আরতি এ—ঘরে এলে নবনীতা জলটা খেয়ে কী করবে বুঝতে পারল না। সন্ধ্যায় সংস্কৃতের মাস্টারমশাই আজ আসবেন। কিছু টাস্ক করা বাকি। এগুলো করে রাখা দরকার ছিল। কিন্তু কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। শরীরে আজকাল যে কী হয়! নানুদার কথা ভাবলেই মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। নানুদা বড় নিষ্ঠুর তুমি। তোমাকে এত ভালো লাগে, তুমি তা টের পাও না কেন।
সে উঠে এবার দেরাজের কাছে গেল। সেখানে একটা বড় অ্যালবামে নতুন ফোটো। ফোটোগুলি সে দেখবে বলে অ্যালবামটা টেনে বের করল। দাদারা কত রকমের ছবি তুলেছে তার। একটা গাছের নিচে বসে আছে সেই ছবি, দৌড়াচ্ছে সেই ছবি—সুন্দর সুন্দর সব ফ্রিজ সট। কখনও বাতাসে চুল উড়ছে, কখনও চোখ উদাস, কখনও নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে। এতসব ছবি তার নিজের। সে প্রায় দেখতে নায়িকার মতো। সিনেমায় সে যদি একটা চান্স পেত। তাঁর চোখ মুখ যে—কোনো উঠতি নায়িকার চেয়ে সুন্দর, সে উঁচু লম্বা। একবার কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিল—নায়িকা চায়। তার ইচ্ছে একটা ছবি গোপনে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু ওর ওই একটা আলস্য আছে—হবে হবে করে শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠে না।
নানুদাকে প্রথম দিন দেখেই ভেবেছিল বাঃ বড় সুন্দর হয়েছে দেখতে নানুদা। যুবক সন্ন্যাসীর মতো দেখতে। রেশমের মতো দাড়ি গোঁফ গালে। হাত দিয়ে ইচ্ছে হয়েছিল দেখতে কত নরম—কোনো উলের বলের মতো কিনা—আর এসব ভাবলেই মাথাটা ঝিম ঝিম করে—সে তার মনের কথাটা কিছুতেই দুম করে বলে ফেলতে পারেনি। আবার দেখা হলে বলবে, নানুদা তুমি আমাকে ভালোবাসবে? আমি তোমার যা ভালো লাগবে তাই করব। কিন্তু সে মানুষটার পাত্তা নেই।
তখনই সে কী ভেবে তার সবচেয়ে সুন্দর ম্যাকসি বের করে ফেলল। গলায় মুখে পাউডার বুলাল। কপালে সুন্দর করে লাল টিপ পরল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকল—এমন শরীর নিয়ে তার এখন কান্না পায়। তার কিছুই ভালো লাগে না কেন! পড়াশোনা ভালো লাগে না। এখন শুধু বেড়াতে ভালো লাগে। সে চিৎকার করে বলল, আরতি মাসি আমি কাকলীদের বাড়ি যাচ্ছি।
আরতি বলল, কাকলীদের বাড়িতে এখন কী করতে যাবে!
কাজ আছে।
কী কাজ বলবে তো! দিদি এলে কী বলব!
দিদি আসার আগেই ফিরে আসব।
আমি কিছু জানি না!
