প্রিয়নাথ এই মানুষটি যে এমনই জবাব দেবে জানতেন।
প্রিয়নাথ বলল, ভুবন চলো আমরা কোথাও কিছুদিন ঘুরে আসি। রাসবিহারীবাবুও চলুন।
রাসবিহারী পরেছেন সিল্কের পাঞ্জাবি এবং ফাইন ধুতি। পায়ে পামসু মোজা। স্নান সেরে আহ্নিক করে তবে এসেছেন। এখনও সকালের শীত বারান্দায় জমা হয়ে আছে। ভুবনবাবু সুতোর চাদর গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন। প্রিয়নাথের পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। এটাই তার পোশাক। গায়ে জহরকোট। প্রিয়নাথ একসময় স্বদেশি করত। দেশ স্বাধীন হবার পর তার আত্মত্যাগের দৌলতে সরকারের তথ্য বিভাগে বেশ বড় চাকরি করেছে। এবং এখন রিটায়ার করার পর শৌখিন মানুষের মতোই বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। পুত্রের মৃত্যুর জন্য যতটা কাতর হবার কথা তার বিন্দুমাত্র চোখে লেগে নেই। প্রিয়নাথের প্রস্তাবে সবারই সায় থাকা সত্ত্বেও কেউ কোনো জবাব দিলেন না।
কেবল রাসবিহারী বললেন, কোথায় যাবেন?
যেদিকে চোখ যায়, সেদিকে—এখন তো আমাদের সবারই পিছু টান কমে এসেছে।
ভুবনবাবু সামান্য সময় চুপ করে থাকার পর একটু মুচকি হেসে প্রিয়নাথকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কোথায় যাবে? যেখানেই যাও সেই এক দৃশ্য—মনে হবে তুমি বড় পিছিয়ে পড়েছ। সবাই দৌড়াচ্ছে। এটা দেখতে কার ভালো লাগে বলো। তারপরই বললেন, নানু এসেছিল। বলল মেসোমশাই একবার আমাদের দিকটাই ঘুরে আসবেন! মন প্রফুল্ল হবে। বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাবেন।
রাসবিহারী এমন একটা খবরে ব্যথিত হলেন। নানু এখানে এসেছে অথচ তাঁর কাছে যায়নি। এমন কী তার রাগ হল ভেবে, মিতা কিংবা ভানু কেউ খবরটা দেয়নি। রাসবিহারী বললেন, কবে নানু, এসেছিল?
সে তো মনে করতে পারছি না। কেউ বাড়ি ছিল না। নীরজা দুপুরে নিদ্রায় মগ্ন ছিল। ও আমার সঙ্গেই দেখা করে গেল। বলল, কীসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং—এ এসেছিল। মানুর খবর কিছু রাখে কিনা বলতে বলল, ও নিয়ে ভাববেন না। মানু কখনও খারাপ কাজ করতে পারে না। তাছাড়া মানু ভালো আছে। আজ হোক কাল হোক ওর সঙ্গে মানুর দেখা হবেই। কী বিশ্বাস থেকে এমন বলল, তাও বুঝতে পারলাম না। আরও কত কথা। এমন সুন্দর কথা বলতে পারে ছেলেটা—সে বলছে, সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এখন আর কারও ওপর তার কোনো রাগ নেই। জীবনে সৎ এবং পরিশ্রমী হওয়া বাদে মানুষের নাকি আর কিছু করণীয় থাকে না। হালের রাজনীতি নিয়ে কথা হল, উগ্র রাজনীতি নিয়েও সে কথা বলল। আজকের যারাই সৎ দেশে তারা কিছু করতে চায়। কীভাবে করবে ঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তবে একটা কিছু ঠিক হবেই। এভাবে একটা দেশের মানুষ বেশিদিন বাঁচতে পারে না বলেও তার বিশ্বাস। যদি যাই ওর কাছেই যাব।
রাসবিহারী কেমন বিভ্রমের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। নানুর চিঠির সঙ্গে এসব কথার যেন কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি বললেন আমাকে কেউ খবরটা দিল না!
আপনি জানেন না সে এসেছিল!
না।
ভানু কিছু বলেনি!
না।
তাজ্জব! নানু যে এসেছিল, ওদের আমি বলেছি। গোপনে মানুও আসে। কারও সঙ্গে দেখা করে না। শুধু আমার সঙ্গেই কথা হয় গোপনে। তবে কী জানেন, আজকাল আমার ছেলেমেয়ে বউ কেউ আমার কথা বিশ্বাস করতে চায় না। ভাবে। আমার মাথা খারাপ।
তারপর কেন জানি কেউ আর একটা কথা বলতে পারল না। সবাই দেখল ভুবনবাবু কেমন উদাস মুখ করে বসে আছেন। রাসবিহারী রাস্তা দেখছিলেন। প্রিয়নাথ মাথা নিচু করে বসে আছেন। তিনজন সমবয়সি মানুষ আজ বড় বেশি টের পেলেন কেউ তাঁরা ঠিকঠাক বেঁচে নেই। তাঁদের জীবনের সবকিছু এক অদৃশ্য শক্তি ধীরে ধীরে হরণ করে নিচ্ছে।