কী যে বলে মানুষটা! আজকাল প্রায়ই এমন সব কথা বলে যাতে করে বড়ই অপরিচিত লাগে মানুষটাকে। এতদিন যাকে নিয়ে ঘর করেছে সে যেন এই মানুষ নয়। সে ছিল অন্য মানুষ। যত দিন যাচ্ছে তত নীরজার কাছে ভুবন নামে একটা পৃথিবী আলগা হয়ে যাচ্ছে। নীরজা বাধ্য হয়ে বলল, প্রিয়নাথ ঠাকুরপো আছে। ওঁর বাড়িতে যাও। সেও তো তোমার বয়সি মানুষ।
প্রিয়নাথ! ভুবনবাবু দু’বার প্রিয়নাথ নামটি উচ্চারণ করলেন। মেয়েদের কবেই বিয়ে হয়ে গেছে। প্রিয়নাথের। ছেলের মৃত্যুর পর সে বোধহয় আরও হালকা হয়ে গেছে। সংসারের মায়া মমতা তার এখন কাকলীকে নিয়ে। কাকলীর বয়সে নীরজাকে তিনি বিবাহ করেছিলেন। এ—সময়ে প্রিয়নাথের সঙ্গে দেখা হলে কাকলীর কথা তিনি বলতেন। প্রিয়নাথ, কাকলীর ভিতরে কষ্টের উদ্রেক হচ্ছে এটা তুমি যত সত্বর টের পাবে তত মঙ্গল হবে সংসারের। এবং তখনই প্রিয়নাথের বিধবা পুত্রবধূর কথা তাঁর মনে হল। এমন কাম ও যৌবন নিয়ে প্রিয়নাথের বিধবা পুত্রবধূই বা দিন কাটাচ্ছে কী করে । ভানু আর কতদিন। অথবা যে সংশয়টা মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে সত্যি নাও হতে পারে। প্রিয়নাথ জীবিত থাকতে ঘরের মধ্যে কোনো ব্যাভিচার চলবে সেটি বিশ্বাস করাও পাপ। তিনি বললেন, চাবিটা দাও নীরজা। আমি যাব।
নীরজা আর না পেরে চাবির গোছাটা ছুড়ে দিল। যা খুশি করো।
মানু আর থাকতে না পেরে বলল, কোনো খবর থাকে তো দিন, আমি দিয়ে আসি।
যাবি তুই!
তোমরা যা করছ?
যদি যাস তবে আর আমি যাব না। চিঠি নিয়ে যা। ওদের দিনক্ষণ দেখে আসতে বলবি। আমরা পরে যাব। তুই যাবি আমাদের সঙ্গে?
মানুষ সোজাসুজি বলল, না।
ঠিক আছে, আমি রমা তোর মা আর প্রিয়নাথ সঙ্গে যাবে।
ভুবনবাবু এবার কলম এবং প্যাড নিয়ে বসলেন। চিঠি লিখলেন, আপনার ছোট কন্যা মিতাকে দেখতে আমাদের অমত নেই। তবে প্রথমে আপনারা এসে দেখে যান। পরে আমরা যাব। পছন্দ হলে কথাবার্তা হবে। এই কয়েকটা কথা লিখে তিনি মানুকে চিঠিটা দিতেই, চিঠির উপর ঠিকানা দেখে মানু কেমন বিস্মিত হল। এই ঠিকানায় আজ তার এমনিতে যাবার কথা। নানু চলে যাবার আগে একটা চিঠি রেখে গেছে। চিঠিতেও এই ঠিকানা লেখা আছে। রাসবিহারী নানুর দাদু। সেই দাদুর কাছে মানুকে আজ তবে দুটো চিঠি নিয়ে যেতে হচ্ছে। একটা নিখোঁজ মানুষের চিঠি, অন্যটা বিয়ের চিঠি। সে ভাবল ভবিতব্য আর কাকে বলে?
