় এইসব চলবে না।
বসন্ত দাগওয়ালা হতাশ হয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছেন। কিছু মানুষ অল্পতেই হতাশাগ্রস্ত হয়।
নাজমুল হুদ ছামাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই তুই রবি ঠাকুর সেজেছিস কী জন্যে?
ছামাদ বলল, ঘাউ!
ওসি সাহেব কিছুক্ষণের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সম্ভবত রবিঠাকুরের কাছ থেকে তিনি ঘাউ আশা করেন নি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তুই কী বললি?
ছামাদ বলল, ঘাউ। এবারের ঘাউ আগের চেয়েও জোরালো। বসন্তের দাগওয়ালা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। তিনি মেরুদণ্ড সোজা করে বসলেন। তার চোখে মুখের ভঙ্গি বলছে—খাইছি তোরে। পাকিস্তানি ডলা কামিং।
ওসি সাহেব বললেন, তুই যদি আরেকবার ঘাউ বলিস, তাহলে আমার হাতের ব্যাটনটা তোর মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে দেব। মুখ ছাড়া অন্য কোনো জায়গা দিয়ে চুকাতে বলতাম। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করেছি বলে বলতে পারছি না। মুখে বাঁধছে।
আমি গলাভর্তি আনন্দ নিয়ে বললাম, স্যার আপনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ?
নাজমুল হুদ বললেন, তাতে তোর কোনো সমস্যা?
জি-না স্যার।
এমএ-তে শেষ না; কবি রবার্ট ফ্রাস্টের উপর এমফিল করেছি। বিশ্বাস হয়?
আমি বললাম, বিশ্বাস হয় না স্যার।
নাজমুল হুদ হতাশ গলায় বললেন, আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না।
মজিদ বলল, আমার বিশ্বাস হয় স্যার। আপনারে দেখলেই বুঝা যায় আপনি বিরাট জ্ঞানী। আপনার চোখেমুখে জ্ঞান।
তোরে না বললাম ঠোঁট নাড়াবি না। ঠোঁট নাড়ালি কোন সাহসে?
স্যার ভুল করেছি। মাফ করে দেন। আর একটা কথা যদি বলি তাহলে মাটি খাই।
নাজমুল হুদ তাকালেন ছামাদের দিকে। কঠিন গলায় বললেন, যা জিজ্ঞেস করব জবাব দিবি। ঘাউ করবি না!
ছামাদ বলল, ঘাউ করব না স্যার। ঘাউ করলে আমিও মাটি খাই।
তুই থাকিস কোথায়?
আগে গোরানে থাকতাম। তিন কাঠা জমির উপরে বাপ একটা দোতলা বাড়ি করেছিলেন। সেই বাড়ি ছাত্রলীগের কংকন ভাই দখল করেছেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু জ্ঞান বিকাশ কেন্দ্র খুলেছেন।
জ্ঞান বিকাশ কেন্দ্রে কী হয়?
উনারা ক্যারাম খেলেন, তাশ খেলেন। গল্পগুজব করেন। সন্ধ্যার পর লাল পানি খান বলে শুনেছি। নিজের চোখে দেখি নাই। শোনা কথায় বিশ্বাস করা ঠিক না।
ছামাদের কথায় ওসি সাহেবের মনে হলো মন সামান্য নরম হয়েছে। তার গলা উঁচু পর্দা থেকে মধ্যমপর্দায় নেমে এল। তিনি বললেন, বাড়ির দখল নেওয়ার চেষ্টা করিস নাই?
একটা মামলা করেছিলাম। পরের দিন মামলা তুলে নিয়ে কংকন ভাইয়ের পায়ে ধরে মাফ চেয়েছি। উনার হাতে চুমু খেয়েছি।
হাতে চুমু খেয়েছিস কেন?
পুরুষ মানুষ, এইজন্যে হাতে চুমু খেয়েছি স্যার।
চা খাবি?
খাব স্যার। আপনায় অসীম দয়া।
ওসি সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, রবীন্দ্রনাথ সেজে আর খবরদার ঝামেলা করবি না। চা খেয়ে বিদায় হয়ে যা।
জি আচ্ছা।
বসন্তু দাগওয়ালা বললেন, কাজটা আপনি ঠিক করছেন না স্যার। পরে বিপদে পড়তে পারেন। র্যাবের হাতে দিয়ে দিন ক্রসফায়ারে ঝামেলা শেষ করে দিবে। ওদের কাজকর্ম আমার পছন্দ। ধর তক্তা মার গ্যাজাল।
ওসি সাহেব অন্যমনস্ক গলায় বললেন, তাও করা যায়।
ছামাদ বলল, চা লাগবে না স্যার। যদি অনুমতি দেন। আমরা আপনাকে কদমবুসি করে এখনই চলে যাই।
নাজমুল হুদ বললেন, কদমবুসি করতে হবে না। চলে যা। আর শোন, তুই তুই করে বলেছি বলে কিছু মনে নিবি না। পুলিশে চাকরি করার কারণে ভদ্রতা গেছে। অথচ এই আমি একসময় এমফিল করেছি। রবার্ট ফ্রাস্টের উপর।
Woods are lovely dark and deep
And I have promised to keep
And miles to go before sleep.
আমরা তিনজন একসঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। থানার গেট থেকে বের হয়ে তিনজন তিনদিকে হাঁটা। রবীন্দ্রনাথ প্ৰথমে কিছুক্ষণ গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটছিলেন। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঝেড়ে দৌড় দিলেন। বাঙালির স্বভাব হলো কাউকে দৌড়াতে দেখলে তার পেছনে পেছনে দৌড়াবে। দুইজন টোকাই এবং একজন মধ্যবয়স্ক লুঙ্গিপরা মানুষকে তার পেছনে পেছনে দৌড়াতে দেখলাম।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মজিদও দৌড়াচ্ছে। তার পেছনে কেউ নেই। সে দৌড়াতে দৌড়াতে এক চলন্ত বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে পড়ল। বেচারা ভালো ভয় পেয়েছে।
কোথায় যাওয়া যায় বুঝতে পারছি না। হাজতবাসের জন্যে প্ৰস্তৃত ছিলাম। হাজতবাস হচ্ছে না বলে সিস্টেমে গণ্ডগোল হয়ে গেছে। হাজাতের কাছাকাছি কোথাও রাত কাটাতে ইচ্ছা করছে। এই সমস্যা সবারই হয়। ফাঁসির এক আসামিকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গলায় দড়ি পরাবার আগে আগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণায় খবর চলে এল। জেলার তার পাছায় লাথি দিয়ে বললেন, যা বাড়ি চলে যা। সে বাড়ি গিয়ে ফ্যানের সঙ্গে লাইলনের দড়ি লাগিয়ে ঝুলে পড়ল। খেল খতম ফাঁসি হজম।
কটা বাজে জানা দরকার। ঘড়ি দেখে ঠিক করতে হবে রাতটা কোথায় কাটাব। মেসে যেতে ইচ্ছা করছে না। রাত যদি এগারোটার কম হয় তাহলে বাদলের কাছে চলে যাব। এগারোটার বেশি হলে ধানমণ্ডি থানায় ফিরে গিয়ে ওসি সাহেবকে বলব, স্যার সাতটা হাজতে থাকতে দিন। আপনার পায়ে ধরি। I touch your foot.
আজকাল হাতঘড়ির চল উঠে গেছে। সময় জিজ্ঞেস করলে লোকজন বিরক্ত হয়। কারণ সময় জানতে তাকে মোবাইল ফোন বের করে টেপা টিপি করতে হয়। সময় ঘড়ির কাছ থেকে চলে গেছে মোবাইল ফোন সেটের কাছে।
লাইটপোস্টের কাছে মোটামুটি উদাস দৃষ্টির এক ভদ্রলোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেলাম। বিনীত গলায় বললাম, ভাই, কয়টা বাজে?
ভদ্রলোক বললেন, সঙ্গে ঘড়ি নাই।
মোবাইল সেটটা দেখে বলুন কয়টা বাজে।
মোবাইল ফোন সেট নাই। চুরি গেছে।
ভদ্রলোকের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার ফোন বেজে উঠল। তিনি বিন্দুমাত্র লজ্জিত বোধ করলেন না। উঁচুগলায় কথাবার্তা চালাতে লাগলেন।
আফতাব? ভালো আছ? আমি ঢাকায় না তো। ঢাকায় থাকলে অবশ্যই তোমার সঙ্গে দেখা করতাম। আমি এখন রাজশাহীতে। সপ্তাহখানিক থাকব। হ্যাঁ, তোমার বিপদের কথা শুনেছি। সো স্যাড।
আমি ভদ্রলোকের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। মোবাইল ফোনের কারণে তিনি ঢাকায় থেকেও রাজশাহীতে অবস্থান করতে পারছেন। এটাকে বিজ্ঞানের পশ্চাৎযাত্ৰা বলা যেতে পারে।
টেলিফোনে ভদ্ৰলোকের কথাবার্তা থেকে আন্দাজ করছি, তিনি আফতাব সাহেবের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছিলেন। টাকা আজই ফেরত দেওয়ার কথা। তিনি টাকার ব্যবস্থাও করেছেন, রাজশাহীতে থাকার কারণে দিতে পারছেন না।
ভদ্রলোক টেলিফোন শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কী চান?
সময় জানতে চাই।
অন্য কারও কাছ থেকে জানেন। ফালতু ঝামেলা।
আফতাব ভাই আপনার কাছে কত পায়?
হোয়াট?
উনি বিপদে আছেন, টাকাটা ফেরত দেওয়া উচিত না? আপনি যখন বিপদে পড়েছিলেন তখন আফতাব ভাই ঠিকই আপনাকে সাহায্য করেছে।
আপনি তাকে চিনেন?
অবশ্যই চিনি। আমি আপনাকেও চিনি।
ভদ্ৰলোক হকচকিয়ে গেলেন। তার মধ্যে আমতা আমতা ভাব চলে এল। এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। আমি রিকশা থামিয়ে ভদ্রলোককে বললাম, আসুন যাই।
কোথায় যাব?
আফতাব ভাইয়ের কাছে যাই। উনাকে টাকাটা দিয়ে আসি।
পুরা টাকা তো আমার সঙ্গে নাই। অল্প আছে।
যা আছে তা-ই দিন। বাকিটা দুই দিন পরে দিবেন। দেরি করবেন না। রিকশায় ওঠেন। রিকশা কোথায় যাবে বলে দিন।
ভদ্রলোক বিরসমুখে রিকশায় উঠে এলেন।
রিকশায় করে আমরা চলে এলাম। কলাবাগানে। সারা পথই ভদ্রলোক উসখুস করতে লাগলেন। একবার মনে হলো। উনি চলন্ত রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়বেন। আমি শক্ত করে তার পাঞ্জাবি চেপে ধরলাম। নেমে গেলে পাঞ্জাবির অর্ধেকটা আমার হাতে রেখে নামতে হবে। ভদ্রলোক এই রিস্ক নিবেন বলে মনে হয় না। পাঞ্জাবিটা দামি।
পাঞ্জাবি ধরে আছেন কেন?
রিকশায় চড়লে আমার কিছু একটা ধরে থাকতে হয়। কিছু ধরে না থাকলে ভয় লাগে। মনে হয় পড়ে যাব।
হুড ধরে রাখুন।
হুড ধরে একবার ক্যাঁচা খেয়েছি, এইজন্যে হুড় ধরি না। আফতাব ভাইয়ের কাছ থেকে কত টাকা ধার করেছিলেন?
আপনার তা দিয়ে দরকার কী? পাঞ্জাবিটা ছাড়েন তো।
পাঞ্জাবি ছাড়ব না।
কলাবাগানে ঢোকার কয়েকটা গলি। একটার সামনে এসে ভদ্ৰলোক রিকশা থামালেন। আমি বললাম, গলিতে ঢুকব না? ভদ্রলোক ইশারায় দেখালেন এবং গলা নামিয়ে বললেন, আফতাব বসে আছে। চায়ের দোকানের সামনে।
মেয়ে দুটা কে?
তারই মেয়ে। বাবার সঙ্গে থাকে। একজনের নাম কেয়া আরেকজনের নাম
আরেকটা মেয়ে হলে তো বিপদে পড়ত, নাম রাখতে হতে গেয়া।
ভদ্ৰলোক রিকশা ভাড়া মিটালেন এবং কিছু বোঝার আগেই গলির ভেতর ঢুকে গেলেন। এতক্ষণ পাঞ্জাবি ধরে থাকা বৃথা গেল। পুরনো দিনের গদ্যের ভাষায়–চক্ষের নিমিষে পক্ষি উড়িয়া গেল।
আফতাব দুই মেয়েকে নিয়ে বসে আছেন চায়ের দোকানের সামনের ফুটপাতে। ফুটপাত রাস্তা থেকে উঁচু। তিনজনই পা বুলিয়ে বসেছে। হিসাবমতো মেয়ে দুটির বসার কথা বাবাকে মাঝখানে রেখে বাবার দুপাশে। তারা সে রকম করে নি। দুইবোন হাত ধরাধরি করে একসঙ্গে বসা। বড় মেয়েটির বয়স ৬/৭ হবে। ছোটটি ৪/৫। দুটা মেয়েই ফুটফুটে। আমি এগিয়ে গেলাম। অতি পরিচিত কেউ এমন ভঙ্গিতে বললাম, কেয়া-খেয়া, এত রাতে রাস্তায় বসে আছ কেন? সমস্যা কী?
তিনজনই চমকে তাকাল। আমি মেয়ে দুটির পাশে বসতে বসতে বললাম, বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে নাকি?
কেয়া বলল, হ্যাঁ বের করে দিয়েছে।
আমি বললাম, ঘটনা কী বলো? অল্প কথায় বলবে, ডিজিটাল যুগে অল্প কথা বলতে হয়।
কেয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল তাকে থামিয়ে তার বাবা বলল, আপনাকে চিনলাম না। আপনার পরিচয়?
আমার নাম হিমু। আমি এই মেয়ে দুটার মামা হই। আপনার নাম আফতাব?
হ্যাঁ। কিন্তু এখনো আমি আপনাকে চিনলাম না।
আমি বললাম, চেনাচিনি পরে। আগে আপনাদের ঘটনা শুনি। এত রাতে আমার দুই ভাগ্নি রাস্তায় বসা-এর মানে কী? এরা কি রাতে খাওয়াদাওয়া করেছে?
মেয়ে দুজন একসঙ্গে বলল, না। ছোট মেয়েটা বলল, মামা! বাবার কাছে টাকা নাই।
আমি বললাম, টাকা না থাকলেও খাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কেয়া মা এবং খেয়া মা, বলো কী খেতে চাও? পোলাও, মুরগির রোস্ট, সঙ্গে ডিম ভুনা—চলবে?
দুজন আবারও একসঙ্গে বলল, চলবে।
খাবারের সঙ্গে কোক বাঁ পেপসি এইসব কিছু লাগবে? কেয়া বলল, আমি খাব সেভেন আপ। খেয়া বলল, আমি ফান্টা।
আমি বললাম, খাওয়ার প্রবলেম সেটেল হয়ে গেল। এখন আফতাব ভাই, আপনার প্রবলেম শুনি। বাড়ি ভাড়া দিতে পারেন নাই বলে বহিষ্কার?
আফতাব বলল, মেয়ে দুটিার সামনে বলতে চাচ্ছি না।
আমি বললাম, এদের সামনেই বলতে হবে। বাচ্চাদের সমস্যা থেকে দূরে রাখা যাবে না। এরা বড় হবে সমস্যার মধ্যেই।
আফতাব আমাকে হাত ধরে চায়ের দোকানের কাছে নিয়ে গলা নিচু করে সমস্যা বললেন।
সমস্যা জটিল না, সাধারণ সমস্যা। আফতাব একজনের সঙ্গে সাবলেট থাকতেন। ছমাসের ভাড়া বাকি পড়ায় এই অবস্থা। ছমাস ধরে আফতাবের চাকরিও নাই। এক কনষ্ট্রাকশান কোম্পানিতে কাজ করত। রড চুরির দায়ে চাকরি চলে গেছে।
রড চুরি করেছেন?
হুঁ।
এই প্রথম চুরি করেছেন না। আগেও করেছেন?
আগেও করেছি; ফর্মেসিতে যখন চাকরি করতাম তখন করেছি। বড় চুরি না, ছোটখাটো চুরি।
রড চুরিটাই বড়? নাকি এরচেয়ে বড় কিছু আছে? ঝেড়ে কাশেন, ঝেড়ে না। কাশলে হবে না।
আফতাব বিড়বিড় করে বললেন, একবার একটা NGO-তে চাকরি করতাম। তখন নতুন মোটরসাইকেল চুরি করে বেচে দিয়েছি।
আপনি তো কামেল আদমি। রড দুজনে মিলে চুরি করেছিলাম। হাফ টন রড। অন্যজনের চাকরি আছে। তার প্রমোশনও হয়েছে। বাদ দেন তার কথা, বাচ্চা দুটাকে আপনি এক রাতের জন্যে রাখতে পারবেন? আমার উপকার হয়। নারায়ণগঞ্জে একজনের কাছে কিছু টাকা পাই, টাকাটা উদ্ধার করতে পারি।
এত রাতে নারায়ণগঞ্জ যাবেন?
গভীর রাত ছাড়া তাকে পাওয়া যাবে না। সে বাড়িতে ঢেকে রাত একটার পর।
তাহলে যান। এরা থাকুক আমার সঙ্গে।
ধার হিসেবে একশ টাকা দিতে পারবেন?
পারব। একশ টাকার একটা নোটিই আমার কাছে আছে। নিয়ে যান।
আফতাব চলে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, অচেনা অজানা একজনের কাছে মেয়ে দুটা রেখে যাচ্ছেন। আপনি কী রকম বাবা?
আফতাব আবার বসে পড়ল। ছোট মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মামা, আমরা কখন পোলাও খাব?
আমি বললাম, তোমার বাবা নারায়ণগঞ্জে যখন রওনা হবে। আমরাও তখন পোলাও খেতে রওনা হব।
ছোট মেয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা তুমি যাও না কেন?
