- বইয়ের নামঃ হরপ্রিয়া
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
জয় হরপ্রিয়া শিবরঞ্জনী
জয় হরপ্রিয়া শিবরঞ্জনী
কোরাস গান
(শিবরঞ্জনী)
(জয়) হরপ্রিয়া শিবরঞ্জনী।
শিব-জটা হতে সুরধনী-স্রোতে
ঝরি শতধারে ভাসাও অবনি॥
দিবা দ্বিপ্রহরে প্রথম বেলা
কাফি-সিন্ধুর তীরে কর খেলা,
দীপ্ত নিদাঘে সারঙ্গ রাগে
অগ্নি ছড়ায় তব জটার ফণী॥
কভু ধানশ্রীতে মায়া-রূপ ধর,
জ্ঞানী শিবের তেজ কোমল কর,
পিলু বারোঁয়ায় বিষাদ-ভোলানো
নূপুরের চটুল ছন্দ আন॥
বাগীশ্বরী হয়ে মহিমা শান্তি লয়ে
আস গভীর যবে হয় রজনি॥
বরষার মল্লারে মেঘে তুমি আস,
অশনিতে চমকাও, বিদ্যুতে হাস,
সপ্তসুরের রঙে সুরঞ্জিতা
ইন্দ্রধনু-বরণি॥
সৈন্ধবী।
কথা কও হরপ্রিয়া শিব-সীমন্তিনী।
দিবা দ্বিপ্রহরের প্রথমার্ধ বেলা
তোমার তনুর জ্যোতি চুরি করি যেন
ঝলমল করে স্বর্ণ-রাগে। কথা রাখো,
তুমি না কহিলে কথা, না হাসিলে তুমি
রবির কনক-ছটা ম্লান হয়ে যায়!
হরপ্রিয়া।
সৈন্ধবী! তুই তো জানিস–
দেখি নাই কতদিন মনোহর হরে।
ধ্যানমগ্ন কোন লোকে কোন রূপ ধরি
কী লীলা যে করিছেন তিনি –
আমি মহামায়া হয়ে জানিতে না পারি।
বল সহচরী। কেন এলি ফিরি
দেবাদিদেব মোর শিব শম্ভুর
পেয়েছিস কোনো সন্ধান?
সৈন্ধবী।
মহাদেবী! সেই কথা এসেছি জানাতে–
যে লীলা করেন তব শিব সুন্দর
শ্যামসুন্দর সাজে, রস-বৃন্দাবনে।
নওল কিশোর রূপ নব ঘনশ্যাম–
মেঘ-অনুলিপ্ত যেন তুষার কৈলাস।
গলে ফণী-হার নাই দোলে বনমালা
জটাজূট হইয়াছে চাঁচর চিকুর,
শশীলেখা হইয়াছে বাঁকা শিখী-পাখা
বিষাণ হয়েছে বাঁশি, বাঘছাল তাঁর
হইয়াছে পীতধরা, মুনি-মনোহর।
শুনি সেই চপলের ঘরছাড়া সুর
গোপিনীরা ধেয়ে আসে পাগলিনি হয়ে।
ঝর ঝর ঝরে শাওন ধারা
ঝর ঝর ঝরে শাওন ধারা
[গান]
রামদাসী মল্লার – ত্রিতাল
ঝর ঝর ঝরে শাওন ধারা।
ভবনে এল মোর কে পথহারা॥
বিরহ-রজনি একেলা যাপি
সঘনে বহে ঝড় সভয়ে কাঁপি।
উথলি উঠে ঢেউ কুটিরে নাহি কেউ
গগনে নাহি মোর চন্দ্রতারা॥
নিভেছে গৃহদীপ নয়নে বারি,
আঁধারে তব মুখ নাহি নেহারি।
তোমার আকুল কুন্তল-বাসে
চেনা দিনের স্মৃতি স্মরণে আসে।
আজি কি এলে মোর প্রলয়-সুন্দর
ঝলকে বিদ্যুতে আঁখি-ইশারা॥
নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায়
নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায়
[গান]
নীলাম্বরী-ত্রিতাল
নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায়
কে যায়, কে যায়, কে যায়?
