এই সেই মেয়ে—সামনের বাইকে অরুণ আগেই কী ঠিক দেখেছিল—না ছুটেছে, তার নিজের জনকে অন্য কেউ সহজেই নিয়ে চলে যেতে পারে। অনেকদিন ভেবেছে অরুণকে বলবে, কী হল, বাড়ি গিয়ে কী দেখলে?
কিন্তু বলি বলি করেও বলা হয় না। তা—ছাড়া সেদিন আর অরুণ আগের মতো সহজেই ডেকে নিতে পারত না—কেমন সাধুপুরুষ হয়ে গেছিল। রমার কাছে অরুণ দিনকে দিন দূরের মানুষ হয়ে যাচ্ছিল। মানুষ দূরের হয়ে গেলে সংসারের গোপন কথা আর জানার অধিকার থাকে না। রমার মনে হয়েছিল, সে অরুণের ওপর তার অধিকার হারিয়েছে।
অমলা বলল, আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?
না এমনি। রমা আঁচলে মুখ মুছল। তারপর বলল, আর এক কাপ চা খাও। বাবার সঙ্গে ওরা বোধহয় জমে গেছে।
মেসোমশাই অরুণ বলতে দেখছি অজ্ঞান।
অরুণ এবাড়ির খুবই নিজের মানুষ। ওর উপকারের কথা আমরা ভুলতে পারব না অমলা।
ওতো একটা অকম্মা লোক। ওকে দিয়ে কারও কোনো উপকার হয়!
রমা কী বলতে গিয়ে থেমে গেল। অরুণের ওপর তার কোনো অভিমান নেই। কোনো রাগ নেই, যেটুকু সে অরুণের কাছে পেয়েছে তার স্মৃতিটুকু ভারী অম্লান এবং এখন বুঝতে পারে রমা যত দিন যাচ্ছে, অরুণকে ভিতর থেকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলছে। সে জানে আরও যত দিন যাবে যত গভীরতা বাড়বে। অরুণ যত ওকে পাশ কাটিয়ে যাবে তত অঘটন তীব্রতর হবে। এবং দিন যত যাচ্ছে বুঝতে পারছে এক ভয়ংকর কষ্টের মধ্যে সে পড়ে যাচ্ছে। এই কষ্ট থেকে রেহাই পেতে হলে তাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। একই অফিস বাড়িতে কাজ করা তার পক্ষে ক্রমে অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
অমলা বলল, দাদার বিয়েটা হয়ে গেলেই তোমার লাগিয়ে দেব।
রমা বলল, দিয়ো। এইটুকু বলেই সে সরে পড়ল। একটা গোপন দুঃখ নিয়ে সরে পড়ল। কেন যে সে এভাবে মরতে গেল। প্রথমে খেলার ছলে যা সে নিয়েছিল, এখন বুঝতে পারছে তাই ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড দাপাদাপির সৃষ্টি করেছে। সে ফের বাথরুমে ঢুকে চোখে জলের ঝাপটা দিল। তারপর মাকে বলল, মানদা কোথায়?
মানদা অন্য ঘর থেকে বলল, যাই দিদিমণি।
আর এক কেতলি জল বসাও। আমি যাচ্ছি!
