বুড়ো মানুষগুলো আরও ঘন হয়ে বসেছে। সে তাদের একটা কথাও শুনতে পাচ্ছে না। সে নড়ে চড়ে বসল। তারপর উঠে দাঁড়াল। হেঁটে গেল কিছুটা। পায়চারি করার মতো। সে পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। বুড়ো মানুষদের—মুখগুলি আবছা—যেন মৃত্যুর কাছাকাছি এই মানুষগুলি। আজ শেষ কিছু সত্য কথা বলার জন্য এক ঠাঁই হয়েছে। সে কাছে গেল। আর মনে হল একটা বুড়োও আর কথা বলছে না। এরা যেন সব বুড়ো মানুষের ডামি! এরা পরস্পরের দিকে ভারি সংশয়ের চোখে তাকিয়ে আছে। নানু বুঝতে পারল সব বুড়োরাই তাকে দেখে আর একটাও কথা বলছে না; তার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল—এবং এটা হয়েছে—সেইদিন থেকে—যেদিন মেসো এবং মাকে ভয়ংকর একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থায় দেখে চোখ তার জ্বলে উঠেছিল, পায়ের রক্ত ঝা করে মাথায় উঠে গিয়েছিল—হাতে কিছু একটা থাকলে কী করত বলা যায় না—বুড়ো মানুষরাও কী সেটা টের পায়। মার ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক, মা সিল্কের শাড়ি পরতে ভালোবাসে। মা, তার মা বাবার কোনো স্মৃতিই আজ শরীরে ধরে রাখেনি। সে বাবার একটি ছবি বুকের মধ্যে রেখে দিয়েছে। সে ছবিটাও ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে আসছে।
সে আবার এসে বেঞ্চিটাতে বসল। বেশ বাতাস দিচ্ছে! গরমকাল। গতকাল সন্ধ্যায় ঝড় হয়ে গেছে শহরে। বৃষ্টিপাত হয়েছে। এখন এই বিকেলে ঠান্ডা বাতাসে শরীরে ঘেমো গন্ধ নেই। তার চুল বড়, তার চোখে হাই পাওয়ারের চশমা এবং মাঝে মাঝে মানুষের মুখ সেই চশমার ভেতর কঠিন রুক্ষ এবং ইতরের মতো দেখায়। অবনীশ নামে একটা লোকের চোখ চশমার কাচে ধরা পড়লেই সে বুঝতে পারে—লোকটা এখন পেছনে হেঁটে যাচ্ছে। তাকে দেখলেই পায়ে পায়ে পেছনে হেঁটে সরে যেতে থাকে।
আজ একবার অবশ্য সে গিয়েছিল মানুর কাছে। এখানে আসার পর কেন জানি কলেজে এই মানুকে ভারি ভালো লেগেছিল। গিয়ে দেখেছে মানু বাড়ি নেই। বাড়ি থাকলে সে এখানে হয়তো আসতই না। অথচ মাথার ভিতরে যে কখন কী হয়ে যায়। মাঝে মাঝেই মনে হয়, হত্যাকারী কে, একবার তদন্ত করে দেখলে হয়। আবার কখনও মনে হয় সে কিছুই আর ফিরে পাবে না। মানুষ যা হারায় সে আর তা ফিরে পায় না।
আর তখনই নানু দেখল, পায়ের কাছে একটা লাল বল। ছোট ছোট শিশুরা সেই লাল বল পায়ের কাছ থেকে তুলে নিয়ে গেল। মাথার ভিতর সঙ্গে সঙ্গে শৈশবের নানা স্মৃতি ভেসে ওঠে। একটা লাল বল জেঠু হাতে দিয়ে বলেছিলেন কবে যেন, এটা তোমার। সেই লাল বলটা সে হারিয়েছে। তখনই নানুর কান্না পায়। বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এক আশ্চর্য নিঃসঙ্গতায় সে ডুবে যেতে থাকে। মনে করতে পারে না তখন, কেন এই পার্কটায় সে এসে বসে থাকে। সেই দুপুর থেকে এখানে—একা। কলেজ যাবার নাম করে সোজা চলে এসেছে এখানে—এবং এসেই মনে হয়েছে, খুব অসময়ে এসে গেছে। সুনীল কাকা এখন অফিসে। তাঁকে পাওয়া যাবে না। সন্ধ্যা