চিঠি লিখতে বসে এই সব হাবিজাবি রাসবিহারীর মনে আসতে থাকে। মানুষের মৃত্যুভয় সব আত্মপ্রত্যয় নষ্ট করে দেয়। অথচ সহজভাবে ভাবলে, এটাই কী নিয়ম, এভাবেই মানুষ সংসার করতে করতে একদিন শেষ হয়ে যায়, এটা বোঝা উচিত। হেমকে এসব বলেও লাভ নেই। বয়স হলে রক্তের জোর কমে আসে, শরীরের ক্ষমতা কমে আসে, মহাপ্রস্থানের পথে তখন রওনা হতে হয়। এবং এসময় কিছু তীর্থস্থান দর্শনে মনে প্রসন্নতা আসে। তিনি লিখলেন, তোমার মার শরীর ভালো না। ভাবছি তোমার মাকে নিয়ে কিছুদিন দক্ষিণভারত ঘুরে আসব। তারপর কী লেখা যায়—মণীষের কথা লিখবেন কিনা ভাবলেন। তাঁর বড় মেয়েটি রুগণ। মণীষের সঙ্গে রানুর অবৈধ সম্পর্কটি তিনি এ—বাড়িতেই টের পেয়েছিলেন। কিন্তু চোখ বুজে থাক ছাড়া উপায় ছিল না। শরীর বলে কথা। তারপর তিনি আরও দু—লাইন লিখলেন, ভানুর চিঠি পেয়েছি, সে ভালো আছে। মিতা গত রবিবারে ভানুকে নিয়ে এসেছিল। ওরা দুপুরে এখানে খেয়েছে।
তারপরের লাইন লিখতে গিয়েই মনে হল, আসলে মানুষের মুক্তি বলে কিছু নেই। তিনি মুক্তি খুঁজছেন, আসলে সেটা সব কিছুর সঙ্গে শুধু কমপ্রমাইজ করে চলা। নানুও কী তাই করছে। না সত্যি সে মানুষের আরও বড় সত্যাসত্য আবিষ্কার করে ফেলেছে। কারণ রাসবিহারীর ধারণা মানু আর দশটা ছেলের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। সে বড় একটা কিছু করে ফেলতে চায়। কিন্তু সেই মুহূর্তেই মনে হল সামান্য একটা ঝি—মেয়ের জন্য যে চলে যায়, তার পক্ষে বড় কিছু করা অসম্ভব। তিনি লিখলেন, নানু চিঠিতে ঝি—মেয়েটির কোনো কথাই লেখেনি। তারপরই মনে হল, এ—বাক্যাংশটি রানুকে পীড়া দেবে। ভেবে কেটে দিলেন। বেশ ভালো করে কেটে দিলেন। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা তিনি চাইলেন না। শেষে লিখলেন নানু ভালো আছে। তুমি এলে আমি মানুর কাছে যাব। বুঝিয়ে বলব, দেখি কী হয়। সে সেই যে চলে গেল আর একবারও এল না। যদিও এসে থাকে কলকাতায়, আমার এখানে এল না। আর একটা কথা লিখছি, মণীশ তো স্বরাষ্ট্র দপ্তরে আছে, তুমি কী ওকে দিয়ে পুলিশের মারফত নানুকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারো না। আসলে সে ওখানে পুলিশের ভয়ে আত্মগোপন করে আছে। মণীষের এত প্রভাব শুনছি, আর এতো সামান্য কাজ—একটা ঝি—মেয়ের জন্য ভদ্রসন্তান দেওয়ানা হয়ে যায় কবে কে দেখেছে। তিনি যে বাক্যাংশ কেটে দিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাই আবার লিখলেন। মনের সেই আদিম সংস্কারের জায়গাটা খুঁচিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে দিয়ে তাই লেখাল। তিনি তারপর কিছুক্ষণ টেবিলে বসে থাকলেন। চিঠি লেখা শেষ হয়েও হচ্ছে না। শরীর থেকে চাদরটা সরে যাওয়ায় শীত শীত অনুভব করলেন। চাদরটি ফের ভালো করে জড়িয়ে নিতেই মনে হল, ও—ঘরে হেম খুব কাশছে। হেমর ঘরে আজকাল তার যেতেও ভয় লাগে। সব সময় একটা না একটা অনুযোগ। যেন হেমর সব কষ্টের হেতু তিনি নিজে।
