এবার সে কেন জানি কিছুটা স্বস্তি বোধ করল।
বসার ঘরটা সে দেখছে। ঠিক আগের মতো নেই। নতুন চুনকামের গন্ধ। সামনে সেন্টার টেবিল। দু’দিকে দুটো লম্বা সোফা, একটা বেতের চেয়ার নীল রঙের, একটা টেলিভিশন সেট, দেয়ালের র্যাকে অনেক বই, গ্রন্থাবলী নতুন নতুন, একটা মাটির ঘোড়া এক কোণায়—খুব ছিমছাম, নীল রঙের পর্দায় লেসের কাজ। সে এবার মনে করার চেষ্টা করল, প্রথম যেদিন অবনীশের সঙ্গে এখানে এসেছিল—তখন ঘরটায় এ—সব ছিল কিনা! অনেক কিছুই ছিল না। অথবা আগে যা ছিল এখন আর কিছু নেই।
কেবল মনে হল সুনীলকাকার মেয়ে নবনীতা কুট করে তার হাত কামড়ে দিয়েছিল।
নানু সব স্পষ্ট মনে করতে পারছে। স্মৃতির এই খেলায় একমাত্র সে দেখেছে কখনও হেরে যায় না। যে দরজা খুলে দিয়েছিল, তার মুখ সে দেখেনি। আর দেখার সময়ও নয় এটা। তার এখন কত সব জরুরি কাজ, কারণ, সুনীলকাকা আর বাবা একসঙ্গে এক সময় এক অফিসে কাজ করত। সুনীলকাকা বাবার অধীনে কাজ করত এবং খুবই সমীহ করত বাবাকে। মেয়েটা কুট করে কামড়ে দিয়েছিল বলে, কাকা নবনীতাকে সেদিন মারবে বলে শাসিয়েছিল। তার সবই মনে পড়ছে।
সে ভীষণ একটা জরুরি কাজে এসেছে। এসেই তার নানারকম চিন্তা—ভাবনা—কীভাবে যে আরম্ভ করবে কথাটা? কারণ, সাত আট বছর আগেকার কথা সুনীল কাকা ভুলেও যেতে পারে। তবু সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একের পর এক জেরা করে যাবে। প্রথম প্রশ্নটা সে কী করবে ভাবল। যেমন এলে পরে পায়ে টুক করে একটা প্রণাম ঠুকতে হবে। প্রণাম ঠুকলে সে দেখেছে, গুরুজনেরা খুব সদাশয় হয়ে যান। প্রণাম ঠুকে কাজ উদ্ধার করা খুব সহজ হবে ভাবল। তারপর পরিচয় দেবে। সে এখন যাদবপুরের দিকে আছে বলবে। মার কথা জানতে চাইলে বলবে, ভালো আছে, আসলে ভালো নেই বললে নানারকম সংশয় দেখা দেবে।
সে এক গ্লাস জল চেয়েছিল, কেউ নেই, অথচ জল খেতে হবে। সে এবার ঘড়ি দেখল। সাতটা বেজে গেছে। তার বাড়িফেরার কথা চারটের মধ্যে—দাদু বারান্দায় পায়চারি শুরু করে দিয়েছেন। বারান্দায় বুড়ো মানুষটার মুখ বড়ই দুঃখী। বুড়ো মানুষটার বড় আশ্রয় ছিল একটা—যা হোক নানু অন্তত জানে না, তার বাবা আত্মহত্যা করেছে। এখন আর তার সেই আশ্রয়টুকুও নেই। তখনই মনে হল কেউ ঢুকছে বাড়িতে। সিঁড়িতে জুতোর শব্দ। রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে কেউ এ—বাড়িতে উঠে আসছে।
সে দরজার কাছে সরে দাঁড়াতেই দেখল, তিনি ঢুকছেন। হাতে ব্রিফকেস। কালো প্যান্ট পরা, সাদা শার্ট এবং কালো রঙের কোট। মাথার সামনেটায় কিছু কাঁচা—পাকা চুল। আগে গোঁফ রাখতেন, এখন মসৃণ মুখ। সে টুক করে প্রণাম করতেই সুনীলকাকা সামান্য ইতস্তত করে বলল, ‘আরে থাক থাক।’ আজকালকার উঠতি বয়সের ছেলেরা এতটা বিনয়ী হয়, সুনীলকাকার বোধহয় জানা ছিল না। ভালো করে মুখটা দেখছিল নানুর। নানু ভাবছে দেখি চিনতে পারে কী না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল, তুমি প্রীতিশদার ছেলে?