মল্লিকা বলল, তুই ওদের সঙ্গে কথা বল। আমি করছি।
মল্লিকা মাসিকে বলল, আমি করি না? তোমরা সবই করছ।
মল্লিকা তবু বলল, যা তো। বলে প্রায় ঠেলে ঠুলে রান্নাঘর থেকে বের করে দিল রমাকে। আসার পর থেকে মল্লিকা দেখেছে, রমা রান্নাঘরেই আছে। সেই সকাল থেকে—মাছ তরিতরকারি কোটা, মাছ ভাজা, টক, মিষ্টান্ন, ছোলার ডাল সব এক হাতে করেছে। রমা এত কাজের, কী পরিচ্ছন্ন সব কাজ! কেমন লক্ষ্মীশ্রী সব কাজে। নীরজা আজ শুধু বসে বসে হুকুম করছে আর সামনে পানের বাটা নিয়ে বসে আছে।
এবং সবার আগে রমা ছোট ভাইটিকে রান্নাঘরে বসিয়ে খাইয়েছে। কারণ সে জানে ভাইটির অভিমান বড় বেশি। আগে কত আবদার করত, এখন আর কোনো আবদার করে না। মানু অরুণকেও সহ্য করতে পারে না। তাকে ঘৃণা করে। মাঝে মাঝে রমার অসম্ভব জেদ মাথায় চেপে যায়, সংসারের জন্য এত করি, দিনরাত খাটি, বাড়ি এসে এক দণ্ড বিশ্রাম পাই না, আমার এতটুকু সুখ পর্যন্ত তোমরা হরণ করে নিতে চাও! আমি যাব। অরুণ এলেই যাব। কিন্তু আজকাল সে বুঝেছে সে ভুল করেছে। ভাইকে আদর করে আজ সে বসিয়ে রান্নাঘরে খাইয়েছে। মানু যা পছন্দ করে পাতে তা বেশি বেশি করে দিয়েছে। না খেলে বলেছে, এখনও আমার ওপর তোর রাগটা যায়নি!
সেদিনই বেশ রাত করে ফিরল মানু। চোখমুখ গম্ভীর। ভুবনবাবু বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। সবাই বাড়ি ফিরে না আসা পর্যন্ত উদ্বেগের মধ্যে থাকেন। কিন্তু এসেই মানু বলল, সে এক্ষুনি বের হয়ে যাবে আবার। সে বলল, বাবা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যান।
ভুবনবাবু এই প্রথম চিৎকার করে উঠলেন, তুই কোথায় যাবি এত রাতে?
কাজ আছে।
কী কাজ?
চিৎকার রমা নীরজা ভানু সবাই বের হয়ে এসেছে। সারাদিন খাটা খাটানি গেছে। সবাই শুয়ে পড়েছিল। কেবল ভুবনবাবু জেগে। মানু এলে দরজা বন্ধ করে দেবেন। এখন সবাই দেখছে মানু নিজের ঘরে কীসব তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। এবং একটা ব্যাগের মধ্যে সব ভরে নিচ্ছে।
ভুবনবাবু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
নীরজা একটা কথা বলতে পারছে না।
ভানু কাছাকাছি যেতে পর্যন্ত সাহস পাচ্ছে না।
রমা শুধু ঘরে ঢুকে বলল, পাগলামি করিস না। কোথায় যাচ্ছিস। বলে ব্যাগটা টেনে নিতে গেলে কেমন অনেক দূর থেকে ভারী অপরিচিতের গলায় যেন বলল, আঃ কী করছ! সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, কাল সকালে পুলিশ আসতে পারে, আমার খোঁজে। বলবেন কিছুই জানেন না। বলে সে কাউকে আর কথা বলতে না দিয়ে তড় তড় করে নিচে নেমে রাস্তার অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
পঁচিশ
পরদিন পুলিশ এসে তন্ন তন্ন করে খুঁজল বাড়িটা। ওরা এটা ফেলছে, ওটা টেনে নামাচ্ছে, এবং কথায় কথায় শালা বানচুত বলছে ভুবনবাবুকে। শালা বানচুত শব্দটি তাঁর প্রতি কেউ কখনও জীবনে ব্যবহার করেনি। তিনি স্থির ধীর মানুষ। সৎ মানুষ। পুত্রের কল্যাণে পুলিশ যা কিছু মুখে আসে গালাগাল করে গেল তাঁকে। তাঁর পরিবারের কেউ গালাগাল থেকে রেহাই পেল না। মানুকে বেজন্মার বাচ্চা বলল কয়েকবার।
পুলিশ ঘিরে রেখেছে বাড়িটা। দু বার দুটো ব্যাটনের বাড়ি খেল ভানু—বল কোথায় গেছে হারামির বাচ্চা। দেশটাকে জ্বালিয়ে খেল। তারপর পুলিশ অফিসারটি একসময় খুব অমায়িক গলায় ডেকে নিয়ে গেল ভুবনবাবুকে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।