ওরা কেউ আর একটা কথা বলল না। সে উঠে চলে গেল। সকালবেলায় দৈনিক কাগজে ভুবনবাবু দেখলেন, আবার দুজন পুলিশ খুন! ভুবনবাবু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুনের খবরগুলি পড়লেন। পরদিন আবার দেখলেন, খুন, এবার ম্যানেজার এবং পর পর পাঁচদিন, পাঁচ জায়গায় পাঁচটি ম্যানেজার খুন দিনের বেলা, চার পাঁচটি ছেলে প্রকাশ্য রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়েছিল। বাস ট্রাম সব থামিয়ে দিয়েছে। সব লোক নিমেষে ফাঁকা, দরজা—জানালা বন্ধ করে দিয়েছে ভয়ে সবাই। ম্যানেজারকে টেনে এনে গলার নলি কেটে ওরা উধাও হয়ে গেছে। যাওয়ার আগে দমাদম বোমা ফাটিয়েছে রাস্তায়।
একটা কিছু হচ্ছে। তারই নাম বুঝি বিপ্লব। গাঁয়ে গঞ্জেও সব বীভৎস খবর। স্কুল কলেজে হামলা ছাত্র নিহত হচ্ছে। আগুন দেওয়া হচ্ছে। যেন আজকালকার মধ্যে মুক্তি মিলে যাবে মানুষের। দেয়ালে দেয়ালে লেখা ফুটে উঠছে সত্তর দশক, মুক্তির দশক। সরকার হিমসিম খাচ্ছে, পুলিশ হিমসিম খাচ্ছে। ভয়ে আর কেউ পুলিশের কাজ নিচ্ছে না। কয়েক মাসের মধ্যে বিত্তবান মানুষের মধ্যে ভয়ংকর সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়তে থাকল।
শীতকালে ভানুর বিয়ে হয়ে গেল। নম নম করে কাজ করা হল। মল্লিকা বিয়েতে তার বড় মেয়েকে নিয়ে এসেছিল। মাঝে ভুবনবাবু একদিন মল্লিকাদের বাড়ি গেছিলেন। স্বামী মারা গেছে পাঁচ সাত বছর আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিল। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ করত। বড় মেয়ে মিনু সেই সংসারের হাল ধরেছে। মেয়েটা ভালোই রোজগার করে। এখনও মল্লিকার ঘর বেশ রুচিসম্মত। মিনু কী কাজ করে কোথায় কাজ করে বললে মল্লিকা কেন জানি এড়িয়ে গিয়েছিল। মল্লিকা আত্মীয় স্বজনের কাছেও একটা বড় যায় না। ভানুর আশীর্বাদের দিন প্রায় জোর করেই মল্লিকাকে ধরে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি দেখেছেন, সব সময় মল্লিকা খুবই বিষণ্ণ থেকেছে। নিজের অভাবের কথা একসময়ে সে আত্মীয়স্বজনদের জানিয়েছিল। তখন কেউ বড় একটা সাহায্য করেনি। ভুবনবাবুরও ক্ষমতা ছিল না সাহায্য করার। এবং অভিমানবশেই আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে মল্লিকা দূরে সরে গেছে। বউভাতের দিন মল্লিকা মিনু দু’জনেই এসেছিল। মিনু মেসোমশাইর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার সময় কেন জানি কেঁদে ফেলেছিল।
তিনি ভেবেছিলেন, মানুর কথা ভেবে বুঝি মেয়েটা কেঁদে ফেলেছে। তিনি তাড়াতাড়ি তাকে তুলে বলেছিলেন, আমার কপালে এই লেখা আছে মিনু। তুই এজন্য কাঁদিস না।
বলা ভালো মানুর আত্মগোপনের পরের সপ্তাহে থানার পুলিশ অফিসারটিও খুন হয়েছিল। গুজব জয়াকে সেই পুলিশ অফিসারটি ধর্ষণ করেছিল। কে বা কারা অদৃশ্য এক রন্ধ্র থেকে গুলি করেছিল এবং যাবার সময় ওর পুরুষাঙ্গটি কেটে দিয়ে গেছে।
ছাব্বিশ
