নবীন বলল, নানু মানে, রানুদির ছেলের কথা বলছেন!
ভুবনবাবু বললেন, কেন তুমি ওকে চেন না?
মানে ওকে খুব ছোট দেখেছি।
নানুকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে হয়। একটা ছেলে সংসারের সবকিছুই অবহেলায় ফেলে চলে গেল—সে না জানি কত বড়!
নানুর সম্পর্কে কোনো কথা উঠলেই ভুবনবাবু বুঝতে পারছেন অরুণরা খুব ঠান্ডা মেরে যায়। কিন্তু যা বুঝেছেন তাতে তো নানুকে খুবই পরোপকারী এবং আদর্শবাদী যুবক বলে মনে হয়। তিনি বললেন, বিয়েতে নানুকে আসতে বলো, আমি তার সঙ্গে আলাপ করব। বাবা নেই, মা দূরে থাকে, বড়ই একা।
অরুণ কিঞ্চিৎ অন্যমনস্কভঙ্গিতে বলল, কারও কথা শোনে না। মানুবাবুকে পাঠাব, যদি আসে।
আমার কথা বোলো। নিশ্চয়ই আসবে। ছেলেটা নাকি আমাদের বাড়িতেও এসেছে। কত ছেলেইতো আসত মানুর কাছে—আমি ঠিক এখন মনে করতে পারছি না নানুটা কে!
সবই অহেতুক কথাবার্তা। মন্দাকিনী বারান্দায় আলো জ্বেলে দিল। সব ঘরে এখন আলো জ্বালা হচ্ছে। এই বাসা বাড়িটা যেন মুহূর্তে প্রাণ পেয়ে গেল। অথচ ভুবনবাবুর মনে হয় যতই আলো জ্বালা হোক, বাড়ির চামচিকেটা ঠিক উড়বেই।
সংসারে এই একটা চামচিকে নিয়তই উড়ছে। চামচিকেটা একটা উদ্বেগের মতো, এই উদ্বেগ নিয়ে সব সময় দিন কাটে। বিয়ের পর থেকেই ভুবনবাবুর এটা হয়েছে। এখন মনে হয় শুধু ভুবনবাবুর জীবনে হবে কেন সবার জীবনে চামচিকেটা অন্ধকারে উড়ে বেড়ায়। এবং এজন্যই ভুবনবাবু আসল কথাটা এবার পাড়লেন। বললেন, অরুণ তোমার তো অনেকের সঙ্গে আলাপ, তুমি রমার জন্য একটা ভালো বর দেখে দাও। নবীনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকেও বলছি। তোমরা তো আমার এখন আর পর নও।
রমা সামান্য ঠোঁট বাঁকিয়ে উঠে গেল। ওরা না থাকলে সে হয়তো ভুবনবাবুকেই ধমক দিত। তুমি আর সংসারে মানুষ পেলে না, তুমি অরুণকে আমার বর খুঁজে দিতে বলছ। তুমি তো জান না, ও কত বড় স্বার্থপর। ও বউ বাদে এখন আর কিছু বোঝে না। আচ্ছা, অমলার চেয়ে আমি দেখতে খারাপ! এ—কথা মনে হতেই সে বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে কতদিন পর যেন নিজেকে খুঁটিয়ে দেখল। মনে মনে বলল অরুণ তুমি আমাকে কী ভাব জানি না, তবে মনে রেখো মরে গেলেও আমি বিয়ে করছি না।
এই সংসারে এখন আরও সব ঘটনা ঘটছে। মানুর ঘরে কাকলী বসে একটা সিনেমা ম্যাগাজিন ওলটাচ্ছে। দু বার ভানু এসে বলেছে, কী কাকলী তুমি এত চুপচাপ?
কাকলী সাড়া দেয়নি—সে একটা ফ্যাশান ম্যাগাজিনে ডুবে আছে। ভানু ফের বলল, তোমার মা কোথায়?
কী জানি! খুব তাচ্ছিল্য গলায় ফুটে উঠল। তারপরই বলল, ভানুকা এবার থেকে তো তুমি আমাদের ভুলে যাবে।
যা পাগলি!
