- বইয়ের নামঃ বুলবুল (প্রথম খণ্ড)
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অধীর অম্বরে গুরু গরজন মৃদঙ বাজে
হাম্বীর — কাওয়ালি
অধীর অম্বরে গুরু গরজন মৃদঙ বাজে।
রুমু রুমু ঝুম মঞ্জীর-মালা চরণে আজ উতলা যে॥
এলোচুলে দুলে দুলে বন-পথে চল আলি
মরা গাঙে বালুচরে কাঁদে যথা বন-মরালী।
উগারি গাগরি ঝারি
দে লো দে করুণা ডারি,
ঘুঙট উতারি বারি,
ছিটা লো গুমোট সাঁঝে।
তালীবন হানে তালি, ময়ূরী ইশারা হানে,
আসন পেতেছে ধরা মাঠে মাঠে চারা-ধানে।
মুকুলে ঝরিয়া পড়ি আকুতি জানায় যূথী,
ডাকিছে বিরস শাখে তাপিতা চন্দনা তুতি।
কাজল-আঁখি রসিলি
চাহে খুলি ঝিলিমিলি,
চল লো চল সহেলি,
নিয়ে মেঘ-নটরাজে॥
আজি এ কুসুম-হার সহি কেমনে ঝরিল যে ধুলায় চির অবহেলায়
সিন্ধু কাফি-খাম্বাজ — যৎ
আজি এ কুসুম-হার সহি কেমনে
ঝরিল যে ধুলায় চির অবহেলায়
কেন এ অবেলায় পড়ে তারে মনে॥
তব তরে মালা গেঁথেছি নিরালা
সে ভরেছে ডালা নিতি নব ফুলে।
(আজি) তুমি এলে যবে বিপুল গরবে
সে শুধু নীরবে মিলাইল বনে॥
আঁখি-জলে ভাসি গাহিত উদাসী
আমি শুধু হাসি আসিয়াছি ফিরে।
(আজি) সুখ-মধুমাসে তুমি যবে পাশে
সে কেন গো আসে কাঁদাতে স্বপনে॥
কার সুখ লাগি রে কবি বিবাগি,
সকল তেয়াগি সাজিলি ভিখারি॥
(তুই) কার আঁখি-জলে বেঁচে রবি বলে
ফুলমালা দলে লুকালি গহনে॥
আজি দোল পূর্ণিমাতে দুলবি তোরা আয়
কালাংড়া-বসন্ত-হিন্দোল — দাদরা
আজি দোল পূর্ণিমাতে দুলবি তোরা আয়।
দখিনার দোল লেগেছে দোলন-চাঁপায়॥
দোলে আজ দোল-ফাগুনে
ফুল-বাণ আঁখির তূণে,
দুলে আজ বিধুর হিয়া মধুর ব্যথায়॥
দুলে আজ শিথিল বেণি, দুলে বধূর মেখলা,
দুলে গো মালার পলা জড়াতে বঁধুর গলা।
মাধবীর দোলন-লতায়
দোয়েলা দোল খেয়ে যায়,
দুলে যায় হলদে পাখি সোঁদাল-শাখায়॥
বিরহ-শীর্ণা নদীর আজিকে আঁখির কূলে
ভরে জল কানায় কানায় জোয়ারে উঠল দুলে।
দুলে বসন্ত-রানি
কুসুমিতা বনানী
পলাশ রঙন দোলে নোটন-খোঁপায়॥
দোলে হিন্দোল-দোলায় ধরণি শ্যাম-পিয়ারি,
দুলিছে গ্রহ তারা আলোক-গোপ-ঝিয়ারি।
নীলিমার কোলে বসি
দুলে কলঙ্কী-শশী,
দোলে ফুল-উর্বশী ফুল-দোলনায়॥
আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদি
আমারে চোখ-ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদি।
খুলে দাও রঙ-মহলার তিমির-দুয়ার ডাকিলে যদি।।
গোপনে চৈতী হাওয়ায় গুল্-বাগিচায় পাঠালে লিপি,
দেখে তাই ডাকছে ডালে কু কু বলে কোয়েলা ননদী।।
পাঠালে ঘূর্ণি-দূতী ঝড়-কপোতী বৈশাখে সখি,
বরষায় সেই ভরসায় মোর পানে চায় জল-ভরা নদী।।
তোমারি অশ্রু ঝলে শিউলি-তলে সিক্ত শরতে,
হিমানীর পরশ বুলাও ঘুম ভেঙে দাও দ্বার যদি রোধি।।
পউষের শূন্য মাঠে একলা বাটে চাও বিরহিণী,
