ফানেলের চূড়ায় ঝুলে মকবুল প্রশ্ন করল, আকাশে এরোপ্লেনটা কী লিখছে রে?
বিজন দেখল একটা এরোপ্লেন আকাশটাকে স্লেটের মতো ব্যবহার করছে। গ্যাস দিয়ে বড় বড় হরফে ভোরের খবর দিচ্ছে। ‘দি ডেইলি হেরাল্ড’—এর খবর। হয়তো উড়োজাহাজটা ভাড়া করা—কিংবা ওদেরই। বিজন দুটো বড় খবরের পর পড়ল : দি শিপ এস এস টিবিড ব্যাংক উইল বি ব্ল্যাক ব্যানড, ইফ সেলিম……
মকবুল ফানেল থেকে বিরক্ত করছে। মকবুল বারবার প্রশ্ন করছে—আকাশে জাহাজটা কী লিখছে রে? বিজন এইসব পড়ে অধীর হয়ে উঠছে। সে মকবুলকে বলল, সেলিমকে এক্ষুনি হাসপাতালে না দিলে জাহাজের সমস্ত কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। সিম্যান—ইউনিয়নের সেক্রেটারি এই হুমকি দিয়েছেন।
ইটন বলল, কাল রাতে এখান থেকে যারা কাজ করে ঘরে ফিরেছে তারাই ইউনিয়নে খবরটা পৌঁছে দিয়ে গেছে।
বিজন ভাবল, সব যেন মন্ত্রের মতো কাজ করল। জাহাজে খুবই লোকের ভিড়। সকলে কাজ থামিয়ে দিয়ে লেখাগুলি দেখছে। কোম্পানির এজেন্ট পর্যন্ত জাহাজে উঠে এসেছেন। মিঃ ট্রয় এবং আরও অনেক সব লোক। ক্লার্করা এসেছেন। ওরা প্রথমে ব্রিজে উঠে গেল। কাপ্তানের ঘরে ঢুকে গেল অনেকে। কাপ্তানকে খুবই বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। তিনি এই খবরে প্রথমে খুবই অধীর এবং উত্তেজিত হয়েছিলেন। দুই সারেংকে ডেকে প্রশ্ন করেছিলেন, কে এ—খবর ইউনিয়নে পৌঁছে দিয়েছে? কার এমন হিম্মত? সেলিমের দরজা কে খুলেছিল? ওর পোর্টহোল কেন বন্ধ ছিল না? এইসব প্রশ্নের শেষে তিনি দেখলেন স্বয়ং এজেন্ট এবং অন্যান্য সব দায়িত্বশীল কর্মচারীরা ওঁর কেবিনে ঢুকে যাচ্ছেন। তিনি কথা বলতে পারছিলেন না—এত উত্তেজিত। তবু এইসব দায়িত্বশীল কর্মচারীদের দেখে কেমন বিব্রত হয়ে পড়লেন। মিঃ ট্রয় নানারকম প্রশ্ন করে ওঁকে আরও বিব্রত করে তুলেছেন। বিজন, ইটন এবং মকবুল, পরে দেবনাথ পর্যন্ত ফানেলের গুঁড়িতে এসে সন্তর্পণে কাপ্তানের কেবিনের সব কথাবার্তা শুনছিল। ওরা শুনে বলল, শালা ঠিক জব্দ হয়েছে এতদিনে।
বিজন মনে মনে এলবিকে ধন্যবাদ জানাল। এলবির লম্বা চোখ এবং ডিমের মতো মুখের গঠন ওর চোখে এখন প্রীতির জোয়ারে ভাসছে। ওর কালো চুলে মনোরম গন্ধ, বিজন গতকাল তা টের পেয়েছে। গতকালের অসহিষ্ণু ভাবটুকু আর ওর ভিতর নেই। এলবিকে সে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারলে খুশি হবে এমত ধারণায় বোট—ডেকে এবং নিচে ভিড়ের ভিতর এলবিকে খুঁজল। এবং খুঁজতে থাকল। অথচ এলবিকে যেই বোট—ডেকে আসতে দেখল, বিজন তাড়াতাড়ি মাস্তুলের আড়ালে আত্মগোপন করল।
এলবি, মিস এলবার্টি এবং সিসিল এলবার্টি—যে—কোনো নামেই ওকে ডাকা চলে। সে মাস্তুলের আড়াল থেকে যদি এই নামে ডাকে নিশ্চয়ই এলবির সাড়া পাবে। এলবি এখন দু’নম্বর বোটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেও যেন কাপ্তানের ঘরের দিকে উঠে যাচ্ছে। বিজন সব দেখেও এলবিকে গুড মর্নিং বলতে পারল না, কৃতজ্ঞতা জানাতে পারল না। এলবির সঙ্গে যে কোনো পরিচয়ই এ—মুহূর্তে এ—জাহাজে মারাত্মক। কাপ্তান তাঁর বিরক্তি ভাবটুকু কলকাতা বন্দর পর্যন্ত পুষে রাখবেন। সারেং সেই ভাবটুকু কলকাতা পর্যন্ত জিইয়ে রাখবেন। তারপর এক শুভদিনে বিজনের নলিতে লাল দুটো দাগ পড়বে। বিজন ব্ল্যাক—লিস্টেড হবে।
সুতরাং সে এলবিকে দেখে আত্মগোপন না করে পারল না। তাই সে এলবিকে দেখেই এই মাস্তুলের আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। এলবি সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল। সে যেন কোনো জাহাজিকে প্রশ্ন করছে, বি—জন, বি—জন কোথায় কাজ করছে?
