তোমার নিশ্চয়ই স্টুয়ার্ড যেতে ইচ্ছা করছে ভিতরে?
স্যার, আপনার কথার উপর আমার কথা বলা সাজে না।
বড় মিস্ত্রি ভাবলেন, এবার কড়া নাড়বেন দরজার। কিন্তু সেই মুহূর্তে দরজা খুলে গেল। বিজনকে খুব বিব্রত দেখাচ্ছে। চোখ মুখ উদ্বিগ্ন। বলল, স্যার ঘরে মদ আছে? মেয়েটা কেমন করছে স্যার! বড় নিস্তেজ, একটু মদ দিলে হত।
সুমিত্র বলল, স্যার, আমি আগেই বলেছি এত ধকল সে সহ্য করতে পারবে না।
বড় মিস্ত্রি চিৎকার করে বলতে চাইলেন, তুমি একটা অমানুষ, সুখানী। অথচ বলতে পারলেন না। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, তুমি একটা পশু, তুমি পশু সুখানী।
স্যার বিশ্বাস করুন, আমি কিছু করিনি।
কিছু করনি!
না স্যার, শুধু আদর করছিলাম। কিন্তু কেবল দেখছি মুখ থেকে ওর থুথু উঠছে সাদা সাদা ফেনার মতো। আমি বারবার আলোতে মুখ দেখলাম। জল দিলাম খেতে। খেল। ফের ওরকম হতেই দরজা খুলে দিয়েছি। আপনারা আসুন।
স্টুয়ার্ড কথা বলতে পারছিল না। বড় মিস্ত্রি বিমূঢ়। নেশার রঙ মুছে যাচ্ছে। এবং তিনি এই সময় সারিবদ্ধ উট দেখলেন, ওরা মরুভূমির উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। সারিবদ্ধ উটের দলটা একটা নগ্ন মানুষকে উত্তপ্ত বালুর উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে শুধু। মানুষটার হাত—পা বাঁধা। তিনি প্রায় চিৎকার করে ওঠবার ভঙ্গিতে বললেন, ওদিকের দরজা বন্ধ করে দাও। আলো নেভাও বাইরের। স্টোর থেকে মদ নিয়ে এসো।
ওরা ভিতরে ঢুকে বাংকের পাশে দাঁড়াল। সবুজ গাউনটা পাশ থেকে তুলে মর্লিনের কোমর পর্যন্ত টেনে দেওয়া হল। সুখানী পায়ের দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে। মর্লিনের বড় বড় চোখ দুটো স্থির। বিবর্ণ হাত দুটো বুকের উপর। মুখের রঙ জলের সঙ্গে গলে গেছে। সাদা এবং অদ্ভুত এক অবয়বের মুখ যা দেখলে ভয় ভীতি ক্রমশ মানুষকে গ্রাস করে।
বড় মিস্ত্রি বললেন, মর্লিন মরে যাচ্ছে সুখানী।
স্টুয়ার্ড বলল, যথার্থই মরে যাচ্ছে মর্লিন?
বড় মিস্ত্রি পুনরাবৃত্তি করলেন, মর্লিন মরে যাচ্ছে সুখানী।
সুখানী বলল, কোনো ডাক্তার….?
ও বাঁচবে না। ডাক্তার ডাকলে সকলে ধরা পড়ে যাব।
স্টুয়ার্ড অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাল, স্যার, আমরা ওকে মেরে ফেললাম।
বড় মিস্ত্রি ধমক দিলেন, আস্তে কথা বল। এত বেশি বিহ্বল হবে না। পোর্টহোল খুলে দেখ ঝড়ের গতি কীরকম? এবং বড় মিস্ত্রি এই নিশ্চিত মৃত্যু জেনে যেন বলতে চাইলেন, এতটুকু পাশবিকতা যে সহ্য করতে পারে না তার মরাই উচিত।
সুখানী পোর্টহোলের কাচ সন্তর্পণে খুলে মুখ গলাবার চেষ্টা করল। বাইরে ঝড়। এবং জলের উপর অন্ধকার। দূরে সমুদ্রের উপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। একটা জাহাজ দেখল সে বাইরে। জাহাজটা লকগেট দিয়ে বন্দরে ঢুকছে। সে সমুদ্রের বুকে পাহাড়টা দেখল, আলো, ঘর বাড়ি দেখল। জাহাজটা এখন এখানেই নোঙর ফেলবে। সে জাহাজিদের হাড়িয়া—হাপিজের শব্দ এবং যাত্রীদের কোলাহল এই পোর্টহোল থেকেই শুনতে পেল। সে বলল, ঝড় কমে যাচ্ছে স্যার। তারপর বলল, পাশে একটা জাহাজ নোঙর ফেলছে।
বড় মিস্ত্রি হাঁটু গেড়ে বসলেন মর্লিনের পাশে। ওর কপালে মুখ হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। বড় মিস্ত্রি ভিতরে খুব কষ্ট অনুভব করছিলেন। ভয়ানক কষ্টবোধে তিনি সুখানীর কোনো কথা শুনতে পাচ্ছেন না। স্টুয়ার্ড স্টোর রুমে গেছে মদ আনতে; তিনি ভালো করে মর্লিনের শরীর ঢেকে বসে আছেন। একটু মদ খেলে যদি উত্তেজনা আসে। অথবা বাঁচবার লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাঁর ইচ্ছা হল মেজ মালোমকে ডেকে এই ঘটনার কথা, ওষুধের কথা অথবা কোনো বুদ্ধির জন্য… তিনি আর ভাবতে পারছিলেন না। স্টুয়ার্ড এ সময় মদ এনে ওর মুখে ঢেলে দিলে, মদটুকু ঠোঁটের কস বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
স্টুয়ার্ড বলল, কী হবে স্যার!
