নানু বলল, আমাকে চলে যেতে বলছ?
লীলা নিজের মাথা খেয়ে ভাবল, কেন যে এমন কথা বলতে গেল! মানুষটা এত ভিতর থেকে কষ্টের কথা বলে যে স্থির থাকা যায় না। মানুষটার মাথাও বোধহয় ঠিক নেই। মামিমা ঠিকই বলত, নানুটা পাগল হয়ে যাচ্ছে। তা না হলে এমন পাণ্ডববর্জিত জায়গায় লীলার খোঁজে কেউ চলে আসতে পারে। সুস্থ মস্তিষ্ক হলে দাদাবাবু আর দশজন দাদাবাবুর মতো হতেন। সে নানুকে আর একটা কথা বলতেও সাহস পেল না।
তখন নানু কেমন ছেলেমানুষের মতো শ্রীহরিকে বলল, আচ্ছা শ্রীহরিদা তুমি আমাকে একটু থাকবার জায়গা দেবে? আমাকে কেউ কাছে রাখতে সাহস পায় না। কেন এটা হয় বলো তো! সবাই তাড়িয়ে দেয়।
এমন কথায় লীলার মুখ খুবই ব্যাজার হয়ে গেল। সে তবু শক্ত হয়ে থাকল। কোনো কথা বলল না।
শ্রীহরি বলল, আরে দাদাবাবু আপনি একটা মানুষ—একটা মানুষের ভাবনা কী বলেন। আমারে দ্যাখেন আমি একটা মানুষ, সেই কোন সালে বাপ গেল, মনে নেই, সেদিন মা চিঠি পেল—বড়ই ভাগ্যবান না হলে কপালে এত সুখ লিখা থাকে শ্রীহরির।
লীলা মাথা নিচু করে রেখেছে বলে, সে গোবড়াকে বলল, কীরে তোর দিদি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। তুই কিছু বলবি না।
লীলার মা তখন ভিতর থেকে বলল, আপনি চলে যাবেন কীগো বাবা, ঝোল—ভাত খাব বলে বসে আছি। জিয়ল মাছের ঝোল। ও লীলা তুই কী রে—বাবা কি তোদের পর। না বাবা দু’দিন থেকে খেয়ে যান—লীলা কে এ বাড়ির! তুই কেরে আবাগির বিটি আমার বাবাকে তাড়িয়ে দিস!
লীলা বুঝতে পারে মানুষের স্বার্থপরতা কতটা হীন হলে এতটা নিচে নেমে কথা বলতে পারে মা। দাদাবাবু কিছুই বুঝবে না। দাদাবাবু তার মার এই লোভের দিকটা টের পেলে ভালো হত। আঙুল উঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হল, দাদাবাবু অভাবে আমাদের কারও মাথা ঠিক নেই। আমাদের মধ্যে থাকলে তুমিও মাথা ঠিক রাখতে পারবে না। তোমার যা আছে আমরা সব রাক্ষসের পাল দুদিনে শেষ করে দেব! তুমি আমাদের কত খাওয়াবে? শেষে মানুষটার দিকে চোখ তুলতেই লীলা কেমন সংকুচিত হয়ে গেল। যেন সত্যি মানুষটাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে অগত্যা বলল, তুমি যেন কোথায় যাবে বললে দাদাবাবু!
চম্পাহাটিতে যাব। কিছু মাছ টাছ, তোমার জন্য সায়া শাড়ি বলেই সে শ্রীহরির দিকে তাকাল। তারপর বলল, যদি আমি একটা ঘর করে থাকি তোমরা বাধা দেবে না তো কেউ?
শ্রীহরি বলল, কে বাধা দেবে। কত জায়গা পড়ে আছে। দিন দিন ঝোপঝাড় বাড়ছে, মানুষজন গাঁ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, পাঁচ কুড়ি টাকা দিলে আপনাকে এক কাঠা ভুঁই দেব দাদাবাবু!
নানু লাফিয়ে উঠল, সত্যি বলছ! এত সস্তা!