যেন জলে চলে থল-কমলিনী
ভ্রমর নূপুর হয়ে বোলে পায় পায়॥
কলসে কঙ্কণে রিনিঝিনি ঝনকে,
চমকায় উন্মন চম্পা বনকে,
দলিত অঞ্জন নয়নে ঝলকে,
পলকে খঞ্জন হরিণী লুকায়॥
অঙ্গের ছন্দে পলাশ-মাধবী আশোক ফোটে,
নূপুর শুনি বন-তুলসীর মঞ্জরি উলসিয়া ওঠে।
মেঘ-বিজড়িত রাঙা গোধূলি
নামিয়া এল বুঝি পথ ভুলি।
তাহারই অঙ্গ তরঙ্গ-বিভঙ্গে
কূলে কূলে নদীজল উথলায়॥
হরপ্রিয়া। সাহানা!
পাগলিনি-প্রায় কোথা হতে এলি?
সাহানা। হরপ্রিয়া!
কুমার কিশোর রূপ দেখেছ শিবের?
রেবা-নদী-তীরে আমি দেখিয়াছি।
সে কি স্বপ্ন? সে কি ভুল?
হোক ভুল। সেই ভুল ফুল হয়ে ফুটিয়াছে মনে।
সুগন্ধে ভরপুর সারা অন্তর।
হরপ্রিয়া। কোথায়, কী হেরিলি সাহানা?
সাহানা। হেরিনু স্বপনে – না, না, স্বপ্ন নয়
দিব্য আঁখি পেয়ে আমি হেরিয়াছি–
নিবিড় অরণ্যে এক সুরম্য প্রাসাদে
আমি যেন গাহিতেছি গান।
সহসা দুয়ারে,
আসিল তরুণ শিব ভিখারির বেশে।
কী যেন চাহিল ভিক্ষা।
তখনও সুরের ঘোর কাটেনি আমার।
কী বলিয়া দিয়াছিনু তাহারে বিদায় –
শুনিবে সে গান?
মুরলী-ধ্বনি শুনি ব্রজনারী
মুরলী-ধ্বনি শুনি ব্রজনারী
[গান]
সৈন্ধবী–সাদ্রা
মুরলী-ধ্বনি শুনি ব্রজনারী
যমুনা-তটে আসিল ছুটে
কুল-মান-যৌবন দিল চরণে ডারি॥
পবন গতিহীন রহে,
যমুনা উজান বহে,
বাঁশরি শুনি বিসরে গীত
ময়ূর-ময়ূরী শুকশারি॥
সচকিত ধেনুগণ তৃণ নাহি পরশে ;
পুবালি-হাওয়া কানন-পথে
নীপ-কেশর বরষে।
বেভুল আহিরিনি
চেয়ে থাকে উদাসিনী,
বাঁশরি শুনি বিসরি গেল
নিতে গাগরিতে বারি॥
হরপ্রিয়া। সাবন্তী!
তাপদগ্ধ শ্রান্ত তনুলতা
নিদারুণ তৃষ্ণা লয়ে কোথা হতে এলি?
কঠোর তপস্বী মহাযোগী শিব শংকর
কি কহিলেন তোরে?
সাবন্তী। বিস্ময়-বিমূঢ়া আমি; দেবী হরপ্রিয়া!
হিমগিরি শিরে তোমারে দেখিয়া এনু
বালিকার বেশে, তপস্বিনী উমা-রূপে।
শংকর সেথা উমাপতি-রূপে
করিছেন লীলা।
কৈলাসে পার্বতী তুমি শিব-সোহাগিনি।
হিমালয়ে উমা তুমি শিব-বিরহিণী
তপস্বিনী মহাভাবে নিমগ্না!