আমি বললাম, আফতাব, আমি পাকেচক্রে এখানে উপস্থিত হয়েছি। বাচ্চা দুটাকে সাহায্য করার জন্যে। প্রায়ই দেখা গেছে মহাবিপদে যারা পড়ে তাদের মাঝে মাঝে উদ্ধারের ব্যবস্থা প্রকৃতি করে। বাচ্চা দুটাকে নিয়ে আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নাই। তাদের কোথায় নিয়ে যাব তা এখনো জানি না, কাজেই আপনাকে ঠিকানা দিতে পারছি না। ধানমণ্ডি থানায় আমি বাচ্চা দুটা কোথায় আছে জানিয়ে রাখব। সেখানে গেলেই খোঁজ পাবেন।
ছোট মেয়েটা বলল, মামা! আমরা খেতে যাব না?
যাব। এখনই যাব।
এখনো জানি না কোথায় যাব। আশেপাশেই কোথাও যেতে হবে, দূরে যাওয়া যাবে না। তোমরা হাঁটতে পারবে না। আর আমার সঙ্গে টাকাও নেই যে রিকশা করে নিয়ে যাব।
বাবা যাবে না?
না।
আমরা একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়ির নাম কমলকুটির। গেটে ধাক্কাধাক্কির শব্দ শুনে লুঙ্গি পরা গেঞ্জি গায়ে এক বৃদ্ধ বের হলেন, বৃদ্ধ অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার?
আমি বললাম, স্যার বাই এনি চান্স, আজ কি আপনার বাসায় পোলাও এবং মুরগির রোস্ট রান্না হয়েছে? সঙ্গে ভুনা ডিম। বাচ্চা দুটা এই খাবার ছাড়া অন্য কিছু খাবে না।
হু আর ইউ?
আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম হিমু। বড় মেয়েটার নাম কেয়া, ছোটটার নাম খেয়া।
রাত বারোটার সময় পোলাও রোস্ট? ফাজলামির একটা সীমা থাকা দরকার। আমি কি আপনার পরিচিত?
জি না।
রাত বারোটার সময় কারও বাড়ির দরজা ভেঙে ফেলে খাবার চাওয়া যায়?
অবশ্যই যায় না।
আপনাকে পুলিশে দেওয়া উচিত।
এত জোরে চিৎকার করবেন না। স্যার। ছোট বাচ্চাটা ভয় পাচ্ছে।
হৈচৈ শুনে এক বৃদ্ধ বের হয়ে এসেছেন। বৃদ্ধর পাশে দাঁড়িয়েছেন। বৃদ্ধার মনে হয়। কঁচা ঘুম ভেঙেছে। তিনি ভয়ে অস্থির হয়ে বললেন, কী হয়েছে?
বৃদ্ধ বললেন, উটকা নুইসেন্স। কিছু হয় নাই। ঘুমাতে যাও।
বৃদ্ধ বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করলেন। খেয়া বলল, মামা! আমার ভয় লাগছে।
আমি বললাম, ভয়ের কিছু নাই। ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে থাক। এক্ষুনি দরজা খুলবে। এক থেকে একশ পর্যন্ত গুনতে থাক, এরমধ্যে দরজা খুলবে।
খেয়া একত্রিশ পর্যন্ত গোনার সময় দরজা খুলল। বৃদ্ধ গভীর গলায় বললেন, খেতে আসো।
আমি বললাম, আপনি অতি কঠিন এক প্রশ্ন করে বসেছেন যার উত্তর কেউ জানে না। জ্ঞান-বিজ্ঞানে বহুদূর এগিয়ে গেলেও আমরা জানি না-আমরা কোত্থেকে এসেছি, কেন এসেছি। যাই হোক, সকালে এসে আমি ওদের কিছুক্ষণের জন্যে থানায় নিয়ে যাব।
বৃদ্ধ বললেন, থানায় কেন?
আমি বললাম, এরা লস্ট প্রপার্টি। লস্ট প্রপার্টির খোঁজ থানায় দিতে হয়।
বৃদ্ধ বললেন, এরা তোমার কেউ না?
জি না।
পথে কুড়িয়ে পেয়েছ?
প্ৰায় সে রকমই।
বৃদ্ধা বিড়বিড় করে বললেন, কমল এইরকম কাজ করত। অসময়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বাসায় নিয়ে এসে বলত, মা এ আজি সারা দিন না খেয়ে আছে। ওকে ভাত খাওয়াও! কত রাগ করতাম কমলের উপর।
বৃদ্ধ বললেন, কমলের প্রসঙ্গ থাক।
বৃদ্ধ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তিনি নিজেকে সামলাতে পারছেন না।
আমি বললাম, কমল কতদিন হলো মারা গেছে?
বৃদ্ধ বলল, অনেকদিন। প্রায় কুড়ি বছর।
আমার ধারণা এই বৃদ্ধ কমলকে ভুলে গিয়েছিলেন। প্রকৃতি একটা বিশেষ ঘটনা ঘটিয়ে আবার মনে করিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতি এমন খেলা সবসময় খেলে।
রাতটা কমলকুটিরে কাটাতে হলো
আমাকে রাতটা কমলকুটিরে কাটাতে হলো। বৃদ্ধ শুরু থেকে কঠিন মুখ করে ছিলেন, হঠাৎ তিনি কঠিন অবস্থা থেকে তরল অবস্থায় চলে গেলেন। তিনি বললেন, আমার স্ত্রী তোমাকে তার ছেলের মতো দেখছে। সেই ছেলে দুপুররাতে চলে যাবে? তুমি ফাজলামি করছ? গেষ্টরুমে তোমার জন্যে ব্যবস্থা করেছি। আরাম করে ঘুমাও। তোমার কী সমস্যা, বাচ্চা দুটির কী সমস্যা আমি জানতে চাচ্ছি না। যাকে আমার স্ত্রী সন্তানের মতো দেখছে সে আমার কাছেও সন্তান। তোমাদের সমস্যা পরে শুনব। এখন ঘুমাও। আমি হার্টের রোগী। রাতজাগা আমার জন্যে নিষেধ। আমার স্ত্রীর জন্যেও নিষেধ। তুমি বলেছিলে বাচ্চা দুটিকে থানায় নিতে হবে। নিয়ে যাও, কিন্তু আবার ফিরে আসবে। এটা আমার অর্ডার। আমি আর্মিতে ছিলাম। ব্রিগেডিয়ার হিসেবে রিটায়ার করেছি। এই বাড়িতে সামরিক ব্যবস্থা চালু আছে। আমার অর্ডারের বাইরে কিছু হয় না। বুঝেছ?
আমি বিকট চিৎকার দিয়ে বললাম, ইয়েস স্যার। আই আন্ডারাষ্ট্যান্ড স্যার।
বৃদ্ধ হেসে ফেললেন। তার হাসি দেখে বাচ্চা দুটা হাসতে শুরু করল। ভেতর থেকে বৃদ্ধা ছুটে এলেন। কিছু না জেনে তিনিও হাসতে শুরু করলেন।
ভোরে ঘুম ভেঙেছে। আমি কেয়া-খেয়াকে নিয়ে বসেছি। তাদের বাবার খোঁজ বের করা দরকার। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দুজনই ঘুমে। তারা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন। বেলা পর্যন্ত ঘুমাবেন এটাই স্বাভাবিক।
কেয়া বাঘার মোবাইল নাম্বার জানে। সেই নাম্বারে টেলিফোন করলাম। একটি মেয়ে রোবটদের গলা নকল করে বলল, সংযোগ দেওয়া সম্ভব না, আপনি যদি ভয়েস মেইলে কিছু বলতে চান… ইত্যাদি। আমি বললাম, কেয়া, নাম্বারটা ভুল না তো?
কেয়া বলল, নাম্বারটা ভুল মামা। খেয়া বলল, নাম্বারটা ভুল মামা। অবশ্যই ভুল। একশবার তুল।
ছোটমেয়েটার মধ্যে বড় বোনের কথা ব্যাখ্যা করার প্রবণতা আছে। বড় মেয়েটাও দেখি ছোটটার কথা ব্যাখ্যা করে। যতই সময় যাচ্ছে এদের অদ্ভুত গুণাবলি প্ৰকাশিত হচ্ছে। তারা বাবাকে নিয়ে মোটেই ব্যস্ত না। তাদের মা কোথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম। বড়টা বলল, বলা যাবে না। ছোটটা বলল, বলা ঠিক হবে না। বললে বড় আপার পাপ হবে।
আমি বললাম, পাপ হলে বলার দরকার নাই। চলো ধানমণ্ডি থানায় যাই। তোমরা কোথায় আছ জানিয়ে আসি। তোমাদের বাবা দুশ্চিন্তা করবেন।
খেয়া বলল, দুশ্চিন্তা করবে না।
কেয়া বলল, ও ঠিকই বলেছে। দুশ্চিন্তা করবে না। একটুও করবে না।
আমি বললাম, দুশ্চিন্তা না করলেও জানানো দরকার। তোমার বাবা ধানমণ্ডি থানাতে খোঁজ করবেন। চলে যাই। থানার ঝামেলা শেষ হোক, তোমাদের এখানে দিয়ে যাব।
ওসি সাহেব ছিলেন না। বসন্ত দাগওয়ালা আছেন। আজ তাঁর গায়ে খাকি পোশাক। শার্টের পকেটের উপর নাম লেখা। মনে হয় তার নাম আব্দুল গফুর। প্লাষ্টিকের র উঠে গেছে বলে নাম এখন আব্দুল গফু। এই থানার সবার নাম থেকে একটা করে অক্ষর উঠে যাচ্ছে কেন কে জানে! ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত না তো?
আমাকে দেখে গফু সাহেব আনন্দিত হলেন বলে মনে হলো। তিনি পাশের কনস্টেবলকে বললেন, এদের হাজতে ঢুকিয়ে দাও। কুইক।
আমি বললাম, কী কারণে হাজতে ঢোকাচ্ছেন জানতে পারি? আজকের খবরের কাগজ পড়েছ? জি-না স্যার।
খবরের কাগজ পড়া থাকলে বুঝতে কেন হাজতে। তোমার কপালে আছে পাকিস্তানি ডলা।
বলেই তিনি ওকিটকিতে কাকে যেন বললেন, আসামির সন্ধানে যেতে হবে না স্যার। আসামি নিজেই ধরা দিয়েছে। এই তো আমার সামনে, সঙ্গে দুটা ট্যাবলেট; জি স্যার হাজতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। না। ট্যাবলেট দুটা বিষয়ে কিছু জানি না। এক্ষুনি জানাচ্ছি। ওভার।
গফু সাহেব ওয়াকিটকি নামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এরা কারা?
আমি বললাম, বড় জনের নাম কেয়া, তারপরেরটার নাম খেয়া। এদের নাম ক খ গ ঘ হিসেবে রাখা হচ্ছে। তারপরেরটার নাম হবে গেয়া। পঞ্চমটার নাম নিয়ে সমস্যা—ঙেয়া।
তুমি দেখি রসে টুইটুম্বুর। রসমালাই হয়ে গেছ। চিপ দিয়ে রস বের করে শুকনা খড় বানিয়ে ফেলব। তুমি বাচ্চা দুটার কে?
কেউ না। তবে ওরা আমাকে মামা ডাকছে। কথায় আছে না বাঁশতলায় বিয়াইছে গাই সেই সূত্রে মামা ডাকাই।
গফু হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ফাজলামি একদম বন্ধ। বাচ্চা দুটার বাবা কোথায়?
আমি বললাম, জানি না স্যার।
কেয়া কলাল, স্যার আমিও জানি না।
খেয়া বলল, বড় আপা সত্যি জানে না। আল্লার কসম জানে না।
বাবা করে কী?
চাকরি গেছে। সর্বশেষ চাকরি গেছে রড চুরির কারণে। এরা দুই বোন হলো চোর কন্যা। এই তোমরা স্যারকে সালাম দাও।
দুজনই একসঙ্গে বলল, স্লামালিকুম। স্লামালিকুম, স্লামালিকুম।
গফু বললেন, এই ট্যাবলেট দুটাকে হাজতে ঢোকাও। এরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে।
আমি বললাম, স্যার একটা খবরের কাগজ কি দেওয়া যাবে? কী অপরাধে হাজতবাস সেটা কাগজ পড়ে জানতাম।
আর একটা কথা না।
কেয়া বলল, এত জোরে ধমক দিবেন না স্যার। আমি ভয় পাই।
খেয়া বলল, বড় আপা খুব ভয় পায়। আল্লার কসম, বড়। আপা ভয় পায়।
আমার হাতে যে খবরের কাগজ তাতে সেকেন্ড লিড় নিউজ হচ্ছে –
টকশোতে রবীন্দ্ৰনাথ
মন্ত্রী বিভ্ৰান্ত
(স্টাফ রিপোর্টার)
একটি টিভি চ্যানেলের লাইভ টকশোতে অবিকল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখা গেছে। তিনি বন ও পরিবেশ মন্ত্রীর সঙ্গে একটি টকশোতে অংশ নেন। মন্ত্রী মহোদয় পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তিনি বারবার অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করতে বলেন, তারপরেও শো বন্ধ হয় না। শেষ পর্যায়ে উনি ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাড়ানোর পর একটি রবীন্দ্ৰনাথের গানের অনুষ্ঠান শুরু করা হয়।
যেসব দর্শক কিছুক্ষণের জন্যে হলেও প্রোগ্রামটি দেখেছেন তারাও মন্ত্রী মহোদয়ের মতোই বিভ্ৰান্ত।
মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন। এটি বিরোধীদলের স্থূল ষড়যন্ত্র। জনতার কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কমাতেই এই সাজানো নাটকের আয়োজন করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে, কথিত রবীন্দ্রনাথকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে রিমান্ডে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রবীন্দ্ৰনাথ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। অনেক রাঘববোয়াল ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়েছে।
এই প্রতিবেদক কথিত রবীন্দ্ৰনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জানেন পুলিশের কাস্টডিতে এমন কেউ নেই। ওসিকে সাময়িকভাবে ক্লোজ করা হয়েছে। পুলিশের আইজি জানিয়েছেন, পুলিশের দিক থেকে কোনো অবহেলা হয়ে থাকলে দায়ী ব্যক্তি কঠোর শাস্তি পাবে।
চ্যানেল আঁখি কর্তৃপক্ষের কেউ টেলিফোন ধরছেন না। চ্যানেল আঁখির মুখপাত্র হিসেবে ভাসান খান বলেছেন, ব্যাপারটা ক্ষুদ্র ভুল বুঝাবুঝি। জনৈক অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে ভুলক্রমে টকশোর প্রোগ্রামে চলে যান। ভুল ধরা পড়া মাত্র অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। ভাসান খানের কাছে নাটকের নাম এবং পরিচালকের নাম জানতে চাইলে ভাসান খান আমতা আমতা করতে থাকেন।
প্রতিবেদক ব্যাপক অনুসন্ধান করেও এমন কোনো নাটকের সন্ধান পান নি।
বাংলাদেশ রবীন্দ্র গবেষণা পরিষদের প্রধান ড. হাকিমুল কবির বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ একজন বিশ্বকবি। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত তাঁর রচনা, এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। ভুল সুর এবং ভুল উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া বর্তমানে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চ্যানেল আঁখি এই ফ্যাশনের আগুনে বাতাস অতীতে দিয়েছে। এখনও দিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথকে কেন টকশোতে আনা হলো এর পেছনের উদ্দেশ্য জাতি জানতে চায়। রবীন্দ্র গবেষণা পরিষদ পুরো ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছে।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে দেশের বুদ্ধিজীবীরা আগামীকাল মানব বন্ধনের কর্মসূচি দিয়েছেন। কাগজে মন্ত্রীমহোদয়ের সঙ্গে কথিত রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি ছাপা হয়েছে। ছবিটা প্রচারিত অনুষ্ঠান থেকে নেওয়া। ছবিতে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্ত্রী মহোদয়কে এক পুরিয়া গাঁজা নিতে সাধাসাধি করছেন। এরকম খবর ছাপা হওয়ার পর হৈচৈ পড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক; আমি হাত থেকে কাগজ নামাতে নামাতে বললাম, লাগ ভেলকি লাগ।
কেয়া বলল, মামা! আমাদের কি জেল হয়ে গেছে?
আমি বললাম, সেরকমই মনে হচ্ছে।
খেয়া বলল, আমরা পাপ করেছি। এইজন্যে আমাদের জেল হয়েছে। পাপ করলে জেল হয়।
কেয়া বলল, পাপ করলে ফাঁসিও হয়। মামা, আমাদের ফাঁসি হবে না তো?
সম্ভাবনা কম।
খেয়া বলল, ফাঁসি হলে জিভ এরকম বের হয়ে থাকে। তাই না মামা?
খেয়া মুখ থেকে জিভ বের করে দেখাল। কেয়া বলল, হয় নাই। এরকম।
খেয়া বলল, না এরকম। আমি দেখেছি তো।
কেয়া বলল, আমিও তো দেখেছি।
আমি বললাম, কোথায় দেখেছ?
খেয়া বলল, বলব না। বললে আল্লা পাপ দিবে।
আমি বললাম, থাক তাহলে বলার দরকার নাই।
কেয়া-খেয়া চুপ করে আছে। চুপ না থেকে অবশ্যি উপায়ও নেই। কারণ দুজনের জিভ মুখ থেকে বের করা। ফাঁসির পর জিভের অবস্থার প্রদর্শনী। আমি বড় ধরনের রহস্যের সন্ধান পাচ্ছি। রহস্যের জট খোলার হলে খুলবে। তাড়াহুড়া করলে আন্ধা গিট্টু লেগে যাবে। আল্লাপাক এইজন্যেই বলেন, হে মানব সন্তান তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া।
আমি কাগজ পাঠে মন দিলাম। বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ তাদের বিজয় কেতন উড়িয়ে যাচ্ছে। শিক্ষক লীগ এখনো পথে নামে নি, তবে নেমে যাবে। একটা খবরে যথেষ্ট পুলকিত বোধ করলাম। আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ মিলিয়ে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে পাঁচটা রাস্তা পাকা করে ফেলেছে। জনগণের দুঃখে কাতর হয়েই তারা কাজটা করেছে। কাজের টেন্ডার বাজারে ছাড়ার আগেই কাজ শেষ। টেন্ডারে যেহেতু কাজ তারাই পাবে, আগে করে ফেলতে কোনো সমস্যা নাই। বরং সুবিধা আছে। কাজ খারাপ হচ্ছে এই নিয়ে তদারকি করার কেউ নেই। তাদের পয়সাও খাওয়াতে হবে না।
নাজমুল হুদ এসেছেন। হাজাতের দরজা খুলে আমাকে তার কাছে নেওয়া হলো। আমার সঙ্গে কেয়া-খেয়া।
ওসি সাহেব বললেন, এই বাচ্চা দুটা জিভ বের করে রেখেছে কেন?
