ভুবনবাবু আবার কী বলতে যাচ্ছিলেন, তখন রমা অরুণের দিকে তাকাল অরুণ ভুবনবাবুর দিকে—গোপন বেদনার ঝড় কোথা থেকে যে উঠে আসে কখন কে জানে, রমা হাত বাড়িয়ে বলল, বাবা ধরুন। হাতে ধানদূর্বা দিয়ে বলল, দাদার মাথায় দিন।
ভুবনবাবু কেমন যন্ত্রের মতো হাত তুলে পুত্রের মাথায় দিলেন। সবই হচ্ছে, কিন্তু কেন জানি প্রবল জোর পাচ্ছেন না ভিতর থেকে! সংসারে একটা বড় রকমের ফাটল দেখা দিয়েছে। তখনই সবাই উলু দিল। নীরজা এবং মন্দাকিনীর উলু বেশ তীক্ষ্ন। মল্লিকাও কম যায় না। বড়ই নিষ্প্রভ রমার উলু তার চেয়েও নিষ্প্রভ অমলার।
তখন ভুবনবাবু বললেন, মানু কোথায়?
রমা বলল, আপনার ছোট পুত্রটির কথা আর বলবেন না, একদণ্ড যদি বাড়ি থাকে।
মনে মনে ভুবনবাবু বললেন, ওর দোষ কী। সংসারে সবাই সব টের পায়। তোমরা মনে করো কেউ কিছু বোঝে না। কিন্তু রমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভুবনবাবুর কষ্ট হল! যেন রমা এক গোপন দুঃখ আজকাল লুকিয়ে রাখছে। কত পালটে গেল সব। এক জীবনে তিনি কী না দেখলেন! এক সময় মানুষের সামনে বড় রকমের আদর্শ থাকত। তাদের সময় কত সব শ্রদ্ধেয় মানুষ বেঁচেছিলেন। একবার মনে আছে ভুবনবাবু প্রায় ত্রিশ মাইল রাস্তা ঝড়বৃষ্টিতে হেঁটে গিয়েছিলেন। সঙ্গে একটা চিঠি। তাঁদের স্কুলের অনাদি মাস্টারমশাই চিঠিটা পৌঁছে দিতে বলেছিলেন। তখন স্বদেশি যুগ, গান্ধীজীর স্বরাজ আন্দোলনে কত মানুষ জীবনের সবকিছু অবহেলা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নেতাজীর কংগ্রেস থেকে বের হয়ে আসা, আরও কত উত্তেজক খবর তখন মানুষের জীবনে একটা আলোড়ন তুলত। এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মানু কিংবা সেই ছেলেটা কী যেন নাম, হ্যাঁ নানু একটা ঝি—মেয়ের খোঁজে চলে গেল, তারা এ—ছাড়া আর কী করবে! তিনি বললেন, অরুণ বাইরে এসো। কথা আছে।
অরুণ সেই ঘটনার পর অনেকদিন এ—বাড়িমুখো হয়নি। এই বুড়ো মানুষটাকে মনে মনে সে ভয় পায়। এবং সমীহ করে। কথাবার্তা কম বলেন। খুবই সহিষ্ণু মানুষ। এখন ডেকে নিয়ে কী বলবে কে জানে!
