রাস্তায় মানুষজন জমে গেছে। রমা রান্নাঘরে নীরজা রান্নাঘরে। মানদা কেবল বলছে, এ—কোন আপদ! পুলিশ সব খুঁজে পেতে দুটো লিফলেট পেল। লিফলেট দুটো দোমড়ানো, বোধহয় একটিতে সুপুরির কুচি রেখেছিল নীরজা এবং একটায় হরীতকী। সেই দুটো সম্বল করে গোঁফে তা দিয়ে একটা বড় রকমের খোঁজখবর মিলে গেছে মতো পুলিশের দলটা বড়বাবুর জন্য দাঁড়িয়ে থাকল।
তখন পুলিশ অফিসারটি দরজা বন্ধ করে বলে গেল, বুড়ো হয়েছেন, কত কিছু দেখতে হবে। আজকাল মানুষ বড়ই ধান্দাবাজ। আপনারা সেকেলে লোক টের পান না। ছেলেটাকে আপনার চোট্টারা সর্বনাশ করে তবে ছাড়ল। কোথা গেছে বলুন! আমরা ধরে এনে শুধরে দেব। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে।
ভুবনবাবু বললেন, জানি না।
পুলিশ অফিসারটি বলল, বড়ই দুঃখময়। দেশে বড় লোক কেবল বড় লোক হচ্ছে, গরিব কেবল গরিব হয়ে যাচ্ছে।
দু দলই লড়াই করবে বলে হাঁকপাঁক করছে। আমাদের হয়েছে মরণ। কার দিকে যাই বলুন। আপনার ছেলেটি কোন দলে গেছে আপনি জানেন! সেটা খুব ভালো দল না। মনীষীদের যখন তখন মাথা কাটছে। আপনি নিশ্চয় জানেন। বাবা যখন পুত্রের খবর আপনি জানবেনই। বলুন—ধরে আনি। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিয়ে দি।
ভুবনবাবু বললেন, জানি না।
দেশটা দেখতে দেখতে কী হয়ে গেল বলুন। এখন শুধু ধান্দাবাজদের রাজত্ব। রাজনীতি বলুন, অর্থনীতি বলুন সমাজ সংস্কৃতি বলুন সব ধান্দাবাজাদের মুঠোয়। আপনারা সৎমানুষ, সে—সব পথে যাবেন কেন। ছেলেটা আপনার রত্ন। রত্নগর্ভা আপনার স্ত্রী। কোথায় আছে নিশ্চয় জানেন। বলুন বলে ফেলুন।
আমাদের সামনে কোনো আদর্শ নেই। অথচ দেখুন এই দেশেই নেতাজী জন্মলাভ করেছেন। গান্ধীজী বলুন, তিলক বলুন, রামকৃষ্ণ, বিদ্যাসাগর, নেহরু কত নাম করব বলুন, তাঁরা সবাই আমাদের এই ভারতবর্ষে জন্মলাভ করেছেন। শিক্ষা, স্বার্থত্যাগ শিক্ষা, অহং শিক্ষা—কী শিক্ষা না দিয়ে গেছেন তেনারা। কিন্তু হল কী—হল কচু। চোর বাটপার জোচ্চোর। ইতর নেমকহারামে দেশটা ছেয়ে গেল। কী বলেন, ঠিক বলিনি! তা যাক এখন বলুন আপনার সুপুত্রটি গেল কোথায়!
ভুবনবাবুর এক কথা, জানি না।
কিন্তু আপনি না জানলে তো হবে না। এত জানেন আর এটা জানবেন না সে কী করে হয়। বয়স হয়ে গেল, দুদিন বাদে নিমতলা যাবেন, মিথ্যে কথা বললে নরকে জায়গা হবে না, ধর্মাধর্ম জ্ঞানতো অন্যের চেয়ে আপনার কম না! মিথ্যা কথা বললে কত বড় পাপ হয় জানেন, মহাভারতে যুধিষ্ঠির বলে একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন, পড়েছেন নিশ্চয়ই—সামান্য মিথ্যাকথা, অশ্বত্থামা হত নর নহে ইতি গজ, ঠিক মিছা কথাও নয়। একটু ঘুরিয়ে বলা, একটু আস্তে গলা খাকারি দিয়ে বলা, তাতেই কী না নরক দর্শন হয়ে গেল। বলেন এটা ঠিক হল—আমরা কত মিছা কথা বলি আমাদের কী হয়—কচু হয়। মহাভারতেই ও—সব লেখা হতে পারে। তারপরই কী ভেবে বেলাইনে চলে যাচ্ছেন ভেবে অফিসারটি ঘুরিয়ে বলল, না না কী যেন বলেন, মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান। আপনি বড়ই পুণ্যবান মানুষ, বলে ফেলুন, আপনার সাধের বিপ্লবী পুত্রটি কোন নিরুদ্দেশে গেল!
