একদিন মনে হয়েছিল, বাবাকে বলবে সব, পরে ভেবে দেখেছে বাবা শুনলে কী ভাববে। নবনীতা জানে এদের থেকে ভয়ের কিছু নেই। সে একবার ভাবল, কাছে গিয়ে বলবে, এই আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে? এই একটু বেড়াব। তখন কী হবে নবনীতার তাও জানা। সবাই এত ভালো ছেলে হয়ে যাবে যে কে আগে প্রাণ করিবে দান গোছের হয়ে যাবে। তার ইজ্জত রক্ষার্থে ওরা তখন হেলায় জীবন দান করতে পারে। এসব মনে হয় বলেই নবনীতা কিছু মনে করে না। অশ্লীল কথাবার্তা নতুন শিখলে যা হয়। এবং সে যে খুব একটা কড়াশাসনে রয়েছে, সেও জেনে ফেলেছে ওদের সব কথার অর্থ কী। আসলে একটাই অর্থ, আমরা বড় হচ্ছি, তোমরা বড় হচ্ছ, আর অপেক্ষায় থাকতে পারছি না।
নবনীতা কেমন স্বগতোক্তি করল, সে তো আমারও। সে এবারও আরও দূরে এসে বুঝল ওদের আর দেখা যাচ্ছে না। এদের মুখগুলি তার চেনা। চুল বেশ লম্বা করে ঘাড় পর্যন্ত ছেঁটে দেওয়া। একটা কালোটুপি ঘাড় পর্যন্ত বসিয়ে দিলে যা হয়—এরা সুচলো দাড়ি রেখেছে সিনেমা হিরোদের মতো, চুল কাটে সিনেমা হিরোদের মতো। সবকিছুই ভাবে সিনেমা হিরোদের মতো। স্বপ্নও দেখে সিনেমা হিরোইনের। নবনীতার তাই শখ সে একদিন বড় হিরোইন হয়ে যাবে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে তার এটা বেশি করে মনে হয়। অবশ্য এখন নানুদার মতো একজন যুবক তার পাশে থাকলে ভালো হয়। খুশিমতো খাওয়া গেলেই হল—জীবনের আর কী দরকার এ—সময় আর সে কিছু মনে করতে পারে না।
নবনীতা দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ল খুট খুট করে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। ওপরে জানালা খোলা। কেউ বাড়ি না থাকলে জানালা বন্ধ থাকত। কাকলী বাড়ি থাকলে এতক্ষণ দৌড়ে নেমে আসত। সে কড়া নেড়ে আবার ডাকল কাকলী।
তখন বুড়ো মতো মানুষটার গলার শব্দ পাওয়া গেল। কাকলীর দাদু সিঁড়িতে কে কে করে নেমে আসছে।
আমি নবনীতা দাদু।
আরে নবনীতা। প্রিয়নাথ ভারী প্রসন্ন গলায় কথাটা বলল। এসো এসো।
কাকলী বাড়ি নেই?
ওরা গেছে ভুবনের বাড়িতে।
নবনীতা বলল, তা হলে যাই। কাকলীকে বলবেন, আমি এসেছিলাম।
এসো না। ওরা এক্ষুনি চলে আসবে।
নবনীতা ইতস্তত করছিল। বুড়ো মানুষদের তার কেন জানি কখনও ভালোমানুষ মনে হয় না। কাকলীর দাদু খুব শক্ত সমর্থ মানুষ। চুল এখনও কালো রেখেছে। চুল কালো না কলপ মাখে বুড়োটা। সে বলল, কাকলীর আসতে খুব দেরি হবে নাতো?
