অপর প্রান্ত থেকে এক জবাব, জানি না।
কিন্তু আমার যে নানুদাকে খুব দরকার ছিল। ওকে বললেন আমি ফোন করেছিলাম। বলবেন কিন্তু। আমার নাম নবনীতা। ওর বাবার বন্ধুর মেয়ে আমি। আমার বাবার নাম….
ততক্ষণে ফোন ছেড়ে দিয়েছে। সে বাধ্য হয়ে আজ বাবার নামও বলল। কারণ সে যে বাজে মেয়ে নয়, সে খুব ভালো মেয়ে—বাবার নাম বলতেও যার কুণ্ঠা নেই কোনো, সে কেন নানুদা কোথায় জানতে পারবে না।
নবনীতা চুপচাপ রিসিভারটা হাতে নিয়ে বসে থাকল। বড় নিষ্ঠুর নানুদার আত্মীয়স্বজন। সে তো নানুদাকে খেয়ে ফেলবে না। বরং বাড়িতে ভয় নানুদাই তাকে খেয়ে ফেলবে। আসলে নানুদার চোখে এক আশ্চর্য মায়ার খেলা আছে। মানুষের বাবা আত্মহত্যা করলে বোধহয় এমনই চোখমুখ হয়ে যায়। কেমন চোখের মধ্যে এক অতল গভীরতা। নবনীতা সব ভুলতে পারে—কিন্তু নানুদার চোখের অতল গভীরতার কথা ভুলতে পারে না। নানুদা ঠিকই বলেছিল, অনেক দাদা জুটে গেল তোমার নবনীতা। তবে আর ভাবনা কী। সত্যি এ বয়সে কী করে যে অজস্র দাদা জুটে যায়! দাদারা আজকাল বাড়িতে আসছে—তারা বেল বটস পরে চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা করে গোঁফ সরু করে তার দিকে চেয়ে থাকতে ভালোবাসে। এবং শরীরের সব পোশাক ভেদ করে দাদারা সবাই তার সব কিছু দেখতে চায় আজকাল। একজন দাদা তো একদিন একা পেয়ে জোরে জড়িয়ে ধরল, চুমো খেল। সে বাধা দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠল না। নিজের মধ্যেই কী যে থাকে! একটা ইচ্ছে ইচ্ছে ভাব সহসা শরীরে মাথাচাড়া দিয়ে যে উঠল আর তাতেই সে কাত হয়ে গেল। কিন্তু পরে সম্বিত ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই দাদাটিকে ধিক্কার দিল। বলল, আপনি আমাদের বাড়িতে আর আসবেন না। এলে বাবাকে বলব, আপনি ভালো না। এ—ছাড়া নবনীতা অন্য দাদাদের কথাটা বলে দেবে বলে ভয় দেখিয়েছিল। সেই যে ভয় পেল দাদাটি, তারপর থেকে সত্যি আর এ মুখো হচ্ছে না। নবনীতার মনে হয়েছিল কাপুরুষ। পৃথিবীতে কারও কাছে এসব কথা বলা যায় না, আহাম্মকটা তাও যদি জানত।
যাই হোক নবনীতার দিন ভালো কাটছে না। স্কুল থেকে ফিরেই বলত নবনীতা, কেউ আমায় ফোন করেছে?
না তো!
কেউ করেনি!
না তো!
কোনো ফোন আসেনি!