ভুবনবাবুর সেই এক কথা—জানি না।
শুনুন, জানতে হয় কী করে জানিয়ে দিতে পারি। সবই পারি। কিন্তু আমাদেরও বাবা মা ভাই বোন আছে। মনে করবেন না আমরা কলাগাছ ফুঁড়ে বসুন্ধরায় হাজির হয়েছি। সব পারি—আপনি পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি, হাত চালাতে লাগে। সেজন্যই বলছিলাম বলে দিন—ও—সব বিপ্লবে টিপ্লবে বিশ্বাস করবেন না, ও বয়সে আমরাও অনেক বিপ্লব টিপ্লব করার কথা ভেবেছি, মিছিলে ঝান্ডা উড়িয়েছি, তারপর চাকরি হয়ে যাবার পর সাধু পুরুষ হয়ে গেছি। এখন মাগ ছেলে বাদে আর কিছু বুঝি না মশাই। আমার অত রাখঢাক নেই। ডমফাই করতে ভালোবাসি না। দুটো পয়সা কী করে হবে, সেই ধান্ধাতেই থাকি। যা দিনকাল, চোখ বুজলে মাগ ছেলে সব রাস্তায়। আদর্শ ধুয়ে জল খাব? রাশিয়া চীন আমেরিকায় নানা রকমের মগজ ধোলাইর কারখানা আছে, কিন্তু শালা আমাদের দেশিমগজ ধোলাইর মতো মহাকার্যোদ্ধারকারী বটিকা আর একটিও নেই। জয়া বলে একটি প্রেমিকা আছে আপনার পুত্রের সেটা কী জানা আছে?
ভুবনবাবু বললেন, জানি না।
আপনি দেখছি মশাই একেবারে বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি। পার্থিব বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। কিন্তু সব খবরই পুলিশের খাতায় আজকাল লেখা হয়ে থাকে। জয়া মেয়েটিকে এনে দু হাত এক করে দিলেই বিপ্লবের কেতাতে আগুন ধরে যেত। আপনারা এত প্রাজ্ঞ হয়ে কেন যে এটা বোঝেন না। দু তিনমাসের মধ্যে আপনার ছেলেটির অধোগতি হয়েছে। হরিবল। পুলিশ অফিসারটি ধার্মিক পাঁঠার মতো তারপর একটা হাই তুলল। কিছুতেই কাজ হবে না। আস্ত ত্যাঁদোর লোক। জায়গামতো না নিয়ে গেলে হবে না। পুলিশ অফিসারটি টুপি টেনে দরজা খুলে তারপর দুলাফে বের হয়ে গেল।
ভুবনবাবু স্থির চোখে বসে থাকলেন।
নিচে পুলিশ ভ্যানটি গর্জে উঠল।
রমা এবং ভানু ছুটে দেখল, বাবা স্থির নিষ্পলক।
রমা ডাকল, বাবা কী বলল লোকটা?
ভুবনবাবু রমাকে দেখলেন।
কী বলল?
কিছু না।
এতক্ষণ শাসাচ্ছিল, আপনি কিছু বলছেন না! ভানু কেমন বিরক্ত গলায় কথাটা বলল।
কপাল। বলে ভুবনবাবু উঠে পড়লেন।
রমা নীরজা ভুবনবাবুর পেছন পেছন গেল। ভুবনবাবু করিডোর ধরে হেঁটে কোথাও যাবেন যেন।