বড় মিস্ত্রি বললেন, জানতে পারলে ফাঁসি হবে।
এই ধরনের কথায় চোখ গোল গোল হয়ে উঠল স্টুয়ার্ডের। সে দ্রুত বলে চলল, আসুন, তবে ওকে পোর্টহোল দিয়ে জলে ফেলে দিই স্যার। কেউ টের পাবে না।
ওকে ভালো করে মরতে দাও। তা ছাড়া বাইরে যাত্রীজাহাজ এসে থেমেছে।
এখন অনেক রাত স্যার। আসুন ওকে জেটিতে ফেলে আসি।
গ্যাঙওয়েতে সুখানী মনসুর আছে। এইসব ঘটনা কাক—পক্ষীতে টের পেলে পর্যন্ত কপালে দুঃখ থাকে।
কী হবে স্যার? আগে এমন ঘটবে জানলে মর্লিনকে তুলে আনতাম না স্যার। কী কুক্ষণে এই বন্দরে এসেছি। ঝড় ঝড় শুধু ঝড়।
ওদের ভিতর নানা ধরনের কথা হচ্ছিল। এবং এইসব বিচিত্র সংলাপ ওদের তিনজনকেই সাময়িকভাবে এই মৃত্যু সম্পর্কে নির্বিকার করে রাখছে। এ সময় ওরা তিনজনই ওর পাশে বসল। বড় মিস্ত্রি বললেন, এসো, আমরা তিনজনই ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকি। ওর মৃত্যু আমাদের জানুর উপর সংঘটিত হোক—এমত এক আবেগদীপ্ত কথায় অবনীভূষণ চোখ বুজলেন। তাঁর মনেই হল না শরীর থেকে যেসব জাহাজি যন্ত্রণা নেমে এই মেয়েটির দুর্বল শরীরে গরল ঢেলেছে তারা এখনও একই শরীরে বিদ্যমান। তিনি যেন কোনো এক উপাসনা গৃহে বসে আছেন এমতই এক গভীর প্রত্যয়ের চোখ। তিনি বললেন, এসো ওকে আমরা শান্তিতে মরতে দিই। কারণ আমরা জানি না ওর নিকট আত্মীয় কেউ আছেন কি না, আমরা কোনো পুরোহিতকেও ডাকতে পারছি না, সুতরাং ঈশ্বরের নাম আমরাই স্মরণ করাব। আর এই গৃহই আমাদের উপাসনাগৃহ।
কেবিনের নীল দেয়ালে একটা মাকড়সা অনবরত নিচ থেকে উপরে উঠে যাচ্ছে। ওদের তিনজনের কোলের উপর মর্লিনের মুখ, শরীর। দেয়ালে পা ঠেকে আছে। মর্লিনের শরীর কম্বল আবৃত। র্যাকে ওর ওভারকোট। হাতের দস্তানা নীল রঙের। চোখ দুটো মর্লিনের ক্রমশ সাদা হয়ে আসছে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। ওরা তিনজনই এই মৃত্যুর দ্বারা অভিভূত হচ্ছিল এবং মৃত্যুর পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে ভাবছিল। ওরা দেখল—চোখ দুটো সাদা হতে হতে একেবারে স্থির হয়ে গেল। একটা ঢেকুরের মতো শব্দ, তারপর মৃত্যু।