সে এবারে গেট খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। সন্তর্পণে সে হেঁটে যেতে থাকল। এ বাড়ির জন্য দুটো চিঠি তার হাতে। কোনটা আগে দেবে অথবা কোন খবরটা তার আগে দেওয়া উচিত। এ সময় সে বুঝে উঠতে পারল না।
বারান্দায় উঠতেই অবাক। চার পাঁচজন লোক খুব গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। আর আশ্চর্য সে এখানে এসে দেখল অরুণদাও এ—বাড়িতে হাজির। সে কখনও অরুণদাকে ধুতি—পাঞ্জাবি পরতে দেখেনি। সে দেখেই সহসা ডেকে উঠল, অরুণদা তুমি!
বারান্দায় আবছা অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি দেখেই অরুণের মনে হল ভারী চেনা গলা। বুকটা ওর কেঁপে উঠল। সে বের হয়ে বলল, তুমি, কী ব্যাপার।
আপনি এখানে!
এই মানে…অরুণ আমতা আমতা করতে থাকল।
মানু বলল, এ—বাড়িতে রাসবিহারী রায় কে?
অরুণের ভিতরটা আবার কেমন ঘাবড়ে গেল। মানু কী তার সঙ্গে যে রমার সম্পর্ক আছে, গোপনে সে একটা কিছু করছিল, সে খবর এ বাড়িতে পৌঁছে দিতে এসেছে।
তখন রাসবিহারী বের হয়ে এলেন। কোথাকার কোনো উটকো লোক অথবা যদি কোনো দুঃসংবাদ বয়ে আনে কেউ সবাই কেমন তটস্থ ভঙ্গিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল, কাকে চাই?
রাসবিহারী রায় আছেন?
রাসবিহারী বলল, আমি রাসবিহারী।
চিঠি আছে। আগে সে বাবার চিঠিটা রাসবিহারীর হাতে দিল। বলল, আমার বাবার নাম ভুবনমোহন গাঙ্গুলী।
ভিতরে এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন! কে একজন যেন কথাটা বলতেই সে ওদের সঙ্গে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। ঘরের দেয়ালে বিদ্যাসাগরের ছবি। সি. আর. দাশের ছবি, নেতাজীর ছবি এবং গান্ধীজীর ছবি। এইসব ছবি কোনো বাড়িতে দেখলেই মনে হয় মানুর মানুষগুলো ভালো নেই। অথবা ভালো না থাকতে পেরে বড় মানুষদের দোহাই দেবার জন্য ছবিগুলিকে সাক্ষী রেখেছে। ওর তখন ঠোঁট কুঁচকে যায়। আপনারা বেশ মাছের তেলে মাছ ভাজছেন মশাইরা। সে চিঠিটা হাতে দিয়ে বলল, বাবা নিজেই আসতেন। কিন্তু ওঁর শরীর ভালো না। আমরা আসতে দিইনি।
অরুণ এখন একেবারে অপরিচিতের ভঙ্গি করে বসে আছে। এবং মুখগুলি দেখেই মনে হল ওরা কোনো গোপন শলাপরামর্শ করছিল এতক্ষণ। ওর মতো একজন মানুষের আগমনে ভেস্তে গেছে। সে বলল, বসব না। বলেই আর একটা চিঠি যখন বের করতে যাবে তখন হা হা করে উঠলেন রাসবিহারী। সে কী সে কী। তুমি এসেই চলে যাবে কেন বোস। মানু বলল, আরও একটা চিঠি আছে। আপনাকে দিতে বলেছে।—ও আমাদের বাসায় কাল সকালে গেছিল। চিঠিটা আপনাকে দিতে বলেছে।
প্রথম চিঠিটা পড়ে শেষ করেছেন মাত্র—তারপরই নানুর চিঠি। রাসবিহারী মাথার মধ্যেও নানুর মতো একটা রেলগাড়ি ঢুকে যাচ্ছে। এই প্রথম বুঝতে পারলেন, তিনিও ইচ্ছে করলে আস্ত একটা রেলগাড়ি মাথার মধ্যে ঢুকতে দিতে পারেন। সবটা ঢুকে গেলে চোখ মুখ কিছুটা অস্বাভাবিক লাগল দেখতে। অবনীশ তখন চিৎকার করে উঠল, সর্বনাশ, তাওওইমশাই আপনার চোখ দেখছি নানুর মতো হয়ে যাচ্ছে। নানু কী লিখেছে?