ভারি ঝামেলা দেখছি—পড়া দেখে আসব, তাও তোমাদের জ্বালায় জানতে পারব না।
পড়ার কথায় আরতি আর কিছু বলতে পারল না। দাদামণি মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই আলগা। এই একটা বিষয়ে আরতির মাতব্বরি নবনীতার ওপর খাটে না। যেতে না দিলেই দাদামণি এলে নালিশ করবে—আমি কী করব, আরতি মাসি যেতে না দিলে আমি কী করব। তখন দাদামণির দুটো একটা ধমক খেতেও হতে পারে। আরতি অগত্যা বলল, যাও। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে। দিনকাল ভালো না—যেখানে সেখানে খুন টুন হচ্ছে।
আজকাল পত্রিকার খুব খুনের খবর ফলাও করে বের হচ্ছে। ক’দিনের মধ্যে চেতলার কাছে একটা সতেরো বছরের মেয়ে খুন হয়েছে, শোভাবাজারের কাছে একটি তেরো চোদ্দো বছরের মেয়েকে কারা তুলে নিয়ে গেছে। কিশোরী মেয়েদের কারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে—আন্ত—রাজ্য মেয়ে চালানকারীদের উপদ্রব বাড়ছে এমনই সব খবর পত্রিকায় আজকাল লেখা থাকে। পত্রিকা পড়লে নবনীতার গা—টা শির শির করে। সে বলল, যাব আর আসব।
আসলে নবনীতা এখন বের হতে চায়। চারপাশে কেবল আনন্দ উজাড় করে দিচ্ছে প্রকৃতি। ঠান্ডা বাতাস বইছে। পার্কের কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া গাছগুলিতে ফুলের সমারোহ। সেজেগুজে সব মানুষেরা যেন কোথায় যাবে বের হয়ে পড়ছে! এ—সময়ে একা ঘরে থাকতে কার মন চায়! এবং বিকেল বেলাটার যেন কী মোহ আছে—তাকে সবসময় ঘর থেকে বের করে নিতে চায়। একটু পার্কে ঘুরে বেড়ানো, কিংবা রাস্তায় যেতে যেতে সুন্দর যুবকদের দিকে দূর থেকে সামান্য চোখ তুলে তাকানোর মধ্যে আছে আশ্চর্য এক মনোহারিণী জীবন। সে কাকলীর বাড়িতে যাবার পথে এসবই দেখবে। কাকলী যদি ওর সঙ্গে একটু বেড়াতে বের হয়, ওর ইচ্ছে, সে কাকলীকে নিয়ে একদিন যাবে মানুদের বাড়িতে। কারণ একা যাওয়া ঠিক হবে না। কোনো মেয়েই কোনো যুবকের বাড়িতে একা যেতে বোধহয় পছন্দ করে না। সে আজ ভারি সেজেগুজে বের হয়েছে। খোঁপায় গুঁজেছে গোলাপ ফুল। রানি ক্লিয়োপেট্রার জীবন নিয়ে একটা ছবি সে দেখেছিল। নিজেকে সে আজ ক্লিয়োপেট্রার মতো দুর্ধর্ষ করে তুলেছে।
রাস্তায় নেমেই সে বুঝতে পারল সারা পৃথিবী এ—মুহূর্তে তাকে উঁচু হয়ে দেখছে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ভয়ংকর লোভী দৃষ্টি তার শরীরটার প্রতি। এমনকি পার্কের বুড়ো লোকগুলিও বাদ গেল না। ভারী দৃপ্ত এবং অহংকারী হয়ে উঠছে তার শরীর। সে সোজা হেঁটে যাচ্ছে। কোনোদিকে দেখছে না মতো সে হাঁটছে। আসলে সে সবই দেখছে। গ্রীষ্মের রোদ্দুর মেঘমালায় ছেয়ে যাচ্ছে বলে পার্কের চারপাশে সবুজ সমারোহ। বাতাসে কোনো ধূলিকণা উড়ছে না। নির্মল পৃথিবীতে সে এখন যুবতী নারী। মন এ—সময়টাতেও এত চঞ্চল হয়ে ওঠে যে কোনটা সে চায় কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
ক্লিনিক হাউজের রোয়াকে সেই বকাটে ছোকরারা আজও তাকে দেখে শিস দিল। এবং অশ্লীল দুটো একটা কথাবার্তা—যেন এদের মা বোন নেই—এবং আর যা মনে হয়, এরা তো তাকে ভালোবাসতেও পারে। ভালোবাসার জিনিস দূরের মনে হলেই ক্ষেপে যায় যুবকেরা। ঠিক নানুদার মতো এরা তাকে আর ভাবতে পারে না।