তখন কাকলী বিছানায় শুয়ে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখেছিল। বৃষ্টি হওয়ায় বেশ ঠান্ডা। সারাদিন পেটের নীচে আবার সেই ফিক ব্যথাটা সে টের পাচ্ছে। ব্যথাটা উঠলে কাকলী স্কুলে যায় না। স্নান করতে ভালো লাগে না। খেতে ভালো লাগে না। কেবল শুয়ে থাকে। মুখে একটা ক্লিষ্ট ছাপ থাকে। সে জানে ব্যথাটা সন্ধ্যার দিকে সেরে যাবে এবং তারপরই সে ঋতুমতী হবে আবার। মাস ছয়েক ধরে এমনই চলছে। এবং তার মাও টের পায় তখন ভিতরে মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে। গরম জলে তলপেটে সেঁক দিতে বলে। এবং সন্ধ্যার দিকেই কাকলী বাথরুমে ঢুকে গেল। মার কাছে থেকে সে কিছুই জেনে নেয়নি। সংসারে যে এটা হয়, এবং একেই নারীত্ব বলে আসছে মানুষেরা, অর্থাৎ কাকলী বুঝতে পারে সময় বড় সুসময়। তিন—চারটে দিন তার একটা গা ঘিন—ঘিন ভাব থাকলেও কেমন মনের মধ্যে একজন পুরুষের জন্য হাহাকার বাজতে থাকে। ভানুকাকা রাতে মার সঙ্গে এ বাড়িতে আসবে। সে বাথরুম থেকে বের হয়েই আয়নার সামনে দাঁড়াল। দাদু এখন নিচে নেমে যাবে। রান্নার মেয়েটা শুধু বাড়িতে। একা কাকলী এখন আয়নার সামনে। দরজা বন্ধ। জানালাও বন্ধ করে দিল কাকলী। আয়নার সামনে ফ্রক খুলে, বগলে পাউডার দেবার সময় কেমন এক নীলাভ রঙের মধ্যে সে ডুবে যায়—শরীরের প্রতিটি অংশ বড় বেশি ফুটে বের হচ্ছে। সে শরীরের চারপাশটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল। পৃথিবীতে কোথাও কোনো অন্য কষ্টে আছে, কাকলীকে দেখে এখন আর এতটুকু বোঝার উপায় নেই। সে পাউডারের ব্রাশ আলতো করে মুখে বুলিয়ে কাজল দিল চোখে। খুব লম্বা কাজল চোখে সে নিজের সৌন্দর্যে কেমন মুগ্ধ হয়ে গেল। যেন কোনো যুবক এখন চারপাশে কেবল নৃত্য করে বেড়াচ্ছে। কাকলী সুন্দর লেস দেওয়া ফ্রক গায়ে বের হয়ে রেকর্ড প্লেয়ারে একটা আশ্চর্য মিউজিক দিয়ে দিল। সে খুব নিভৃতে মিউজিকের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে দেখল, ভানুকাকার সঙ্গে এক বড় সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। ভানুকাকা তাকে ক্রমে একটা অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরছে। ভিতরে প্রচণ্ড উষ্ণতার জন্ম হচ্ছে। শরীর কাঁপছে থির থির করে মুখ কাঁপছে প্রতিমার মতো। সে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। তার ঘুম চলে আসছে।
মানু চিঠির নম্বরটা মিলিয়ে দেখল—না, সে ঠিকই এসেছে। সামনে সুন্দর লন, পাঁচিলের পাশে কিছু গন্ধরাজ কাঠ—মালতীর গাছ। গেটে সবুজ বোগেন—ভেলিয়ার ঝাড়। নানুর দাদুর রুচি আছে।
লন পার হলেই দোতলা বাড়ি। ওপরের ঘরগুলিতে একটাও আলো জ্বলছে না। সেটা যেন নিচের ঘরগুলিতে পুষিয়ে নেওয়া হচ্ছে। নিচের ঘরগুলোতে বেশ মানুষজনেরও ভিড়। এ—বাড়ি থেকে একটা ছেলে উধাও হয়ে গেছে এত আলো জ্বলতে দেখে সেটা আদপেই অনুমান করা যায় না। প্রায় উৎসবের মতো বাড়িটা। নিচের ঘরে সে রাস্তা থেকে মানুষজনের চলাফেরা টের পাচ্ছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে মানু ঝুঁকে দেখল, কাছে কেউ নেই—সে গেট খোলার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল, খুলছে না। কোথায় আটকে যাচ্ছে। গেট থেকে সোজা লাল নুড়ি বিছানো পথটা বারান্দায় সিঁড়িতে গিয়ে শেষ হয়েছে। নানু ওর সঙ্গে দেখা করে বলেছিল, এই চিঠিটা তুই দিয়ে আসবি। চিঠিটাতে নানু লিখেছে, দাদু আমি লীলাকে খুঁজতে যাচ্ছি। কবে ফিরব, কী ফিরব না ঠিক নেই। আমার জন্য তুমি চিন্তা করবে না। এবং এই চিঠি পৌঁছে দেবার ভার মানুর ওপর রেখে গেছে। আরও কত কথা বলে গেল নানু। সে একবার তার খোঁজেও এসেছিল। কিছু সমস্যার কথা বলার ছিল তখন। কিন্তু লীলা চলে যাবার পর তার নাকি মনে হয়েছে জীবনে তার একটিই সমস্যা—এবং সে লীলাকে আবার খুঁজে পেলেই সে সমস্যাটা মিটে যাবে। অদ্ভুত গম্ভীর রাশভারি ছেলে নানু—অথচ কাল ওকে খুব উদাস দেখাচ্ছিল। লীলা! কে এমন প্রশ্ন করেছিল মানু। জবাবে নানু বলেছে, লীলা কিশোরীর নাম। লীলা বড় সুন্দর নাম। শুনেই তোমার বোঝা উচিত মানু লীলা বড় ভালো মেয়ে। তারপর নানু সহসা গান গেয়ে ওঠার মতো বলেছিল ন…ব…নী…তা। আজকাল নানুর মনের মধ্যে পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্য নাড়া খেলেই এমন একটা শব্দে সে তা প্রকাশ করতে চায়।