রাসবিহারী বললেন, নানু লীলার খোঁজে চলে গেছে। নানু নিরুদ্দেশ।
রাসবিহারী তারপর মানুর দিকে তাকিয়ে বললেন, নানু তোমার সঙ্গে বুঝি পড়ে?
মানু বলল, হ্যাঁ। পড়ে।
নানু আর কিছু বলে যায়নি?
না। আমি যাই।
বোসো বাবা। ভিতরে এসে বসো। এখুনি যাবে কী!
তিনি ফের বললেন, অরুণ দেখতো অমলা কী করছে। তোমার মাকে বলো, ওকে একটু মিষ্টি দিতে। কত সব সুখবর আজ আমার। আমার কী হবে। তারপর অরুণ উঠে যেতে চাইলে মানু বলল, অরুণদা বাইক এনেছ? তোমার গাড়িতে যেতাম।
অরুণকেও চেন!
অরুণদা আমাকে চাকরি দেবে বলেছেন, না অরুণদা।
অরুণ বোকার মতো তাকিয়ে থাকল। যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। কোনো শব্দই কানে যাচ্ছে না।
রাসবিহারী বাহবা নেবার জন্য, অর্থাৎ দেখো আমি কত বড় মানুষের শ্বশুর বোঝানোর জন্য যেন বললেন, অরুণ আমার জামাই। এরাও জামাই। আর এই হল নানুর জ্যেঠু অবনীশ। ইয়েস বয়, তোমাকে নানু কী বলেছে ফের ফিরে আসবে?
চিঠিতে তো তেমন কিছু লেখা নেই।
আই মিন এনি ডিসকাসান?
মানু বলল, না। ওর ডিসকাসান করার বাড়তি সময় হাতে ছিল না।
তারপর মানুর কেন জানি মনে হল এই মুখগুলি সব মুখোশ পরা। সে রাসবিহারীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তাহলে যাই।
আরে না না। বোস। আমরা শিগগরিই খবর পাঠাব কবে যাচ্ছি।
মানুর মনে হল, টাক মাথার লোকটা আবার বোধহয় ডিসকাসানের কথা তুলবে। আসলে নানু তাকে যা বলেছে খুবই সংক্ষিপ্ত। যা পরিচয় তাতে নানুর এর চেয়ে বেশি বলারও কথা নয়। সে রাস্তায় দাঁড়িয়েই চিঠি দিয়েছে। একবার মাঝে খুঁজে গিয়েছিল, পায়নি। এবং সেজন্য তার কোনো অনুযোগই নেই। নানুর সঙ্গে একদিন দিদিরও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। নানুর দিদির সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। দিদি যে খারাপ হয়ে গেছে নানু কী সেটা টের পেয়ে গেছিল!
তখন অরুণদা খুব ভালো মানুষের মতো রাসবিহারীকে বলল, বাবা, মানু আমার খুব পরিচিত। ওদের বাড়ির সবাই। মিতার সঙ্গে ভানুবাবুর বিয়ে হলে বেশ মানাবে। ভানুবাবু মানুষটিও খুব ভালো। সংসারের প্রতি বড়ই কর্তব্যপরায়ণ।
কী আশ্চর্য আমি এত সবের কিছুই জানতাম না।
মানু কী বলবে ভেবে পেল না। সে কেবল বলতে পারত, অরুণদা তুমি দিদিকে নিয়ে বাইকে কতদূর যেতে চাও! কিন্তু কিছুই না বলে সে দেয়ালে বিদ্যাসাগরমশাইর ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর একটু মিষ্টিমুখ। সে যতক্ষণ ছিল, ‘ওর আর নানু সম্পর্কে একটা কথাও বলেনি। মিতার সম্বন্ধের ব্যাপার আর এ বাড়ির এক ছেলে গতকালই নিরুদ্দেশ। তাও একটি ঝি—মেয়ের জন্য। আর সেই খবর বয়ে এনেছে ছেলের ছোট ভাই। এসব ভেবেই হয়তো ওরা নানু যে তাদের আত্মীয় হয় তা আর দ্বিতীয়বার মুখ ফুটে বলতে চাইল না।