না না। এল বলে।
নবনীতা দরজার ভিতরে ঢুকে গেল। বাড়িতে আর কেউ নেই কিনা সে এখনও জানে না। মাসিমা থাকবে না কারণ কাকলীর দাদু, ওরা তা হলে বলত না। রান্নার মেয়েটা যদি থাকে। সে ভেবেছিল কাকলীকে নিয়ে সে বেড়াতে বের হবে। কিন্তু কাকলী নেই। সে আবার কী ভেবে বলল, থাক আজ দাদু, কাল আসব।
প্রিয়নাথ লম্বা পাজামা পাঞ্জাবি পরেছে। বেশ দীর্ঘকায় মানুষ। সিঁড়িতে আরও লম্বা হয়ে গেল যেন কথাটা শুনে! —ভয় কী এসো না।
না না ভয় নয়। আমি বলছিলাম কী….। কাকলীর সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
প্রিয়নাথ বলল, বোস, ওরা চলে আসবে।
নবনীতা কী করবে বুঝতে পারছে না। সে যে খুব আর বালিকা নেই, সে যে ইচ্ছে করলেই দাদুর ঠাট্টা তামাসার মধ্যে আগের মতো মজা পায় না সেটা বোঝায় কী করে! তবু শালীনতা বোধ ওর খুব তীব্র। খুবই খারাপ দেখায় না গেলে। সে উঠে প্রিয়নাথের ঘরে বালিকার মতো মুখ করে ঢুকে গেল। এবং বেশ দূরত্ব রেখে সে একটা চেয়ারে বসল।
আর এই ঘরটাতে এলেই সে একজন বুড়ো মানুষের গন্ধ পায়। প্রিয়নাথ না থাকলেও সে টের পেত এ—ঘরে একটা বুড়ো মানুষ থাকে। কিন্তু এখন সে এই গন্ধটা পাচ্ছে না কেন! সে দেখল প্রিয়নাথ জানালার পর্দা সরিয়ে দিচ্ছে। দরজার পর্দা সরিয়ে দিচ্ছে। দরজার পর্দা সরিয়ে দিতে দিতে বলল তোমার বাবা কেমন আছেন?
ভালো।
একদিন মাকে নিয়ে বেড়াতে এসো।
আসব।
আসলে দুই প্রজন্মের ফারাক এত বেশি যে—কোনো কথা খুঁজে পাওয়া ভার। প্রিয়নাথ বারবারই নবনীতার সুন্দর পোশাক লক্ষ্য করছে। তাদের সময়ে মেয়েরা এত সুন্দর করে সাজতে জানত না। তার ভারি আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছিল নবনীতাকে। কিন্তু ওই যে বয়েস, মনে হচ্ছে বড় তাড়াতাড়ি জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই বয়েসও কেন আকাঙ্ক্ষার এত বেশি চাড় ভেবে পায় না।
নবনীতারই বা ভালো লাগবে কেন! সে উসখুস করছিল। দু—বার উঠে গিয়ে রাস্তায় উঁকি দিয়েছে। অথবা নিচের সিঁড়িতে যদি পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুই না। কাকলীর দাদু ঘরের মধ্যে কৌটা খুলে কী খুঁজছে। দুটো বোতলের ছিপি খুলে ফেলল। এবং সে যে এ—ঘরে আছে তা যেন খেয়াল নেই তার।
তখন বাধ্য হয়ে নবনীতা বলল, আমি যাই দাদু।
আরে না না। চা করছি। চা খাও। ততক্ষণে ওরা এসে যাবে।
নবনীতা কী বলবে বুঝতে পারল না। না, বলতে পারত, কিন্তু চায়ের প্রতি ওর একটা আজন্ম প্রলোভন আছে। সে বলল, কেউ তো নেই।
তাতে কী হয়েছে। আমি কী খুব বুড়ো মানুষ ভাব! মনে হল প্রিয়নাথ এবার সত্যি যুবক হয়ে যাবে। সে প্রায় একজন যুবকের মতোই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবং রান্নার গ্যাস জ্বেলে জল চাপাল।
নবনীতার এটা খারাপ লাগছিল। সে বলল, আমি করছি। আপনি এ—সময় বুঝি চা খান?
ওই অভ্যাস। তবে সবই তো ছেড়ে দিয়েছি। এটা এখনও আছে। তুমি করবে! আহা আমার কী সৌভাগ্য। এসো না ভিতরে। তুমি তো আমার নাতিন। এত সুন্দর করে সাজো কেন?