লীলা দুধ আনতে গেছে বাবা।
দুধ দিয়ে কী হবে?
আজ্ঞে আপনি চা খাবেন না!
নানু জেঠুর বাড়িতে গেলেই বলত, চা করো লীলা। লীলা করতে পারত না। লীলার কষ্ট হত তখন। সে কী ভালোবাসে না বাসে লীলা এত টের পায় কী করে! লীলা তো তখন রান্নাঘর থেকে বের হতে চাইত না। ডেকে ডেকে সারা হতে হত। দাদাবাবুরা বোধহয় ভালো হয় না। লীলা এর আগে অন্য কোথাও কাজ করেছে কী না এখনও জানে না। ভাবল লীলা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করবে—লীলা আমি কী খুবই খারাপ। আমি কী তোমাকে অসম্মান করব ভেবেছ! তারপর নানুর মনে হল লীলাকে আসলে এসব কথা সে কখনও বলতেই পারবে না। লীলাকে এসব বললেই মাথা নিচু করে রাখবে। এমনকি চোখ থেকে টস টস করে জলও ফেলতে পারে।
সে এবার বাইরে বের হয়ে এল। সত্যি মুক্ত আকাশ। যত দূরেই সে চায় দূরদিগন্ত প্রসারিত মাঠ সামনে। কেমন শস্যবিহীন, এবং অনুর্বর। লীলাদের বাড়ির তিন দিকেই আগাছা এবং জঙ্গল। সামনে সদর রাস্তা। দূরের গঞ্জে বোধহয় চলে গেছে।
তখনই ভিতর থেকে লীলার মার ক্ষীণ গলা পাওয়া গেল, ও গোবড়া গেলি কুথি! বাবাকে জল দে। হাত মুখ ধুবে বাবা।
নানু বলল, আমি দেখছি গোবড়া গেল কোথায়। আসলে নানু লীলার ভাইদের নাম এখনও ঠিক ঠিক জানে না। কোনটাকে লীলা গোবড়া বলে কাল রাতে ডেকেছে সে এখনও তা মনে করতে পারল না! পর পর লীলার চারটি ভাই। সব কটির রঙ শ্যামলা—চোখ বড় বড়, হাত পা কাঠি কাঠি। শুধু মাথাটা সম্বল করে এরা বেঁচে আছে। ছোটটা এত শীর্ণ যে জোরে কথা বলতে পারে না। তারপরই কোলে পর পর দুটো। একটা ঘরে আছে সে টের পেল। বাকিগুলির একটাও বাড়ির ত্রিসীমানায় নেই। ধুলো কাল খেয়েই চলে গেছে। বলেছে, আজ আবার আসবে খেতে। নানুকে বলে গেছে, বাবা আপনি থাকুন। নিজের বাড়ি মনে করে থাকুন। কথাবার্তায় এত সুন্দর যে মনেই হয় না লোকটার মনে কোনো পাপ চিন্তা আছে। এসব ভাবতে গিয়েই সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। শ্রীহরি লোকটিকেও তার ভালো লেগেছে।
নানু হাঁটতে হাঁটতে সদর রাস্তায় চলে এল। এই রাস্তাটাই গতকাল তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। একটা নদী পার হলে রাস্তাটা পাওয়া যায়। কিছু গ্রাম গঞ্জ পার হয়ে দুক্রোশের মতো ফাঁকা মাঠ। ফাঁকা মাঠের মাথায় এই গ্রাম! গ্রামটার নাম তার জানা ছিল। আবার দু ক্রোশ হেঁটে গেলে সামনে কোনো গ্রামটাম পাওয়া যেতে পারে। উত্তরে বিশাল একটা বনভূমি আছে বলে তার মনে হল। আসলে ওটা বনভূমি না অন্য কিছু এখনও ঠিক জানে না। লীলাকে নিয়ে সব একবার দেখবে ভাবল। কিন্তু লীলা সোমত্ত মেয়ে—তাকে নিয়ে ঘুরলে কথা হতে পারে। লীলার বড় ভাইটা যদি সঙ্গে থাকে অথবা শ্রীহরি, শ্রীহরিই তার যেন সহায়—সেই সব খবর দিতে পারবে।
