বুককি।
বুককি! সে কে!
ভুবনবাবু মানুর বন্ধুদের খুব একটা চেনেন না। আলো থাকলে তিনি মুখ দেখলে চিনতে পারতেন।
রমা বলল, গোবিন্দবাবুর ছেলে।
অঃ।
তারপরই মনে হল সে যদি মানুর খবর রাখে। রাখারই কথা। বলে যেতেও পারে তাকে! তিনি বললেন, বুককি এদিকে আয়।
খুব সতর্ক বুককি। সে এসে ঘরে ঢুকেই ফিস ফিস করে বলল, জয়াকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ!
জয়াকে!
রমা বলল, জয়াকে দিয়ে কী হবে?
পুলিশের ধারণা জয়া সব খবর রাখে মানুর।
ভুবনবাবু বললেন, জয়া যদি বলে দেয় সব।
রমা নীরজা দাঁড়িয়েছিল। বুককিও দাঁড়িয়ে আছে। ভুবনবাবু খাটে বসে আছেন। আবছা বিবর্ণ অন্ধকারে তিনি বুককির মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। কার কাছে কী আবার বলে ফেলবেন ভয়ে বললেন, দাঁড়িয়ে আছো কেন, আলোটা এ ঘরে দিতে পারছ না?
রমা তাড়াতাড়ি টেবিল ল্যাম্প এনে রাখলে ভুবনবাবু বুককিকে চিনতে পারলেন। এ বাড়িতে মাঝে মাঝে এসেছে। তিনি বললেন, তুমি জানো মানু কোথায় গেছে?
বুককি কেমন ইতস্তত করতে থাকল।
আমি তো ওর বাবা! ও যতদিন ফিরে না আসবে আমি আর ঘুমোতে পারব না, জানো।
চিন্তা করবেন না। ও ভালো আছে।
কোথায় আছে?
সে আমিও জানি না মেসোমশাই। মানু এদিকে কেমন হয়ে গেছিল।
ওর কাছে প্রায়ই চিঠি আসত। আমিই দিতাম চিঠিগুলি।
তোমাকে কে দিত?
রোগা মতো একটা ছেলে দিয়ে যেত।
তুমি জানতে না, কোথায় থাকে সে।
না। বারবারই এক কথা বলত।
কী বলত?
বলত, অতসব জানার দরকার নেই। মানু বলেছে চিঠি তোমাকে দিতে। তুমি দিয়ে আসবে।
মানুর কাছে আসত না কেন?
এ পাড়ার কেউ কেউ তাকে চিনে ফেলতে পারে। ভয়ে আসত না।
তখনই মনে হল, গৌরীবাবুর ছেলে আজ সাত আট মাস হল পাড়া ছেড়ে চলে গেছে। বুককি ঠিক এ—পাড়ার ছেলে নয়। সে থাকে জমির লেনে। দুটো বাস স্টপেজ পার হয়ে তাকে এখানে আসতে হয়। জয়া বুককিদের পাড়ার মেয়ে।
রমা বলল, ছেলেটা রোগা ফর্সা মতো?
ঠিক ফর্সা নয়, শ্যামলা রঙ।
চোখ বড় বড়?
চোখ বড় নয় বরং বেশ লম্বা বলা যেতে পারে।
এ পাড়ায় বছরখানেক আগে নানারকম খণ্ডযুদ্ধ লেগে থাকত। কোথায় উত্তরবঙ্গের একটা জায়গায় জোতদার খুন হল তারপর থেকেই ক্রমে শহরটায় কেমন একটা চাপা আক্রোশ কারা ছড়িয়ে যাচ্ছে। শহরের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে যারা বাঁচছে, যারা বস্তিতে থাকে, যাদের জীবনধারণের কোনো অবলম্বন নেই, তাদের পক্ষ হয়ে এই বিপ্লব। অন্নহীন মানুষের জন্য লড়াই। সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না হলে মানুষের মুক্তি নেই এমন সব কথাবার্তা চারপাশে কারা ফিস ফিস করে কানে কানে যেন কেবল বলে যাচ্ছিল।
রমা জানত কোনোরকমে যদি একটা কাজ জুটিয়ে দিতে পারত মানুকে তবে এই কানাকানির ভয় থাকত না। এবং একসময় সে অরুণকে বলেছিল, যে—কোনো একটা কাজ দিয়ে অরুণ ওকে এখন বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। তুমিত জানো, উঠতি ছেলেদের কী ছোঁয়াচে রোগে ধরেছে। ওকে ভুবনেশ্বর পাঠিয়ে দাও। ওখানে তো আমাদের একটা সেল—এম্পোরিয়াম আছে। তুমি ইচ্ছে করলেই পারো।
অরুণ বলেছিল, একটু সময় দিতে হবে।
রমা বলেছিল, কিন্তু জানোতো আমাদের পাড়াটা ভালো না। নষ্ট হয়ে যেতে কতক্ষণ। রমা কিংবা নীরজা অথবা ভুবনবাবু যা আশঙ্কা করেছিলেন শেষ পর্যন্ত মানু তাই হয়ে গেল।
ভুবনবাবু বললেন, জয়াকে ছেড়ে দিয়েছে?