না হলে বাড়িতে সে ফিরবে না। অকারণ আগে থেকে গিয়ে দরজায় খুট খুট করে লাভ নেই। অথচ সে সারাটা বিকেল আসল কথাটা একবারও মনে করতে পারেনি। স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা চালিয়েছিল আজ। ওর মনে হয়েছিল এই পার্কটায় সে শৈশবে এসেছে। দৌড়ে বেড়িয়েছে। লাল বল নিয়ে খেলা করছে। অবনীশ নামক এক অবিবাহিত যুবক ছিল তার বন্ধুর মতো—যা সে চেয়েছিল, তা যত দুর্লভই হোক এনে দিয়েছে। এখন মানুষটাকে বললে কেমন হয়, তুমি তো আমার শৈশবে সব দুর্লভ বস্তু সংগ্রহের জন্য প্রাণপাত করেছ, এখন এনে দিতে পারো না বাবার একটা ছবি। তোমার বউ তোমার মেয়ে আমাদের সব বন্ধুত্ব মুছে দিল। তুমি ভুলে গেলে আমার সামান্য অসুখে তোমার চোখে ঘুম থাকত না। তোমরা এখন এত স্বার্থপর হয়ে গেছ।
সে উঠে দাঁড়াল। একা বসে থাকলে হিজিবিজি চিন্তা মাথায় ঝপাৎ করে ঢুকে যায়।
সে হাঁটছিল পার্কের এখানে সেখানে। আলোর ডুম জোনাকির মতো স্থির হয়ে আছে। পার্কটা শেষ হলে একটা কাঁটাতারের বেড়া এবং গেট। সে গেট পার হয়ে ডান দিকে দেখল, দুজন মাঝবয়সি লোক অন্ধকার রাস্তাটায় হেঁটে যাচ্ছে। পাশে গাছপালা নিবিড় এবং কেমন এক অরণ্যের গন্ধ। কোনো মেয়ে খিল খিল করে হাসছে। তার মনে হল, সে কতদিন হাসে না। সেই ভয়ংকর দৃশ্যটা তার মাথা খারাপ করে দিয়েছিল। তার মা, মা না ভদ্রমহিলা, না পড়ন্ত বয়সের যুবতী মাকে কেন সে যে আর কতদিন থেকে মার মতো ভাবতে পারে না, আর তার তখনও একটা ভীষণ কষ্ট হয়—ষড়যন্ত্র করে শেষ পর্যন্ত এই শহরটায় তার নির্বাসন হয়েছে। এবং তখনই মনে হল, সামনে সেই বাড়িটা। সে খুট খুট করে দরজায় কড়া নাড়বে ভাবল, কিন্তু পাশের জানালায় দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। কোনো বনভূমির জ্যোৎস্নার মতো চোখ তুলে তাকে দেখছে।
সে বলল, এটা সুনীল বসুর বাড়ি?
হ্যাঁ।
তিনি আছেন?
এখনও ফেরেননি।
সে আবার সিঁড়ি থেকে নেমে এল। আর একটু ঘুরে আবার আসবে ভাবল। তখনই সেই তরুণী, তাকে বলল, বসুন, বাবা এক্ষুণি এসে যাবে, বলে দরজা খুলে দিল। দরজায় আরও দুটি সুন্দর শিশুর মুখ—তারাও তাকে দেখছে। নবনীতার কেউ হয়। ছোট ভাইবোন থাকলে মেয়েরা আরও সুন্দর হয়ে যায় নবনীতাকে দেখে এটাও টের পেল নানু।
নানুর চোখ এখন অন্য দিকে। সে দেয়াল দেখতে দেখতে ঘরে ঢুকে গেল। চোখে মুখে অতীব এক উদাসীনতা। সে যেন ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছে। তার কিছু জরুরি কাজটাজ আছে, অন্তত বসার ভঙ্গি দেখে তা বোঝা গেল না। বরং মনে হচ্ছিল, নানু শেষ পর্যন্ত সঠিক জায়গার খোঁজ পেয়ে গেছে। অথবা বহু দূরের পথ অতিক্রম করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে। কোথাও আর যাবার কথা নেই, কোথাও আর ফেরার কথাও নেই। সে বসেই জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, এক গ্লাস জল দেবেন? খাব। কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে চোখ তুলে তাকাতেই বুঝল মেয়েটি ঘরে নেই।