আমাদের কথা মনে থাকবে না।
খুব থাকবে।
তোমার তো ভালোবাসার মেয়ে চলেই আসছে।
সংসারে সবাইকে ভালোবাসতে হয়। ভানুবাবু কেমন দার্শনিক অথচ শয়তানের প্রতিভূর মতো কথাটা একটা অবোধ কিশোরীকে শুনিয়ে দিল।
তারপর দরজা দিয়ে বের হতে গিয়ে করিডোরে মন্দাকিনীর সঙ্গে ভানুর গায়ে গা লেগে গেল। মন্দাকিনীকে আইবুড়ো মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। গলায় হার, হাতে দু গাছা সোনার চুড়ি এবং ঠোঁটে খুবই হালকা লিপস্টিক। মন্দাকিনী ফাঁক বুঝে ভানুবাবুর শরীরে একটা চিমটি কেটে দিল। ভানুবাবু বলল, এই কী হচ্ছে!
খুব তো নেবে। চোখে মুখে তো লালা উপছে পড়ছে।
কেমন দেখলে?
কাকে?
কাকে আবার?
ও মিতাকে! ধুস। তোমার পাশে ও কিছু না। অমলা আসছিল, ওরা কথা পালটে নিল। ও ভানুবাবু কাকলীকে দেখেছ?
দেখগে মানুর ঘরে চুপচাপ বসে আছে।
অমলা চোখ তুলে ভানুবাবুকে দেখল। উঁচু লম্বা মানুষ—অরুণের মতোই সুপুরুষ। মিতার সঙ্গে মানাবে খুব। এবং সেই এক দৃশ্য চোখে ভাসে—বিয়ে কেন হয়, কীজন্য এই শুভ কাজ, একজনকে ধরে আনা, অর্থাৎ বড়ই সুসময় চলে যাচ্ছে জীবনে, তাকে অবহেলায় ফেলে রাখতে নেই, জমি উর্বর, শুধু শস্য বুনে দিলে সুজলা সুফলা ধরণি। অমলা ভানুর দিকে চেয়ে এইসব ভেবে সামান্য হাসল। ভানুবাবুও সামান্য হেসে পাশ কাটাতে গেলে দু হাত তুলে দিল অমলা—কোথায় যাচ্ছেন?
কোথাও না।
খুব ভালো করে ঘুমাবেন।
কেন বলুন তো।
চোখে কালি পড়ছে কেন!
অঃ। ও ঠিক হয়ে যাবে।
অমলা তারপর বাথরুমের দিকে চলে গেল। রমা বাথরুমে আছে, অমলা দরজায় শব্দ করতেই রমা বের হয়ে এল। …….ও তুমি। তোমাকেই খুঁজছি।
রমা এই অমলাকে আজ প্রথম দেখল। মানু সেদিন বাড়িতে এসে সব ভেঙে দেবার পর কী কারণে অনেকদিন অরুণ এবং রমা পাশ কাটিয়ে গেছে। কোনো কথা বলেনি দু’জন তারপর বাবার চিঠি অরুণের হাতে দিতেই সম্পর্কটা আবার জোড়া লেগে গেল। চিঠিতে বাবা আশীর্বাদের কথা লিখেছিলেন! এখন আর মানুকে পাঠাতে হয় না। রমাই যা কিছু দরকারি কথা পাত্রীপক্ষকে অরুণের মারফত জানিয়ে দেয়।
অমলা বলল, আমরা এবার যাব।
অমলা সুন্দর লতাপাতা আঁকা সিল্কের শাড়ি পরেছে। পায়ের পাতার ওপর পড়ে আছে সায়ার কারুকাজ করা লেস। মুখটা ডিমের মতো মসৃণ, সামান্য চাপা। হাসলে গালে টোল পড়ে। ডানদিকের গজদাঁত অমলাকে কেমন সোহাগী করে রেখেছে। রমা বলল, যাবেইতো। এত তাড়াতাড়ি কেন। তোমার কর্তাকে কেউ খেয়ে ফেলবে না।
অমলা চোখ টেনে কপালে তুলে বলল। —আমার বড় ভয়, কেউ যদি সত্যি খেয়ে ফেলে! তারপর রমাকে জড়িয়ে ধরে হা হা করে হেসে দিল।