যাক মনে রেখেছে। সে বলল, হ্যাঁ।
কত বড় হয়ে গেছ।
সে কিছু বলল না।
বোস। তারপরই হাঁক দিল, নবনীতা দেখ কে এসেছে। তোমার মাকে ডাক। সুনীলকাকা গলার টাই আলগা করে প্যান্ট টেনে বসে পড়ল। বলল, কতক্ষণ?
সে বলতে পারত, অনেকক্ষণ। সেই দুপুরে বের হয়েছে। এখন বাজে সাতটা। সে তার কিছু না বলে বলল, এই মাত্র।
তোমরা সবাই ভালো আছ?
ভালো নেই বলতে পারত, সেটা ঠিক হবে না ভেবে বলল—ভালো। সবাই ভালো।
বউদি একটা কী কাজ নিয়েছে শুনলাম।
ঠিকই শুনেছেন। গলাটা আবার শুকনো লাগছে নানুর। সে বলল, এক গ্লাস জল। খুব তেষ্টা পেয়েছে।
আরতি এক গ্লাস জল।
আরতি এ—বাড়ির কাজের মেয়ে। এক ডাকেই হাজির। জল রেখে গেল। কিন্তু নবনীতা অথবা আর কেউ এল না। এখন তার মনে পড়েছে, কাকিমার ঠোঁটের নীচে একটা বড় তিল আছে। মুখটা মনে নেই—তিলটার কথা মনে আছে।
তখন সুনীলকাকা বলল, তুমি বস, আমি আসছি।
সুনীলকাকা ভিতরে ঢুকে গেল। এবং পরক্ষণেই নাটকের পাত্র—পাত্রীরা যেভাবে মঞ্চে ঢোকে—ঠিক সেভাবে প্রথমে কাকিমা, পরে নবনীতা। সে ভালো ছেলের মতো কাকিমাকেও টুক করে প্রণাম করে ফেলল। তার যা কাজ তাতে খুব ঘনিষ্ঠতার দরকার হবে। যেন সে এ—বাড়িরই ছেলে।
সুনীলকাকার স্ত্রীর নামটা সে মনে করার চেষ্টা করল। না, পারছে না। আপাতত এটার খুব প্রয়োজন নেই। তবু কেন যে মাথার মধ্যে কারা টরেটককা বাজায়—বাজাবার সময় সে শুনতে পেল, তুমি বড় হয়ে গেছ। নবনীতা, তোর নানুকে মনে পড়ে?
নবনীতা বলল, আমাদের বাড়ি খুব আসতে তুমি?
খুব মিথ্যে কথা। সে সুনীলকাকার বাড়িতে কখনও—সখনও বাবার সঙ্গে অথবা বাবার দাদার সঙ্গে আসত। খুব বেশি না। যাতায়াতের পথে বাড়িটা ছিল বলে মাঝে মাঝেই দেখা হয়ে যেত। এবং নবনীতার একটা ডল পুতুল ছিল। ভেতরটা ফাঁকা। তাতে নবনীতা চকলেট ভরে রাখত। মাথায় টুপি ছিল পুতুলটার।
তখনই নবনীতা বলল, চিনে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি? কত দিন পর!
নানু হেসে দিল। বলতে পারত, তুমি মেয়ে কথা না খুঁজে পেয়ে যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছ। শৈশবের কথা কেউ ভুলে যায়! কেউ পারে ভুলতে।
সে বলল, দোতলায় নতুন ঘর হয়েছে দেখছি।
নবনীতা লম্বা ফ্রক পরেছে। ফাঁপানো চুল ঘাড় পর্যন্ত। এবং ডিমের মতো মসৃণ মুখ। যেন এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে আসছে। আড় চোখে সে নানুকে দেখছে সেটাও সে টের পেল। যুবতী হবার মুখে এই মেয়ের চোখ টল টল করছে।