কেউ আসে না। জমিতে কিছু ফলে না। জল হলে কিছু হয়, না হলে সম্বৎসর অজন্মা। এ—পোড়া দেশে কে থাকে দাদাবাবু বলেন।
শ্রীহরির কথায় নানু হাতের কাছে যেন এক বড় আকাশ পেয়ে গেল। অনাবাদি থেকে থেকে ক্রমে খড়ের জমি হয়ে যাচ্ছে। লীলার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তাড়িয়ে দিলে কী হবে। শ্রীহরিদা আমার আছে। আমি শ্রীহরিদার কাছে থাকব।
লীলা বলল, সেই ভালো। এখন যেখানে যাবে বলছিলে তাড়াতাড়ি যাও। ফিরতে বেশ বেলা হবে। শ্রীহরির দিকে তাকিয়ে বলল, শ্যাম লোহারের সাইকেলটা দ্যাখো পাও কিনা। তুমি চাইলে না করবে না। পেছনে বসে যেতে ওঁর কষ্ট হবে।
নানু বলল, আমার কষ্টে তোমার কী আসে যায়?
লীলা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আমার কেন আসতে যাবে, আমি আপনার কে?
নানু লীলার কথায় বিমর্ষ হয়ে গেল। লীলা আঘাত পেয়েছে। সে লীলাকে আঘাত দিতে চায় না। এখানে আসার পর সে অন্য মানুষ হয়ে গেছে। এখন আর কেন জানি তার কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। সে তাড়াতাড়ি কথা ফিরিয়ে নিয়ে বলল, লীলা কিছু মনে করো না। তুমি আঘাত পাবে জানলে সত্যি এভাবে বলতাম না।
লীলার চোখ জলে ভার হয়ে গেল। এই মানুষটার মধ্যে কী যে আছে! কথায় কথায় আজকাল তার চোখে জল আসে। এমনটা তার আগে কখনও হত না। সাইকেল নিয়ে এলে শ্রীহরিকে লীলা বলল, তুমি একটা ভালো দেখে মাদুর নিয়ে এসো। বালিশ চাদর কিছু ঘরে নেই। রাতে আমি ভালো ঘুমতে পারিনি।
নানু বলল, তোমার আর কী লাগবে বলে দাও।
লীলা বলল, আমার? সামান্য হেসে বলল, যা বলেছি ঐটুকু মনে করে এনো। তা হলেই আমার সব হয়ে যাবে।
তারপর লীলা শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে উদ্ধব দাসের বাড়ি গেল। উদ্ধব দাসের বউ কামিনীর কাছ থেকে কোদালটা চেয়ে নিল। গোবড়া এবং সে মিলে বাড়ির আনাচে কানাচে যে ঝোপজঙ্গল ছিল সব সাফ করে ফেলল। মানুষটার মর্জি বোঝা ভার। কতদিন থাকবে, কে জানে। সাপের উপদ্রব আছে। এতক্ষণে মনে হল, একটা টর্চ বাতি আনতে বললে ভালো করত। চারদিক থেকে সে সতর্ক থাকতে চায়। পুকুরের জল সহ্য নাও হতে পারে। সে গোবড়াকে দিয়ে এক কলসি জল আনিয়ে নিল—এবং স্নান সেরে রান্নার জন্য উনুনে শুকনো খড়কুটো গুঁজে দিল। সন্টি মন্তিকে পাঠাল মাঠে, ওরা ছাগল দুটোকে ঘাস খাওয়াবার জন্য নিয়ে গেল। মোরগগুলি ঠুকরে ঠুকরে ঘাসের পোকামাকড় খাচ্ছে। ছোট বোনটা কাঁদছিল—একটু বাড়তি দুধ ছিল, সবটা গরম করে খাওয়াল। শ্যাম লোহারকে বলতে হবে—এ’ কদিন দুধের দরকার হবে। একটু বেশি দুধ চাই। বাবু মানুষের ছেলে দাদাবাবু। ভালোমন্দ খেতে অভ্যস্ত।