লীলা দূর থেকেই দেখল দাদাবাবু রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সে লোহারদের বাড়ি গেছিল দুধ আনতে। এ গাঁয়ে ওরাই এখনও দু বেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পায়। অনেক জমিজমা—কিছু আবাদ হয় কিছু অনাবাদি। পুকুরে মাছ আছে গোয়ালে গোরু আছে। এখনও শ্যাম লোহার গাঁ ছেড়ে যায়নি। ওর অন্য ভাইরা শহরে চলে গেছে। পাটকলে কাজ করে তারা। লোহারদের সেজ বউ শহরের ইস্কুলের মাস্টারনি। সেই লীলাকে কাজ ঠিক করে দিয়েছিল। গাঁয়ের দুঃস্থ পরিবারগুলির ভরসাও এই লোহার পরিবার। সম্বৎসরই এই লোহার পরিবারকে ধরে কেউ না কেউ শহরে কাজ নিয়ে চলে যায়। লীলাকে নিয়ে গিয়েছিল লাবণ্য বউদি। নেবার সময় বলেছিল, মাকে, খাবে থাকবে সঙ্গে ত্রিশ টাকা মাইনা। পূজায় শাড়ি পাবে—কাজকর্ম বলতে তিনজন লোকের দেখাশোনা। এই কড়ারেই লাবণ্য বউদি লীলাকে নিয়ে গিয়েছিল। ত্রিশটা টাকা মার অনেক। ত্রিশ টাকায় এখনও এক মণ ধান পাওয়া যায়। এক মণ ধান লীলাদের সংসারে অনেক। এক মণ ধানের জন্য মা তাকে প্রায় বিক্রি করে দিয়েছিল। দাদাবাবুকে নিয়ে সে এখন কী যে করে! মানুষটা যেন এ—পৃথিবীরই মানুষ নয়।
লীলাকে দূর থেকে দেখেই নানু চিৎকার করে বলল, লীলা কী ফাইন। লীলাকে দূর থেকে বড় রহস্যময়ী নারীর মতো মনে হচ্ছে। লীলার হাতে একটা এনামেলের গেলাস। গেলাসটা হাতে নিয়ে বড় সন্তর্পণে হাঁটছে লীলা। সামনে পেছনে লীলার সেই সৈন্যবাহিনী—কেউ দৌড়ে আসছে, কেউ হেঁটে আসছে, কেউ লাফিয়ে আসছে। লীলা কাছে এসে বলল, তুমি দাদাবাবু হাত মুখ ধুয়ে নাও। তখনই নানু সামান্য থেমে বলল, গোবড়া কার নাম?
গোবড়া এগিয়ে বলল, আমি গোবড়া।
লীলার বড় ভাইটিকে নানু বলল, তুই একবার শ্রীহরিকে ডাকবি?
লীলা সামান্য হেসে বলল, ডাকতে হবে না। চায়ের গন্ধে ও এমনিতে চলে আসবে।
আর আশ্চর্য নানু দেখল, ঠিক চায়ের গন্ধে শ্রীহরি সত্যি চলে এসেছে। মুড়ি চা—প্রায় গোল হয়ে বসে গেল। খেতে খেতেই নানু বলল, শ্রীহরিদা, তোমাকে একটা কথা বলব?
বলেন বলেন। আজ্ঞে আপনি বলবেন না তো কে বলবে!
প্রথমে তুমি আমাকে এখানকার সব ঘুরিয়ে দেখাবে।
যথার্থ কথা। আজ্ঞে দেখাব।
তোমার তো একটা দেখছি ভাঙা সাইকেল আছে?
তা আছে দাদাবাবু।
ওটাতে দুজন যাওয়া যায়?
ও আমার পুরনো বান্দা। বড় বিশ্বাসী দাদাবাবু। —কোথায় যাবেন।
চম্পাহাটিতে।
কখন?
এখুনি বের হব।
লীলা বলল, দাদাবাবু রাতে তোমার ঘুমের কষ্ট গেছে। এখানে থাকলেই কষ্ট। তোমাকে বরং শ্রীহরিদা ট্রেনে তুলে দিয়ে আসুক।