নবনীতা লজ্জা পেল। কিছু বলল না।
এই বয়সে আমরা এত সাজতে জানতাম না। তোমাকে আদর করলে রাগ করবে নবনীতা!
সে কপট রাগ দেখিয়ে বলল, যান আমাকে কেন, কাকলীকে করতে পারেন না!
প্রিয়নাথ হাসল। বলল, ওকে তো সব সময় করি—তোমাকে করলে কেমন না জানি লাগবে।
নবনীতার চোখমুখ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল।
তখন এই শহরে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। বাসে ট্রামে অফিস ফেরত মানুষেরা গাদাগাদি করে ফিরছে। ভাবতেই পারবে না একজন উঠতি যুবতী একজন প্রৌঢ় মানুষের সামনে এমনভাবে মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। চোখমুখ লালচে। নবনীতার বুক ঢিপ ঢিপ করছিল। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হতে পারে। সে বলল, না যাই। কাকলী এলে কিন্তু বলবেন, ওকে আমার খুব দরকার।
প্রিয়নাথ তখন হা হা করে হেসে উঠল। এবং তুই তুকারি আরম্ভ করে দিল কথাবার্তায়। বলল, তুই কী রে! আমাকে দাদু ডাকিস, আদর করলে তোর কী ক্ষতিটা হবে! এই বলে কাপে চা ঢালল। তারপর বলল, নে না। এই নে বলে সে ক্রিম ক্রেকার বিস্কুট, ফ্রিজ থেকে দুটো সন্দেশ দিল বের করে।
নবনীতা কেমন বোবার মতো হাতে তুলে নিল সব। বুড়ো মানুষটা আসলে তাকে নিয়ে মজা করছে। সে সব সত্যি ভেবে সামান্য আহাম্মকের কাজ করেছে। খুব কাচুমাচু গলায় বলল, আপনি কিন্তু কাকলীকে কিছু বলবেন না।
বললে কী হবে?
না বলবেন না।
কেন দোষের কী আছে। আমি তো তোকে নিয়ে বিছানায় শুইনি!
ভারী অসভ্য আপনি।
প্রিয়নাথ তার গাল টিপে বলল, সব বুঝিস তা হলে!
নবনীতার হাত পা কাঁপছিল। কত তাড়াতাড়ি চা খাওয়া যায় যেন তার পাল্লা দিচ্ছে। তারপর প্লেট মেঝেতে রেখে সে প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকল।
প্রিয়নাথ বলল, এই তুই চলে গেলে সব বলে দেব। বলব, তুই আমাকে ভালোবাসিস। তুই আমার বউ। বেশ জমবে।
নবনীতার কেমন দ্রুত শ্বাস ওঠানামা করছিল। বুড়ো মানুষটা কী সত্যি কিছু করতে চায়—না মজা—না পাগল, তাও সে বুঝল না। সে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকল। তার কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। মাথাটা কেমন তার ঘুরছে।
চব্বিশ
নীরজা বলল, ওগো এসো, ঘরে এসো।
বারান্দায় ভুবনবাবু এক কোণে একটা নীল রঙের বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসেছিলেন। সামনের রাস্তায় একটা ভিখারি হেঁটে যাচ্ছে। পর পর দুটো বাস পাল্লা দিচ্ছে। একটা আর একটাকে পেছনে ফেলে ছুটতে চাইছে। রাস্তার ওপাশে মাঠ এবং নতুন ঘরবাড়ি উঠছে। তিনি ঘরের ভেতরে খুব কোলাহল শুনতে পাচ্ছেন। বারান্দায় ছোট ছোট কাচ্চা—বাচ্চারা দাপাদাপি করছে, রেলিং—এ ঝুঁকছে এবং ভিতরে কেউ হাসছে জোরে, কিছু যেন হাত থেকে পড়ে গেল—নীরজা এইমাত্র ডেকে গেল। আবার কেউ ডাকতে আসবে। রমা অথবা মন্দাকিনী। অরুণ এবং অমলা—আজও আসতে পারে। ছোট শ্যালিকা মল্লিকা এসেছে। অনেকদিন পরে ভানুর আশীর্বাদ উপলক্ষে রমাই নিয়ে এসেছে। আরও অন্যান্য আত্মীয়। এবং ভুবনবাবু মনে হয় সবাই কেমন বড় দূরে সরে গেল। দাদা বউদি ভাইয়েরা এবং ভাইপোরা। ভুবনবাবুর এক বিরাট আত্মীয়স্বজনের সংসার ছিল, আজকের আশীর্বাদে সামান্য ক’জন মানুষের উপস্থিতি তাকে কেমন ভিতরে ভিতরে পীড়া দিচ্ছে।
