এখন কত সব এমন ভাবনা মাথায় কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে লীলার। বাপ ধুলো দুপুর হলেই চলে আসবে—এখানেই খাবে। সে বড় এনামেলের হাঁড়িটা চাপিয়ে মাকে বলল, এসো মাথাটা ধুয়ে দি। ওরা ফিরে এলে সময় পাব না!
রাস্তায় নানু বলল, শ্রীহরিদা এখানে চাষ—আবাদ বুঝি ভালো হয় না?
শ্রীহরি বেশ দ্রুত সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। পাশে নানু। বাতাসের সাঁ সাঁ শব্দে শ্রীহরি নানুর কথা বুঝতে পারছিল না। সে নানুর দিকে তাকিয়ে বলল, আজ্ঞে আমাকে কিছু বললেন?
নানু বুঝতে পারছে আর জোরে তাকে কথা বলতে হবে। ওরা এখন পাশাপাশি যাচ্ছে—এখানে রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত। নানু প্রায় শ্রীহরির সংলগ্ন হয়ে এল—এখনও সে সাইকেল ভালোই চালায়, কতদিন সাইকেল চড়া অভ্যাস ছিল না, কতদিন পর আবার একটা সাইকেলে সে সকালের মাঠে বের হয়ে পড়েছে। সে বেশ জোরে বলল, শ্রীহরিদা এখানে চাষ—আবাদ কেন হয় না?
জল নেই। জল হলে সোনা ফলতে পারে।
নানু বলল, তুমি চাষ বোঝো শ্রীহরিদা?
ঐটাই সংসারে বুঝি দাদাবাবু।
তুমি নাকি পুলিশে নাম লিখিয়েছিলে?
ওরে ব্বাস, ও—কথা আর বলবেন নি!
কেন কী হয়েছে?
কাল রাতে লীলা যখন ওর বিছানা করে দিচ্ছিল, তখন শ্রীহরিদার সম্পর্কে অনেক খবর দিয়েছে। কোথাও গিয়ে থাকতে পারে না মানুষটা। গাঁয়ের টানে চলে আসে। ওর মামা পুলিশে কাজ করে—সেই বাউণ্ডুলে ভাগ্নেকে পুলিশে নাম লেখাতে বলেছিল। শ্রীহরিদা সাইকেল থেকে হাত তুলে হাওয়ায় দুলিয়ে বলল, আর যাচ্ছিনে ও লাইনে।
কোন লাইনে যাবে তবে?
ও একটা লাইন ঠিক ধরে নেব।
নানু বলল, আমারও যে একটা লাইন ধরতে হবে শ্রীহরিদা। খেতে হবে তো!
কী যে বলেন! শ্রীহরি খুব লজ্জায় যেন পড়ে গেছে নানুর এমন কথা শুনে। কোনো মরণে ধরেছে যে নানুবাবুকে লাইন ধরতে হবে! সে তো আর তার মতো উলটোপালটা লোক নয়। শ্রীহরি বলল, চম্পাহাটির ঘোষালরা খুবই অর্থবান লোক দাদাবাবু। ছোট ঘোষালের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আমাকে খুব ভালো চোখে দেখে। সলা করলে দুটো একটা বুদ্ধি দিতে পারবে ছোট ঘোষাল।
নানু শ্রীহরির কথায় হেসে ফেলল। —কেন তুমি কোনো সলা দিতে পারবে না?
আমার কথা কে লয় দাদাবাবু। আমি একখানা আবার মানুষ!
নানু বলল, আমার একখানা ঘরের দরকার।
সে করে দেবনে।
কোথায় করবে?
লীলাদের বাড়িতেই দেবনে।
ওরা দেবে কেন?
শ্রীহরি বলল, আপনি দাদাবাবু পাগল আছেন।
ও—কথা কেন হরিদা! সবাই আমাকে পাগল ভাবে কেন?
আপনি আর থাকার জায়গা পেলেন না! এমন একটা আজাগাঁতে চলি এলেন! মাথায় খুন আছে!
