এলবি বলল, তুমি বল, আমি নোট করছি।
নিজের ভুলটুকু বুঝতে পেরে বিজনও হাসল।—তোমাকে নোট নিতে হবে না। মুখে বললেও চলবে। ঘটনা হচ্ছে পার্থ বন্দরে ….
এলবি এ—সময়ে বাধা দিল বিজনকে, জাহাজটার নাম বল। তোমরা কোন দেশের ক্রু, কোন দেশ থেকে এসেছ সব বলতে হবে।
জাহাজের নাম ‘এস এস টিবিড ব্যাংক’। আমরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছি।
তারপর?
বিজন জাহাজের সব ঘটনা, সেলিমের বর্তমান অবস্থা, এমনকি সারেং এবং কাপ্তানের গোটা চক্রান্তের কথাও খুলে বলল। বিশেষ করে মেয়েটির স্বাভাবিক আগ্রহে সব খুলে বলতে পারল। এখন সে আর কোনো আড়ষ্টতায় ভুগছে না। এখন সে রবীন্দ্রনাথকে দেখে রীতিমতো উত্তেজিত হতে পারছে। সে এবার একটু ঝুঁকে বলল, এর একটা বিহিত করতেই হবে দয়া করে। নতুবা বেচারা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। বেচারার ঘরে বিবি আছে। ছোট একটি মেয়ে আছে। ওরা সব ওরই পথ চেয়ে বসে আছে।
এখন বিজনকে দেখলে কে বলবে, এ জাহাজি বিজন। কে বলবে এ বিজন কথায় কথায় শিস দেয়। কথায় কথায় মিথ্যা কথা বলে বিদেশি রমণীকুলে বাহবা নিতে চায়! বিজনের চোখ—মুখ মানুষের ভালো করার প্রবৃত্তিতে বস্তুতই সজল হয়ে উঠেছে এখন।
এলবি বলল, ও ঠিক আছে। মিঃ ট্রয় এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না। জাহাজিদের ভালো করাই আমাদের কাজ।
বিজন ওঠবার সময় ফের রবীন্দ্রনাথকে দেখল এবং অদম্য কৌতূহল চাপতে না পেরে বলল, আমরা ট্যাগোরের দেশ থেকে এসেছি। তোমরা ট্যাগোরের ভক্ত দেখছি। দেখি তোমরা এখন আমাদের জন্য কতটা কী করতে পার।
তুমি ভারতবর্ষের লোক? কিন্তু ভারতবর্ষ তো বিরাট দেশ। এখানে পাঁচ বছর আছি। ভারতবর্ষ থেকে আসা কিছু কিছু জাহাজিদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। অথচ দুর্ভাগ্য ওরা কবির ছবি দেখেও কোনো কৌতূহল প্রকাশ করেনি। বিশ্রী ধরনের পোশাক পরে এখানে এসেছে। চেয়ারে না বসে মেঝেতে বসে পড়েছে। শীতে দেখেছি ওরা ভয়ানকভাবে কাঁপত। শীতের গরম জামাকাপড় পর্যন্ত নেই।
বিজন বলল, ওরা এখনও আছে। জাহাজে গেলে তুমি ওদের এখনও দেখতে পাবে।
এলবি বলল, ভারতবর্ষের লোক ভাবতে তোমাকে কষ্ট হয়।
বিজন বলল, মাপ করবেন। যারা তখন ছিল এখনও আছে। তাদের জাহাজি জীবনের এক বিচিত্র অধ্যায় আছে। ওরা আসছে চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, সন্দীপ অঞ্চল থেকে। ওরা অজ্ঞ। চাষি পরিবার থেকে আসছে।
বিজন ভাবল—এইসব জাহাজিদের জাতীয় পোশাকের প্রতি এলবির তীব্র ঘৃণা। বস্তুত লুঙ্গি এবং কাঁধে গামছা ফেলে এইসব জাহাজিদের বড় বড় এভিন্যু ধরে হাঁটা এবং নিজেদের ভারতবাসী বলে পরিচয় দেওয়া এলবির কাছে বিশ্বকবিরই যেন অবমাননা। সেজন্য বিজনের দুর্লভ ইংরেজি বলার কায়দা এবং উজ্জ্বল বিদেশি পোশাক, উপরন্তু কবির প্রতি শ্রদ্ধাটুকু এলবিকে বিজন সম্বন্ধে অভিভূত করেছে। বস্তুত এলবি ভারতবর্ষের দারিদ্র্যকে সহ্য করতে পারে না। আজও পারছে না। ওর চোখেমুখে এইসব যেন ধরা পড়ছে।
বিজন বলল, ওরা অজ্ঞ নিরক্ষর বলেই রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ওদের কোনো কৌতূহল নেই।
এলবি সহসা বলল, বাবা কবিকে ইউরোপে দেখেছেন। তুমিও কবির দেশের লোক। তুমি কবিকে দেখেছ?