আমি বললাম, জানি না স্যার।
ওরা কি সবসময় জিভ বের করে রাখে?
মিনিট দশেক আগে জিভ বের করেছে, তারপর থেকে আর ঢোকাচ্ছে না।
ষ্ট্রেঞ্জ! এই তোমরা জিভ মুখে ঢোকাও।
দুজন সঙ্গে সঙ্গে জিভ ঢুকিয়ে আবার বের করে ফেলল।
ওসি সাহেব চমৎকৃত হয়ে বললেন, চাইল্ড সাইকোলজি বোঝা কঠিন। আমার সাইকোলজি পড়ার শখ ছিল, কী মনে করে ইংরেজি পড়লাম। এই বাচ্চারা জিভ মুখে ঢোকাও। দুজনের জিভ চুকল এবং সঙ্গে সঙ্গেই বের হয়ে এল।
ওসি সাহেব। আবারও বললেন, ষ্ট্রেঞ্জ। এখন তার চোখে রীতিমতো মুগ্ধতা। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, পুরো ব্যাপারটার একটা ভিডিও করে রাখলে কেমন হয়?
আমি বললাম, ভালো হয় স্যার। ওসি সাহেব খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, মোবাইল ফোনের ফালতু ভিডিও না। প্রফেশনাল ভিডিও; আমার শালাকে খবর দেই। সে প্যাকেজ নাটক বানায়। নাম হিরন্ময় কারিগর। ছদ্মনাম। ভালো নাম ছানাউল্লাহ। তার কোনো নাটক দেখেছেন?
আমি বললাম, জি-না স্যার।
আমিও দেখি নাই। নাটক দেখার সময় কোথায়! চোর-ডাকাত আর সন্ত্রাসী দেখে সময় পাই না। আমার শালা বলেছে তার একটা নাটক ভালোবাসা দিবসে প্রচার হবে। নাটকের নাম ভালোবাসার তিন কাহন। তিনটা মেয়ে একটা ছেলেকে ভালোবাসে। শেষে ঠিক হয় লটারি হবে। লটারিতে যে মেয়ের নাম উঠবে সে-ই ছেলেটিকে বিয়ে করতে পারবে। বাকিরা দূরে সরে যাবে। লটারিতে তিনজনের নামই একসঙ্গে উঠে। নাটক এখানেই শেষ।
আমি বললাম, তিনজনের নাম একই সঙ্গে কীভাবে উঠবে?
ওসি সাহেব বললেন, আমিও একই প্রশ্ন আমার শালাকে করেছিলাম। সে বলল, নাটকের এইটাই ক্লিক। পর্দায় দেখতে হবে। আচ্ছ, এই কন্যারা, জিভ ভেতরে।
জিভ ভেতরে চলে গেল। তবে এবার আর বের হলো না। ওসি সাহেব বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। হতাশ গলায় বললেন, এদের সমস্যাটা কী? জিভ বের করছে না। কেন? এই জিভ বের করো। বের না করলে কঠিন শাস্তি।
শাস্তির কথায় দুই কন্যার ভাবান্তর হলো না। তারা কঠিন মুখ করে বসে রইল। নাজমুল হুদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাগজ পড়েছেন?
আমি বললাম, জি স্যার।
কোনো বক্তব্য আছে?
আপনার জন্যে খারাপ লাগছে স্যার।
আমার জন্যে খারাপ লাগছে কেন?
আপনি সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। এইজন্যে খারাপ লাগছে।
নাজমুল হুদের মুখে আনন্দের হাসি দেখা গেল। তিনি হঠাৎ এত আনন্দিত কেন বুঝতে পারছি না। ভদ্রলোকের হাবভাব যথেষ্টই বিস্ময়কর।
তিনি আমার দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, আমরা পুলিশরা হচ্ছি কাকের মতো। কাকের মাংস কাক খায় না। পুলিশের মাংস পুলিশ খায় না। সাংবাদিকদের ঠান্ডা রাখার জন্যে বলা হয়-সাময়িক বরখাস্ত। এক থানার ওসি ক্লোজ হলে অন্য থানায় তাকে ওপেন করা হয়। এখন কি পরিষ্কার?
জি স্যার।
দেশে নিউজের আকাল বলে নিউজ তৈরি করা হচ্ছে। এক ছাত্রলীগের নিউজ কত ছাপবে। কয়েকদিন রবীন্দ্ৰনাথের নিউজ ছাপা হবে। তারপর শেষ। আপনি খামাখা থানায় এসে ধরা খেয়েছেন কেন—এটাই তো বুঝলাম না।
বাচ্চা দুটিার জন্য এসেছি স্যার। ওরা মিসিং চাইল্ড। ওরা জানে না। ওদের বাবা কোথায়। ওরা যে আমার কাস্টডিতে আছে। এটা রিপোর্ট করতে থানায় এসে ধরা খেলাম।
ওসি সাহেব বললেন, ধরা খাওয়াখাওয়ির কিছু নাই। থানায় রিপোর্ট করে বাচ্চা নিয়ে চলে যান।
রবি ঠাকুরুকে খুঁজে বের করবেন না?
না। অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অনেক মাতামাতি হয়েছে। আর না। বাচ্চা দুটা কোন ঠিকানায় আছে ভালোমতো লিখে রেখে চলে যান। আমি আমার শালাকে ক্যামেরা দিয়ে পাঠাব। সে জিভের ব্যাপারটা রেকর্ড করে ফেলবে। নাম মনে আছে তো? হিরন্ময় কারিগর।
আমাকে ছেড়ে দিয়ে আপনি বিপদে পড়বেন না তো?
বিপদের মধ্যেই আছি। নতুন আর কী পড়ব।
আপনি বললে আমি ছামাদ মিয়াকে খুঁজে বের করতে পারব।
কোনো প্রয়োজন নাই। ইউ গোট লস্ট। ম্যাচের কাঠির আগুনকে দাবানল বানানোর কিছু নাই। সকাল আটটার সময় ডিরেকটিভ বাংলাদেশের সব থানায় থানায় চলে গেছে।
Catch poet Tagore
Dont misbehave
Handle With honour.
আমি চিন্তাই করতে পারছি না। কার মাথায় এরকম একটা ডিরেকটিভ দেওয়ার চিন্তা এসেছে। যান যান। আপনি ভাগেন। আরো কী আশ্চৰ্য, বাচ্চা দুটা আবার জিভ বের করে ফেলেছে। ভেরি ইন্টারেস্টিং ভেরি ইন্টারেস্টিং। এই তোমরা দুটা মিনিট বসো! কেক খেয়ে যাও।
ওসি সাহেবের ওয়াকিটকি বেজে উঠেছে। তিনি রিভলভিং চেয়ারে ঘুরতে ঘুরতে কথা বলছেন।
না না। স্যাক্স। কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে আমি কথা বলব না। আপনি যদি প্রয়োজন মনে করেন, আমাকে ক্লোজ করে অন্য কোনো থানায় ওপেন করে দেন। তবে স্যার আমার ধারণা রবীন্দ্ৰ হাঙ্গামা থেমে যাবে। সাংবাদিকরা নতুন একটা নিউজ আইটেম পেয়েছে। এটা নিয়েই এখন তাদের মাতামাতি করার কথা। পড়েন নাই? এক পরিবারের সাতজনের অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু। আমরা সেফ সাইডে আছি। কয়েকদিন এইটা নিয়েই চলবে ইনশাল্লাহ। কীভাবে আগুন ধরল, মৃত্যুর আগে কে কী বলল, এইসব ছাপা হতে থাকবে। খবরের কাগজের দোষ দিয়েও তো লাভ নাই স্যার। পাবলিক খবর চায়। এত খবর সাপ্লাই দিবে কীভাবে? ডিমান্ড বেশি সাপ্লাই কম। আমি স্যার সাবসিডিয়ারিতে ইকনমিক্স নিয়েছিলাম, সেখানে পড়েছিল অব ডিমিনিশিং রিটার্ন। আমি বেশি কথা বলছি? সরি স্যার। আর কথা বলব না। মুখ বন্ধ।
কেয়া-খেয়ার জন্যে পেস্ট্রি এসেছে। খেয়া চামচ দিয়ে ঠিকমতো খেতে পারছে না। ওসি সাহেব বললেন, চামচ, আমার কাছে দাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
কেয়া বলল, পুলিশ মামা! আমাকেও খাইয়ে দিতে হবে।
ওসি সাহেব বললেন, নো প্রবলেম।
দুজনেই হা করে আছে। ওসি সাহেব পালা করে ওদের মুখে পেন্ত্রি দিচ্ছেন।
বসন্ত দাগওয়ালা এক ফাঁকে ঘরে ঢুকলেন, বিরক্তমুখে বললেন, কী হচ্ছে?
ওসি সাহেব বললেন, পেষ্ট্রি খাওয়া হচ্ছে।
ধামড়ি দুই মেয়ে। এদের মুখে তুলে খাওয়াতে হবে কেন? স্যার আপনি মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি করেন।
ওসি সাহেব যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করলেন। পেস্ট্রি পৰ্ব্ব শেষ হওয়ার পর কোক আনালেন। সেটাও গ্লাসে করে মুখে তুলে খাওয়ানো হলো।
খেয়া বলল, পুলিশ মামা গল্প বলো।
ওসি সাহেব গল্প শুরু করলেন। ঠাকুরমার ঝুলির ডালিম কুমারের গল্প। কনস্টেবলরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। একজন দুজন করে ঘরে ঢুকছে। বাংলাদেশের থানাগুলিতে অনেক কিছুই হয়, রূপকথার আসর কখনো বসে না।
ওসি সাহেব হাত-পা নেড়ে গল্প বলছেন। শ্রোতার সংখ্যা বাড়ছে।
ডালিম কুমার যাচ্ছে, যাচ্ছে, যাচ্ছে। তার হাতে তলোয়ার। সে চেপেছে ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়ার ক্ষুরে টগবগ শব্দ হচ্ছে…
চতুর্থ অধ্যায়ের শুরু
হিমুর গল্প সবসময় উত্তমপুরুষে লেখা হয়। এই চ্যাপ্টার থেকে হিমু উত্তমপুরুষে লেখা হচ্ছে না। হিমু-পাঠে অভ্যস্ত পাঠকদের সাময়িক সমস্যা হতে পারে। আমি দুঃখিত, কিছু করার নেই। চতুর্থ অধ্যায়ের শুরুতেই পাত্র-পাত্রী কে কোথায় কী করছে জানিয়ে দেই।
কেয়া-খেয়া
এরা দুজন কমলকুটিরে মহাসুখে আছে। বৃদ্ধ ধমকা-ধমকি করেও কিছু করতে পারছেন না। তাদের জন্যে জামা, জুতা কেনা হয়েছে। দুজনই বার্বিডল উপহার পেয়েছে। কেয়া তার বার্বিডলের নাম দিয়েছে ফুরফুন, খেয়া তারটার নাম দিয়েছে কুনকুন। তাদের আলাদা রুম দেওয়া হয়েছে। এই রুমে তারা থাকছে না। বৃদ্ধবৃদ্ধার শোবার ঘরে থাকছে। রাতে শোওয়ার সময় একপাশে বৃদ্ধি, অন্যপাশে বৃদ্ধা, মাঝখানে দুই কন্যা। বৃদ্ধ ঘনঘন বলছেন, একী বিপদে পড়লাম! কিন্তু তিনি যে অত্যন্ত আনন্দ আছেন তা বোঝা যাচ্ছে। বার্বিডল তিনিই কিনে এনেছেন। মাঝে মাঝে এই দুবোন জিভ বের করে কেন বসে থাকে এটা নিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা চিন্তিত। এদেরকে সাইকিয়াট্রিক্ট দেখানোর পরিকল্পনা তাদের আছে।
বাচ্চা দুটি বৃদ্ধ-বৃদ্ধার স্থবির জগতে কী আলোড়ন এনেছে তা বোঝানোর জন্যে টেলিফোন কথাবার্তার কিছু অংশ দেওয়া হলো। বৃদ্ধা তার মেয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। এই মেয়ে অষ্ট্রেলিয়া-প্রবাসী।
বৃদ্ধা : বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না রে মা। কেয়ার স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেছে। স্যান্ডেল। কিনতে যেতে হবে।
মেয়ে : কেয়া কে?
বৃদ্ধা : আমাদের সঙ্গে থাকে। দুই বোন কেয়া-খেয়া। কী যে দুষ্ট!
মেয়ে : আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এরা কারা?
বৃদ্ধ : ওদের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কাল বলেছি—আমি তোদের সঙ্গে থাকব না। জঙ্গলে চলে যাব। তারপর দুই বোন শুরু করুল কান্না।
মেয়ে : মা, তুমি বাবাকে দাও তো। বাবার সঙ্গে কথা বলি।
বৃদ্ধা : তোর বাবা খেয়াকে নিয়ে গেছে আইসক্রিম কিনতে। তোর বাবা আদর দিয়ে দুই বিচ্ছুকে মাথায় তুলেছে। কাল কী দেখলাম শোন। তোর বাবা ঘোড়া সেজেছে। দুই বোন ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে আছে। আমাকে দেখে কেয়া বলল, নানু, তুমি আসো। ঘোড়ায় ওঠে। তিনজনের জায়গা হবে। কী যে যন্ত্রণায় আছি।
ওসি, ধানমণ্ডি
নাজমুল হুদ
তাকে ধানমণ্ডি থানা থেকে ক্লোজ করে তেজগন্ন থানায় ওপেন করা হয়েছে! আবার তাকে ধানমণ্ডি থানায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে বলে আপাতত কোনো ডিউটি দেওয়া হয় নি। তিনি থানায় হাজিরা দিয়ে তার শালা হিরন্ময় কারিগরের কাছে গেছেন। হিরন্ময় কারিগর একটা ডকুমেন্টারি বানাচ্ছেন। ডকুমেন্টারির নাম একজন গার্মেন্টকর্মীর একদিন। গামেন্টকর্মীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন চিত্রনায়িকা মিস রিনকি। যার সাম্প্রতিক ছবি প্রেম দে, না দিলে থাপ্পড় খাবি সুপারহিট হয়েছে। মিস রিনকি নানান নখড়া করছেন। হিরন্ময় কারিগর নখড়া সামলাতে পারছে না।
ছামাদ মিয়া
ছামাদ মিয়া রবীন্দ্রনাথ সেজে হিমুর মেসের ঘরে বসে আছে। হিমু মেসে নেই তাতে কোনো সমস্য হয় নি। হিমুর ঘরের দরজা সবসময় খেলাই থাকে। তাকে নিয়ে যে খবরের কাগজে বিরাট হৈচৈ হচ্ছে এটা সে জানে বলেই আবারও রবীন্দ্ৰনাথ সাজা। এবারের সাজ আগেরবারের চেয়েও ভালো হয়েছে। মেসের অনেকেই উঁকি মেরে তাকে দেখে যাচ্ছে। একজন এসে তার মেয়ের জন্যে অটোগ্রাফ নিয়েছে। ছামাদ ইংরেজিতে অটোগ্রাফ দিয়েছে। সেখানে লেখা—Be Hapy, দুটা P র জায়গায় একটি P, ইংরেজি বানানে ছামাদ সামান্য দুর্বল।
মেসের ম্যানেজার ভোর বাংলা নামের পত্রিকার সম্পাদককে জানিয়েছে— যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত হৈচৈ তাদের কাগজে হয়েছে তিনি বাংলা মেসে উপস্থিত আছেন। ভোর বাংলার সিনিয়র সাংবাদিক ফজলু মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হয়েছেন। তার সঙ্গে সিনিয়ার ফটো সাংবাদিক ময়না ভাই আছেন। তারা মালিবাগের কাছে জামে আটকা পড়েছেন। ভয়ঙ্কর জাম। আজ সারা দিনে ছুটবে এরকম মনে হয় না।
জনাব গফু
ইনি এখন ধানমণ্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি। তিনি যে কাজেকর্মে আগের ওসির চেয়েও দক্ষ তা প্রমাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হিমুর মেসের ঠিকানায় অভিযান চালাবার জন্যে ফোর্স নিয়ে জিপে উঠে বসে আছেন। জিপ ছাড়ছে না, কারণ জনাব গফু র্যাবকেও খবর দিয়েছেন। তিনি চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন পত্রিকার হেডলাইন–
কথিত রবীন্দ্ৰনাথের ডানহাত হিমু গ্রেফতার
(স্টাফ রিপোর্টার)
পুলিশ-র্যাবের যৌথ অভিযানে অবশেষে কথিত রবীন্দ্রনাথ নাটকের হোতা হিমু গ্রেফতার। অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছেন চৌকশ পুলিশ অফিসার জনাব গফুর। হিমু মুখ খুলতে শুরু করেছে। সে ইতোমধ্যেই অনেক রাঘববোয়ালের নাম বলেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তারা হিমুকে চার দিনের রিমান্ডে নিতে চায়। রিমান্ডে না নেওয়া হলে অনেক অজানা তথ্য অজানাই থেকে যাবে। চৌকশ অফিসার হিমুকে গ্রেফতারের নাটকের যে রোমহর্ষক বৰ্ণনা দেন তা উনার জবানিতেই পত্ৰস্থ করা হলো। ইত্যাদি…
হিমু
হিমু নিখোঁজ। সে কোথায় আছে, কী করছে জানা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝেই হিমু। ড়ুব দেয়, মনে হয় এবারও ড়ুব দিয়েছে। আমরা হিমুর ভেসে ওঠার প্রতীক্ষায় আছি।
ভোর বাংলার সিনিয়ার সাংবাদিক জনাব ফজলু কিছুক্ষণ হলো ছামাদের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করেছেন। এখন তিনি পুরোপুরি হতাশ। ছামাদ মিয়া শখের বশে রবীন্দ্রনাথ সাজে। এই নিউজের কোনো ভেল্যু আছে? পাবলিক চায় একসাইটমেন্ট। একজন শখে রবীন্দ্ৰনাথ সাজে, এর মধ্যে একসাইটমেন্ট কোথায়?
