- বইয়ের নামঃ রাঙা জবা – শ্যামাসংগীত
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আঁধার-ভীত এ চিতে যাচে মা গো আলো আলো
আঁধার-ভীত এ চিতে যাচে মা গো আলো আলো ।
বিশ্ববিধাত্রী আলোকদাত্রী
নিরাশ পরানে আশার সবিতা জ্বালো
জ্বালো আলো আলো॥
হারিয়েছি পথ গভীর তিমিরে,
লহো হাতে ধরে প্রভাতের তীরে,
পাপ তাপ মুছি করো মাগো শুচি
আশিস অমৃত ঢালো॥
দশপ্রহরণধারিণী দুর্গতিহারিনী দুর্গে
মা অগতির গতি
সিদ্ধিবিধায়িনী দনুজদলনী
বাহুতে দাও মা শকতি।
তন্দ্রা ভুলিয়া যেন মোরা জাগি
এবার প্রবল মৃত্যু লাগি
রুদ্র দাহনে ক্ষুদ্রতা দহো
বিনাশো গ্লানির কালো॥
আজও মা তোর পাইনি প্রসাদ
আজও মা তোর পাইনি প্রসাদ
আজও মুক্ত নহি।
আজও অন্যে আঘাত দিয়ে
কঠোর ভাষা কহি॥
মোর আচরণ, আমার কথা
আজও অন্যে দেয় মা ব্যথা,
আজও আমার দাহন দিয়ে
শতজনে দহি॥
শত্রু-মিত্র মন্দ-ভালোর যায়নি আজও ভেদ,
কেহ পীড়া দিলে, প্রাণে আজও জাগে খেদ।
আজও জাগে দুঃখশোকে
অশ্রু ঝরে আমার চোখে
আমার আমার ভাব মা আজও
জাগে রহি রহি॥
আদরিণী মোর শ্যামা মেয়েরে কেমনে কোথায় রাখি
আদরিণী মোর শ্যামা মেয়েরে
কেমনে কোথায় রাখি।
রাখিলে চোখে বাজে ব্যথা বুকে
(তারে) বুকে রাখিলে দুখে ঝুরে আঁখি॥
শিরে তারে রাখি যদি
মন কাঁদে নিরবধি,
(সে) চলতে পায়ে দলবে বলে
পথে হৃদয় পেতে থাকি॥
কাঙাল যেমন পাইলে রতন
লুকাতে ঠাঁই নাহি পায়।
তেমনি আমার শ্যামা মেয়েরে
জানি না রাখিব কোথায়।
দুরন্ত মোর এই মেয়েরে
বাঁধিব আমি কী দিয়ে রে,
(তাই) পালিয়ে যেতে চায় সে যবে
অমনি মা বলে ডাকি॥
আমার ভবের অভাব লয় হয়েছে শ্যামা-ভাবসমাধিতে
আমার ভবের অভাব লয় হয়েছে
শ্যামা-ভাবসমাধিতে।
শ্যামা-রসে যে-মন আছে ডুবে
কাজ কীরে তার যশ-খ্যাতিতে॥
মধু যে পায় শ্যামা-পদে
কাজ কী রে তার বিষয়-মদে,
মুক্তি যে-মন যোগমায়াতে
ভাবনা কী তার রোগ-ব্যাধিতে॥
কাজ কী রে তার লক্ষ টাকায়,
মোক্ষ-লক্ষ্মী যাহার ঘরে;
কত, রাজার রাজা প্রসাদ মাগে
সেই ভিখারির পায়ে ধরে।
ও মা, শান্তিময়ী অন্তরে যার,
দুঃখ-শোকে ভয় কী রে তার,
সে, সদানন্দ সদাশিব জীবন্মুক্ত ধরণিতে॥
আমার হৃদয় অধিক রাঙা মাগো
আমার হৃদয় অধিক রাঙা মাগো
রাঙা জবার চেয়ে।
আমিসেই জবাতে ভবানী তোর
চরণ দিলাম ছেয়ে॥
মোর বেদনার বেদির পরে
বিগ্রহ তোর রাখব ধরে,
পাষাণ-দেউল সাজে না তোর
আদরিণী মেয়ে॥
স্নেহ-পূজার ভোগ দেব মা, অশ্রু-পূজাঞ্জলি,
অনুরাগের থালায় দেব ভক্তি-কুসুমকলি।
অনিমেষ আঁখির বাতি
রাখব জ্বেলে দিবারাতি,
(তোর) রূপ হবে মা আরও শ্যামা
অশ্রুজলে নেয়ে।
(আমার) অশ্রুজলে নেয়ে॥
আমার আনন্দিনী উমা আজও এল না তার মায়ের কাছে
(আমার) আনন্দিনী উমা আজও
এল না তার মায়ের কাছে।
হে গিরিরাজ দেখে এসো
কৈলাসে মা কেমন আছে॥
মোর মা যে প্রতি আশ্বিন মাসে
মা মা বলে ছুটে আসে;
মা আসেনি বলে আজও
ফুল ফোটেনি লতায় গাছে॥
তত্ত্ব-তালাশ নিইনি মায়ের
তাই বুঝি মা অভিমানে
না এসে তার মায়ের কোলে
ফিরিছে শ্মশানে মশানে।
ক্ষীর নবনী লয়ে থালায়
কেঁদে ডাকি, ‘আয় উমা আয়!’