সহসা এই প্রশ্নে বিজন কিঞ্চিৎ বিব্রত হয়ে পড়ল। ওর জাহাজি মনটা ধীরে ধীরে ওর অস্তিত্বকে গ্রাস করছে। সে বলল, নিশ্চয়ই। নিমতলা থেকে বটতলা বেশি দূরে নয়। নিমতলার কাছেই জোড়াসাঁকো। আমার ছেলেবেলায় কত ও—পাড়ায় কত খেলতে গেছি। কতদিন আমরা কবিকে দেখে প্রণাম করেছি। তিনি তখন প্রায় অচল।
তুমি ওঁকে প্রণাম করেছ! তুমি ওঁকে স্পর্শ করতে পেরেছ!
বিজন বিনয়ের আধার হয়ে গেল। বিজন বলল, কবি আমাদের আশীর্বাদ করতেন। বলতেন ভালো ছেলে হবে, দেশের দুঃখ দূর করবে।
এলবি ফের আশ্চর্য এক শ্রদ্ধার ভঙ্গিতে বলল, তুমি ওকে স্পর্শ করতে পেরেছ, প্রণাম করতে পেরেছ!
বিজন দেখল এলবির চোখ দুটো শ্রদ্ধায় গভীর হয়ে উঠছে। এলবি একবার ঘাড় ফিরিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখল, একবার বিজনকে দেখল। কবির খুব নিকটের একজন যুবাকে স্পর্শ করার প্রকট ইচ্ছায় সে হাত বাড়িয়ে দিল। যেন বলতে চাইছে—তুমি বি—জন, তুমি কবিকে স্পর্শ করেছ, তুমি কবির দেশের, ঘরের লোক। এলবির মনে এই ভাবগুলো কাজ করছে।
এলবি বলল, বাবা তখন ইউরোপে ছিলেন। বাবা কবিকে ইউরোপে দেখেছেন। বাবা মাকে এবং আমাকে বলতেন, হি ইজ এ সেইন্ট, জাস্ট অ্যাজ পিটার অর পল। বিজন সেই ঋষিপুরুষদের আশীর্বাদ পেয়েছে। এলবি বিজনের আরও ঘনিষ্ঠ হতে চাইল।
এলবি বলল, তোমরা আর কতদিন থাকবে এ—বন্দরে?
প্রায় মাস দুই। জাহাজ এখানে মাস দুই বসবে। ড্রাইডক হবে। মেরামত হবে।
সহসা এলবি বলে বসল, আমার একটা অনুরোধ তোমায় রক্ষা করতে হবে।
বিজন একটু অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। তবু সে বলল, বল; রাখব। যদি ক্ষমতায় কুলোয় নিশ্চয়ই রাখব।
তোমার কাছে আমি ট্যাগোরের কবিতা বাংলা—ভাষায় শুনতে চাই। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা। যখন থেকে ট্যাগোরের কবিতার সঙ্গে প্রথম পরিচিত হই তখন থেকে ইচ্ছা—তোমার দেশে যাব, ভারতবর্ষকে দেখব। কবির শান্তিনিকেতন দেখব। আমি এইজন্য প্রথম থেকেই টাকা জমিয়ে আসছি। কবির কবিতা বাংলা ভাষায় শুনব—কত দিনের ইচ্ছা আমার!
তার জন্য কী আছে—সেলিমের ঝামেলাটা চুকে যাক। তারপর একদিন তোমায় শোনানো যাবে।