রমা বলল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
জয়াদের বাড়ি যাব।
জয়াদের বাড়ি এখন যেতে হবে না।
কেন, গেলে কী হবে?
রাস্তায় লোকজন জড়ো হয়েছে। নিচে নামলেই আপনাকে আজে বাজে প্রশ্ন করবে। আপনি এখন কোথাও বের হবেন না।
ভুবনবাবু পুত্রকন্যার কথায় নিরস্ত হলেন। চারপাশের মানুষ তামাশা দেখতে ভিড় করেছে। ভুবনবাবু ধীরে ধীরে মানুর ঘরে ঢুকে ওর খাটে বসে পড়লেন। ছেলেটা এমন কী করত যার জন্য পুলিশ এ—ভাবে তাকে অপমান করে গেল! এই অপমান লাঞ্ছনা নির্যাতন শেষ বয়সে তাঁর কপালে লেখা ছিল তবে। মনে মনে বললেন, মানু বাপের দিকটা দেখলি না একবার। সংসারে আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। তুই কোথায় গেলি তাও বলে গেলি না। এত উদ্বেগ নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে! তারপরই মনে হল, না বলে গিয়েছে ভালোই করেছে। পুলিশ তাকে সহজে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। নির্যাতন শেষ পর্যন্ত এমন হতে পারে যে তিনি সব ফাঁসও করে দিতে পারতেন। আর ঠিক দুপুরেই এল দুজন পুলিশ, তারা ভুবনবাবুকে থানায় ধরে নিয়ে গেল।
বিপদের সময় রমার একমাত্র মানুষ অরুণ, যাকে সে ফোনে সব বললে ছুটে এল। সব খুলে বললে, অরুণ বলল, দেখছি। এখন বিকেল হয়ে গেছে, গোবিন্দদা এখানে আছেন। তাছাড়া অরুণের দূর সম্পর্কের এক দাদা বিধানসভার সদস্য। দেশ স্বাধীন হবার আগে বিপ্লবী ছিল, এখন কংগ্রেসি। যখন যে দল ভারী সেখানে নাম লেখাবার প্রবণতা আছে মানুষটার। মানুষটা খুবই রাশভারি, খুব প্রভাব আছে উঁচু মহলে। ছয়কে নয় করতে বড়ই ওস্তাদ মানুষ। অরুণ বুঝতে পারছে এ—সময়ে দাদার স্মরণাপন্ন হওয়া ছাড়া তার উপায় নেই। মনে মনে সে তার দাদাকে ঘৃণা করে। কারণ সে জানে, ভদ্রলোকের রাজনীতির দিন শেষ হয়ে গেছে। গুণ্ডা বদমাসরা সব এখন এম এল এ। লম্পট হলে তো কথাই নেই—তার দাদাটির ক্ষেত্রে সবই প্রযোজ্য। সে তার শরণাপন্ন হয়ে বিকেলের দিকে ভুবনবাবুকে বাড়ি নিয়ে আসতে পারল।
কিন্তু এ কী চেহারা মানুষটার! উদভ্রান্তের মতো চোখ। কারও সঙ্গে একটা কথা বলছেন না। পাগল পাগল চেহারা। সিঁড়ি ধরে উঠতে পারছিলেন না। শরীরে হাত দিলেই কঁকিয়ে উঠছেন। রমা বাপের এমন অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল! ভানু কেমন হঠকারী যুবক হয়ে গেল, বলল শালাদের আমি খুন করব।
অরুণ বলল, কোথায় লেগেছে মেসোমশাই।
ভুবনবাবু, বললেন, জল খাব রমা।
ওরা সবাই বুঝতে পারল, পাঁজাকোলে করে তুলে নিয়ে যেতে হবে। রমা মুখ নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সব রাগ কেন জানি এখন মানুর ওপর গিয়ে পড়ছে। নীরজা দরজায় হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে। ভুবনবাবুকে বিছানায় শুইয়ে দিলে, রমা জল নিয়ে এল। ভুবনবাবু উঠে বসতে চাইলেন। অরুণ বলল, বসতে পারবেন?