দুঁহু হায় চাই বিষাদে, মধ্যে কাঁদে তৃষ্ণা-জলধি।।
ভিড়ে যা ভোর-বাতাসে ফুল-সুবাসে রে ভোমর কবি,
ঊষসীর শিশ-মহলে আসতে যদি চাস নিরবধি।।
আসিলে এ ভাঙা ঘরে কে মোর রাঙা অতিথি
পিলু-ভৈরবী — কাহারবা
আসিলে এ ভাঙা ঘরে
কে মোর রাঙা অতিথি।
হরষে বরিষে বারি
শাওন-গগন তিতি॥
বকুল-বনের সাকি
নটিন পুবালি হাওয়া
বিলায় সুরভি-সুরা,
মাতায় কানন-বীথি॥
বনের বেশর গাঁথে
কদম-কেশর ঝুরি,
শিশির-চুনির হারে
উজল উশীর-সিঁথি॥
তিতির শিখীর সাথে
নোটন-কপোতী নাচে,
ঝিঁঝির ঝিয়ারি গাহে
ঝুমুর কাজরি-গীতি॥
হিঙুল হিজল-তলে,
ডাহুক পিছল-আঁখি,
বধূর তমাল-চোখে
ঘনায় নিশীথ-ভীতি॥
তিমির-ময়ূর আজি
তারার পেখম খোলে,
জড়ায় গগন-গলে
চাঁদের ষোড়শী তিথি॥
মিলন-মালায় বাজে
গোপন মৃণাল-কাঁটা,
নয়ন-জলে কি কবি
আঁকিস তাহারই স্মৃতি॥
আসে বসন্ত ফুলবনে সাজে বনভূমি সুন্দরী
ভীমপলশ্রী — দাদরা
আসে বসন্ত ফুলবনে
সাজে বনভূমি সুন্দরী।
চরণে পায়েলা রুমুঝুমু
মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি॥
ফুলরেণু-মাখা দখিনা বায়
বাতাস করিছে বনবালায়,
বনকরবী-নিকুঞ্জছায়
মুকুলিকা ওঠে মুঞ্জরি॥
কুহু আজি ডাকে মুহুমুহু,
‘পিউ কাঁহা’ কাঁদে উহু উহু
পাখায় পাখায় দোঁহে দুহুঁ
বাঁধে চঞ্চর-চঞ্চরী॥
দুলে আলোছায়া বন-দু-কূল,
ওড়ে প্রজাপতি কলকা ফুল,
কর্ণে অতসী স্বর্ণদুল
আলোকলতার সাতনরি॥
পদ্ম ডালিয়া পায়ে বালা
করিয়াছে সারা বন আলা,
দ্বারে মঞ্জরী-দীপ জ্বালা,
ডালপালা রচে ফুলছড়ি॥
কবি, তোর ফুলমালি কেমন,
ফাগুনে শূন্য পুষ্পবন,
বরিবি বঁধুরে এলে কানন
রিক্ত হাতে কি ভুল ভরি॥
এ আঁখি-জল মোছো পিয়া ভোলো ভোলো আমারে
ভৈরবী — কাওয়ালি
এ আঁখি-জল মোছো পিয়া
ভোলো ভোলো আমারে।
মনে কে গো রাখে তারে
ঝরে যে ফুল আঁধারে॥
ফোটা ফুলে ভরি ডালা
গাঁথো বালা মালিকা,
দলিত এ ফুল লয়ে
দেবে গো বলো কারে॥
স্বপনের স্মৃতি প্রিয়
জাগরণে ভুলিয়ো,
ভুলে যেয়ো দিবালোকে
রাতের আলেয়ারে॥
ঝুরিয়া গেল যে মেঘ
রাতে তব আঙিনায়,
বৃথা তারে খোঁজো প্রাতে
দূর-গগন-পারে॥
ঘুমায়েছ সুখে তুমি
সে কেঁদেছে জাগিয়া,
তুমি জাগিলে গো যবে
সে ঘুমায়ে ওপারে॥
আগুনে মিটালি তৃষা
কবি কোন্ অভিমানে,
উদিল নীরদ যবে
দূর বন-কিনারে॥
এ নহে বিলাস বন্ধু, ফুটেছি জলে কমল
মান্দ্ — কাহারবা
এ নহে বিলাস বন্ধু, ফুটেছি জলে কমল।
এ যে ব্যথা-রাঙা হৃদয় আঁখি-জলে-টলমল॥
কোমল মৃণাল-দেহ ভরেছে কণ্টক-ঘায়,
শরণ লয়েছি গো তাই শীতল দিঘির জল॥
ডুবেছি এ কালো নীরে কত যে জ্বালা সয়ে,
শত ব্যথা ক্ষত লয়ে হইয়াছি শতদল॥
আমার বুকের কাঁদন তুমি বল ফুল-বাস,
ফিরে যাও, ফেলো না গো শ্বাস
দখিনা বায়ু চপল॥
ফোটে যে কোন্ ক্ষত-মুখে
কবি রে তোর গীত-সুর,
সে ক্ষত দেখিল না কেউ,
দেখিল তোরে কেবল॥