- বইয়ের নামঃ পিপলী বেগম
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অবসর প্রকাশনা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
তারা তিন বোন — তিলু, বিলু, নীলু
তারা তিন বোন –তিলু, বিলু, নীলু। সবচে বড় হল তিলু, সে ভিকারুননেসা স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। খুব শান্ত মেয়ে।
তারপর বিলু, সেও ভিকারুননেসা স্কুলে পড়ে। ক্লাস থ্রী। সে মোটেও শান্ত না। দারুণ হৈ চৈ করে। কদিন আগে সিঁড়ি থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে। ভাঙ্গা হাত প্লাস্টার করে এখন তার গলায় ঝোলানো। বিলু খুব খুশি। হাতের প্লাস্টারে ছবি আঁকতে পারছে।
সবচে ছোট নীলু। এবার তার স্কুলে ভর্তি হবার কথা ছিল। অনেক কটা স্কুলে টেস্ট দিয়েও এলাউ হয় নি। নীলু খুব কেঁদেছিল। নীলুর বাবা মতিন সাহেব বলেছেন –মা পচা স্কুলগুলিতে তোমাকে পড়তে হবে না। আমিই তোমাকে পড়াব। নীলু অবাক হয়ে বলেছে, তুমি কি করে পড়াবে? তুমি তো মাস্টার না। তুমি ডাক্তার।
ডাক্তাররাও পড়াতে পারে মা।
না পারে না।
নীলুর কথাই ঠিক হয়েছে। মতিন সাহেব পড়াতে পারছেন না। সময় পাচ্ছেন না। তিনি সেই সকালে যান, ফিরতে রাত এগারোটা বাজে। তিলু বিলু ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ঘুম চোখে জেগে থাকে নীলু। মতিন সাহেব ঘরে ঢুকতেই সে বলে, বাবা আমাকে পড়াবে না?
অবশ্যই পড়াব মা।
বই নিয়ে আসব?
আজতো অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল থেকে আমরা শুরু করব।
আচ্ছা।
কালও শুরু করা যায় না, আরো দেরি হয়। তিলু বিলুর মা শাহানা একদিন বললেন, তুমি কয়েকদিন হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় থাকোতো। বাচ্চারা তোমার চেহারা ভুলে যাচ্ছে। একদিন দেখা যাবে রাস্তার কাউকে দেখে চেঁচিয়ে উঠবে –বাবা! বাবা!
মতিন সাহেব সত্যি সত্যি ছুটি নিয়েছেন। দুদিনের ছুটি। বাচ্চাদের সঙ্গে তিনি গত দুদিন ধরে আছেন। ওদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলেছেন। মনোপালি খেলেছেন, নাম-দেশ-ফুল-ফল খেলেছেন। এখন সন্ধ্যা। মেয়েরা বাবাকে ঘিরে বসেছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। ঘরে মোম জ্বালানো হয়েছে। গল্প শোনার রাত। মেয়েরা গল্প শুনতে চায়। মতিন সাহেব পড়েছেন বিপদে। কোন গল্পই তাঁর মনে আসছে না। পাঁচ মিনিট ধরে তিনি মাথা চুলকাচ্ছেন। মাথা চুলকালে ছেলেবেলায় শোনা কোন গল্প মনে পড়তে পারে –এই তাঁর ক্ষীণ আশা। মাথা চুলকানোয় কোন লাভ হচ্ছে না। তিলু বলল, কি হল বাবা, শুরু কর। তুমি না বলেছিলে আমাদের সব কথা শুনবে।
কি শুরু করব?
কি আবার, গল্প।
কিসের গল্প শুনতে চাও? ভূতের?
বিলু বলল, ভূতের গল্প আমি মরলেও শুনব না। একটা বাঘের গল্প বল, বাবা।
মতিন সাহেব ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যদি ছাদের দিকে তাকালে কিছু মনে পড়ে!
কি হল বাবা?
মনে করার চেষ্টা করছি।
মনে আসছে না?
উঁহু।
একবার শুরু করে দাও। শুরু করলেই দেখবে মনে পড়বে।
কিভাবে শুরু করব?