নানু এখান থেকে চলে যাবার পর দুখানা চিঠি লিখেছে। চিঠি দুটো রাসবিহারী খুব যত্নের সঙ্গে তার নিজস্ব কাঠের বাক্সে রেখেছিলেন। তিনি ভাবলেন, চিঠি দুটো ফের আর একবার পড়ে দেখবেন। আজ দুপুরে রানুরও চিঠি এসেছে। চিঠিতে এবার রানু নানুর সব খবর জানার জন্য খুব উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এতদিন পরে ছেলের জন্য এই উদ্বেগটুকুতে রাসবিহারী বিশেষ প্রসন্ন। নানু মার কথা তার চিঠিতে কোথাও উল্লেখ করেছিল কী না, যদি না করে থাকে—আসলে কী একটা বয়েস হয়ে যায়, যখন ছেলেমেয়েরা নিজস্ব এক জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়—তখন সম্পর্কে চিড় ধরে বোধহয়। কিন্তু আশ্চর্য চিঠি দুটো খুঁজে পেলেন না। তিনি তো চিঠি দুটো তার কাঠের বাক্সেই রেখেছিলেন। এখন আর কাউকে ডেকে বলতে পারেন না, তোমরা আমার বাক্স কেউ হাঁটকেছ। শেষ দিকে মিতার এই স্বভাব ছিল। টাকাপয়সার দরকার হলে সে অনেক সময় বাক্স হাঁটকাত। টাকাপয়সা তিনি সবসময় বইয়ের ভাঁজে রাখেন। বাক্সটায় তার কিছু ধর্মগ্রন্থ আছে। পাতার ভাঁজে ভাঁজে টাকা, চিঠি, পুজোর ফুল বেলপাতা, এবং তাবিজ ও একটি রুদ্রাক্ষের মালা সবই ঠিক আছে অথচ চিঠি দুটো নেই।
তিনি অগত্যা মেয়ের চিঠির জবাব লিখতে বসলেন। লিখবেন, নানু ভালো আছে। ওর পর পর দুখানা চিঠি পেয়েছি। ওখানে ও জমিজমা কিনে চাষ—আবাদ করবে বলে জানিয়েছে। শহর তার ভালো লাগছে না। সে লিখেছে, আমি একটা নতুন জগৎ আবিষ্কার করেছি দাদু। ফুল ফল গাছপালার কথাও লিখেছে। রাতের জ্যোৎস্না খুব মায়াবী। সকালের সূর্য আশ্চর্য প্রাণপ্রাচুর্য এনে দেয়। দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ, আর রাতের গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে অজস্র নক্ষত্রমালা দেখতে দেখতে প্রায়ই তার মনে একটা প্রশ্ন জাগে, এবং সে প্রশ্নটা বাকি জীবনের সত্যাসত্য নিয়ে। নানু লিখেছে, দাদু তুমি নিজেও এই পৃথিবীতে এনে এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। শেষে লিখেছে, আমি যে লাল বলটা হারিয়েছিলাম, এখানে এসে সেটা ফিরে পেয়েছি।
পরের প্যারাতে কী লিখবেন ভাবলেন, নানু সম্পর্কে চিঠি থেকে তার এই কথাটুকু মনে হয়েছে। তিনি নানুকে লিখেছিলেন, মাকে চিঠি দিয়ো। রানুকে চিঠি দিলে পত্রে তার উল্লেখ থাকত। পত্রে নানুর চিঠির কোনো উল্লেখ নেই দেখেই বুঝতে পারলেন, নানু তার মাকে কোনো খবরই দেয়নি। এমনকি আর কাউকে সে চিঠি লেখেনি। অবশ্য নানু যে স্বভাবের তাতে আর কাউকে সে চিঠি লিখতেও যাবে না। চিঠি পাবার পর মনে হয়েছে একবার তিনি সত্যি নানুর কাছে চলে যাবেন। কিন্তু স্টেশন থেকে পাঁচ সাত ক্রোশ হেঁটে গেলে নানুর সেই স্বপ্নের দেশ। এ—বয়সে এতটা পথ হাঁটতে পারবেন কিনা সংশয়ে এখনও তাঁর যাওয়া হয়ে উঠল না। সংসারে তিনি এখন মুক্ত। অথচ কথাটা যত সহজে ভাবতে পারলেন জীবনযাপনে যদি তার বিন্দুমাত্র আঁচ পাবার চেষ্টা করতেন। হাজার রকমের গেরো তাঁকে সবসময় বিড়ম্বনার মধ্যে রেখে দিয়েছে। হেমর শরীর দিনকে দিন খারাপের দিকে। ইদানীং শ্বাসকষ্টে ভুগছে। ওষুধপত্রে কাজ দিচ্ছে না। টোটকা করেছে কিছুদিন, তারপর দেবস্থানে গিয়েছে। বর্তমান গুরুর খোঁজে আছে। কোনো এক ব্রহ্মচারীর খবর পেয়ে দুদিন সেখান থেকে ঘুরে এসেছেন। কিন্তু গুরুটিকে পছন্দ হয়নি। তবে বাড়িতে সাঁইবাবার ছবি ঝুলিয়ে কিছুদিন বেশ প্রশান্তিতে ছিল, কিন্তু শ্বাসকষ্ট বাড়তেই সে বলেছে, আমাকে প্রভুর কাছে নিয়ে চলো। মনে মনে তার প্রভু ঠিক হয়েই আছে—অযথা গুরুর খোঁজাখুঁজি করেছে। শীতের শেষে ভেবে রেখেছেন, এবার প্রভুর কাছে হেমকে নিয়ে যেতেই হবে। প্রভুর দর্শনে যদি হেম আরোগ্য লাভ করে। নানুর কাছে কবে যাবেন কিছুতেই স্থির করে উঠতে পারছেন না।