বিজন আঁতকে উঠল। সে ধীরে ধীরে টুইন ডেকে নেমে গেল এবং দু’লাফে ফল্কা পার হয়ে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে নিজের ফোকসালে ঢুকে দরজা বন্ধ করার আগে অন্য জাহাজিদের বলে দিল, কেউ ওকে যদি খোঁজ করে তবে যেন বলা হয় সে জাহাজে নেই। বন্দরে নেমে গেছে। তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাংকে বসে হাঁপাতে থাকল।
কী সর্বনাশ—বিজন ভাবল। বিজন নিজের ভুলের জন্য নিজেই ক্ষেপে গেল। গতকাল যা ওর সবচেয়ে বেশি বলা দরকার ছিল, এলবিকে তাই বলা হয়নি। ওর উচিত ছিল, এ খবর তোমাদের আমি পৌঁছে দিলাম এ কথা যেন জাহাজের কেউ না জানে। তবে আর গরিবের চাকরিটা থাকবে না। সেলিমের সঙ্গে তবে আমিও মরব। অথচ সেই কথাটাই এলবিকে বলা হয়নি।
এলবি এদিকে এসে দেবনাথকেও প্রশ্ন করল, বিজন কোথায়?
দেবনাথ ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, বিজন তো এখানেই ছিল। বলে ইতস্তত এদিক—ওদিক চোখ তুলে তাকাল। তারপর বলল, চল কেবিনে। বোধহয় সে সেখানেই আছে।
নীচে নামবার আগে এলবিকে নিয়ে দেবনাথ একবার ভিড়ে বিজনকে খুঁজে দেখল। তাকে ওরা সেখানে পেল না। সেলিম ভিড়ের ভিতর স্ট্রেচারে শুয়ে আছে। সেলিম কাঁদছে। সারেং বুঝ—প্রবোধ দিচ্ছে। বলছে, ভালো হয়ে গেলেই কোম্পানি তোকে দেশে পাঠিয়ে দেবে। কাঁদছিস কেন? ভালোর জন্যই তোকে হাসপাতালে দিচ্ছে।
বিজন এই বাংকে বসেও যেন টের পাচ্ছে—এইমাত্র সেলিমকে ধরাধরি করে নিচে জেটিতে নামানো হল। সেলিম কাঁদছে। সে বলছিল, বিবির কোলে মাথা রেখে মরব। সে বলেছিল, আমার দেশের মাটিতে আমার কবর হবে। সে এ—কথাগুলো বিজনকে বলেছিল। ওর খুব দুঃখ হচ্ছে এ সময়—সে কাছে থাকতে পারল না, বলতে পারল না—রোজ আমি যাব। বিকেলে যাব। তুই ভয় পাবি না। তুই ভালো হয়ে উঠবি—বলতে পারল না….তখন দরজাটা কে যেন ঠেলছে। সে এই বাংকে বসে দেবনাথের গলার শব্দ পেল। দেবনাথ বলছে—এই, দরজা খোল। দরজা বন্ধ করে ভিতরে কী করছিস?