ফজলু বিরসমুখে বললেন, আপনি মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে টকশো করলেন কেন?
ছামাদ বলল, আমি কিছু জানি না স্যার। ভুলে ঢুকেছি। আর যাব না। যদি যাই মাটি খাই। ঘাউ।
ঘাউ বললেন কেন?
মাঝে মধ্যে নিজের অজান্তেই বলি। আর বলক না।
আপনার চুল-দাড়ি সবই নকল?
জি। তবে টাইট ফিটিং। টান দিয়া দেখেন।
ফজলু দাড়ি টানাটানির কোনো আগ্রহ বোধ করলেন না। সংবাদের হেডলাইন কী দেবেন। এই নিয়েই তার চিন্তা। পৰ্বতের মুষিক প্রসব এই হেডলাইন হতে পারে। তাতে এক সংখ্যাতেই শেষ। দুই-তিন সংখ্যা চালানোর মতো কিছু থাকবে না। প্রথম দিন একটু আভাস দিয়ে পরের দুই দিনে যবনিকা অপসারণ করা দরকার। পাবলিক একটু একটু করে জানবে, পুরোটা জানবে না।
রবীন্দ্রনাথের লাইন দিয়ে নিউজ হতে পারে–শিরোনাম হবে আজি হতে শতবর্ষ পরে। শতবর্ষ পরে ছামাদ মিয়া নামের একজনের ইচ্ছা হলো রবীন্দ্ৰনাথ সাজবে। এই নিয়ে গল্প। প্রথম দিন রবীন্দ্ৰনাথ হিসেবে তার ছবি। দ্বিতীয় দিনে আসল ছামাদের ছবি। শিরোনাম-কে এই ছামাদ?
ফারুক বললেন, দাড়ি গোঁফ খোলেন; আলখাল্লা খোলেন। নরমাল ছবি তোলা হবে। লুঙ্গি গেঞ্জি।
ছামাদ দ্রুত আদেশ পালন করল। ময়না ভাই ছবি তুলতে তুলতে বললেন, স্যার আপনি পোশাকটা পরেন। আপনার একটা ছবি তুলে দেই। রবীন্দ্রনাথ সাজলে আপনাকে কেমন লাগে দেখি।
ফারুক বললেন, এইসব ফাজলামির কি আর বয়স আছে?
ছামাদ বিনীত গলায় বলল, পরেন না। স্যার। গরিবের একটা রিকোয়েস্ট।
ময়না ভাই বললেন, সুন্দর করে তুলে দেই, বাঁধিয়ে বাড়িতে রাখবেন। ভাবি মজা পাবেন।
ফারুক বললেন, তোমার ভাবি মজা পাবে কথাটা ঠিক বলেছ। যে-কোনো ফালতু জিনিসেই সে মজা পায়। দেখি দাঁড়িগোঁফ পরাও! কুটকুট করবে না তো?
ফারুক রবীন্দ্রনাথ সেজে তিনটা ছবি তুললেন। ঘরের ভেতরে আলো কম থাকায় বারান্দায় এলেন ছবি তুলতে। থিমেটেক ছবি। বারান্দার রেলিং-এ ঝুঁকে উদাস চোখে আকাশের মেঘমালা দেখতে দেখতে ছবি! ময়না ভাই একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এবং আকাশ ধরার চেষ্টা করছেন। এইসময় অফিসার গফুর র্যাব নিয়ে বারান্দায় ঢুকলেন। অত্যন্ত ক্ষিপ্ৰতায় কবিগুরুর হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেওয়া হলো। তিনি ওয়াকিটকিতে তৎক্ষনাৎ ডিআইজি সাহেবকে জানালেন, কবিগুরু আন্ডার অ্যারেস্ট স্যার। ওভার।
সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার এবং সিনিয়র ফটোগ্রাফার দু’জনই থানা হাজতে। ভয়ঙ্কর অপরাধী ছাড়া কাউকে থাকা হাজতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রাখার নিয়ম নেই। কিন্তু সিনিয়র কিন্তু সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার জনাব ফারুককে অতিরিক্ত নিরাপত্তার কারণে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রাখা হয়েছে। হাত বন্ধ থাকায় তিনি মুখ থেকে নকল চুল দাড়ি খুলতে পারেন নি। আলখাল্লাও খুলতে পারেন নি। তাঁকে ভয়ঙ্কর চিন্তিত এবং বিমর্ষ দেখা যাচ্ছে। সেই তুলনায় সিনিয়র ফটোগ্রাফার ময়না ভাইকে বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তিনি বেশ আয়েশ করেই সিগারেট টানছেন।
ফারুক বললেন, হ্যান্ডকাফ খোলার ব্যবস্থা করুন। গলা চুলকাচ্ছে, চুলকাতে পারছি না।
ময়না ভাই বললেন, আমি কীভাবে হ্যান্ডকাফ খুলব? চাবি তো আমার কাছে না।
কোথায় চুলকাতে হবে ঠিকমতো বলুন আমি চুলকিয়ে দিচ্ছি। গলা? সামনের দিকে না পেছনের দিকে? আরেকটা কথা স্যার বিপদে অস্থির হতে নাই। আপনি বেশি অস্থির।
থানার সামনে ক্যামেরা হাতে বিভিন্ন চ্যানেলের লোকজন। এদের মধ্যে দু’জন সাহেবও আছেন। তারা CNN থেকে কাভার করতে এসেছেন। তাদের কাউকেই হাজতিদের সঙ্গে দেখা করতে হচ্ছে না। তবে শোনা যাচ্ছে পুরো ঘটনা জানিয়ে একটা প্রেস বিফ্রিং করা হবে। ব্রিফিং করবেন। ভারপ্রাপ্ত ওসি জনাব গফু। তিনি এখন বাথরুমে বসে আছেন। বাথরুমে নাপিত এসেছে, সে তাকে শেভ করে দিচ্ছে। সকালে তাড়াহুড়োর কারণে শেভ করা হয় নি। এতগুলো ক্যামেরার সামনে মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। দ্রুত শেভ করতে গিয়ে ঝামেলা হয়েছে। নাপিতের ক্ষুরের টানে গালের কোনো ভেইন কেটেছে। রক্ত পড়ছে, তুলা চেপেও রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। নাপিত একটা পাকিস্তানি থাপ্পড় খেয়ে তবদা মেরে গেছে।
প্রেস ব্রিফিং শুরু হয়েছে। গফু গালে তুলা চেপে ধরেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন।
দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা আমার। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি। কথিত রবীন্দ্রনাথ একটা মেসবাড়ির কক্ষে মিটিং করছে তার পরবতী কার্যক্রম ঠিক করার জন্যে।
কালবিলম্ব না করে আমি থানার ফোর্স, চারজন র্যাব ভাই এৰং বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুটি কুকুর নিয়ে অকুস্থলে হানা দেই। গোপন সূত্রের খবর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল প্রমাণিত হয়। আল্লাপাক রাব্ববুল আলামিনের অনুগ্রহে এইবার ভুল প্রমাণিত হয় নাই। আমি সশব্দে বুটের এক ধাক্কায় দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে শিকারি হায়েনার মতো লাফ দিয়ে আসামির উপর পড়েই তাকে ঝাপটে ধরি। ধস্তাধস্তিতে আমার যে গাল কেটে গেছে তা বুঝতেও পারি নাই।
ভারপ্রাপ্ত ওসি সাহেব গাল থেকে তুলা সরালেন। দর্শকসারি থেকে উফ্ শব্দ উঠল। দর্শকদের মধ্যে নাপিতও ছিল। সে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেল।
এখন আপনাদের যদি কোনো প্রশ্ন থাকে করতে পারেন। একজন একটির বেশি প্রশ্ন করতে পারবেন না। বলুন আপনার কী প্রশ্ন?
গ্রেফতারের পর কথিত রবীন্দ্ৰনাথ কী বলছেন?
দুঃখের বিষয় তিনি কিছুই বলছেন না। কিছু জিজ্ঞেস করলে বিড়বিড় করছেন।
তিনি কি একই ধরা পড়েছেন, না সদলবলে ধরা পড়েছেন?
আমরা তার একজন সহযোগীকে ধরতে সমর্থ হয়েছি। তার অন্য সহযোগী একফাঁকে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়।
এরা কি কোনো জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত?
আসামির লম্বা দাড়ি দেখে সে রকমই মনে হচ্ছে। দেশজুড়ে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। আমরা শিঘ্রই এই বিষয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারব। তবে আপনাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি–আরো তিনজন কথিত রবীন্দ্রনাথকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একজন শান্তাহার রেলস্টেশনের চাবিক্ৰেতা। সে নিজেকে নির্দোষ দাবি করছে। তার চেহারাই এরকম। অন্যজনকে সীমান্ত অতিক্রমের সময় ধরা হয়। সে চাদরের নিচে লুকিয়ে ভারত থেকে ফেনসিডিল আনে। লম্বা চুল-দাড়ির কারণে তাকে সুফি মানুষের মতো লাগে বলে বিডিআর ধরে না। তৃতীয়জন বলছেন তিনি কাহালুর ছাত্রলীগের সংস্কৃতি সম্পাদক। তাঁর বয়স একষট্টি তবে তিনি তাঁর ছাত্ৰত্ব সম্পর্কে গ্যারান্টি দিচ্ছেন। তিনি তার দীর্ঘ জীবনে সবসময় কোনো না কোন বিষয়ে অধ্যয়ন করেছেন। বর্তমানে তিনি ন্যাশনাল হোমিওপ্যাথি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। এখন আমি আর একটি প্রশ্ন নেব। হ্যাঁ আপনি প্রশ্ন করুন। এখন আপনার টার্ন।
এমন কি হতে পারে যে ছাত্রলীগকে জনগণের সামনে ছোট করার জন্যে কেউ রবীন্দ্ৰনাথ সেজে ছাত্রলীগে ঢুকে পড়েছে?
অবান্তর প্রশ্ন! জবাব দিব না।
অবাস্তর হবে কী জন্যে? পত্রপত্রিকায় দেখেছি অনেক শিবিরের ক্যাডার দাড়ি কামিয়ে ছাত্রলীগে ঢুকেছে। নিয়মিত শোভ করছে।
পলিটিক্যাল প্রশ্নের জবাব দিব না। আমরা সরকারি কর্মচারী। আমাদের কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। তবে ঘটনা সত্য হতে পারে।
ভোর বাংলার সম্পাদক থানায় এসেছেন। তিনি দুটি বৈঠক করেছেন। প্রথম বৈঠক সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার ফারুক খানের সঙ্গে। তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কৰ্থাবার্তা হয়।
সম্পাদক : (হতভম্ব। বিস্মিত। রাগান্বিত এবং হতাশাগ্ৰস্ত। সবই একই সঙ্গে) আপনি সাংবাদিকতার নামে এই কাজ করছেন? নিজেই রবীন্দ্ৰনাথ সেজে টক শোতে অংশ নিচ্ছেন। আবার নিজেই এই বিষয়ে রিপোর্ট করছেন। সাপ হয়ে দংশন করছেন। ওঝা হয়ে ঝাড়ছেন। ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
ফারুক : ঘটনা এরকম না।
সম্পাদক : ঘটনা। কী রকম? আপনি কি অস্বীকার করবেন যে, আপনি রবীন্দ্রনাথ সাজেন নি? এখনো তো দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে বসে আছেন।
ফারুক : আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারছি না। সব আউলা লেগে যাচ্ছে। ময়না ভাই প্লিজ। ঘটনা। কী হয়েছে বলুন।
ময়না : স্যার উনার কোনো দোষ নাই। আমি ক্যামেরা হাতে বলছি। মাতাল যেমন মদের বোতলে হাত দিয়ে মিথ্যা বলতে পারে না, ক্যামেরাম্যানও ক্যামেরায় হাত দিয়ে মিথ্যা বলতে পারে না।
সম্পাদক : কথা পেঁচাবেন না, টু দ্য পয়েন্ট কথা বলুন।
ময়না : সব দোষ আসলে ভাবির।
সম্পাদক : এখানে ভাবি এল কোত্থেকে? ভাবি কে?
ময়না : ফারুক স্যারের স্ত্রী। উনার অদ্ভুত স্বভাব। সব ফালতু জিনিসে উনার আনন্দ। মেয়েছেলে এ রকমই। কবি বলেছেন, স্ত্রী চরিত্রম দেবী না জানন্তি, কুত্ৰাপি মনুষ্যা। এর অর্থ…
সম্পাদক : ভ্যারভ্যার করছেন কেন?
ময়না; ভ্যারভ্যার কখন করলাম?
সম্পাদক : এই তো এখন করছেন। ইন্ডিয়টের মতো ননষ্টপ যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছেন।
ময়না : আমাকে ইডিয়ট বলেছেন?
সম্পাদক : হ্যাঁ বলেছি। রাগ সামলাতে না পেরে বলেছি। সরি ফর দ্যাট।
ময়না : তোর চাকরি আর করব না। আমি ট্যাকনিকাল পারসন। আমার চাকরির অভাব? তোর পত্রিকায় চাকরি না করলে কী হয়? আমার …ল হয়?
সম্পাদক : তুই তুই করছেন কেন এবং অশালীন কথা বলছেন কেন?
ময়না ভাই : রাগ সামলাতে না পেরে তুই তুই করছি। সরি ফর দ্যাট। এই নে তোর পত্রিকার ক্যামেরা।
সম্পাদক : ক্যামেরা তো ভাঙা।
ময়না : ক্যামেরা পুলিশ আছাড় দিয়ে ভেঙেছে। আমি ভাঙি নাই। সাহস থাকলে পুলিশের সাথে গিয়া দরবার কর।
সম্পাদক : লেন্স ভাঙা ক্যামেরা হতে উঠে দাঁড়ালেন।
দ্বিতীয় বৈঠক
স্থান : ওসি সাহেবের কক্ষ।
সম্পাদক : আপনার সম্পর্কে আমাদের কাছে কিছু তথ্য আছে। সেনসেটিভ কিছু তথ্য।
গফুর : (হাসিমুখে) আপনি সাংবাদিক, আপনার কাছে তো তথ্য থাকবেই। আপনি রোগী হলে আপনার কাছে থাকত পথ্য।
সম্পাদক : রসিকতা করার চেষ্টা করবেন না। আমি উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক না। আমার পত্রিকার নাম ভোর বাংলা। যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। একটা পত্রিকার অনেক ক্ষমতা। পত্রিকা এমন এক রিপোর্ট করতে পারে যে এক রিপোটে আপনার চাকরি শেষ। রিপোর্টের কারণে আপনাকে জেলের ভাত খেতে হচ্ছে।
গফুর : কী রিপোর্ট?
সম্পাদক : যেমন ধরুন ভাসমান পতিতাদের কাছ থেকে আপনি নিয়মিত তাদের আয়ের একটা অংশ নিয়ে থাকেন। তাদের একজনের নাম শমিতা। তাকে প্রায়ই আপনার বিশেষ শারীরিক প্রয়োজনে সাড়া দিতে হয়।
গফুর : (অবাক) শামিতা কে?
সম্পাদক : বললাম না, ভাসমান পতিতা। শমিতা পত্রিকায় বিশাল ইন্টারভ্যু দিবে। সেই ইন্টারভ্যু ছবিসহ ছাপা হবে। আপনারা পুলিশেরা যেমন ইচ্ছেমতো সাক্ষী হাজির করতে পারেন। আমরাও পারি ইচ্ছেমতো ইন্টারভ্যুর ব্যবস্থা করতে। নেপোলিয়ানের মতো জেনারেল পত্রিকার ভয়ে অস্থির থাকতেন। আপনি কেউ না, ডোবার পুঁটিমাছ। পুঁটিমাছ আমি ধরব না। ডোবা সেঁচে ফেলব! আপনি শুকনা ডোবায় খাবি খাবেন।
গফুর : আমাকে কী করতে হবে?
সম্পাদক : রবীন্দ্রনাথ হিসেবে যাকে ধরেছেন, তাকে ছেড়ে দিতে হবে। সে আমার পত্রিকার সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার। অত্যন্ত ভালো মানুষ! পাকে চক্ৰে রবীন্দ্ৰনাথ সেজেছে।
গফুর : এখন তাকে ছাড়া কীভাবে সম্ভব? আমি কনফারেন্স করে বলেছি যে কথিত রবীন্দ্রনাথ ধরা পড়েছে। সাংবাদিকরা ছবি তুলেছে।
সম্পাদক : দাড়ি গোঁফ আলখাল্লাসহ ছবি উঠেছে। চেহারা কিছুই বোঝা যাবে না। ফারুকের সঙ্গে ময়না বলে যে বদটাকে ধরেছেন ওকে দাড়ি গোঁফ পরিয়ে দিলেই হবে। বুঝতে পারছেন কী বলছি?
গফুর : (একই সঙ্গে হতাশ, চিন্তিত, বিক্ষিত এবং রাগত)
সম্পাদক : কথা বলছেন না কেন? আপনি কি চান। একজন রিপোর্টার আপনার পেছনে লাগিয়ে দেই যাতে সে আপনার নাড়িনক্ষত্র বের করে নিয়ে আসতে পারে। আপনি নিশ্চয়ই কাউকে না কাউকে হাজতে পিটিয়ে মেরে ফেলে বলেছেন, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। এখন বলুন, ফারুক কি ছাড়া পাচ্ছে?র
ওসি : অবশ্যই পাচ্ছে। আপনার মতো একটা মানুষের অনুরোধ আমি রাখব না তা কি হয়?
সম্পাদক : ময়না বলে যেটা আছে। ঐটাকে একটু সাইজ করে দিবেন। এটা আমার ব্যক্তিগত অনুরোধ। আগের অনুরোধ ছিল পত্রিকার পক্ষ থেকে। আপনার কি গল্প-কবিতা লেখার বদঅভ্যাস আছে?