উমার তপস্যা-তেজে ধরা দগ্ধপ্রায়,
তৃষ্ণায় কাতর জড়জীব।
মেঘ-বিহীন খর-বৈশাখে
মেঘ-বিহীন খর-বৈশাখে
[গান]
সাবন্তী সারং – তেতাল
মেঘ-বিহীন খর-বৈশাখে
তৃষ্ণায় কাতর চাতকী ডাকে॥
সমাধি-মগ্না উমা তপতী
রৌদ্র যেন তাঁর তেজঃজ্যোতি
ছায়া মাগে ভীতা ক্লান্ত কপোতী–
কপোত-পাখায় শুষ্ক-শাখে॥
শীর্ণা তটিনী বালুচর জড়ায়ে
তীর্থে চলে যেন শ্রান্ত পায়ে।
দগ্ধ-ধরণি যুক্ত-পাণি
চাহে আষাঢ়ের আশিস-বাণী।
যাপিয়া নির্জলা একাদশীর তিথি
পিপাসিত আকাশ যাচে কাহাকে॥
হরপ্রিয়া। কী লো নীলাম্বরী!
একদৃষ্টে মোর পানে চেয়ে
মৃদুমন্দ হাসি – কী হেরিস্ অমন করিয়া?
দেখেছিস তুই বুঝি পিনাকপাণিরে?
নীলাম্বরী। হুঁ! দেখিয়াছি শিবে শিবানীর সাথে।
হরপ্রিয়া। শিবানীর সাথে? সে কোন শিবানী?
নীলাম্বরী। যে শিবানীর একরূপ হ্লাদিনী রাধিকা।
যে শিবানী গোলোকে রাধিকা,
শিবলোকে হরপ্রিয়া
বৈকুন্ঠে কমলা
বৃন্দাবনে তিনিই শ্রীমতী হয়ে নীল শাড়ি পরি
নীল যমুনার তীরে করিছেন লীলা!
যখন আমার গান ফুরাবে তখন এসো ফিরে
যখন আমার গান ফুরাবে তখন এসো ফিরে
[গান]
সাহানা–ত্রিতাল
যখন আমার গান ফুরাবে তখন এসো ফিরে
ভাঙবে সভা বসব একা রেবা নদীর তীরে॥
গীতশেষে গগন-তলে
শ্রান্ত তনু পড়বে ঢলে
ভালো যখন লাগবে না আর সুরের সারঙ্গিরে॥
মোর কন্ঠের জয়ের মালা তোমার গলায় নিয়ো।
ক্লান্তি আমার ভুলিয়ে দিয়ো প্রিয়, হে মোর প্রিয়।
ঘুমাই যদি কাছে ডেকো
হাতখানি মোর হাতে রেখো
জেগে যখন খুঁজব তোমায় অকূল অশ্রুনীরে
তখন এসো ফিরে॥
হরিপ্রিয়া। মোর অনুবর্তিনীরা একে একে সবে
আসিল ফিরিয়া মোর কাছে।
কোথায় মেঘলা-মতী? সে তো ফিরিল না?
জান হে সন্ধান তাহার?
তারই শুধু হল নাকি শিব দর্শন?
কে তুমি তরুণ?
মল্লার। চরণে প্রণাম লহো দেবী হরপ্রিয়া!
আমি মেঘমল্লার তব কিংকর।
মেঘলা-মতীরে লয়ে আমি গিয়াছিনু
যোগীন্দ্র শিবের সন্ধানে।
সরযূর তীরে।
হেরিয়া শ্রীরামচন্দ্রে ছদ্মবেশি শিবে,
মেঘবর্ণা তব সহচরী আর ফিরিল না।
রামদাসী মল্লার-রূপে
নব জন্ম, নব দেব লয়ে
নব দূর্বাদলশ্যাম-রামের অর্চনা
করিছে যে অযোধ্যায়, ভারতে, ধরায়।
আজও মোর মনে পড়ে –
তার সেই সকরুণ গান।