নানু বলল, হরিদা আমি আর কোথাও সত্যি যাব না। মাথায় আমার সত্যি খুন আছে।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ হরিদা।
শ্রীহরির কেন জানি এই বাবু মানুষটাকে বেশ ভালো লেগে গেছে। গতকাল গাঁয়ের সবাই খবরটা জেনে গেছিল। শ্রীহরিই বাড়ি বাড়ি বলে বেড়িয়েছে, লীলার দাদাবাবু এয়েছে। এই দাদাবাবুটি কে, এই নিয়ে গাঁয়ের কেউ কেউ টীকাটিপ্পনি কেটেছে। তবে এখন যা সময়কাল কার ঘরে কে আগুন দেয়। সব ঘরেই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। খিদের আগুন। একটা লোকের দয়াতে ধুলো দফাদারের বিটি বউ ছানাপোনারা ভরপেট খাচ্ছে, এজন্য কোনো কোনো ঘরে কিছুটা হিংসার উদ্রেক হচ্ছিল। লীলার ভয় অন্য রকমের। পাঁচ রকমের কথার ভয় তো আছেই, তার ওপর এই দাদাবাবুর মর্জির কথাও সে জানে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভয় পুতনা রাক্ষসীর মতো সেই বিশাল জীবটিকে, যার চোখের পলকে লীলার বুকের জল নিমেষে শুকিয়ে যেত। সে যদি চলে আসে। এবং এসেই যা করবে, দরকার হলে পুলিশ—টুলিশও নিয়ে আসতে পারে—এতসব ভয়ের মধ্যে সারাটা রাত লীলার কেটেছে—লীলা সারারাত ভালো ঘুমাতে পারেনি, এবং মনে হয়েছে দাদাবাবুকে যে করে হোক বুঝিয়ে সুজিয়ে ট্রেনে তুলে দিতে হবে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেলে লীলার নিশ্চিন্তি। কিন্তু সকালে লীলা বলতে গিয়েই থেমে গেছিল। তেমনি শ্রীহরিও থাকা নিয়ে কোনো আর কথা বলতে পারল না নানুকে। রোদে শ্রীহরি ঘামছিল। দাদাবাবুর মুখটাও লাল হয়ে উঠেছে রোদে। সামনে রোদ পড়লে যা হয়। শহুরে মানুষের এত কষ্ট সহ্য হলে হয় শেষপর্যন্ত। নানুর সেসব কোনো হুঁশই ছিল না। দেখলেই বোঝা যায় বেঁচে থাকার এক প্রচণ্ড আবেগে সে টগবগ করে ছুটছে এখন। সে গুন গুন করে গাইছে….. ন—ব—নী—তা।
তেইশ
আজও নবনীতা ফোনের ডায়াল ঘোরাল। এ সময়টাতে কেউ বাড়ি থাকে না। এ—সময়টাতে আরতী মাসি ঘুমিয়ে থাকে। সে শুধু একা। ক’দিন স্কুল বন্ধ—কম্পার্টমেন্টাল পরীক্ষার সিট পড়েছে স্কুলে। স্কুল ছুটি থাকলে দিনটা বড় দীর্ঘ মনে হয়! বিকেল বেলাটায় সে প্রতিদিনই ফোন করছে—কিন্তু আশ্চর্য একটাই জবাব, সে বাড়ি নেই। কোথায় গেছে বললে কিছু বলছে না। বাড়ির ছেলে কোথায় গেছে বলতে এত সংকোচ কেন নবনীতা বুঝতে পারে না। নানুদা বেটাছেলে, মেয়ে হলে এক কথা ছিল—একজন পুরুষমানুষের খবর দিতে ওদের এত দ্বিধা কেন নবনীতা বুঝতে পারে না। নানুদের বাড়ির নম্বর ঠিকানা কিছুই সে জানে না। ভাগ্যিস সে ফোনের নম্বরটা চেয়ে রেখেছিল। এবং এখন নবনীতার একটাই কাজ, যখনই একা থাকে, নিরিবিলি থাকে, রিং করে বলে, হ্যালো নানুদা আছে? নানুদা নেই! আবার হ্যালো, নানু আছে, নানু নেই। হ্যালো কে আপনি? আমি মিতা, আমি দাদু, আমি নানুর দিদিমা—নানুদা নেই কেন? কোথায় গেছে? কবে আসবে?