তখনই রমা খুট করে দরজা খুলে ফেলল। প্রায় আবির্ভাবের মতো লাগছিল। এমন উঁচু লম্বা মেয়ে সে কমই দেখেছে। চুল ঘন, মিহি চুলে তোয়ালে জড়ানো। হাতে ভেজা সায়া, শাড়ি, ব্লাউজ। বাসি কাপড় ধুয়ে একেবারে পরিচ্ছন্ন রমা। ভেতরের রক্তপ্রবাহ কেমন মাতাল সমুদ্রের মতো ওকে ধাক্কা মারে। এত উষ্ণতা জীবনে থাকে কেন! তার নিজের কিছু আছে, উলটে পালটে দেখতে দেখতে বছর দু’বছর না ঘুরতেই জীর্ণ বাসের মতো হয়ে যায় কেন! প্রকৃতির কোন কুটবুদ্ধি শরীরে তার খেলে বেড়ায়। কতবার মনে হয়েছে এটা ঠিক না। গোপনে সে একটা ভারি পাপ কাজে লিপ্ত হবার জন্য উন্মুখ। অথচ এই মেয়েটা তাকে নিয়ে বেশ খেলাচ্ছে। কোথাও যখন গভীরে ডুবে যেতে ইচ্ছে হয়, রমার বালিকার মতো দুঃখী মুখ। তখন সে আর গভীরে নেমে যেতে পারে না। চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়, রমা প্লিজ। রমা মরে যাব।
রমা তখন পাশ কাটিয়ে বারান্দায় শাড়ি মেলতে যাচ্ছে। পালিয়ে পালিয়ে কিছুটা দেখছিল। খুব অবহেলা ভরে। চোখে বিন্দুমাত্র লোলুপতা ছিল না। আবার মানু অজস্র কথা বলে যাচ্ছে। সে হুঁ—হা করছে। সিগারেট টানছে। রমার সঙ্গে গোপনে যে কিছু কথাবার্তা হয়ে গেল মানু হয়তো টেরই পেল না। এই বাড়ি, ঘরদোর, আসবাবপত্র সবই ওর কাছে বড় মহার্ঘ হয়ে যায় রমার জন্যে। সে কেমন দীনহীনের মতো কেবল সব কিছু তাকিয়ে দেখে।
রমা নিজের মনেই বলল তখন, এই তুমি পালিয়ে পালিয়ে এত কী দেখছ! চোর কোথাকার! কী ভেজা বেড়ালের মতো বসে আছে দ্যাখ। কিছু যেন খুঁটে খেতে জানে না বাবু। রমা বারান্দা থেকে বলল, কী অরুণদা মানুর সঙ্গে বেশ জমে গেছ। আমরা যে বাড়িতে আছি দেখে তা মনে হয় না।
আরে না না। তুমি যাবে তো?
কোথায়!
বা রে বললাম না, জীবনবাবুর ছেলের অন্নপ্রাশন।
না গেলেই নয়?
দ্যাখ ভেবে। যাও তো সঙ্গে নিতে পারি।
না গেলে ভারি খারাপ দেখাবে?
অরুণ এসেই কত সব জীবনবাবুর বিয়ে, অন্নপ্রাশন, বউভাত, পিকনিকের কথাবার্তা বলে যে সুখ পায়। আগে এটা সত্যি বিয়ে অন্নপ্রাশন ছিল। পরে কিছুদিন যেতে না যেতেই দাদার মনে সংশয়, তারপর কিছুদিন সে এ—বাড়িতে আসতই না। দাদাই খবর দিয়ে ফের আনিয়েছে। ওদের ভুবনেশ্বরে সেলস এম্পোরিয়ামে একটা পোস্ট খালি আছে। যদি অরুণ চেষ্টা চরিত্র করে মানুকে ঢুকিয়ে দিতে পারে। সংসারে অরুণই একমাত্র ভরসা।
রমা নিজের ঘরে ঢুকে গেছে তখন। গলায় ঢুকে পাউডার ঢেলে দিচ্ছে। গলা বাড়িয়ে একবার মাকে বলল, অরুণদাকে চা দাও, মা।
ও—ঘর থেকে অরুণ বলল, কিচ্ছু না।
মা বলল, তুই ফিরবি কখন?
ফিরতে রাত হবে।
মা আর কিছু আজকাল বলতে সাহস পায় না। বসার ঘরে বাবা একা। বয়স বাড়লে মানুষেরা খুব নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। বাবা একদিন বলেছিলেন, এবারে বল আর কতদিন ঝুলিয়ে রাখবে।
রমা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেছিল। বলেছিল, বললে কী হবে!
