বাড়িতে ফিরে মানু নিজের ঘরে কিছুক্ষণ বসে থাকবে ভাবল। কারণ সে আজ তার বাড়ির জন্য দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাবা মা এবং দিদির জন্য বিশেষ করে। অরুণদা নানুর মেসো। অরুণদাকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন। ভালো জামাইর জন্য একটা বয়সে বাপেদের বড় দুর্ভাবনা। মেয়েকে যে এত বড় করা তা একজন ভালো সুপাত্রের কাছে ভোগের নিমিত্ত তুলে দেওয়া। ভোগের নিমিত্ত কথাটিই তার মনে হল। রাসবিহারীবাবু ভোগের নিমিত্ত একজনকে বড় করে তুলেছেন ঘরে। ভানুবাবু ভোগের নিমিত্ত। দিদির নিমিত্ত হয়তো এতদিনে অনেকবারই হয়ে গেছে। দিদি এখন শুধু এঁটো বাসন। পড়ে থাকলে কেবল মাছি ভন ভন করবে।
বাড়ি ফিরলেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কীরে দিয়ে এলি?
সে বলল, হ্যাঁ। তারপর মানুর আর কিছু বলতে ইচ্ছা হল না। দাদা এখনও বাড়ি ফিরে আসেনি। দিদি শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল। মাথার কাছে রেডিয়োতে রবীন্দ্রসংগীত। দিদির মুখ ভারী উৎফুল্ল ছিল। দাদার বিয়ের চিঠির কথা শুনেই সে লাফিয়ে উঠেছিল। তারপর আঁচল ঠিক করে বাবার ঘরে হাজির। —কবে আমরা দেখতে যাব?
মানু সহসা কেন জানি ছোটলোকের মতো তখন চিৎকার করে উঠল, তোমায় যেতে হবে না।
রমা অবাক। মানু কখনও এভাবে কথা বলে না। বাবা অথবা মার সঙ্গে ঠান্ডা কথাবার্তা মাঝে মাঝে বলে থাকে। মাথা গরমও করে থাকে মাঝে মাঝে। কিন্তু তার সঙ্গে মানু সব সময় বেশ সহজ হয়ে কথা বলে। মানুর জামা—প্যান্ট হাতখরচা সবই রমা দেয়। ছোট ভাইটির জন্য তার ভারি মমতা। অরুণদাকে সে ধরে রেখেছে—ঠিক কিছু একটা হয়ে যাবেই। হায় সেই মানুর চোখ বাঘের মতো হয়ে যাচ্ছে কেন। রমা তাকাতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে।
বাবা বললেন, আজকাল যে তোদের কী হয়েছে বুঝি না। একটুকুতেই রেগে যাস। রমা গেলে কী হবে!
মানু ভাবল, সত্যিতো দিদি গেলে এমন কী অনিষ্ট হবে। দিদিকে জানতেই হবে সব। বাবা—মাকেও। তারপর আর বোধহয় বাবা এ—বিয়েতে রাজি থাকবেন না। মেয়ের জামাইবাবুর খবরে বাড়ির সবার সংশয় দেখা দিতে পারে। সে এবার বলে ফেলল, বাবা মেয়েটি অরুণদার আত্মীয়।
নীরজা বলল, তাই নাকি। ওমা আমরা তো তা জানি না।
মানু বলল, মেয়েটি অরুণদার স্ত্রীর ছোট বোন।
ভুবনবাবু বললেন, অরুণ মানে অরুণের কথা বলছিস তো!
তাই বলছি। বুঝতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন?
সবার মুখ কেমন থম মেরে গেল। মা দিদির দিকে তাকিয়ে কী যেন আঁচ করার চেষ্টা করল। তখন দিদি সরল গলায় বলল, অরুণের স্ত্রী আছে বলে কী হয়েছে?