রাত বাড়ছিল। এত বড় বাড়িটাতে এখন তিনি আর হেম। কেন এই বাড়িটা যে করতে গেলেন! যৌবনে মানুষের কত স্বপ্ন থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সবই কাচের পাত্রের মতো মনে হয়। জীবনের ইচ্ছাগুলো বড়ই ক্ষণভঙ্গুর, তবু সব আগলে একটা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো এই আবাসে তিনি বেঁচে আছেন। সামনের জানলা খোলা, লনে জ্যোৎস্না। কিছু গাছপালা ডুবে আছে। এই গাছপালাগুলোই মনে হয় তাঁর শেষ বেলার সঙ্গী। এবং বাড়িটিতে যদি তার নিজের রোপণ করা গাছপালাগুলি না থাকত, তবে যে—কোনো পান্থনিবাসের মতো বাড়িটাকে ছেড়ে তিনি অন্যত্র চলে যেতে পারতেন। তার সেজন্য এতটুকু কষ্ট হত না। কিন্তু গাছপালা বোধহয় মানুষের নীরব বন্ধুত্ব কামনা করে। শেষ বয়সে এটা তিনি বেশি টের পান বলে কোথাও গিয়ে দুচার দিনের বেশি থাকতে পারেন না। এ বাড়িটাতে এখন গাছপালাগুলিই তাঁর আকর্ষণ। হেম যে এতদিনের সঙ্গী ছিল, সেও দিনকে দিন অদ্ভুতভাবে জীবন থেকে সরে যাচ্ছে। যদি হেমর মৃত্যু হয় তার কোনো কষ্ট হবে না। বরং কেন জানি কিছুদিন থেকে মনে মনে তিনি হেমর মৃত্যু কামনা করছেন। এই গেরোটা মানুষের খুবই বড় গেরো।
চিঠিটা ভাঁজ করলেন। কাল সকালেই চিঠিটা ডাকে দিতে হবে। রানু বিয়েতে এসেছিল মাত্র দুদিনের ছুটি নিয়ে। তখন ছেলে সম্পর্কে প্রায় নীরব ছিল। অথচ তার এই চিঠিটাতে নানুর জন্য ভারী আবেগের সঞ্চার হয়েছে। এতদিনে কী রানু শরীরের দিক থেকে কোথাও কিছু খামতি টের পেয়েছে। সে বুঝেছে কী শরীরের রক্তমাংসে আর তেমন বান ডাকার ব্যাপারটা নেই। ক্রমশ তা কমে আসছে। অথবা বয়সের রেখা ক্রমে শরীরে দগদগে ঘায়ের মতো ফুটে উঠছে। এখন তার একমাত্র সম্বল বলতে শ্রীমান দুর্গাদাস ওরফে নানু।
তিনি চিঠিটা টেবিলে রেখেই বাইরে বের হয়ে এলেন। শীতের জ্যোৎস্না তাঁর বাড়ির সর্বত্র এখন ছম ছম করছে। রাস্তায় দুটো কুকুর দৌড়ে যাচ্ছিল, আউট হাউসে নিধু ঘুমোচ্ছে বোধ হয়। গোরুর ঘরে খচ খচ শব্দ হচ্ছিল। দূরে শেষ বাস অথবা রিকশার টুংটাং শব্দ তিনি লনে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলেন। শুনতে পেলেন, বহু দূর থেকে এক বালক, হাত তুলে তাঁকে যেন ইশারায় ডাকছে। বহুদূর অথবা যেন কোনো গতজন্মের ঘটনা, সেই বালকের হাত ধরে কেউ হাঁটছে। বাবার হাত ধরে সে কোথাও যাচ্ছে। তাঁর মনে হল বাবা এমনি শীতের রাতে তাকে লণ্ঠন নিয়ে আনতে যেতেন মাস্টারমশাইর বাড়ি থেকে। সে বাবার হাত ধরে বাড়ি ফিরত। বাবা বলতেন, সদা সত্য কথা বলিবে। বাবা প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষদের জীবনী বলতেন, রাসু তুমি বড় মানুষ হবে। এইসব ভাবলে তিনি কেমন বিমর্ষ হয়ে যান। তিনি চেয়েছিলেন এক, হলেন অন্য। প্রবঞ্চনা শঠতা বাদে এক সময় জীবনে তাঁর কোনো সম্বল ছিল না। এখন তাঁর মনে হয় কার জন্য তিনি জীবনে এই শঠতা এবং প্রবঞ্চনা সম্বল করে এখানে এসে পৌঁছেছেন। শূন্য এক মাঠ, খাঁ খাঁ মরুভূমির মতো যেন তাঁকে এখন গিলতে আসছে। তিনি একা লনে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় পেলেন।