বললে কী হয় তোমরা জানো না।
চাকরিটা তবে থাকবে না।
যেন বাবার মনে পড়ে যায় সত্যি, তবে চাকরি থাকবে না। মেয়েটা তার উঁচু লম্বা বলেই এমন একটা দামি চাকরি পেয়ে গেল। শ্যামলা রং। চোখ বড় চিবুক সামান্য চাপা। তবু রমার মুখে এক ধরনের কোমল ব্যক্তিত্ব আছে, সে যে—কোনো মানুষের পক্ষে লোভনীয়। রমা নিজের টাকায় একাই বাড়ির আজকাল সব প্রাচুর্য রক্ষা করতে পারে। আসলে চাকরির শর্তটা এই রকমের। আসলে যারাই আসবে সেই বিরাট অফিস বাড়িটাকে, যেখানে রমা কাচের ঘরে বসে থাকে, সবার সঙ্গে সামান্য হেসে কথা বললে লোকগুলির মনের ভেতর এক সুন্দর জগৎ তৈরি হয়ে যায়, জটিল সব লেন—দেন অফিসের দোরগোড়ায় এসেই সহজ সরল হয়ে যায়। আসলে মেয়েটা তার গৌরব। অফিসবাড়ির অনেক কূটতর্ক ওর হাসিতে জলের দামে বিকোয়।
এ—সব কারণেই তিনি দ্বিধা এবং সংশয়ে ভুগছেন। কিছু স্থির করতে পারছেন না। বরং নিবেদিত যৌবন রমার—এমনই তিনি ভাবেন। তিনি মাঝে মাঝে ভাবেন, তারপর কী হবে!
তারপর কী হবে কেউ জানে না।
অরুণ নিজেও জানে না তারপর কী হবে।
আর রমাও বসে থাকে না তারপর কী হবে ভেবে। সে বরং অরুণ আছে বলেই তার সঙ্গে কিছুটা তারপর কী আছে জীবনে বুঝতে পারে। আর অফিস বস যেহেতু অরুণের আপন মামা, কেউ আর রমাকে ঘাঁটাতে চায় না। বরং অরুণ হাতে ধরে নিয়ে এসেছিল বলে, অরুণের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখে ফেললে, কেউ চটে যেতে পারে না। অরুণের কোনো আত্মীয় হবে। একবার তো জীবনবাবুই দেখেছিল, স্কুটারে একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলজ্বল করছে। যে—কোনো সময় দাউ দাউ করে অগ্নিকাণ্ড ঘটে যেতে পারে, কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করতে সাহস পাননি। অরুণবাবুর স্ত্রী যখন যুবতী এবং লাবণ্যময়ী, স্ত্রীর চোখেই দৃশ্যটা পড়বে একদিন। তখন যা হবার হবে। মজা দেখার মতো অন্তত জীবনবাবুর এই জীবনে একটা ঘটনা ঘটে যাবে। সেই আশাতেই তিনি লেজারে কেবল যোগ করে যাচ্ছেন। বিয়োগ করছেন না।
তিন
বিকেল মরে আসছে। গাছপালা থেকে রোদ ক্রমে সরে যাচ্ছিল। পার্কের বড় পুকুরে একদল মানুষ ডুবছে ভাসছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বুড়ো মানুষের জটলা। তারা সবাই মুখোমুখি বসে। কী কথা বলছে নানু শুনতে পাচ্ছে না। সে বলেছিল একটা বেঞ্চিতে। মাথায় কাকেরা উড়ছে। শিরিষের লম্বা একটা ডাল নেমে এসেছে তার মাথার ওপর। ও—পাশটায় কিছু ছেলের পায়ে একটা লাল বল। এবং যেখানে যেমন সুবিধা জোড়ায় জোড়ায় যুবক যুবতী। তার মনে হল বাবা মাকে নিয়ে বিশ বছর আগে এমনি কোনো নিরিবিলি জায়গায় বসত। তারপর তাদের বিয়ে হয়েছিল। স্মৃতির মধ্যে ডুবে গেলে, সে সব দেখতে পায়। জীবনের প্রথম কোনো স্মৃতি তার পেছনে, আরও পেছনে যেতে যেতে মনে হয় তার, সে সেই যখন মাতৃজঠরে অথবা তারও আগে শরীরের রক্ত কণিকার সামান্য ডি এন এ—তার আরও আগে যখন অপার্থিব কিছু মনের মধ্যে পাখা বিস্তার করতে থাকে, তখন তার মনে হয় সে সূদুর অতীতে চলে গেছে। সেখানে একজন বুড়ো মানুষ চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, হাত ধরে আছে এক ছোট্ট শিশু—সাদা কেডস জুতো পায় লাফিয়ে লাফিয়ে এটা কী ওটা কী বলছে। এমন কেন মনে হয়, কিংবা কোনো গাছপালা মাঠ পার হয়ে তার নীল কুটির—পাশে একটা বড় দীঘি তাতে অজস্র পদ্মফুল ফুটে আছে। কিছু পদ্মফুল আর এক যুবতীকে সে দেখতে পায়—স্নান করায় শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছবির মতো স্পষ্ট। আকাশটা সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে আছে।