যে কন্যারে চায় ত্রিভুবন
তাকে ছেড়ে মা কি বাঁচে।
আমার উমা কই, গিরিরাজ, কোথায় আমার নন্দিনী
আমার উমা কই, গিরিরাজ,
কোথায় আমার নন্দিনী?
এ যে দেখি দশভুজা
এ কোন রণরঙ্গিণী॥
মোর লীলাময়ী চঞ্চলারে ফেলে,
এ কোন দেবীমূর্তি নিয়ে এলে।
এ যেমহীয়সী মহামায়া বামা মহিষমর্দিনী॥
মোর মধুর স্নেহে জ্বালাতে আগুন
আনলে কারে ভুল করে,
এরে কোলে নিতে হয় না সাহস,
ডাকতে নারি নাম ধরে।মা,
কে এলি তুই দনুজদলনী বেশে,
কন্যারূপে মা বলে ডাক হেসে,
তুই চিরকাল যে দুলালি মোর
মাতৃস্নেহে বন্দিনী॥
আমার কালো মেয়ে পালিয়ে বেড়ায়
(আমার) কালো মেয়ে পালিয়ে বেড়ায়
কে দেবে তায় ধরে।
(তারে) যেই ধরেছি মনে করি
অমনি সে যায় সরে॥
বনের ফাঁকে দেখা দিয়ে
চঞ্চলা মোর যায় পালিয়ে,
(দেখি) ফুল হয়ে মা-র নূপুরগুলি
পথে আছে ঝরে।
তার কন্ঠহারের মুক্তাগুলি আকাশ-আঙিনাতে
তারা হয়ে ছড়িয়ে আছে, দেখি আধেক রাতে।
আমি কেঁদে বেড়াই, কাঁদলে যদি
আসে দয়া করে॥
আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে, কে দিয়েছে গালি
আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে,
কে দিয়েছে গালি
(তারে) কে দিয়েছে গালি।
রাগ করে সে সারা গায়ে
মেখেছে তাই কালি॥
যখন রাগ করে মোর অভিমানী মেয়ে
আরও মধুর লাগে তাহার হাসিমুখের চেয়ে।
কে কালো দেউল করল আলো
অনুরাগের প্রদীপ জ্বালি॥
পরেনি সে বসন-ভূষণ,
বাঁধেনি সে কেশ,
তারই কাছে হার মানে রে ভুবনমোহন বেশ।
রাগিয়ে তারে কাঁদি যখন দুখে
দয়াময়ী মেয়ে আমার ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে;
(আমার) রাগি মেয়ে, তাই তারে দিই
জবা ফুলের ডালি॥
আমার মা আছে রে সকল নামে
আমার মা আছে রে সকল নামে,
মা যে আমার সর্বনাম।যেনামে ডাক শ্যামা মাকে
পুরবে তাতেই মনস্কাম॥
ভালোবেসে আমার শ্যামা মাকে
যার যাহা সাধ সেই নামে সে ডাকে,
সেই নামে মা দেয় রে ধরা
কেউ শ্যামা কয়, কেহ শ্যাম।
এক সাগরে মিশে গিয়ে
সকল নামের নদী সেই হরিহর কৃষ্ণ ও রাম,
দেখিস তাঁকে যদি,
নিরাকার সাকারা সে কভু,
সকল জাতির উপাস্য সে প্রভু,
নয় সে নারী নয় সে পুরুষ,
সর্বলোকে তাঁহার ধাম॥