বল –এক দেশে ছিল এক বাঘ।
মতিন সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। বৃষ্টি আরো চেপে আসছে। কে জানে ঝড় শুরু হবে কি-না। তিনি অসহায় গলায় বললেন, তোর মা ফেরার পর গল্প শুরু করলে কেমন হয়? সেও শুনতে পেত।
নীলু বলল, মা আজ রাতে ফিরবে না, বাবা। মা ছোটমামার বাসা থেকে টেলিফোন করেছে। সে মামার বাসায় আটকা পড়েছে। বাড়ির সামনে এক-কোমর পানি। মা কাল ভোরে আসবে। মা বলেছে তুমি যেন আমাদের দেখেশুনে রাখ।
বলিস কি? এ তো আরেক যন্ত্রণা হল।
কোন যন্ত্রণা হয়নি, বাবা। তোমাকে কিছু দেখতে হবে না। তুমি গল্প বললেই হবে। তিন জনের জন্যে তিনটা গল্প। শুরু কর —
রাতের খাবারের কি ব্যবস্থা হবে।
মা রান্না করে রেখে গেছে। খিদে লাগলে আমরা খেয়ে নেব।
কি রান্না?
খিচুড়ি আর ডিমের তরকারী।
হাসের ডিম না মুরগীর ডিম?
বাবা তুমি ইচ্ছা করে –অন্য কথা বলছ। গল্প শুরু কর।
রাতের খাওয়ার পর শুরু করলে কেমন হয়?
খুব খারাপ হয়। শুরু কর বাবা।
মতিন সাহেব বললেন –এক দেশে ছিল এক পিপড়া …
তিলু চেঁচিয়ে বলল, বাবা তুমি কি বললে? কি ছিল?
পিপড়া।
পিপড়া? তুমি পিপড়ার গল্প বলবে?
হু।
পিপড়ার কি কোন গল্প হয়, বাবা?
বাঘের গল্প যদি হয়, হাতির গল্প যদি হয় তাহলে পিপড়ারও গল্প হয়।
বিলু বলল, এত ছোট একটা জিনিস চোখেই দেখা যায় না।
মতিন সাহেব বললেন, ভূতও তো চোখে দেখা যায় না। পিপড়া ছোট হলেও দেখা যায়।
তিলু বিলু বলল, আমরা পিপড়ার গল্প শুনব না। শুধু নীলু বলল, সে শুনবে। নীলু বলল, বাবা, তুমি আবার বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলবে না তো?
অসম্ভব। বানিয়ে বলব না।
সত্যি গল্প?
গল্প সব সময় সত্যি হয়। গল্প কখনো মিথ্যা হয় না।
তিলু বিলু বলল, সব গল্পই কি সত্যি?
অবশ্যই সত্যি।
একটা গল্পে যখন বাঘ কথা বলে সেটাও কি সত্যি?
সেটাও সত্যি। এমনি পৃথিবী আর গল্পের পৃথিবী –দুটি আলাদা পৃথিবী। দুটি পৃথিবীই সত্যি। আমাদের পৃথিবীতে বাঘ কথা বলে না, কিন্তু গল্পের পৃথিবীতে বলে। বুঝতে পারলে?
তিলু বিলু মাথা নাড়ল না, তবে নীলু মাথা নাড়ল অর্থাৎ সে বুঝেছে। বিলু বলল, বাবা দেখ নীলু কিছু না বুঝেই মাথা নাড়ছে। মতিন সাহেব বললেন, আমার ধারণা নীলু ঠিকই বুঝেছে ছোট বলেই যে সে কিছু বুঝবে না তা তো না। বরং ছোটরাই অনেক বেশি বোঝে।
মতিন সাহেব গল্প শুরু করলেন।
.
এক দেশে ছিল এক পিপড়া। মেয়ে পিপড়া। তার নাম পিপলী বেগম। বয়স খুব বেশি না, মানুষের হিসেবে তার বয়স তের বছর। দেখতে সে খুব সুন্দর। সবচে সুন্দর তার চোখ। ঝকঝকে নীল। চোখ দেখলেই বোঝা যায় পিপলী বেগমের খুব বুদ্ধি। স্কুলের পরীক্ষায় সে সব সময় ফার্স্ট হয়। শুধু সেবার পরীক্ষায় খুব খারাপ করল। অঙ্কে পেল মাত্র ১৯। ভূগোলে তেইশ। তাদের আপা পিপলীকে অফিসঘুরে ডেকে নিয়ে গেলেন।