ওদিকে বারান্দায় বেশ হাসি ঠাট্টা হচ্ছিল। মন্দাকিনীর গলা স্পষ্ট। বেশ জোরে কথা বলতে পারে। এবং আশ্চর্য ভঙ্গি মেয়েটার। ওর স্বামীর মৃত্যু সেদিন হয়েছে। আচ্ছা, মানুষ কী শোক দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াতে পারে! বয়ে বেড়ানোটা স্বাভাবিক, না সেখানে জীবনের লক্ষণ আছে। এত সহজে যে শোক মন্দাকিনী ভুলতে পেরেছে ওটাতো জীবনেরই লক্ষণ। কিন্তু তিনি মন্দাকিনীর উচ্চস্বরে কথাবার্তার মধ্যে খুঁত ধরতে যাচ্ছেন কেন! আসলে কী মন্দাকিনী এবং ভানুর মধ্যে একটা সংশয়ের ব্যাপার ছিল বলে! আজতো আশীর্বাদের দিন। এ—দিনে এসব কথা মনে আসছে কেন! মন্দাকিনী এ—বাড়িতে আশীর্বাদের সময় থাকবে সেটা পছন্দ ছিল না বলে! মনে মনে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত বারান্দার নিরিবিলি জায়গা কী তাই বেছে নিয়েছেন!
রমা ডাকল, বাবা আসুন!
ভুবনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। রমা কী আগেই জানত অরুণের বউ আছে! সে জেনেই কী মিশত? তখনই অমলা দরজায়—আসুন মেসোমশাই। সব মুখগুলি কত পবিত্র দেখতে এখন! কে বলবে এরাই কখনও কী যে ভয়াবহ হয়ে যায়। আচ্ছা, তিনি ভয়াবহ কথাটা ভাবছেন কেন! মানুষের যে স্বভাবই এই। সে ধার্মিক, লম্পট, সে সরলমতি কখনও কুটিল মতি। সে লোভী আবার উদাসীন!
এজন্য কখনও স্বার্থপর দৈত্য এবং কখনও বিদ্যাসাগরমশাই। তিনি ভিতরে ঢুকে অরুণকে বললেন, নানুর খোঁজে কেউ তোমরা গেছিলে?
অরুণ এরকম কথা এই সময় প্রত্যাশা করেনি। সে বলল, না, মানে…..অরুণ কেমন সত্য গোপন করতে চাইছে।
তোমরা ওর খোঁজখবর নিচ্ছ না, বাবা নেই ছেলেটার!
অরুণ কাঁচুমাচু গলায় বলল, যাব ভাবছি।
কোথায় যেন গেছে!
মানু তো কিছু বলে না। মানু এখন দেখছি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। দেখা কোথায় হয় যে তার কাছ থেকে নানুর খবর নেব। সারাদিন কোথায় কী করে বেড়ায় তাও জানি না। নানুর মা বিয়েতে আসবে তো?
আসার কথা আছে। তবে সরকারি কাজ ছুটিছাটা নিয়ে নানা ঝামেলা। নানুর মা আমাদের বিয়েতে আসতে পারেনি।
অমলা এক কোণায় দাঁড়িয়ে জানালায় মুখ রেখেছে। ওর মুখ স্পষ্ট নয়। অমলাদের বাড়ি থেকে ওর জামাইবাবু এবং অরুণ এসেছে আশীর্বাদ করতে। আশীর্বাদের কাজ প্রায় শেষ—ভানু বড় আসনে বসে আছে শুধু বাবার জন্য। বাবা মাথায় সামান্য ধানদূর্বা দিলেই তার ছুটি। সে উঠব উঠব করছিল—কিন্তু এতক্ষণ অমলা এবং অরুণই জোর করে বসিয়ে রেখেছে।