এবং ঘরে ফিরে মনে হল, এক পরিত্যক্ত আবাসে তিনি এসে ঢুকছেন। শুধু ইঁদুরের কিছু খুট খুট শব্দ শুনতে পেলেন। হেমর কোনো সাড়াশব্দ নেই। শ্বাসকষ্ট, যদি কম দম বন্ধ হয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে যায় কেমন ভূতুড়ে একটা অস্তিত্ব অনুভব করে তিনি ভিতরে কেঁপে উঠলেন। এবং খুব সন্তর্পণে হেমর ঘরে ঢুকে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিলেন। হেম ঘুমোচ্ছে। হেমর মৃত্যু হয়নি তো! নিশ্বাস পড়ছে কী না ভেবে তিনি হেমর নাকের ওপর হাত রাখতেন, না, নিশ্বাস পড়ছে। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। এই বাড়িতে একসময় সব ঘরগুলি শোরগোলে ভরে থাকত। ছয় মেয়ে এবং মেয়েরা বড় হতে থাকলে বাড়িতে যুবক আত্মীয়দের ভিড় লেগেই থাকত। সবসময় তখন হেম ছিল ব্যস্ত। একদণ্ড ওর দম ফেলবার সময় ছিল না। এক হাতে সব সে আগলে রেখেছিল। আত্মীয়স্বজনে বাড়িটা ভরে থাকত। কেউ এলে মেয়েরা ছাড়তে চাইত না। এখন মনে হয় সবই অন্য জন্মের ঘটনা। যদি নানুটাও থাকত। নানুর বউ এবং তখনই আবার একটা ঝি—মেয়ে এবং বংশের কৌলীন্য সব কেমন তার ঘিলুর মধ্যে রক্তের প্রবাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিমেষে তিনি একজন অবুঝ অভিভাবক হয়ে উঠলেন। তাঁর মনেই থাকল না, তিনি অসহায়, সবাই তাঁকে ছেড়েছুড়ে চলে গেছে। রক্তের মধ্যে কী যে এক নিছক আভিজাত্য মানুষের থেকে যায়। তিনি সব জটিলতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য অবশেষে বললেন, ঠাকুর সবই তোমার ইচ্ছা।
আসলে এই ইচ্ছার কথা বলে যতই তিনি রেহাই পেতে চান ততই তাঁকে যেন কেউ দম বন্ধ করে মারতে চায়। কেমন এক জ্বালা মাথার মধ্যে কেবল কুট কুট করে কামড়াচ্ছে। আমরা তোর কাছে এত পর হয়ে গেলাম! একটা ঝি—মেয়ে তোর সর্বস্ব হয়ে গেল : এবং এই করে রাসবিহারীর মনে হল সামান্য একটা মেয়ে তাঁদের সব কৌলীন্য কেড়ে নিচ্ছে। প্রথম দিকে যতটা হালকাভাবে নিয়েছিলেন, দিন যত যেতে থাকল তত কেমন গুরুত্ব বাড়তে থাকল আর তিনি ভাবতে থাকলেন, ক্রমেই হেরে যাচ্ছেন। অথচ এই জ্বালা তার আগে তেমন হয়নি। যেন আমার কী যার ছেলে তার কোনো মাথাব্যথা নেই, আমি কেন চিন্তা করে মারি। এ—সবই তাঁকে দীর্ঘকাল চুপচাপ থাকতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু রানুর উদ্বেগপূর্ণ চিঠি পেয়ে তিনি কিছুটা বিচলিত বোধ করলেন। বিধবা মার তুই একমাত্র ছেলে, কত আশা—ভরসা—আর তুই এখন একটা ঝি—মেয়ের সঙ্গে থেকে সত্য দর্শন করছিস।
আগামীকাল ভুবনবাবুর বাড়িতে তাঁর যাবার কথা। ভুবনবাবুর ছেলেটিরও খোঁজ নেই। নানুর মতো উগ্র রাজনীতির শিকার। ভুবনবাবুর সঙ্গে তাঁর জীবনের কোথায় যেন বড় রকমের একটা মিল আছে। শোবার সময় তিনি জল খেলেন, এবং ঘুমের ওষুধ খেলেন। আজকাল ঘুমের খুব ব্যাঘাত হচ্ছে। সারারাত কোনো কোনো দিন জেগে থাকেন। রাস্তায় গাড়ির শব্দ পান, খুব নিশুতি রাতে পাতা পড়লেও তিনি টের পান, গাছ থেকে পাতা ঝরছে।