না।
তুমি বসো না। নীরজা একটা মোড়া এনে দিল। নীরজার চোখমুখ শুকনো। ভানু বাড়ি নেই। অরুণ আর ভানু সেই দাদাটির সঙ্গে পরামর্শ করতে গেছে। কারণ পুলিশের পাল্লায় পড়লে সহজে আর রক্ষা থাকে না। কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে নিয়ে যাবে সেজন্য আগে থেকেই সতর্ক থাকা ভালো। মস্তান দাদাটিকে পুলিশ খুবই ভয় পায়। তার কারণ দাদাটি তার বাড়ির বসার ঘরে একটা এমন ছবি টাঙিয়ে রেখেছে, যা দেখলে পুলিশের হৃৎকম্প না উঠে উপায় নেই। সেই ফোটোটাই তার তুরুপের তাস।
ভুবনবাবু খুব বিস্ময়ের গলায় বললেন, জয়া ওখানে থাকবে কোথায়?
পুলিশ লক—আপে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে ভুবনবাবু আর্ত চিৎকার করে উঠলেন, পুলিশ লক—আপে!
রমা বলল, ও কী মিসায় অ্যারেস্ট হয়েছে?
সে জানি না।
ভুবনবাবু বললেন, ভাবতে পারছি না! তিনি নিজের ওপর দিয়ে যা প্রত্যক্ষ করে এসেছেন, তার যদি বিন্দুমাত্র জয়াকে জিজ্ঞেস করে কিংবা দৈহিক নির্যাতন করে, এবং আরও কিছু উৎকট দৃশ্য চোখের ওপর ভাসতেই কেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গিয়ে বললেন, তোমরা পারোনা বুককি, এখনই গিয়ে থানাটায় আগুন ধরিয়ে দিতে? একটা সামান্য মেয়ে, কী ভালো মেয়ে, শুনেছি মেয়েটা সাত পাঁচে থাকে না, কবিতা লেখে, সেই মেয়েটাকে তোরা নিয়ে গেলি!
রমা বলল, কী বলছ যা—তা বাবা!
ভুবনবাবুর খেয়াল হল, জয়ার পর রমা। এমনকি রমার পর নীরজাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। পুলিশের হাতে অসীম ক্ষমতা। তিনি মুখে কুলুপ এঁটে দিলেন। আর একটা কথা বললেন না।
নীরজাই কেমন বোকার মতো বলল, ওকে মারধোর করেনি ত কথা বার করার জন্য?
ওর মাতো শুনেই অজ্ঞান। ওর বাবা ছুটোছুটি করছে। ওর পিসিমার দেওর পুলিশে কাজ করে। রুমন আরও সব পাড়ার ছেলেরা থানায় গেছে। পিসিমা গেছে ওর দেওরের কাছে।
ভুবনবাবু শুধু বললেন, কী যে হবে!
তারপর সবাই চুপ। বুককিও কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। কার কোপ কার ঘাড়ে পড়বে কেউ বলতে পারে না। কেমন ভীতসন্ত্রস্ত চোখমুখ। পুলিশ যদি জানে সেই পত্রবাহকের কাজ করছে তবে তাকেও ধরে নিয়ে যেতে পারে। এখন ছুতো পেলেই হয়েছে। বুককি বলল, আজ রাতের ট্রেনে আমিও চলে যাব। মুর্শিদাবাদে আমার মাসিমা থাকেন। তারপরই থামল, না বলা ঠিক হচ্ছে না। বড়ই গোপন রাখা দরকার। কোথা থেকে কীভাবে ফাঁস হয়ে যাবে কেউ জানে না। পুলিশের গুপ্তচর এখন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছে। তা না হলে জয়ার সঙ্গে মানুর সামান্য সম্পর্ক আছে সেটাই বা টের পেল কী করে পুলিশ। সে উঠে পড়ল। —আমি যাই।