জি-না।
গল্প-কবিতা কিছু লেখা থাকলে পাঠিয়ে দিবেন। সাহিত্য পাতায় ছাপিয়ে দিব।
ধানমণ্ডি থানার ক্লোজ হওয়া ওসি নাজমুল হুদ অনেক দিন পর বিমলানন্দ উপভোগ করছেন। চোর-ডাকাতের পেছনে দৌড়াতে হচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ মানুষজন টেলিফোনে গুরুত্বহীন বিষয়ে কথা বলছেন না। মন্ত্রী মহোদয়দের পলিটিক্যাল এপিএসরা হুমকিধামকি করছে না। তিনি তার শ্যালক হিরন্ময় কারিগরের কাজ দেখছেন। তার বসার জায়গা হয়েছে সুপারহিট নায়িকা মিস রিনকির কাছাকাছি। মাঝখানে দুটা ফাঁকা চেয়ার আছে। তিনি ইচ্ছা করলে একটা চেয়ার ডিঙিয়ে নায়িকার পাশে বসতে পারেন। যে-কোনো কারণেই হোক তার সাহস হচ্ছে না। শোনা গেছে এই নায়িকা নানান নখড়া করে, তাকে তেমন কোনো নখড়া করতে দেখা যাচ্ছে না। নায়িকা একটু পরপর হ্যান্ডব্যাগ থেকে আয়না বের করে একদৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকছে। এটা নিশ্চয়ই নখড়ার মধ্যে পড়ে না।
নাজমুল হুদকে নাশতা দেওয়া হয়েছে। ট্যাবলেট সাইজের সিঙ্গাড়া। নাজমুল হুদা অতি সুস্বাদু ছয়টা সিঙ্গাড়া খেয়ে ফেলেছেন। আরও খেতেন, চক্ষুলজ্জায় খেতে পারছেন না। নায়িকা মিস রিানকির সামনেও কাচামরিচ, পেয়াজসহ একগাদা সিঙ্গাড়া দেওয়া হয়েছে। নায়িকা একটা সিঙ্গাড়া ভেঙে খানিকটা মুখে দিয়ে মুখ বিকৃত করেছেন। এরপর ওসি সাহেবের পক্ষে দুই হালি সিঙ্গাড়া খেয়ে ফেলা যায় না।
কিছুক্ষণ আগে মিস রিনকির একটা শট হয়েছে। গামেন্টস ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে সে চুড়িওয়ালির কাছ থেকে কী সুন্দর করেই না চুড়ি কেনার অভিনয় করল, অসাধারণ।
মিস রিনকি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, পানি খাব। আশেপাশে কেউ নেই। ওসি সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কত বদমাইশকে নিজের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়েছেন, আর ইনি সম্মানী মহিলা। অপূর্ব অভিনয়।
মিস রিনকি পানির গ্লাস হাতে নিলেন। ছোট্ট চুমুক দিলেন। জিভ ভেজানোর মতো কয়েক ফোঁটা পানি মুখে নিলেন। অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, ধন্যবাদ। নায়িকারা নায়ক ছাড়া অন্য কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। ওসি সাহেব বললেন, আপনার চুড়ি কেনার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
ও আচ্ছা।
কেন মুগ্ধ হয়েছি বলব? যদি বিরক্ত না হন, অল্পকথায় বলি।
মিস রিনকি হ্যাঁ না কিছু বলল না। পানির গ্লাসে আরেকবার ছোট্ট চুমুক দিল। ওসি সাহেব বললেন, আপনি চুড়িওয়ালির সামনে বসলেন। হাত ভর্তি করে চুড়ি পরলেন। অনেক দরাদরি করলেন। দরে বনল না। মন খারাপ করে সব চুড়ি ফেরত দিলেন। হাত থেকে চুড়ি বের করার সময় দুটা চুড়ি ভেঙে গেল। আপনি ভাঙা চুড়ির দাম দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, আবার ফিরে এসে ভাঙা চুড়ি দুটা নিয়ে চলে গেলেন। অসাধারণ, অসাধারণ! আমার হাতে অস্কার পুরস্কার থাকলে আজই একটা পেয়ে যেতেন।
বসুন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
ওসি সাহেব বসলেন। রিনকি বলল, এখানে যা করেছি সব নিজে বুদ্ধি খাটিয়ে করেছি। ডিরেক্টর শুধু বলেছে আপনি হাতে চুড়ি পরবেন। দাম না বনায় হাত থেকে চুড়ি খুলে দিয়ে চলে যাবেন। বাড়তি কাজ অর্থাৎ চুড়ি ভেঙে যাওয়া, ভাঙা চুড়ির টাকা দেওয়া এবং ভাঙা চুড়ি নিতে আবার আসা-সব আমি আমার চিন্তা থেকে করেছি।
আবারও বলছি, অসাধারণ।
আপনাকে ধন্যবাদ। আমার কপাল খারাপ, সব অগা মগা বগা ডাইরেক্টরের হাতে পড়ি।
এই ডাইরেক্টর কেমন? হিরন্ময় কারিগর। অগা মগা বগার মধ্যে কোন ক্লাসে পড়ে?
সে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বগা শ্রেণীর। বগার চেয়েও খারাপ, ছাগা বলতে পারেন।
ঠিকই বলেছেন, আসলেই ছগা। দুবারে এসএসসি পাশ করেছে। ইন্টারমিডিয়েটে আটকে গেছে। সেদিন এক পত্রিকায় ছাগার ইন্টারভ্যু ছাপা হয়েছে। ছাগা বলেছে সে অষ্ট্রেলিয়া থেকে সিনেমাটোগ্রাফির উপর ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। ডিগ্রি তো দূরের কথা, অস্ট্রেলিয়া কোথায় তা-ই ছগাটা জানে না।
তাকে চিনেন? আমার ছোট শ্যালক।
সরি, না জেনে অনেক কিছু বলেছি।
না জেনে কেন বলবেন! জেনেশুনেই বলেছেন। হাতি চেনে মাহুতকে, সাপ চেনে ওকপ্লাকে, নায়িকা চেনে ডিরেক্টরকে।
আপনি খুব গুছিয়ে কথা বলেন। আপনি কি অভিনয় করেন?
না, তবে আপনাকে দেখে অভিনয় করার ইচ্ছা হয়েছে। জানি পারব না। চা খবেন? চা দিতে বলব?
বলুন।
এখন কোন শট হবে?
বলতে পারছি না, ডিরেক্টর বলতে পারবেন।
নাজমুল হুদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দৃশ্য নেওয়াকে যে শট বলে তা-ই জানতাম না। পুলিশের লোক তো। আমার কাছে শট মানে গুলি করা।
আপনি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে?
জি। ধানমণ্ডির থানার ওসি ছিলাম, এখন আমাকে ক্লোজ করা হয়েছে।
আপনার ছেলেমেয়ে কী?
বিয়ের দ্বিতীয় দিনে আমার স্ত্রী মারা যান, তারপর আর বিয়ে করি নাই। একদিকে ভালোই হয়েছে। পুলিশের চাকরিতে ঘরে ফিরতে ফিরতে কোনোদিন রাত দুটা বাজে, কোনোদিন তিনটা বাজে। রেহনুমা দ্বিতীয় দিনে মরে গিয়ে বেঁচে গেছে।
আপনার স্ত্রী বিয়ের দ্বিতীয় দিনে মারা গেছেন শুনে খুব খারাপ লাগল। আমার আসলেই মনটা খারাপ হয়ে গেছে।
ওসি সাহেব বললেন, দ্বিতীয় দিনে মারা গেছে এটা মন খারাপ করার মতো কোনো ঘটনা না। সে ফাঁস নিয়ে মারা গেছে। অন্য জায়গায় প্রণয় ছিল। জোর করে বিয়ে দিয়েছে। কাজেই বিয়ের শাড়ি ফ্যানের সঙ্গে লাগিয়ে ফাঁসিতে ঝুলে পড়েছে।
Oh God! আপনার এই স্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তারপরেও আপনার যোগাযোগ আছে?
কেন থাকবে না? রেহনুমা মারা গেছে। তার বাবা-মা, ভাইবোন এরা তো বেঁচে আছে। রেহনুমারি ছোটভাই ছোটবোন দুজনই দুলাভাই বলতে পাগল।
মিস রিনকি ইতস্তত করে বললেন, কিছু মনে করবেন না। আপনি কি ঘুষ খান?
খাওয়ার খুবই ইচ্ছা হয়। কিন্তু খাই না। সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম, ঘুষ না খাওয়ার পেছনে এটা একটা কারণ। সাহিত্যের সঙ্গে অভাব যায়, ঘুষ যায় না।
এই মাসের ১৩ তারিখ রাতে কি আপনার কাজ আছে?
চাকরি থাকলে কাজ থাকবে। না থাকলে ফ্রি। কেন বলুন তো?
১৩ তারিখ আমার জন্মদিন। আমি সবসময় চেষ্টা করি জন্মদিনের রাতে ১৩জন ভালো মানুষ আমার সঙ্গে ডিনার করবেন। আপনাকে আমি সিলেক্ট করলাম। আমার জন্মদিনে আপনার নিমন্ত্রণ।
আমি ভালো মানুষ?
প্রাথমিকভাবে সে রকমই মনে হচ্ছে।
জীবনে প্রথম কেউ আমাকে ভালো মানুষ বলল। যাই হোক, এখন বলুন আপনাকে নিয়ে ১৩, নাকি বাদ দিয়ে ১৩?
আমাকে নিয়ে ১৩।
যিশুখ্রিস্টের লাষ্ট সাপারের মতো?
হ্যাঁ।
১৩ জনের মধ্যে কতজন জোগাড় হয়েছে?
আমি তো আছিই। আমাকে ছাড়া আর মাত্র দুজন জোগাড় হয়েছে। একজন আপনি। অন্যজনকে আপনি চিনবেন না। তার প্রধান কাজ রাতে ঢাকা শহরের পথে পথে হাঁটা। তার ভালো নাম হিমালয়। ডাকনাম হিমু। অনেক দিন হয়ে গেল তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। আপনি পুলিশের লোক, আপনি কি তাকে ১৩ তারিখের আগে খুঁজে বের করতে পারবেন?
কী নাম বললেন?
হিমু।
নাজমুল হুদের কাছে নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে। হিমু যে চোর-ডাকাত কেউ না এটা বোঝা যাচ্ছে। চোর-ডাকাতের নাম তার মনে থাকে। ভালো মানুষের নাম মনে থাকে না। তিনি নিশ্চিত মিস রিনকির নাম তার মনে থাকবে না। তবে মিস রিনকিকে নিয়ে দুলাইনের ছড়া বানালে নামটা মনে থাকবে। ভালো মানুষের নাম তিনি এইভাবে মনে রাখেন।
আনন্দ ফিনকি
নায়িকা রিনকি।
এই তো হয়েছে। রিনকি নাম তিনি আর ভুলবেন না। তিনি বিড়বিড় করে কয়েকবার ছড়াটা বললেন, যাতে কখনো ভুলে না যান।
রিনকি বলল, বিড়বিড় করে কী বলছেন?
নাজমুল হুদ বললেন, কিছু না কিছু না। তাকে অত্যন্ত লজ্জিত মনে হলো। আরেকটা ছড়া তার মাথায় এসেছে।
রিনকির চোখ কালো
এই মেয়েটা ভালো।
বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র
সকাল দশটা পাঁচ।
বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান কংকন ভাই তালা খুলে গবেষণা কেন্দ্ৰে ঢুকলেন। মেঝেতে অনেকগুলি পত্রিকা পড়ে আছে। তিনি পত্রিকার সংখ্যা গুনলেন। তার ভুরু খানিকটা কুঁচকাল। মাত্র চারটা পত্রিকা। গবেষণা কেন্দ্র থেকে সব পত্রিকা অফিসে চিঠি গেছে। নিয়মিত সৌজন্যসংখ্যা পাঠানোর জন্যে। গবেষণার জন্যে পত্রিকা প্রয়োজন। সবাই পাঠাচ্ছে না। চিঠিতে কাজ হবে না। কিসলুকে পাঠাতে হবে। সোজা আঙুলে ঘি না। উঠলে কিসলুর আঙুলে যি আনতে হবে।
কংকন ভাইয়ের পত্রিকা পড়ার অভ্যাস নেই (তার কোনোকিছু পড়ারই অভ্যাস নেই) তারপরেও একটা পত্রিকা হাতে নিলেন। নাম ভোর বাংলা। পত্রিকার প্রধান খবর–
রবীন্দ্ররহস্য ঘনীভূত
কংকন ভাই আগের কোনো খবর পড়েন নি, কাজেই রবীন্দ্ররহস্য বিষয়ে কিছুই জানেন না। রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুর ধরা পড়েছেন শুনে তিনি বিস্মিত হলেন। বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ থেকে গত মাসেই কবিগুরুর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কাঙালিভোজ হয়েছে। ওয়ান আইটেম। গরুর মাংসের তেহারি। এখন দেখা যাচ্ছে, তিনি বেঁচে আছেন এবং পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। এমন একজন সম্মানিত মানুষকে পুলিশ উধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া গ্রেফতার করবে না। তাহলে কি বর্তমান সরকার রবীন্দ্ৰনাথবিরোধী অবস্থান নিয়েছে? যদি নিয়ে থাকে তাহলে বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্ৰকেও একশনে যেতে হবে। কবিগুরুর কুশপুত্তলিকা দাহের ব্যবস্থা করতে হবে। কুশপুত্তলিকার অভাব নেই। তিনটা বানানোই আছে। কংকন ভাই মনোযোগ দিয়ে দ্বিতীয়বার খবরটা পড়ে মোটামুটি বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন।
একটা মেস থেকে রবীন্দ্রনাথকে গ্রেফতার করেছেন থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি জনাব গফুর। যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট, গাত্রবর্ণ গৌর। সাংবাদিকরা তার ছবি তুলেছেন।
কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে রবীন্দ্ৰনাথ বদল হয়েছেন। দেখা গেছে হাজাতের রবীন্দ্রনাথের উচ্চতা তিন ফুট। গাত্ৰবৰ্ণ ঘন কৃষ্ণ! ভারপ্রাপ্ত ওসিকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে।
রহস্য সমাধানের জন্যে ব্যাপক তদন্ত শুরু হয়েছে। দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কাছে আবেদন করা হচ্ছে, রবীন্দ্ৰনাটকের মূল নায়ককে পুলিশে ধরিয়ে দিতে। মূল নায়কের নাম ছামাদ মিয়া। ছামাদ মিয়া সম্পর্কে যে-কোনো তথ্য র্যাব বা থানাকে জানাতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
কংকন ভাই খবর পড়ে কিছুক্ষণের জন্যে তব্দা মেরে রইলেন। দেশে এত কিছু ঘটে গেছে তিনি জানতেন না। ছামাদ মিয়া সম্পর্কে তথ্য তার কাছে আছে! এই বদমাইশ কাজী নজরুল ইসলাম সেজে বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রে এসেছিল। থাপ্পড় খেয়ে বিদায় হয়েছে।
কংকন ভাই সিগারেট ধরালেন। চা ছাড়া সিগারেট টেনে সুখ পাওয়া যায় না। হাশেম এখনো আসে নি বলে চা খাওয়া যাচ্ছে না। গবেষণা কেন্দ্ৰে চা-কফির ব্যবস্থা আছে। সিগারেট টানতে টানতে কংকন ভাইয়ের মাথায় নতুন আইডিয়া চলে এল। তিনি খানিকটা উত্তেজিত বোধ করলেন। রবীন্দ্ৰ-ঝামেলা মিটে গেলেই এই আইডিয়া নিয়ে এগুতে হবে। দেরি করা যাবে না।
কংকন ভাই সিগারেট ধরালেন। চা ছাড়া সিগারেট টেনে সুখ পাওয়া যায় না। তার মোবাইল ফোন গত রাতে চুরি গেছে। মানুষ মোবাইল ফোন সেট পকেটে রাখে। কংকানও রাখত, আই ফোন কেনার পর পকেটে রাখা বন্ধ করেছে। আই ফোন হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘোরার আনন্দই আলাদা। সবাই সারাক্ষণ দেখছে হাতের মুঠোয় কী জিনিস। মানুষকে দেখাতে গিয়েই দুর্ঘটনা। হাতের মুঠোর জিনিস ফসকে গেছে। এখন কংকন ভাই খানিকটা স্বস্তি বোধ করছেন। মাথায় যে আইডিয়া এসেছে তার সফল বাস্তবায়ন হলে একটা নতুন আই ফোন কেনার পরেও হাতে কিছু ক্যাশ টাকা থাকবে।
বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রের নাম পাল্টে নজরুল পাঠচক্ৰ দেওয়া। এখানে লোকজন আসবে, জাতীয় কবির রচনা পাঠ করবে। তার সম্পর্কে জানবে।
বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্ৰ নাম রাখার কিছু বিপদ আছে। সরকার বদল হলেই নাম বদল হবে। নতুন নাম জিয়া গবেষণা কেন্দ্র। বাড়ি ছাত্রদলের দখলে চলে যাবে। নজরুল পাঠচক্র-এ এই চক্কর থাকবে না। নতুন নামকরণ উপলক্ষে কাঙালিভোজের আয়োজন করা হবে। আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলগুলোকে দাওয়াত দেওয়া হবে।
এটা কংকন ভাইয়ের অপ্রধান আইডিয়া। প্রধান আইডিয়া হচ্ছে, যখন রান্নাবান্না শুরু হবে তখন একদল উছুঙ্খল মানুষ হামলা করবে। অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে যাবে। কয়েকজন গুরুতর আহত হবে।
এতে লাভ দুটা। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না। ডেকোরেটরের কাছ থেকে রান্না করার হাঁড়িপাতিল ভাড়া করলেই হবে। জখমও হবে ডেকোরেটরের লোকজন। এদের জখম হওয়ার সময়ও হয়ে গেছে। ফ্রি সার্ভিস দিতে চায় না। ঘাড়ে ধরে আদায় করতে হয়। দেশের প্রতি মায়া নাই। আছে। টাকার ধান্দায়। বদমাইশের দল।
দ্বিতীয় লাভ হলো প্রচার।
কংকন ভাই কাঙালিভোজ উপলক্ষে চাঁদা সংগ্ৰহ কীভাবে করা যায় তা ভাবতে লাগলেন। আশেপাশের বাড়িতে যেতে হবে। সঙ্গে থাকবে কিসলু। কিসলুর চেহারা দেখলেই বাড়িওয়ালার কলিজা পানি হয়ে যাবে। মুখ ফুটে চাঁদা চাওয়ার আগেই চাঁদা চলে আসবে। চা-নাশতা চলে আসবে। অনেকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হবে। অতি ভদ্র অতি বিনয়ী নারীকণ্ঠে টেলিফোন যাবে।
নারীকণ্ঠ বলবে, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ থেকে বলছি। আমি রিনা। কেমন আছেন? শুভ দুপুর। (চাঁদা চাইতে হবে বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রের নামে। নজরুল পাঠচক্রের নামে চাঁদা চাইলে দুই টাকার ছেড়া নোটও পাওয়া যাবে না।)
টেলিফোনে যে নারীকণ্ঠ চাঁদা চাইবে সে কংকন ভাইয়ের স্ত্রী, নাম সুমনা। মহিলা লীগের প্রচার সম্পাদিকা। সুমনা আদর্শ পত্নী। স্বামীর সব কাজে সাহায্য করতে প্ৰস্তৃত। সে বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রের একজন গবেষক। মন্ত্রীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের তার ভালো দক্ষতা আছে। গত মাসেই ত্ৰাণমন্ত্রীর কাছ থেকে পাঁচশ কম্বল, তিনশ সুয়েটার এবং আঠারো টিন অলিভ ওয়েল নিয়ে এসেছে। সব গবেষণা কেন্দ্রে জমা আছে।
কংকন ভাইয়ের গভীর চিন্তামগ্ন অবস্থায় যিনি ঢুকলেন তার গায়ে হলুদ পাঞ্জাবি। পা খালি। তার নাম হিমু। ভালো নাম হিমালয়। তিনি কংকন ভাইকে দেখে বিনয়ে গলে গিয়ে বললেন, কংকন ভাই, কেমন আছেন? শুভ দুপুর।
কংকন ভাই বললেন, আপনি কে?