পরদিন রাসবিহারীবাবু সকাল সকাল ভুবনবাবুর বাড়িতে চলে গেলেন। দু’জন সমবয়সি মানুষের দেখা হলে কিছুটা হালকা হবেন ভেবেছিলেন তিনি। সেখানে গিয়ে দেখলেন প্রিয়নাথও হাজির। আজকাল কী হয়েছে ভুবনবাবুর, তিনি মাঝে মাঝে কোনো বুড়ো মানুষের সঙ্গে দুদণ্ড কথা বললে সুখ পান। রমা তাঁকে অফিস থেকে ফোনে এমনই বলেছিল। আপনি আসবেন মেসোমশাই। বাবা আজকাল কেমন হয়ে যাচ্ছে। সে প্রিয়নাথকেও অফিস যাবার পথে বলে গেছিল। অন্তত বাবা কিছুটা সমবয়সি মানুষের সঙ্গে থাকলে স্বাভাবিক কথাবার্তায় মশগুল হয়ে থাকতে পারবেন। এবং কিছুদিন থেকেই ভুবনবাবু কতদিন বুড়ো মানুষের সঙ্গে দেখা হয় না বলে বেরই হয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
রাসবিহারী ভুবনবাবুর বাড়ি পৌঁছে দেখলেন, রমা অফিস ছুটি নিয়েছে। ভানুও অফিস যায়নি। মিতা এখনও এ—বাড়িতে রান্নাঘরের ছাড়পত্র পায়নি। প্রিয়নাথবাবু বিধবা বউমাও এসেছেন। অনেক দিন পর তিন সমবয়সি মানুষ বারান্দায় বসে প্রথমে দেশের দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা আরম্ভ করলেন। দ্রব্যমূল্য থেকে, দেশ বাড়ি, শৈশবকাল, বাবা জ্যাঠাদের গল্প, একান্নবর্তী পরিবারের গল্প, এভাবে বর্তমান প্রজন্মের কথাও এসে পড়ল।
রাসবিহারী বললেন, মানুর কোনো আর খবর পেলেন না!
ভুবনবাবু ধুতি কোঁচা দিয়ে পরেন। গায়ে ফতুয়া। চুল খুব ছোট করে ছাঁটা। সাদা চুল এবং মুখ সদ্য কামানো বলে, খুবই শৌখিন মানুষের মতো দেখতে লাগছিল। ভুবনবাবু খুব লম্বা নন, খুব বেঁটে নন, এখনও অসুখ—বিসুখ কম। এদিকে রাতে দুবার উঠতে হচ্ছে, ব্লাডসুগার করাবেন। ভেবেছেন। রাতে আর ভাত খান না। দুধ রুটি এবং কলা এই প্রায় রাতের খাবারে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনও চা—টাই বেশি খান। চা খেতে তিনি ভালোবাসেন। ইতিমধ্যে একবার চা হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় রাউন্ডের চা এসেছে। বেতের চেয়ারে গোল হয়ে বসছেন। তাস পাশা খেলার অভ্যাস থাকলে এ সময়ে এটাই জমে ওঠার কথা। কিন্তু ভুবনবাবুর তাস পাশার নেশা নেই, এক সময়ে বই পড়ার নেশা ছিল, এখন পত্রিকা পড়ার নেশা। পত্রিকার খবর থেকে বিজ্ঞাপন, পাত্র—পাত্রীর খবর এবং আজ কোথায় যাবেন এই শিরোনামায় তিনি কিছু কিছু খবর নিয়ে বিকেল হলেই আজ কোথায় যাবেন জায়গাতে নিঃশব্দে কোনো কোনো দিন চলেও যান। রমার কাছে, ভানুর কাছে এটা খুবই অস্বাভাবিক ঠেকছে। বাবাতো এমন ছিলেন না। কিছু বললে, বলেন, মহাবোধি সোসাইটিতে গেছিলাম। বেশ বললেন, দয়ানন্দজী। ধর্ম সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেল বলে আজ দেশের এই দুরবস্থা। অবশ্য এখন মানু সম্পর্কে রাসবিহারী কিছু জানতে চাইছেন। কী বলবেন ভাবছিলেন। গোটা চারেক উড়ো চিঠি এসেছে, কে বা কারা করিডোরে রাতে ফেলে যায়। —আমি ভালো আছি বাবা। এই চারটি শব্দ লেখা থাকে। হাতের লেখা থেকে তিনি বুঝতে পারেন ওটা মানুরই চিঠি। কাজেই তিনি বললেন, মনে হয় ভালোই আছে। না থাকলে খবর পেতাম।