অথচ ওরা যখন পাশাপাশি বসল, তখন ভুবনবাবু অন্য মানুষ। তিনি বললেন, বিয়েতে আমরা কিছুই চাইনি। শাঁখা সিঁদুর দিয়ে বিয়ে দিলেও আপত্তি নেই তুমি জানো। কিন্তু একটা কথা—মিতা এ—বাড়িতে এসে সুখী হবে তো! মানু বড়ই অবুঝ ছেলে। ওকে নিয়েই আমার ভয়।
অরুণ বলল, আপনি কিছু ভাববেন না। আজকালকার ছেলে এ—রকমেরই সবাই। বয়স হলে, চাকরি করলে তারপর বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর কী ভেবে বলল, নবীনদার সঙ্গে আপনার আলাপ হয়নি। ওকে ডাকি।
ভুবনবাবু বললেন, ডাকো।
নবীন এলে অরুণ বলল, এই দাদাটি আমার বোম্বাই থাকে। কাগজে কাজ করে।
কোন কাগজে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া গ্রুপে আছে।
খবরের কাগজের লোকদের সম্পর্কে ভুবনবাবু এক ধরনের শ্রদ্ধা আছে। তিনি বললেন, বসুন। আপনারা খবরের কাগজের লোক কত খবর রাখেন।
নবীন বলল, ওই বাইরে থেকে এমনটা মনে হয়।
ভুবনবাবু কথাটা শুনেও শুনলেন না। তিনি বললেন, কাগজে আজকাল খুব আশার কথা লেখা থাকে।
নবীন বুঝতে পারল না ভুবনবাবু কেন এ—কথা বলছেন।
প্রায়ই দেখি দেশের নেতারা কেবল হোপস দিচ্ছে, বেকার থাকবে না বলছে। কিন্তু দিন দিন যে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।
নবীন বলল, দেশের সম্পদ কম। জনসংখ্যা বেশি। আন্ডার ডেভালাপড কান্ট্রিগুলোর এই একটা বড় বিষফোঁড়া।
মানুষের স্বাধীনতা নিয়ে আজকাল কাগজে খুব লেখা হচ্ছে।
সত্যিকারের স্বাধীনতা এখনও অর্জন করা গেল না।
মহান ব্যক্তিদের মাথা কাটা হচ্ছে। কারা করছে জানেন?
ভুবনবাবু খুবই অসংলগ্ন হয়ে পড়েছিলেন কথাবার্তায়। আসলে একটু আলাপ করা। সত্যবাদী কাগজগুলির একজন এই লোকটা। দেশের লোক ঈশ্বরের পরই খবর কাগজ সত্য ভেবে থাকে। সেই দপ্তরের একটা লোক তাঁর বাড়িতে আজ অতিথি। এটা একটা বড় রকমের অহংকার তাঁর জীবনে। তিনি নবীনের সঙ্গে কী বিষয় নিয়ে কথা বলবেন—ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছেন না। তিনি অগত্যা অরুণের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা সবাই চা মিষ্টি খেয়েছ ত!
অমলা তখন বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রাসবিহারীবাবুর মেয়েদের চেহারায় আভিজাত্য আছে। অমলা কাছে আসতেই বললেন, এসো মা! আমরা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছি।
অমলা হাসল। রমাও তখন উঁকি মারছে। বেশ গম্ভীর গলায় বললেন, জানো তো নবীন আমাদের একজন জাঁদরেল রিপোর্টার। ওর এক কলমের খোঁচায় কত কিছু হতে পারে। তারপর নবীনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের খুব দৌড়ঝাঁপ করতে হয়।
তা করতে হয়।
আচ্ছা কাগজে যে দেখি দেশের গরিবদের নিয়ে সরকারের খুব মাথাব্যথা সেটা কি সত্যি। না লিখতে হয় বলে লেখা। জনমনে সুড়সুড়ি দেওয়া।
নবীন বলল, কাগজ বিক্রি চায়। জনগণ যাতে খুশি তাই লেখা হয়। সরকারও চায় যে—কোনোভাবে ক্ষমতা দখলে রাখা।
অথচ দেখো আমরা সব সত্য ভেবে রোজ সকালে সন্ধ্যাপাঠের মতো কাগজ পাঠ করি।
অভ্যাস।
এই অভ্যাসের কথা আসতেই ভুবনবাবুর মনে হল, সত্যি এটা অভ্যাস। এক সময় ছিল, যখন খবরের কাগজ সম্পর্কে তার কোনো স্পৃহা ছিল না। তখনও দিন চলে যেত। এখন খবরের কাগজ না পেলে দিনটা বড়ই ফাঁকা ঠেকে। কোথায় কী ঘটছে জানার জন্য বড়ই উদগ্রীব তিনি। ভুবনবাবু এবার নবীনের দিতে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের নানুও একটা খবর হতে পারত।