শ্রমিকটি বলল, ম্যান ইজ সিক?
সে বলল, ইয়েস, সিক। টিবিতে ভুগছে।
টিবিতে ভুগছে! হাসপাতালে দিচ্ছে না! বড় আশ্চর্য! যেন শ্রমিকটি ঝুপ করে আকাশ থেকে পড়ল।
বড় আশ্চর্য! বিজন হাঁটতে থাকল। লোকটি ওর পাশাপাশি হাঁটছে। সে বলল ফের, এ নিয়ে পাঁচ বন্দর ঘোরা হল। কাপ্তান এতদিন হাসপাতালে দেবেন দেবেন করছিলেন, এখন শুনতে পাচ্ছি দেওয়া হবে না। জাহাজ দেশে ফিরবে। সেও দেশে ফিরবে।
এসব দেখেও তোমরা চুপ করে আছ!
বিজন দেখল লোকটি যেন এই মুহূর্তে বিদ্রোহ করে সকলকে জানাতে চাইছে, জাহাজে একজন জাহাজি টিবিতে ভুগছে অথচ ওকে হাসপাতালে দেওয়া হচ্ছে না, কাপ্তান কোম্পানির টাকা বাঁচাচ্ছে। আপনারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদপত্র পেশ করুন।
শ্রমিকটিকে বেশ চিন্তিত দেখাল। পাশের অন্যান্য কুলিদের সে ঘটনাটা খুলে বলল। ওরা সকলে একত্র জমা হচ্ছে। ওরা এই নিয়ে জটলা পাকাতে চাইছে যেন। ওরা যেন বলতে চাইছে—তোমরা সেলর, তোমরা এইসব সমুদ্রগামী জাহাজগুলোকে বন্দর থেকে বন্দরে নিয়ে যাও, ঝড়ের দরিয়া পার করে জাহাজের কোম্পানির প্রতিপত্তি বাড়াও—আর তোমাদের চিকিৎসা হবে না, তোমাদের জন্যে হাসপাতালের বন্দোবস্ত থাকবে না, কোম্পানি বেইমানি করবে, তোমরা ভেড়ার মতো ঘাস খাবে—সে ঠিক কথা নয়। তোমরা বিদ্রোহ কর। সে বিদ্রোহে আমরা যোগদান করব। তোমাদের একতার অভাব, আমাদের একতা ইচ্ছা করলে ধার নিতে পারো। দেউলিয়া হবার ভয় নেই।
ভিতর থেকে লম্বা লোকটি বের হয়ে বিজনকে বলল, ইউ বেটার গো টু মিস্টার ট্রয়। তিনি সিম্যান ইউনিয়নের সেক্রেটারি। ঠিকানা—পাঁচ কলিন স্ট্রিট; স্টেশনের পাশ দিয়ে যে বড় এভিন্যুটা পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে সেখানে গিয়ে খোঁজ করবে। তাঁকে পেলে, ঘটনাটি খুলে বলবে। তিনিই সব ব্যবস্থা করবেন।
বিজন ওদের ধন্যবাদ জানাল। এবং কেবিনে ঢুকে লোকটিকে এক বোতল সরষের তেল দিয়ে বলল, ইউ হ্যাভ ডান এনাফ। আমি আজই মিঃ ট্রয়ের কাছে যাব।
অথচ সে দেবনাথের মুখ দেখে বুঝতে পেরেছিল—এইসব আবেগধর্মিতার লক্ষণগুলো ভালো নয়। সেলিমের উপকার করে তোর কী আখের হবে এমন ভাব দেবনাথের মুখে। সুতরাং স্পষ্টতই দেবনাথ যেতে রাজি হল না।
বিকেল। শীতের বিকেল। চারটে না বাজতেই শীতের সমুদ্রে অলস সূর্য উত্তাপের জ্বালায় ডুব দিচ্ছে। গাছগুলো নেড়া নেড়া। ইউক্যালিপটাসের পাতা খসে পড়ছে। আকাশ থেকে যেন শীতের তুষার ঝরছে। ঠান্ডা ঠান্ডা, হাত—পা জমে যাবে ভাব। বিজন হাতের দস্তানা টেনে দিল। টুপিতে কপাল ঢেকে দিল। তারপর ধীরে ধীরে গ্যাংওয়ে ধরে নেমে গেল। সমুদ্র থেকে শীতের হাওয়া ফের উঠে আসছে।
ইচ্ছা হল বন্দরে নেমে ট্যাক্সি করার। ইচ্ছা হল দু’ শিলিং—এর আপেল কেনার। এবং ইচ্ছা হল এভিন্যুর টিন—কাঠের ঘরের ভিতর ঢুকে দু দণ্ড জুয়া খেলার। তবু সেলিমের জন্য আপাতত হাঁটতে থাকল সে। ধীরে ধীরে হেঁটে গেল, ঝুলন্ত ব্রিজ অতিক্রম করতে পনেরো মিনিট, সিম্যান—মিশান বাঁয়ে ফেলে রেলওয়ে স্টেশন অতিক্রম করতে অনধিক পনেরো মিনিট—তারপরই চড়াই পথে উঠতে গিয়ে কলিন স্ট্রিট মিলবে। নাম্বার ফাইভ কলিন স্ট্রিট। মনে মনে নম্বর মুখস্থ করার মতো উচ্চারণ করল কথাটা এবং দুটো সুন্দরী মেয়েকে রমণীয় হতে দেখে শিস দিয়েও ফেলল। এবং যদি ওরা প্রশ্ন করে ওর শিস শুনে, তুমি সিম্যান?