বাবা রাত করে ফেরেন। বাবা মাঝে মাঝে নেশা করে বাড়ি ফেরেন। মাও সংসারে এত অঢেল সময় যে বাড়িতে একা বসে থাকতে পছন্দ করে না। মার বন্ধুবান্ধবরা মিলে একটা কাটা কাপড়ের এজেন্সি নিয়েছে পার্ক স্ট্রিটে। হাল ফ্যাশানের ডিজাইনের ফ্রক নানা জায়গায় চালান দিয়ে মার হাতে আজকাল অনেক পয়সা আসছে। মা বলেছে এখন আর ভাড়াবাড়ি নয়। নতুন ফ্ল্যাট। ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনসে। ওখানে উঠে গেলে নানুদার সঙ্গে জীবনেও আর তার দেখা হবে না। অন্তত উঠে যাবার আগে নানুদার ঠিকানা তাকে খুঁজে বার করতেই হবে। নানুদা ফিরে এলে তাকে ফোন করলে অন্য কোনো নবনীতা জবাব দেবে। তার আগে সে একবার ভাবল এক্সচেঞ্জ থেকে খোঁজখবর নিয়ে জানার চেষ্টা করবে বাড়ির ঠিকানাটা কী। একবার সে বাবাকে দেখেছিল, এভাবে বাড়ির ঠিকানা পেতে। ঠিকানা পেলে কোনো দাদার সঙ্গে সে ঠিক ও—ঠিকানার পৌঁছে যেতে পারবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আজকাল বাড়িতে খুব কড়াকড়ি চলছে। সেই যে নানুদার সঙ্গে গোপনে সিনেমা দেখে এসেছিল সেই থেকে। এ—বয়সে নাকি ছেলেমেয়েদের মাথা ঠিক থাকে না। যে—কোনো অসম্ভব ঝুঁকি জীবনে নিতে ভ্রুক্ষেপ করে না তারা। তাকে কোথাও যেতে হলে আরতী মাসিকে সব বলে যেতে হয়।
নবনীতা রিসিভারটা এবার রেখে দিল। খুব একা এবং নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে নিজেকে। কটা দিন তার বেশ হৈ—হুল্লোড়ের মধ্যে কেটে গেছে। বহরমপুরে বাবার মেসো থাকে। সেখানে দুদিন, গঙ্গার ধারে বেড়াতে যাওয়ার মধ্যেও ছিল আশ্চর্য আনন্দ। সবাই মিলে গাড়ি করে গিয়েছিল লালবাগ, তারপর নদী পার হয়ে খোসবাগ। সিরাজের কবরের পাশে সুন্দর মতো আমবাগান, সেখানে সবুজ ঘাস, ওরা ঘাসের ওপর বসে গরম ফুলকো লুচি মাংস খেয়েছে।
নানুদাটা যে কী—সঙ্গে থাকলে কী ক্ষতিটা ছিল!
এ—সময় মনে হল নবনীতার এ—বাড়িতে কেউ রেকর্ড প্লেয়ার চালিয়ে দিয়েছে, নতুন দম্পতি একতলার বাসাটায় উঠে এসেছে। সঙ্গে একজন অফিসেরই বেয়ারা অথবা পিয়ন থাকে বাড়িতে। সকাল বিকেল স্বামী স্ত্রী সেজেগুজে কোথায় যায়। আজ বোধহয় যাওয়া হয়নি। নতুন বউকে ছেড়ে এক দণ্ড কোথাও গিয়ে থাকতে বোধহয় মানুষটার কষ্ট হয়। অফিস যায় সবার শেষে, আসে সবার আগে। ছাদে উঠলে বউটি তার সঙ্গে আলাপও করেছিল। মিষ্টি হাসিখুশি মুখ। নতুন বিয়ে হলে সবারই এমনটা হয়। ওর ইচ্ছা হল, উঁকি দিয়ে দেখে এখন বউটি কী করছে। অসময়ে আজ রেকর্ড প্লেয়ার বাজছে কেন! সিঁড়ির কার্নিশ থেকে হাঁটু গেড়ে বসলে, ওদের শোবার ঘরটা স্পষ্ট, জানালায় কারুকাজ করা পর্দা, বাতাসে উঠে গেলেই কিছুটা আব্রু খুলে যায়। দেখা যায় গোদরেজের লকার, নতুন পালিশ করা খাট, ছোট সেন্টার টেবিলে, শিয়রের কাছে এক গেলাস জল রেকাবে ঢাকা। এসব দেখতে দেখতে নবনীতার কখনও কখনও গলা শুকিয়ে যায়।
সে উঠে এসে দেখল বউটি সামনে দাঁড়িয়ে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঘসছে। পাশে মানুষটি বসে আছে। পা দোলাচ্ছে। আর সিগারেট খাচ্ছে। একবার উঠে খচ করে কী যেন টিপে দিল। বাজছে কোনো মিউজিক। অবেলায় মানুষটা এমন কেন করছে? সারা রাতটা তবে কী করবে? এসব মনে হতেই দেখল বউটি বড় করে সিঁদুরের টিপ পরছে। প্রসাধন করছে। এবং সায়া শাড়ি খুলে ফেলছে। নবনীতা বুঝতে পারছে না সায়া শাড়ি খুলে ফেলার আগে এত করে প্রসাধন করার কী দরকার থাকতে পারে। পুরুষমানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে না। সে পর্দার আড়ালে এবং তারপরই বাতাসে ঢেউ খেলে গেলে সে দেখল, সেই পুরুষমানুষ লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। বউটি এগিয়ে যাচ্ছে। দিনের বেলায় আলো জ্বেলে নিয়েছে। পর্দা ফেলা বলে যে সামান্য অন্ধকার ছিল সেটাও থাকতে দিল না। নবনীতার চোখমুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকল। সেই আগের মতো গলা কাঠ—নিচে মনে হল খুট খুট শব্দ। আরতি মাসি চলে আসতে পারে। দৌড়ে নিচে নেমে গেল এবং খাটে হাত পা বিছিয়ে পড়ে থাকল কিছুক্ষণ।