ভুবনবাবু উঠে ততক্ষণে বসে পড়েছেন। জলটা খেলেন। তারপর বললেন, তোমাদের একটা কথা বলছি, মানু যদি বাড়ি ফিরে আসে, ওকে কিন্তু এসব কিছু বল না।
অরুণ বলল, পুলিশের অত্যাচার দিন দিন বাড়ছে। অথচ যা চেহারা দেখছি কোনদিক থেকে ঝড় উঠবে বলা যাচ্ছে না। সেও বলল, মানুকে না বলাই ভালো। ওদের দলটাও বসে নাই। তারপরই অরুণ বলল, আচ্ছা রমা, মানু এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তোমরা কেউ আগে তো আমায় বলনি!
এই প্রথম রমা কেমন মানুর পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলল, একে নষ্ট হওয়া বলে অরুণ!
তা হলে তোমাদের আসকারাতেই এটা হয়েছে!
রমা বলল, না তাও না। যা সময়কাল অরুণ, এটাই হওয়ার কথা। আমরা ধরে বেঁধে কতদিন আর সব ঠিকঠাক রাখব। তারপর রমা বুকের আঁচল টেনে বলল, তবে আমরা ওকে আসকারা দিইনি। বাড়িতে খুব বেশি একটা সময় মানু এদিকটায় থাকতও না। পড়াশোনাও মন দিয়ে করল না। অবশ্য ওরই বা দোষ কী বল—চারপাশে যা সব দেখছে!
কী দেখছে?
কী দেখছে না বল?
হঠাৎ রমাকে বিপ্লবী কথাবার্তা বলতে দেখে অরুণ এই পরিবারের এত দুঃখের সময়েও না হেসে পারল না।
তুমি হাসছ?
না হাসছি না।
দেখছ না চারপাশে কেমন সব ধান্ধাবাজ মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর কেমন অপরাধীর গলায় বলল, আমরাও অরুণ ভালো ছিলাম না।
অরুণ আর কথা বলতে পারল না। এই পরিবারে সবারই বুকে কথাটা বড় বেশি বাজল। সংসারে পাপ ঢুকে গেলে এমন হয়—এই এক বিশ্বাস নিয়ে ভুবনবাবু আপাতত চোখ বুজে পড়ে থাকলেন। নীরজা পায়ের কাছে বসে ভুবনবাবুর পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।
সন্ধ্যার পরই লোডশেডিং। পাড়াটা অন্ধকার। কেমন নিঝুম হয়ে গেছে। পাশের বাড়িটার একতলায় ব্যাংকের অফিস। ওপরের তলায় ব্যাংকের এজেন্টের কোয়ার্টার। ওদের বাড়িতে এ সি জ্বলে, চারপাশে যখন অন্ধকার থাকে, তখন ও—বাড়িটায় আলো জ্বলে। সেই আলোতে ভুবনবাবুর ঘরটা কেমন আবছা ফ্যাকাশে বিবর্ণ রঙ ধরেছে। টেবিলে ল্যাম্প জ্বেলে দিয়ে গেছিল নীরজা। ভুবনবাবু এখন অন্ধকার পছন্দ করছেন বলে আলোটা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর সেই সময় মনে হল খুট খুট করে কেউ কড়া নাড়ছে। গোপনে মানু ফিরে এল না ত! ভুবনবাবু খুবই চঞ্চল হয়ে উঠলেন। তিনি উঠতে যাবেন, তখন মনে হল কেউ দরজা খুলে দিচ্ছে। তিনি দরজার মুখে গিয়ে দেখলেন, চুপি চুপি কেউ করিডরে ঢুকতেই নীরজা দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। অস্পষ্ট আলোতে তিনি বুঝতে পারলেন না কে ঢুকছে। রমা নীরজা দু জনই আছে। তারাও কিছু বলছে না। তিনি বললেন, কে!