সে বলবে, ইয়েস।
যদি বলে, ইন্ডিয়া থেকে এলে?
সে বলবে, ইয়েস?
যদি বলে, তুমি গান জানো?
সে বলবে, ইয়েস।
তুমি ক্রিকেট খেতে পারো?
সে বলবে ইয়েস।
সুতরাং ওর গান, খেলা এবং এই শঠতা সবই ইয়েসের কোঠায় পড়বে।
বিজন নিজের মনেই হেসে ফেলল। সুন্দরী রমণীরা এখন ঝুলন্ত ব্রিজের উপরে উঠে যাচ্ছে। ব্রিজের রেলিং ধরে কিছু মেয়েপুরুষ গুঞ্জনে মশগুল। অথচ সুন্দরী রমণীরা ওকে দেখেও প্রশ্ন করল না। ওর শিস দেওয়ার অর্থকে ব্যতিক্রম বলে ভাবল না। সুতরাং সে জোরে জোরে হেঁটে ওদের পিছনে ফেলে নিচে নেমে একটি চলন্ত ফলের দোকান থেকে দু’শিলিং—এর আপেল কিনল। তারপর বুলফাইটের বিজয়ী মাটাডরের মতো এইসব সুন্দরী রমণীদের এবং সুন্দর পুরুষদের ভিড় ঠেলে বের হয়ে গেল। বের হয়ে যাচ্ছে। সে হাঁটছে। এখন যেন সহসা মনে হল সেলিম পীড়িত। সে বাংকে শুয়ে রক্ত তুলছে মুখে। দেশে একমাত্র পিসিমা বেঁচে আছেন, তাঁকে টাকা পাঠাতে হবে। আজও বয়স্কা সুন্দরী রমণীদের দেখলে সে তার মাকে স্মৃতির কোঠায় সংগ্রহ করতে পারে। সে সামনের বয়স্কা সুন্দরী রমণীকে প্রশ্ন করল উড ইউ হেলপ মি? আপনি কি আমাকে কলিন স্ট্রিটে যেতে সাহায্য করবেন?
বয়স্কা সুন্দরী রমণী বলল, তুমি কি স্ট্রেঞ্জার?
সে বলল, ইয়েস। আমি সেলর।
এ বন্দরে প্রথম এলে?
ইয়েস, এই প্রথম এসেছি।
ইওর কানট্রি?
বিজন দেশের নাম করল।
অল রাইট। তুমি এসো। তুমি গ্যান্ডিম্যান। তুমি ভালো লোক আছ এমন ভাব যেন বয়স্কা সুন্দরী রমণীর চোখে।
বিজন শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট পথে এগিয়ে গেল। সে দীর্ঘস্থায়ী আলাপে রাজি হল না। নতুবা এদের ভিন্ন ভিন্ন রকমের সংশয় আর দুঃসহ রকমের প্রশ্নের মুখে পড়ত—এখনও দুর্ভিক্ষ আছে? এখনও মহামারি হয়? এখনও সন্ন্যাসীরা গাঁজা খেতে খেতে ধর্মালোচনা করে? এখনও হিমালয়ের বুকে নাক জাগিয়ে সাধু মহান্তরা বরফের নিচে ঈশ্বর—উপাসনা করছেন?