আমাকে একজন পাঠিয়েছে।
কে পাঠিয়েছে?
তাঁর নাম তো বলতে পারছি না। নিষেধ আছে। তিনি আপনার কাছে সামান্য চাঁদা চান। খুবই অল্প।
হতভম্ব কংকন ভাই অনেক কষ্টে নিজের হতভম্ব ভাব সামলালেন, তখন রাগ তাকে অভিভূত করল। তিনি রাগে তোতলাতে তোতলাতে বললেন, আমার কাছে চাঁদা চায়। বান্দির পুতটা কে?
কংকন ভাই, আপনি উনার বিষয়ে যে নোংরা কথা বলেছেন সেটা আমি শুনি নাই। মাঝে মাঝে আমি কানে কম শুনি। যাই হোক, আপনি তের তারিখ রাত আটটার মধ্যে টাকার ব্যবস্থা করবেন। বেশি না, তের লাখ। তের তারিখের সঙ্গে মিল রেখে তের লাখ; দশ তারিখ হলে বলতাম দশ লাখ। আপনার তিন লাখ টাকা বাঁচিত। কিন্তু উনি ডেট দিয়েছেন তের।
তের লাখ টাকা চাঁদা চায়! আমার কাছে? আপনি কে? কী নাম?
আমার নাম হিমু। অনেকে ডাকে হিমালয়। হিমালয় ঠান্ডা তো কাজেই হিমালয়। আমি নিজেও ঠান্ডা। আবার কেউ কেউ ডাকে হিমবাহ। হিমবাহ বুঝেন তো? পানির উপরে সামান্য বের হয়ে থাকে। সবটাই থাকে নিচে। আপনি আমার পানির উপরের অংশ দেখছেন। নিচেরটা দেখছেন না।
তোমার পেটের ভূড়ি বের করতে আমার এক মিনিট লাগবে। আমারে চিনো না।
আপনাকে কেন চিনব না! আপনি কংকন ভাইয়া। অন্যের বাড়ি দখল করে আসর জমিয়ে বসেছেন। আজ আপনি একা কেন? আপনার লোকজন কোথায়? মোবাইলে টেলিফোন করে লোকজন যে ডাকবেন তাও সম্ভব না। মোবাইল হারিয়ে ফেলেছেন, তাই না? আহারে, এমন দামি সেট!
তুই জানস ক্যামনে? এই মোবাইলের খবর তুই ক্যামনে জানস?
হিমু বলল, শুরু করেছিলেন আপনি, তারপর তুমি, এখন তুই।
আমি আপনি দিয়ে শুরু করেছি, শেষ পর্যন্ত আপনি বলব। ভদ্রতার খেলাফ হবে না; কষ্ট করে জানোলা দিয়ে একটু বাইরে তাকাবেন। কাউকে কি দেখা যায়? উনাকে চিনেন? উনার নাম জগলু। আঙুলকাটা জগলু। উনি নিজের আঙুল কাটেন না। অন্যের আঙুল কাটেন। এইজন্যেই নাম আঙুলকাটা জগলু। কংকন ভাই, আপনার এখানে চায়ের ব্যবস্থা আছে না? এক কাপ চা খাওয়া যাবে?
কংকন কিছু বলল না। অ্যাড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকাল। কিসলুর আসার কথা। এখনো কেন আসছে না। জানোলা দিয়ে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ভাওতাবাজি হতে পারে। আঙুলকাটা জগলুকে কংকন চিনে। আঙুলকাটা জগলু দিনেদুপুরে বের হবে না। তাছাড়া সে যতদূর জানে আঙুলকাটা জাগলু জেলে। তার কাছে মনে হচ্ছে পুরোটাই ভাওতাবাজি। দেশ চলছে ভাওতার উপরে।
কংকন ভাই, চায়ের কথা বলেছিলাম।
চা বানানোর লোক নাই।
অপেক্ষা করি, আপনার লোকজন আসুক। চা খাই। আমি আপনার এখান থেকে চা না খেয়ে চলে যাব এটা কেমন কথা? আপনার ইজ্জত আছে না?
সাহস থাকলে বসে থাক।
হিমু শান্ত গলায় বলল, সাহসের আমার অভাব নাই। সাহসের অভাব আপনার। আমি চায়ের জন্যে অপেক্ষা করব। আসুক আপনার লোকজন! শুনেছি আপনার এখানে ক্যারাম খেলা হয়, একদান ক্যারামও খেলব।
কংকনের ঠোঁটের কোনায় এই প্রথম সামান্য হাসির আভাস দেখা গেল। কারণ কিসলু আসছে। দরজা দিয়ে তাকে দেখা যাচ্ছে। কিসলুর সঙ্গে হাশেমও আছে।
কংকন বলল, তুই বোস তোরে আমি চা খিলাব। একজন মুখ হা করায়ে ধরে রাখবে অন্যজন মুখে গরম চা ঢালবে। যত পারিস খাবি।
হিমু বলল, ধন্যবাদ। চা মুখে ঢেলে দিবে, আমাকে কিছু করতে হবে না— এইজন্যে শুকরিয়া। কংকন ভাই, আপনি মহান।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে কিসলু ঢুকল। তার পেছনে পেছনে হাশেম। কিসলু ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলল, হিমু ভাই! আপনি এখানে। কী আশ্চর্য! আমাকে চিনেছেন?
না।
আমি কিসলু। আপনার জন্যে জানে বাঁচলাম। ঐ রাতে আপনি না থাকলে জানে মারতাম। ওরে ব্যাপারে, কী বিপদ যে গেছে! আপনারে এইখানে দেখব। চিন্তাই করি নাই। যে রাতে আপনারে প্রথম দেখি আমি কিন্তু আপনারে মানুষ ভাবি নাই। ভাবছি ফেরেশতা। কিছু মনে নিয়েন না হিমু ভাই, আপনারে কদমবুসি করব।
হিমু বলল, দ্রুত এক কাপ চা খাওয়াও তো কিসলু।
চা এক কাপ কী জন্যে খাবেন? চা খাবেন হাজার কাপ।
কংকন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। সে তার এক জীবনে অনেক বিস্ময়কর ঘটনা দেখেছে, এরকম দেখে নি। তার শরীর ঝিমঝিম করছে। সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করছে। বিচিত্র কারণে সিগারেট ধরাতে ভয় লাগছে।
কিসলু লোকটাকে কদম্বুসি করেছে এটা না হয় মানা গেল। তার দেখাদেখি হাশেমও কদমবুসি করে হাত কচলাচ্ছে—এর অর্থ কী?
হিমু বলল, কিসলু। চা দুকাপ বানাবে! বাইরে আঙুলকাটা জগলু আছে। উনাকে এক কাপ চা দিবে।
আঙুলকাটা জগলুর কাছে। এ না জেলে আছে?
হিমু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জেলে নকল জগলু। আসলটা বাইরে। তুমি চা নিয়ে যাও। দেখলেই চিনবে। আমি দোতলায় যাচ্ছি। কংকন ভাইকে দোতলায় পাঠাও। তার সঙ্গে আমার প্রাইভেট কিছু কথা আছে।
হিমু এবং কংকন ভাই মুখোমুখি বসা। হিমুর হাতে চায়ের কাপ। কংকন ভাইয়ের হাতে পানির গ্লাস। গ্লাসে কয়েক টুকরা বরফ। পানিতে ভদকা নামক ওষুধ খানিকটা দেওয়া হয়েছে। এই ওষুধ ভয় কমাতে সাহায্য করে। ওষুধের দুটা বোতল কংকন ভাইয়ের প্রাইভেট আলমারিতে সবসময় থাকে।
হিমু বলল, ভয় পেয়েছেন?
কংকন জবাব দিল না। হিমু বলল, আমাকে শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন। আমি নির্বিষ। তের লাখ টাকা চাঁদার কথা যা বলেছি সেটাও ভুয়া। আপনাকে চাঁদা জোগাড় করতে হবে না।
কংকন ভাইয়ের ফ্যাকশে মুখে কিছু রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে। ফ্যাকাশেভাব কিছুটা দূর হয়েছে। তিনি ঘনঘন গ্লাসে কয়েকটা চুমুক দিলেন। হিমু বলল, চাঁদা না দিলেও তের তারিখ এই বাড়িটা ছেড়ে দেবেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা অন্য কোথাও করবেন। ভালো কথা, আপনি ছাত্রলীগ করেন। বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নিহত হলেন তখন কিন্তু আপনার ছাত্রলীগ টু শব্দ করে নাই। মিটিং মিছিল দূরের কথা।
সেই সময়ের ছাত্রলীগ কী করছে তার দায়িত্ব তো আমাদের না।
হিমু বলল, আচ্ছা এই সময়ের ছাত্রলীগের কথাই হোক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে অ্যারেক্ট করে জেলে ঢোকানো হলো। তখনো কিন্তু আপনারী টু শব্দ করেন নি। মিটিং না, মিছিল না। আজ অন্যের বাড়ি দখল করে গবেষণা কেন্দ্র খুলে বসেছেন।
ওষুধে কাজ দিয়েছে। হারানো সাহস ফিরে আসছে। কংকন খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল, আপনি কি ভেবেছেন এত সহজে পার পেয়ে যাবেন? না। আমি এর শোধ যদি না নেই। আমার নাম কংকন না। আমার স্ত্রীর নাম সুমনা না।
হিমু নামের মানুষটা হাসছে। এই লোকটা হাসছে কেন? তার হাসির কী আছে? হাসির শব্দ শুনে কংকনের আবার ভয় লাগতে শুরু করেছে। কংকন বড় করে গ্লাসে চুমুক দিল। সে বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ফোঁস ফোঁস শব্দ হচ্ছে।
হিমু বলল, যে অন্যকে ভয় দেখায় সে নিজে সবসময় ভয়ের মধ্যে থাকে। ভয়ে আপনার কলিজা শুকিয়ে গেছে। ভয়ের প্রধান কারণ হলো, আপনি আমাকে বুঝতে পারছেন না। মানুষ ভূতপ্রেত বুঝে না বলে ভূতপ্রেত ভয় পায়। মৃত্যুকে বুঝতে পারে না বলে মৃত্যু ভয় পায়। আপনি আমাকে এই কারণেই ভয় পাচ্ছেন। আমি এখন চলে যাব। ভাই, ভয়টা দূর করেন। কাউকে ভয় দেখাতে আমার ভালো লাগে না । এরপরেও কেন যে মাঝে মাঝে ভয় দেখাই!
এই বাড়ি বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রের জন্যে ছামাদ দান করেছে। আমার কাছে দলিল আছে। আমার নামে দলিল ।
আপনি আবার ছামাদের নামে দলিল করে দিবেন। ছামাদ বেচারার নিজের বাড়ি থাকতে ফুটপাতে ঘুমায়।
সেটা আমার দেখার বিষয় না। বাড়ি লিখে দেওয়ার সময় মনে ছিল না?
হিমু উঠে দাঁড়াল। শান্ত গলায় বলল, ভাই আমি যাচ্ছি। সুমনা ভাবিকে আমার সালাম দিবেন।
হিমুকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল কিসলু। কিসলু গলা নামিয়ে বলল, আপনি বললেন আঙুলকাটা জগলুর কথা। আমি চা নিয়ে দেখি কেউ নাই। তখনই বুঝলাম ঘটনা আছে। হিমু ভাই, ঘটনা কী? আঙুলকাটা জগলুকি ছিল?
না।
তার কথা কী জন্যে বলেছেন?
কংকনকে ভয় দেখানোর জন্যে বলেছি।
কংকন ভাই ভয় খাওয়ার জিনিস না, তয় আপনারে বিরাট ভয় পাইছে। অবশ্য আপনারে তো ভয় পাইতেই হবে।
হিমু বলল, কিসলু যাই?
কিসলু বলল, চলেন একটা চায়ের দোকানে বসি। আপনার সঙ্গে এক কাপ চা খাই। আপনার মুখ থেকে দুটা ভালো কথা শুনি। চারদিকে মন্দ কথা শুনি, দুষ্ট কথা শুনি। দুটা ভালো কথা শুনতে মন চায়।
রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চি পাতা। হিমু এবং কিসলু বসেছে। হিমু হাসিতে হাসতে বলল, ভালো কথা শোনার জন্যে প্রস্তুত?
কিসলু বলল, জি হিমু ভাই।
হিমু বলল, একজন সাধুর গল্প শোনো। সাধুর নাম ঋষি কাশ্যপ। তার কাছে ভয়ঙ্কর এক খুনি এসেছে। সে সাধুর কাছে দীক্ষা নিতে চায়।
সাধু বললেন, তুমি অতি ভয়ঙ্কর মানুষ। তারপরেও তোমাকে আমি দীক্ষা দিব। একটা শর্ত আছে। আজ সন্ধ্যার মধ্যে তোমাকে যে-কোনো একটা ভালো কাজ করতে হবে।
কী রকম ভালো কাজ সাধুজি?
যে-কোনো ভালো কাজ। যত তুচ্ছই হোক ভালো কাজ হলেই হবে। একটা ভালো কাজ করে আমার কাছে আসবে, আমি তোমাকে দীক্ষা দিব।
ভয়ঙ্কর মানুষ ভালো কাজের সন্ধানে বের হলো। একটা কুকুরের সঙ্গে তার দেখা। কুকুরটা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে যাচ্ছে, কারণ তাঁর একটা ঠ্যাং নেই। পিঠে ঘা। ভয়ঙ্কর মানুষটার মনে হলো কুকুরটা কষ্ট পাচ্ছে। তার কষ্ট লাঘব হওয়া দরকার। সে থান ইট দিয়ে কুকুরের মাথায় বাড়ি দিয়ে তাকে মেরে ফেলে সাধুর কাছে উপস্থিত হয়ে ভালো কাজটা কী করেছে তা বলল। বিস্তারিত বলল। সে ভালো কাজ করতে পারায় আনন্দিত।
সাধুজি বললেন, হ্যাঁ ঠিক আছে। স্নান করে আসো, তোমাকে দীক্ষা দেব।
কিসলু বলল, এটা কী করে সম্ভব? ঐ লোক তো ভয়ঙ্কর মন্দ কাজ করেছে। ভালো কাজ তো করে নাই।
হিমু বলল, যে ভালো কাজ করতে পারে তার দীক্ষার প্রয়োজন নাই। যে ভালো কাজ করতে পারে না তারই দীক্ষার প্রয়োজন।
হিমু ভাই, জটিল গল্প শুনলাম।
হিমু বলল, এই গল্প আমি আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি। বাবা প্রায়ই আমাকে শিক্ষামূলক জটিল জটিল গল্প বলতেন। ভালো কাজ বাঁ সৎকর্ম নিয়ে বাবার একটা থিওরি আছে। থিওরিটা সত্য। শুনবে?
কিসলু আগ্রহ নিয়ে বলল, শুনব।
বাবা বলতেন, যে-কোনো মানুষ যদি প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ সাত দিন করে সে মহাপুরুষের পর্যায়ে উঠে যাবে। এর পর সে যা-ই বলবে তা-ই সত্য হবে।
বলেন কী!
চেষ্টা করে দেখবে? প্রতিদিন একটা ভালো কাজ করাও কিন্তু বেশ কঠিন।
অবশ্যই চেষ্টা করে দেখব। এখনই একটা ভালো কাজ করব। ঐ দেখেন হিমু। ভাই, একটা বুড়া মানুষ রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছে, গাড়ির কারণে পার হতে পারছে না। তাকে যদি রাস্তা পার করায়ে দেই কাজটা কি ভালো কাজ হবে?
অবশ্যই হবে। কিসলু। লাফ দিয়ে উঠে দাড়াল। ছুটে গেল রাস্তায়। দুহাত তুলে গাড়ি থামাল। বৃদ্ধকে হাত ধরে রাস্তা পার করল। বৃদ্ধ বলল, আব্বাজি, আপনার নাম?
কিসলু বলল, আমার ডাকনাম কিসলু।
বৃদ্ধ বলল, আধাঘন্টার উপর চেষ্টা করতেছিলাম। রাস্তা পার হইতে পারি নাই। আপনে পার করেছেন। আজ মাগরেবের ওয়াক্তে আপনার জন্যে দোয়া করব বলে আপনার নাম জানতে চেয়েছি।
কিসলুর চোখে পানি এসে গেল। সে বের হলো দ্বিতীয় ভালো কাজের সন্ধানে। একটা ভালো কাজ করে সে তৃপ্তি পাচ্ছে না।
হিমুর বাবা ভালো কাজ বিষয়ে হিমুকে লিখিত উপদেশ দিয়ে গেছেন। তিনি লিখেছেন–
বাবা হিমালয়,
ভালো কর্ম বা সৎকর্ম করার তোমার প্রয়োজন নাই। সৎকর্ম নেশার মতো। একটি সৎকর্ম করলে আরেকটি করতে ইচ্ছা করবে। সৎকর্মের নেশা তৈরি হবে। যে-কোনো নেশাই মানুষের জন্যে ক্ষতিকর। নেশা হলো নেশা। ভালো নেশা মন্দ নেশা বলে কিছু নাই। তুমি সেই সৎকর্ম করবে। যা অন্যরা করতে পারছে না। অন্যদের করার ক্ষমতা নাই।
সৎকর্ম যেমন নেশা তৈরি করে অসৎকর্মও করে।
এখন কি বুঝতে পারছি সৎকর্ম অসৎকর্ম একই মুদ্রার দুই পিঠ?