ভুবনবাবু শুধু বললেন, কিছু হয়নি। তারপর বারান্দার অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। অথবা বলা যায় ভুবনবাবুকে সহসা একটা বড় রকমের অন্ধকার সহসা গ্রাস করে ফেলল। রমা দেখল তার সামনে আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই। সে কেমন একা নিঃসঙ্গ হয়ে গেল। তারপর যেন জনান্তিকে বলা, একটা লোক বিয়ে করেছে বলে চণ্ডীপাঠ অশুদ্ধ হয়ে যাবে! আমি তো জেনেই মিশছি। মানুর জন্য কী চেষ্টা করছে জানো!
রমা আবার কী বলতে যাচ্ছিল—ও—ঘরে মানু ফুল ভলিউমে রেডিয়ো ছেড়ে দিয়েছে। রমার কথাগুলি শব্দের মধ্যে অসংখ্য বুদবুদ তুলে তলিয়ে যেতে থাকল। এবং রাতে বাবা অসুস্থ বলে কিছুই খেলেন না। নীরজা কোনোরকমে দরকারি কাজ সেরে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। পরদিন সকালে দেখা গেল মানু নিচে একটা লোকের চুলের মুঠি ধরে টেনে আনছে। লোকটা নীরোদবাবুর ড্রাইভার। সে গাড়ি চাপা দিয়ে কাউকে হত্যা করেছে। মোড়ের মাথায় হল্লা। গাড়ি ভেঙে দিয়েছে। এবং গাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে। দোষ, সে গাড়ি গ্যারেজ করতে গিয়ে দেখতে পায়নি পাশে কেউ বাচ্চা রেখে বাবুদের বাড়িতে কাজ করতে গেছে। ড্রাইভার না জেনেই একটা দু মাসের বাচ্চার বুকে গাড়ির চাকা তুলে দিয়েছে। রক্তাক্ত চাকার নিচ থেকে সেই শিশুর আর্তনাদ মানু শুনতে পাচ্ছিল। এবং সে জানে চুলের মুঠি ধরে এখন না নিয়ে এলে, ড্রাইভারকে সাহসী বিবেকবান মানুষেরা খুনই করে ফেলবে। সে নীরোদবাবুর ড্রাইভার অনিমেষকে আপাতত একটা ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। পুলিশের ভ্যান না আসা পর্যন্ত সে এখান থেকে নড়তে পারছে না।
বাইশ
নানুর সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। এখনও সূর্য ওঠেনি। অথচ ঘুম ভেঙে গেল। এত সকালে ওঠার অভ্যাস কোনোদিন নেই। এবং সুনিদ্রা হলে যা হয়, নানু উঠেই আড়মোড়া ভাঙল, হাই তুলল। ছেঁড়া মাদুরের ওপর কারুকাজ করা কাঁথা লীলা পেতে দিয়েছিল। অর্থাৎ এত অভাবের মধ্যেও লীলার পরিচ্ছন্নতা বোধ খুবই তীব্র। ঘুমের এজন্য কোনোই ব্যাঘাত ঘটেনি। বরং কতকাল পর ঘুমের শেষে এক আশ্চর্য প্রশান্তি। সে দেখল, তরুলতার ফাঁক দিয়ে লাল সূর্য উঠে আসছে। আর চারপাশে তরুলতার সবুজ ঘ্রাণ, হালকা হলুদ রঙ। এবং একধরনের নির্জনতায় সে ডুবে যাচ্ছিল। বাড়িতে কেউ নেই যেন। গোবড়া সন্টি মন্তিরা গেল কোথায়, লীলা কোথায়! তখনই মনে হল সে কি কাল কোনো স্বপ্নের মধ্যে লীলাকে আবিষ্কার করেছিল। আসলে সে কি লীলার খোঁজ করতে করতে এক গভীর বনের মধ্যে প্রবেশ করেছে! এসব মনে হতেই বুকটা গুড় গুড় করে উঠল। তখনই দরজার ভিতর কাশি শোনা গেল। লীলার মা কাশছে। সে অবাক হল, এমন কেন হয়, সবসময় লীলাকে তার এত হারাবার ভয় কেন! সে ডাকল, লীলা! লীলা!