কিসলু সন্ধ্যা মেলাবার আগেই চারটি সৎকর্ম করে ফেলল। সৎকর্ম এবং তার ফলাফল নিম্নরূপ–
১. বৃদ্ধকে রাস্ত পার করানো।
(বৃদ্ধ তার নাম জানতে চেয়েছে এবং বলেছে মাগরেবের নামাজে তার জন্যে দেয়া করবে।)
২. একজন টোকাইকে পাউরুটি এবং কলা কিনে দেওয়া।
(টোকাই পাউরুটি-কলা হাতে নিয়েই দৌড় দিয়েছে। তার আচরণ রহস্যময়।)
৩. এক মহিলা মালিবাগ যাবে, রিকশা পাচ্ছিল না। কোনো রিকশাই মালিবাগ যাবে না। তার জন্যে রিকশার ব্যবস্থা করে দেওয়া।
(এই মহিলার আচরণও টোকাইয়ের মতো। সে গম্ভীরমুখে রিকশায় উঠেছে। কিসলুর দিকে ফিরেও তাকায় নি। যেন রিকশা এনে দেওয়া কিসলুর দায়িত্ব।)
৪. একজন ট্রাফিক পুলিশকে এক বোতল পানি কিনে দেওয়া।
(পানির বোতল পেয়ে ট্রাফিক পুলিশ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে প্রায় পানি আসার উপক্রম। ট্রাফিক পুলিশ বলল, ভাই, আপনি আমাকে পানির বোতল দিলেন। কী জন্যে? কিসলু বলল, অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করেছি আপনি রোদে দৌড়াদৌড়ি করছেন। আপনাকে দেখে মনে হলো, আপনার পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। ডিউটি ছেড়ে যেতে পারছেন না। ট্রাফিক পুলিশ বলল, ভাই আপনি হাতটা বাড়ান। আপনার হাতটা একটু ধরব।)
সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে, এখন ভালো কাজ না করলেও চলে; ভালো কাজ সন্ধ্যা পর্যন্ত করার কথা। তারপরেও কিসলুর মাথায় ঘুরতে লাগল—আর কী করা যায়? সে রীতিমতো অস্থির।
ধানমণ্ডি থানা থেকে ক্লোজ করে খাগড়াছড়ি
অফিসার গফুরকে ধানমণ্ডি থানা থেকে ক্লোজ করে খাগড়াছড়ি থানায় ওপেন করা হয়েছে। তিনি সেখানে ভালো আছেন। থানা কম্পাউন্ডের পেছনে অনেকখানি জায়গা। তিনি সেখানে সবজি চাষ শুরু করেছেন। পাহাড়ি বেগুন লাগিয়েছেন। থানায় কাজকর্ম নাই। পাহাড়িয়া ঘুস দেওয়া শিখতে পারে নি বলে থানায় আসে না। মামলা-মোকদ্দমা নাই। ঝামেলা নিজেরা মিটিয়ে ফেলে; কাজেই অফিসার গফুর সবজি চাষে মন দিয়েছেন। রাতে জঙ্গল দেখেন। হাতির ভয়ে সারা রাত তাকে জেগে থাকতে হয়। প্রায়ই বন্য হাতির পাল বের হয়। এদের ঝোকাটা কোনো এক দুৰ্বোধ্য কারণে থানার দিকে। একটা পুরো রাত তাকে থানা কম্পাউন্ডের বিশাল শিরিষগাছে উঠে কাটাতে হয়েছে। সেই রাতে হাতির পাল আরেকটু হলে থানায় ঢুকে যেত। শিরিষগাছে দ্রুত ওঠার জন্যে তিনি অর্ডার দিয়ে একটা মই বানিয়েছেন। মই গাছের সঙ্গে সেট করা হয়েছে।
নাজমুল হুদকে পুরনো জায়গায় এনে ওপেন করা হয়েছে। রবীন্দ্ৰ-সমস্যার পূর্ণ সমাধানের জন্যে তাকে সাত দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সাত দিনে সমাধান না হলে তাকেও খাগড়াছড়ি যেতে হবে। ১৩ তারিখ সাত দিন শেষ হবে। তবে খাগড়াছড়ি নিয়ে তিনি চিন্তিত না। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, চাকরি ছেড়ে দেবেন। তার মধ্যে অভিনয়ের প্রবল আকাঙ্ক্ষা দেখা যাচ্ছে। তিনি আজিজ সুপার মার্কেট থেকে একটা বই কিনেছেন। বইয়ের নাম অভিনয় কলা। বইয়ে অভিনয়-বিষয়ে অনেক টিপস দেওয়া আছে। চোখের এবং মুখের এক্সারসাইজ দেওয়া আছে। আয়নার সামনে এইসব এক্সারসাইজ তিনি নিয়মিত করছেন। গলার স্বর উন্নত করার জন্যে হারমোনিয়াম কিনে সারেগামাপাধানিসা করছেন। আবৃত্তি ক্লাসে ভর্তি হয়ে বৃন্দ আবৃত্তি করছেন।
রাতে তার ভালো ঘুম হচ্ছে না। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছেন। সব স্বপ্নই অভিনয়বিষয়ক এবং প্রতিটি স্বপ্নে মিস রিনকি থাকছেন। শুধু থাকছেন তা-না, তার স্ত্রী হিসেবে অভিনয় করছেন। গত রাতের স্বপ্নে তিনি এবং মিস রিনকি একটা স্কুলের সামনে দাঁড়ানো। দুজনেই ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ হচ্ছে তাদের শিশুকন্যা স্কুলে। তারা শিশুকন্যাকে নিতে এসেছেন। স্বপ্নে শিশুকন্যার নাম জানা যায় নি।
ওসি সাহেব তার খাসকামরায়। আজ তার মেজাজ ভয়ঙ্কর খারাপ। মেজাজ খারাপের প্রধান এবং একমাত্র কারণও মিস রিনকি! পত্রিকায় তাকে নিয়ে একটা খবর বের হয়েছে। তিনি নাকি চিত্ৰজগতের সুপার হিরো গালিব খানের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন। প্রতিবেদক দাবি করছেন, তার কাছে কাবিননামার ফটোকপি আছে। প্রয়োজনে তিনি তা প্ৰকাশ করবেন। মিস রিনকি এবং গালিব খানের ছবিও ছাপা হয়েছে। ছবিতে দুজন দুজনের দিকে প্ৰেমপূৰ্ণ নয়নে তাকিয়ে আছেন।
ওসি সাহেবের ইচ্ছা করছে ভয়ঙ্কর কিছু করতে, যাতে এক কথায় তার নিজের চাকরি চলে যায়। খাকি পোশাক পরে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। ভয়ঙ্কর কী করবেন তাও মাথায় আসছে না। আপাতত বলপয়েন্টের খোঁচায় গালিব খানের দুটা চোখ ফুটা করে দিয়েছেন। অন্ধ গালিব খানকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে।
নাজমুল হুদের এমন মানসিক অবস্থায় থানায় ঢুকাল কংকন ভাই। সে এসেছে সচেতন নাগরিক হিসাবে ছামাদ মিয়া বিষয়ে তথ্য দিতে এবং হিমুকে নিয়ে একটা ডায়েরি করিয়ে রাখতে। ডায়েরিতে লেখা হবে হিমু তাকে জীবননাশের হুমকি দিয়েছে।
ওসি সাহেব, আমার নাম কংকন। আমি বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান পরিচালক। ভালো আছেন?
এই বলে কংকন হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়াল। ওসি সাহেব ও বলে ঝিম মেরে রইলেন। হ্যান্ডশোকের জন্যে হাত বাড়ালেন না। কংকনের মাথা ঝিমঝিম করছে। সে হাত বাড়িয়ে আছে, ওসি সাহেব হাত বাড়াচ্ছেন না। এ-কী ভয়ঙ্কর অপমান! এত বড় অপমানের ভেতর দিয়ে তাকে একবার শুধু যেতে হয়েছিল। সে গিয়েছিল ধর্মমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। তাকে এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখার পর মন্ত্রীর পিএস বলল, দেখা হবে না। কংকন বলল, আপনি কি উনাকে আমার কার্ড দিয়েছেন? পিএস বলল, দিয়েছিলাম। মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, দেখা হবে না। কংকন সেই অপমানের শোধ ভালোভাবে নিয়েছিল। এক পয়সা দামের ওসির অপমানের শোধ সে কীভাবে নিবে তা-ই এখন ভাবছে। কংকন, হাসিমুখে বলল, আপনি বোধহয় লক্ষ করেন নি। আমি হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়িয়েছি।
ওসি সাহেব। আবারও বললেন, ও। এবারও তাকে হাত বাড়াতে দেখা গেল না। তিনি রিভলভিং চেয়ারে একটা চক্কর দিলেন। হাতের বলপয়েন্ট দিয়ে গালিব খানের নাম কেটে লিখলেন গাধা খান।
কংকন গম্ভীর মুখে বসল। হাত গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া তার আর কিছু করার নেই। ঘরে ওসি ছাড়া আর কেউ নেই বলে তার অপমান কারও চোখে পড়ল না। মানী ব্যক্তির মান আল্লা রক্ষা করেন-কথাটা ভুল না।
আপনাকে আগে একবার বলেছি, মনে হয় মিস করেছেন, আমি বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান পরিচালক।
ওসি সাহেব খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে বললেন, তাহলে বলেন দেখি বঙ্গবন্ধু পাঞ্জাবির নিচে গেঞ্জি পরতেন নাকি পরতেন না? ঝটপট জবাব চাই।
হতভম্ব কংকন বলল, এটা আমাদের গবেষণার বিষয় না। ওসি সাহেব, আমার নাম কংকন। নামটা আপনার পরিচিত থাকার কথা। আমি ছাত্রলীগের…
কংকন কথা শেষ করার আগেই নাজমুল হুদ আনন্দিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, পাইছি তোরে।
কী বললেন? বললাম, পাইছি তোরে। তুই ছামাদের বাড়ি দখল করে গবেষণা কেন্দ্ৰ খুলেছিস। ঠিক ধরেছি না? আজ তোকে পাকিস্তানি ডলা দেওয়া হবে। পাকিস্তানি ডলা কী জানস? উপরের চামড়া থাকবে টাইট, ভিতরে হাডিড গুড়া। এক্কেবারে ট্যালকম পাউডার।
কংকন বলল, আপনি বোধহয় জানেন না। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনাকে খাগড়াছড়িতে ট্রান্সফার করতে পারি।
ট্রান্সফার কর। তারচেয়ে ভালো হয়। চাকরি খেয়ে ফেল। বান্দরের বাচ্চা খান্দর। তুই একটা খান্দর। খান্দর কী জানস? বান্দরের থাকে একটা লেজ আর খান্দরের থাকে দুইটা লেজ। তোর প্যান্টের ভিতর আছে দুইটা লেজ। পাছায় হাত দিয়ে দেখ।
কংকন শান্ত গলায় বলল, আপনার টেলিফোনটা কি ব্যবহার করতে পারি? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটা কল করব।
কোনো সমস্যা নাই, কল কর। আইজি স্যারকে করা। প্রধানমন্ত্রীর পিএসকে কর। যত ইচ্ছা টেলিফোন করতে থাক। টেলিফোন করার আগে মাথাটা একটু সামনে এগিয়ে আন। তোর কান মিলে দিব।
কী বললেন?
বললাম মাথাটা একটু সামনে আন, তোর কান মলে দিব। বান্দরের বাচ্চা খান্দর।
ইউ আর এ ম্যাড পারসন।
নাজমুল হুদ আনন্দিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। বেল টিপে কনস্টেবলকে ডেকে বললেন, এই খান্দরটাকে কানে ধরে হাজতে নিয়ে ঢুকাও।
কংকন কল্পনাও করে নি। সত্যি সত্যি এই কাজ করা হবে। এক পয়সা দামের কনস্টেবল তাকে কানে ধরে হাজতে ঢোকাবে। হাজতের দেয়ালে হেলান দিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে মোবাইল ফোন নেই যে সে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তার গা বিমঝিম করছে। বারবার মনে হচ্ছে এইসব কিছুই ঘটে নাই। সে দুঃস্বপ্ন দেখছে। ঘুম ভাঙলেই দেখবে সে সুমনার পাশে শুয়ে আছে। তার পায়ের উপর সুমনার গাবদা পা।
ওসি সাহেব মিস রিনকির খবর আরেকবার পড়লেন। তার মেজাজ আরও খানিকটা খারাপ হলো। তিনি গাধা খান নাম কেটে লিখলেন খান্দর খান। এতে তার মন খানিকটা শান্ত হলো। খ এর অনুপ্রাসটা ভালো লাগছে। এইসময় থানায় ঢুকাল কেয়া-খেয়ার বাবা, আফতাব। সে ভয়ে ভয়ে বলল, স্যার আমার মেয়ে দুটার সংবাদ নিতে এসেছি। ওদের নাম…
ওসি সাহেব কথা শেষ করতে দিলেন না। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, হাজতে ঢুকে যাও। দেরি করবা না। এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনক, এর মধ্যে হাজতে ঢুকবে।
আফতাব বলল, আপনি কী বললেন বুঝলাম না। স্যার, কোথায় ঢুকে যাব?
হাজতে ঢুকে যাবে। আর কোথায়?
আফতাব ভীত গলায় বলল, আমার মেয়েরা কি আপনাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে? ওদের কথা বিশ্বাস করার কিছু নাই।
ওসি সাহেব বিকট গলায় চিৎকার দিলেন, ঘাউ!
আফতাব লাফ দিয়ে সরে গেল। বিকট ঘাউ সে আশা করে নি। ওসি সাহেব ছামাদের কাছে ঘাউ শুনেছিলেন। তার মস্তিষ্ক ঘাউ জমা করে রেখে দিয়েছিল, সময় বুঝে বের করেছে। আফতাব বিড়বিড় করে বলল, স্যার আমি নিরাপরাধ।
ঘাউ ঘাউ!
এবারের ঘাউ প্ৰচণ্ড নিনাদে। সেকেন্ড অফিসার এবং দুজন কনস্টেবল ছুটে এল। আফতাব বলল, জোবেদা নিজে ফাঁসিতে ঝুলেছে। আমি নামাতে গেছি। মেয়েরা এটা বুঝে নাই। তারা ভেবেছে আমি ফাঁসিতে ঝুলায়েছি।
কেয়া খেয়ার মা।
সে ফাঁসিতে ঝুলল কেন? তার সমস্যা কী?
জানি না স্যার কী সমস্যা।
তোর কী সমস্যা? আফতাব চুপ করে আছে। তার কলিজা শুকিয়ে আসছে। তিন বছর আগের ঘটনা সবাই ভুলে বসে আছে। আজ হঠাৎ কী হয়ে গেল।
ওসি সাহেব বললেন, পুলিশ ইনভেসটিগেশন হয় নাই?
হয়েছিল। পুলিশ রিপোর্ট দিয়েছে আত্মহত্যা।
পুলিশকে কত টাকা দিয়েছিলি?
তিন লাখ চব্বিশ হাজার। ভিটামটি সব গেছে।
ম্যাজিষ্ট্রেট খবর দিয়ে আনাচ্ছি। ম্যাজিস্ট্রিটের সামনে জবানবন্দি দিবি। যা ঘটেছে সব খুলে বলবি।
স্যার, আমার ফাঁসি হয়ে যাবে। বাচ্চাগুলিকে কে দেখবে?
আমি দেখব। সেকেন্ড অফিসার, হ্যান্ডকাফ পরায়ে চেয়ারের সাথে একে আটকে দাও। ম্যাজিস্টেটকে খবর দাও। বদমাইশটা জবানবন্দি দিবে। দিবি না?
জি স্যার দিব।
যে ওসিকে ঘুস দিয়েছিলি তার নাম কী?
স্যার উনার নাম গফুর। মুখে বসন্তের দাগ।
কংকনকে হাজত থেকে বের করা হচ্ছে। সে বলল, খবর তাহলে হয়েছে। ওসি সাহেব নিশ্চয়ই পাতলা পায়খানা শুরু করেছেন। কাপড়াচোপড় নষ্ট করে ফেলার কথা। হা হা হা।
সেকেন্ড অফিসার বললেন, হা হা বন্ধ। তোকে ডলা দিতে নিয়ে যাচ্ছি। ফিমেল হাজত খালি, ঐখানে তোকে ডলা দেওয়া হবে। ওসি সাহেবের হুকুম।
কংকন হতভম্ব গলায় বলল, ওসি সাহেবের না হয় মাথা খারাপ। ভাই, আপনার কি মাথা খারাপ? আমি ছাত্রলীগের বিশিষ্ট কর্মী। বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক।
সেকেন্ড অফিসার গলা নামিয়ে বললেন, আমি ছাত্রজীবনে ছাত্রদল করেছি। আপনাকে পাকিস্তানি ডলা আমি নিজে দিব। পনেরো মিনিট ডলার পর আপনি যদি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তাহলে ডলা বন্ধ হবে। তা না হলে ডলা চলতেই থাকবে। তুলতুলা শরীর বানায়েছেন, ডলা দিতেও আরাম হবে।
কংকনের মুখে স্কচটেপ লাগানো হলো। কোনোরকম শব্দ করার তার উপায় রইল না।
আফতাব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়েছে। সে স্ত্রী হত্যার দায় স্বীকার করেছে। ওসি সাহেবের ঘাউ শব্দই তার জন্যে কাল হয়েছে।
কংকানও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়েছে। তবে তার জন্যে পাকিস্তানি কৌশলের প্রয়োজন পড়েছে। কংকন বলেছে–
আমি ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম। পুলিশ কী করে যেন টের পায়। দৌড়ে আমাকে ধরে ফেলে। আমার পকেটে যে পিস্তল পাওয়া গেছে এটা আমার। বুকপকেটের ক্ষুরটা এক নাপিতের দোকান থেকে সংগ্রহ করেছি।
প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্যে পিস্তল, ক্ষুরু, চাপাতি, রাম দা, পুলিশের সংগ্রহে পুলিশের সংগ্রহে সবসময় থাকে।
কংকনের সঙ্গে তার স্ত্রী সুমনার টেলিফোনের কথাবার্তা মূল কাহিনীর জন্যে জরুরি না। তারপরেও উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারছি না। পুরো টেলিফোনের কথাবার্তা ওসি সাহেবের সামনে হয় এবং কথাবার্তা রেকর্ড করা হয়। বিচারপর্ব শুরু হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর কথাবার্তা আলামত হিসাবে কোর্টে জমা দেওয়া হয়।
কংকন : হ্যালো সুমনা।
সুমন : সারা দিন কোনো খোঁজ নাই। মোবাইল হারায়ে ফেলেছি, তোমার তো উচিত ছিল আজ একটা মোবাইল কেনা। তুমি কোথায়?
কংকন : আমি ধানমণ্ডি থানায়।
সুমনা; থানায় কেন? কোনো সমস্যা? কথা বলছ না কেন? হ্যালো হ্যালো।
কংকন : আমি ধরা পড়েছি সুমনা।
সুমনা : কী করেছ যে ধরা পড়েছ। কথা বলো না কেন? হ্যালো হ্যালো।
কংকন : ছিনতাই।
সুমনা : ছিনতাই মানে? তুমি ছিনতাই করেছ?
কংকন : করার আগেই ধরা পড়েছি।।এই পর্যায়ে সেকেন্ড অফিসার চাপা গলায় বললেন, আপনার পকেটে কি পাওয়া গেছে ভাবিকে কাইণ্ডলি বলেন, না বললে আবার পাকিস্তান।
সুমনা : হ্যালো হ্যালো।
কংকন : পুলিশ আমার পকেটে পিস্তল আর ক্ষুর পেয়েছে।
সুমনা : পিস্তল, কার পিস্তল?
কংকন : আমার।
সুমনা : হায় খোদা, তুমি কী বলো!
[সেকেন্ড অফিসার বললেন, ভাবিকে বলুন, I love you, আজ ভ্যালেনটাইনস ডে।]
কংকন : সুমনা I love you.
আজ ভ্যালেনটাইনস ড়ে জানার পর ওসি সাহেব খানিকটা বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। কাকতালীয়ভাবেই তখন তার কাছে একটা টেলিফোন এল।
নারীকণ্ঠ : হ্যালো!
ওসি : আপনি কে? কাকে চান?
নারীকণ্ঠ : ধমকাচ্ছেন কেন? পুলিশে চাকরি করেন বলে কেউ টেলিফোন করলেই ধমক দিয়ে শুরু করবেন? সরি বলুন।
ওসি : আপনি কে? কী চান?
নারীকণ্ঠ : আমি রিনকি। আমি কিছু চাই না।
ওসি : মিস রিনকি, ক্ষমা চাই, ক্ষমা চাই, ক্ষমা চাই, ক্ষমা চাই।
নারীকণ্ঠ : একবার ক্ষমা চেয়েছেন যথেষ্ট। একশবার ক্ষমা চাই বলতে হবে না।
ওসি : আপনি আমাকে টেলিফোন করবেন চিন্তাই করি নাই। ম্যাডাম, আপনাকে অভিনন্দন জানাতে ভুলে গেছি।
নারীকণ্ঠ : অভিনন্দন কেন? আমি কী করেছি?
ওসি : আপনার বিয়ের খবরটা কাগজে পড়লাম। হাওয়া থেকে পাওয়া। ছবিসহ নিউজ। আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছে।
নারীকণ্ঠ : আপনি মনে হয় নিয়মিত কাগজ পড়েন না। নিয়মিত কাগজ পড়লে জানতেন যে মাসে একবার আমার বিয়ে হয়।
ওসি : Oh my God! বিয়ে করেন নি? আমার বুক থেকে মনে হচ্ছে দুই মণ ওজনের গ্রানাইট পাথর নেমে গেছে।
নারীকণ্ঠ : আমার বিয়ে হয় নি। তাতে আপনার বুক থেকে পাথর নামল কেন?
ওসি : না মানে ইয়ে, আমি আপনার ভক্ত তো। ভক্তদের কাছে নায়িকার বিয়ে হওয়া দুঃসংবাদ। আমি কি বোঝাতে পেরেছি?
নারীকণ্ঠ : জি পেরেছেন। আচ্ছা শুনুন আমি খুবই অসুস্থ। জ্বর। একটু আগে থার্মোমিটার দিয়ে মেপেছি—একশ দুই। আপনি কি আমাকে দেখতে আসবেন?
ওসি : এক্ষুনি আসছি। ঠিকানা বলুন।
নারীকণ্ঠ : খালি হাতে আসবেন না। ফুল আনবেন। আজ ভ্যালেনটাইনস ডে।
ওসি : অবশ্যই ফুল আনব। অবশ্যই। অবশ্যই, অবশ্যই।
নারীকণ্ঠ : আপনি আবার ভেবে বসবেন না যে আমি আপনার প্রেমে পড়েছি।
ওসি : আমি ভাবছি না। নায়িকারা নায়কদের প্রেমে পড়ে। খাকি পোশাক পরা পুলিশের প্রেমে পড়ে না। নিয়ম নাই।
ওসি সাহেবের সঙ্গে দুই হাজার টাকা ছিল। তিনি সেকেন্ড অফিসারের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ধার করে পাঁচ হাজার টাকার গোলাপ কিনলেন। পাঁচ টাকা করে গোলাপের পিস। এক হাজার গোলাপ পাওয়া গেল।
যেদিন তার স্ত্রী রেহনুমা মারা যায় সেদিন ভোরবেলায় তিনি তার স্ত্রীকে এক হাজার গোলাপ উপহার দিয়েছিলেন।
জনৈক মন্ত্রী টেলিফোন করেছেন। ওসি সাহেব থানায় নেই। টেলিফোন ধরলেন সেকেন্ড অফিসার। মন্ত্রী মহোদয় বললেন, আপনি কি অফিসার ইনচার্জ?
জি স্যার, ওসি সাহেব অপারেশনে গেছেন। আমি সেকেন্ড অফিসার। আমার নাম আখলাখ।
কংকন নামে কেউ কি আপনাদের কাস্টডিতে আছে?
জি স্যার।
তিনি আমাদের একজন বিশিষ্ট কর্মী। তাকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।
অবশ্যই স্যার। আমি নিজে গাড়ি করে বাসায় পৌঁছে দিব।
ধন্যবাদ। আপনার নামটা যেন কী?
আখলাখ।
আপনি ভালো অফিসার। আমি আপনার জন্যে হাই লেভেলে সুপারিশ করব।
স্যার। থ্যাংক য়্যু।
কংকনকে কতক্ষণের মধ্যে রিলিজ করছেন?
আপনার কাছ থেকে লিখিত অর্ডার পাওয়া মাত্র রিলিজ করে দিব। কংকন ভাইজানের নিউজ পত্রিকায় চলে গিয়েছে তো, এখন রিলিজ করলে পত্রিকাওয়ালারা আমাকে ধরবে। আপনার লিখিত অর্ডার পেলে বলতে পারব মন্ত্রীর লিখিত নির্দেশে সন্ত্রাসী ছেড়ে দিয়েছি।
মন্ত্রী মহোদয় বললেন, হুঁ।
আখলাখ বললেন, স্যার আমার সামনে একজন সাংবাদিক বসে আছেন। কংকন ভাইকে রিলিজ করতে বলছেন তো, উনি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। উনাকে টেলিফোনটা দেই?
মন্ত্রী মহোদয় সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে দিলেন।
আখলাখের সামনে কেউ নেই। মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলার কৌশল সে শিখেছে ওসি নাজমুল হুদের কাছে। আখলাখ হাজতের দিকে গেলেন। কংকনকে বের করলেন। কংকন বলল, মন্ত্রীর টেলিফোন এসেছে?
অখিলাম বললেন, হুঁ। এখন বুঝবি কত ধানে কত চাল। আখলাখ বললেন, আমার আগে তুই বুঝবি। তোকে নিয়ে যাচ্ছি ডলা দিতে। যতবার মন্ত্রীর টেলিফোন আসবে ততবার ডলা খাবি।
ভাই, আমি তো জবানবন্দি দিয়েছি। আপনি বলেছিলেন জবানবন্দি দিলে ডলা দিবেন না। ভাই, আপনার পায়ে ধরি, আমার স্ত্রীর সঙ্গে একটু যোগাযোগ করায়ে দেন। আমি তাকে বলব যেন আর কোনো মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ না করে। আপনাকে আমি ভাই ডাকলাম। ধর্মের ভাই।
আখলাখ কংকনকে তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিল। সুমনা বলল, তুমি ভয় পেয়ো না। আমি হাই লেভেলে যোগাযোগ করেছি। এখন যাচ্ছি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে।
কংকন বলল, সব যোগাযোগ বন্ধ করো। তুমি কিসলুকে খুঁজে বের করো। যদি কেউ কিছু করতে পারে কিসলু পারবে। আর কেউ কিছু পারবে না।
কিসলু সৎকাজের সন্ধানে বের হয়েছে। চুনোপুটি সৎকাজের বদলে রুই, কাতলা টাইপ সৎকাজ তার ভাগ্যে জুটেছে। ঝিনাইদহ থেকে এক ফ্যামিলি এসেছে ঢাকায়। বাস থেকে নামতে গিয়ে পরিবারের প্রধান ট্রাকের ধাক্কায় ছিটকে পড়েছে। এখন মারা যায়, তখন মারা যায় অবস্থা। কিসলু তাকে নিয়েই ছোটাছুটি
তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ডাক্তার বলেছেন। ছয় ঘণ্টা পার না হলে কিছু বলা যাবে না। কিসলু ঠিক করেছে ছয় ঘণ্টা সে হাসপাতালেই থাকবে। কখন কী দরকার হয়। আহত মানুষটির স্ত্রী কিসলুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাবা, আপনি আমার ছেলে। কিসলু বলল, মা, অস্থির হবেন না। এক মনে আল্লাকে ডাকেন। আমার মন বলছে সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লা মেহেরবান।
ছয় ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই ডাক্তার বললেন, পেশেন্টর অবস্থা অনেক ইমপ্রুভ করেছে। আশঙ্কামুক্ত।
কিসলুর এখানকার দায়িত্ব শেষ। সে পরের সৎকাজের সন্ধানে পথে নেমেছে।
আজি রজনীতে হয়েছে সময়, এসেছি বাসবদত্তা
মেসের ঘরে হিমু শুয়ে আছে। শহর জুড়ে লোডশেডিং। আকাশে থালার মতো চাদ ওঠায় শহর অন্ধকারে ড়ুবে যায় নি। জানোলা দিয়ে হিমুর ঘরে জোছনা ঢুকেছে। জোছনার কোনো রঙ থাকে না; শুধু সিনেমার জোছনা হয় নীল। হিমুর কাছে আজ রাতের জোছনা সিনেমায় জোছনার মতো নীল লাগছে। জোছনারাতে বনে যাওয়ার নিয়ম। হিমু চোখ বন্ধ করে বলল, শহরটা অরণ্য হয়ে যাক। হিমু। চোখ মেলল, হ্যাঁ শহরটা অরণ্য হয়ে গেছে। এখন শহরের অলিতে গলিতে হাঁটা মানে গহীন বনের ভেতরের পায়ে চলা পথে হাঁটা।
দরজার আড়াল থেকে কেউ একজন ক্ষীণ গলায় ডাকল, হিমু ভাই।
হিমু বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, কে ছামাদ?
জি হিমু ভাই।
বাইরে কেন? ভিতরে আসো।
লজ্জায় ঘরে ঢুকতে পারতেছি না। সারা দিন এক পিস টেষ্ট বিস্কুট আর এক কাপ চা ছাড়া কিছুই খাই নাই। ভাত খাইতে মন চাইতেছে। চারটা ভাতের ব্যবস্থা করতে পারবেন?
হিমু বলল, বুঝতে পারছি না। নীল জোছনার রাতে হা করে জোছনা খাওয়া নিয়ম। ভাত খাওয়া ঠিক না।
তাহলে বাদ দেন। না খেয়ে আমার অভ্যাস আছে।
বাদ দিলাম। চলো আজ জোছনা খাব।
চলেন যাই। পুলিশের ভয়ে লুকায়া ছাপায়া থাকি। স্বাধীন চলাফেরা বন্ধ। আপনার সঙ্গে আজ হাঁটব।
হিমু বলল, জোছনারাতে পুলিশ কাউকে ধরে না। নিয়ম নাই। ভয়ঙ্কর কোনো সন্ত্রাসীর দেখা পেলেও আজ রাতে পুলিশ তার দিকে তাকিয়ে হাসবে। নীল জোছনার নিয়ম তাই।
হিমু পথে নামল। তার হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে তার বিশেষ কোনো গন্তব্য আছে। গন্তব্যহীন পথযাত্রা না। তারা দুজন প্রেসক্লাবের সামনে এসে দাঁড়াল। শহর এখনো অন্ধকারে ডুবে আছে। ন্যাশনাল গ্রীডে নিশ্চয়ই বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে। সমস্যা যে হয়েছে তা আকাশের চাঁদ ধরতে পেরেছে। সে জোছনা বাড়িয়ে দিয়েছে।
আরে, হিমু ভাই না?
কে কিসলু?
জি।
সৎকাজ চালিয়ে যাচ্ছ?
এর উপরেই আছি। আজ সারা দিনে কী কী করেছি শুনেন। হাসপাতালে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। কারও A নেগেটিভ ব্লাড লাগবে কি না। ব্লাড দিলাম। তারপর একজনরে পাওয়া গেল রাস্তায় উসটা খেয়ে পড়ে চশমা ভেঙে ফেলেছে। চশমা ছাড়া কিছুই দেখে না। আন্ধা। তারে বাড়িতে নিয়া গেলাম। সে আমারে ছাড়বে না। ভাত খাওয়াবে। তারপর…
কিসলু! সৎকাজের বর্ণনা বন্ধ। আমি ছামাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। তোমাদের বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্রের বাড়িটা ছামাদের। তুমি তাকে বাড়ির দখল বুঝিয়ে দিবে। আজ রাতেই নিয়ে যাবে। এই একটা সৎকাজে অনেক দূর আগাবে।
অবশ্যই আমি উনারে নিয়া যাব; বাড়ির দখল যেন তার থাকে সেই চেষ্টা নিব। হিমু ভাই, আমি অনেকদূর আগায়েছি। এখন অনেক কিছু বুঝতে পারি।
কী রকম?
ছামাদ ভাই সারা দিন কিছু খান নাই। উনার ভাত খাইতে ইচ্ছা করতেছে। এইটা পরিষ্কার বুঝতে পারতেছি।
ঠিকই বুঝেছ। তুমি আরও অনেকদূর যাবে। চলো হাঁটতে বের হই।
উনার খাওয়ার ব্যবস্থা আগে করি।
না।
তারা তিনজন হাঁটতে হাঁটতে ধানমন্ডি লেকের পড়ে চলে এল। কিসলু বলল, জোছনা ফাইট্যা পড়তাছে। ঠিক না হিমু ভাই?
হুঁ।
চলেন লোকের ধারে বসি।
চলো।
তারা তিনজন কাঁঠালগাছের নিচে এসে বসল। কঁঠালগাছের বড় বড় শিকড় বের হয়ে লেকের পানির দিকে নেমে গেছে। শিকড়ে বসার সুন্দর জায়গা তৈরি হয়েছে।
প্রকৃতির নিজের হাতে বানানো বেঞ্চ। তিনজন চুপচাপ বসে আছে। কারও মুখে কোনো কথা নাই। ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে কাঁঠালগাছের পাতায় শব্দ হচ্ছে। গাছে কাকের বাসা। হঠাৎ একসঙ্গে কয়েকটা কাক কা কা করে উঠল। এদের সঙ্গে আশেপাশের অনেক কাক যুক্ত হলো। চারদিকে কী কী কী কী কা। ছামাদ ভীত গলায় বলল, হিমু ভাই! ঘটনা কী?
হিমু বলল, প্রবল জোছনায় কাকদের মধ্যে বিভ্ৰম তৈরি হয়। তারা ভোর হয়েছে ভেবে ডাকাডাকি শুরু করে। প্রকৃতি যে শুধু মানুষের জন্যে বিভ্রম তৈরি করে তা-না, পশুপাখি সবার জন্যেই তৈরি করে।
কে যেন এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। বাইশ-তেইশ বছরের একজন যুবক। তার হাতে একটা পুঁটলি। লেকের পানি ঘেসে সে এগুচ্ছে। পানিতে সুন্দর ছায়া। যেন দুজন মানুষ এগিয়ে আসছে। একজন আসছে পানির ভেতর দিয়ে। যুবক এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। শান্ত গলায় বলল, আপনারা এখানে কী করেন?
হিমু বলল, জোছনা দেখি।
আপনাদের মধ্যে হিমু কে?
আমি।
যুবক বলল, আপনারা কি রাতের খানা খেয়েছেন?
হিমু বলল, না।
আপনাদের জন্যে খানা নিয়ে এসেছি।
হিমু বলল, খাবার কে পাঠিয়েছে?
যুবক জবাব না দিয়ে পুটলি খুলে প্লাস্টিকের বাক্স বের করল। তিনটা বাক্স। বড় এক বোতল পানি! কাগজের প্লেট, প্লাষ্টিকের চামচ।
হিমু আবারও বলল, খাবোর কে পাঠিয়েছে?
যুবক বলল, খাবার গরম আছে খেয়ে নেন। খাবার পাঠিয়েছেন রূপা আপা। উনি জানালা দিয়ে আপনাকে দেখেছেন। আপনি উনার বাড়ির সামনে দিয়ে এসে গাছের নিচে বসেছেন।
হিমু বিড়বিড় করে বলল, আজি রজনীতে হয়েছে সময়, এসেছি বাসবদত্তা। কাকদের কা কা চিৎকারের কারণে হিমুর কথা বোঝা গেল না। নীল জোছনায় কাকদের হৃদয়ে অস্থিরতা। তারা তাদের অস্থিরতা ছড়িয়ে দিতে চাইছে। মানুষ যেমন ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়, ফুল ছড়িয়ে দেয় সৌরভ।