রমা বুঝতে পারল, অরুণ বসার ঘরে ঢুকে গেছে। সে এবার শাওয়ার পুরো খুলে দিল। শরীরে বৃষ্টিপাতের মতো এক স্নিগ্ধ করুণা। সে বুঝতে পারছিল, অতলে ডুবে যাচ্ছিল সে। সব জেনেও কিছু আর তার করার নেই।
আগে দাদা বাবা মিলে কী না করেছে। এখন দাদার ধারণা অরুণ ইচ্ছে করলে মানুকেও একটা চাকরি দিতে পারে। দাদা বাবা সবাই সেজন্যে স্কুটারের শব্দ পেলে ছুটে চলে যায়। কে আগে প্রাণ করিবেক দান এমন যেন ভাব। রমা হেসে বাঁচে না। শাওয়ারের জল মাথায় মুখে সর্বাঙ্গে—কি যে ঠান্ডা! শরীরের রোমকূপে বিন্দু বিন্দু জলকণা ক্রমে গভীরতর হচ্ছে। সারা শরীরে সাবানের ফেনা, পাম—অলিভের সৌরভ আর তখন সেই দুষ্টু লোকটা বাবা দাদার সঙ্গে সরল বালকের মতো ঠিক গল্প জুড়ে দিয়েছে। কে বলবে, ওর উদ্ভট সব পরিকল্পনা যে—কোনো কুটবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের চেয়ে প্রবল।
আয়নায় রমার শরীরের সবকিছু ভেসে বেড়াচ্ছে। শরীরে কী যে মোহ থাকে মানুষের, শেষ হয়ে যায় না, বার বার ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখতে কেন যে এত ভালো লাগে—আচ্ছা অরুণ, তুমি বসে গল্প করছ, কিছু ভাবছ না তো। এই মিথ্যুক মারব! আমি বাথরুমে, তুমি কিছু ভাবছ না! তুমি আমাকে মনে মনে দেখতে পাচ্ছ, আমি এখন কী কী করতে পারি ঠিক তুমি জানো সব। তুমি খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছ, আমি জানি। আমার হয়ে গেল বলে। বের হলেই সাবানের গন্ধটা ভুর ভুর করবে তোমার নাকে। তেলের সুগন্ধ চুলে। তুমি তো খুব ভালোবাসো এসব গন্ধ নিতে। স্নান সেরে বের হলেই জানি আমাকে দেখতে খুব ভালো লাগে তোমার। পাগলামি করবে না। আজকাল যা করছ। কিন্তু তুমি তো জানো, আমার কী কী ইচ্ছে হয়, আমার কিন্তু ভয় লাগে অরুণ। সত্যি ভয় লাগে। কোনো বড় হলঘরে ঢুকে যাবার মতো ভয়।
অরুণ তখন বলল, এই যে মানুবাবু, তোমার ক্লাব তো হেরে গেল।
মানুর রাতে ভালো ঘুম হয়নি। হাই উঠছিল। দিদি না আসা পর্যন্ত কেউ না কেউ একজন ওরা জেগে থাকে। দাদা বাজার করতে যাবে—দাদাকে সে ঢুকে বলল, তুমি যাও। অতিথির অসম্মান না হয় আবার! মানু অথবা বাবা, যে কেউ একজন হলেই চলে! মা মানদাকে দিয়ে ঘরের ঝুল পরিষ্কার করাচ্ছে। মানু খুব বিষণ্ণ গলায় বলল, এত ক্লিকবাজি থাকলে হারবে না!
অরুণ বলল, ক্লিকবাজি কারা করছে?
কারা আবার। সাপোর্টাররা ভাবছেন ছেড়ে দেবে।
ঠ্যাঙাবে বলছ?
কিছু একটা হবেই।
এসব কথা খুবই অদরকারি অরুণের কাছে। তবু কিছু কথা অদরকারি হলেও বলে যেতে হয়। কাগজটা এক ফাঁকে তুলে প্রথম পাতার খবর দেখল। জনগণের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা—অরুণ প্রথম দু—চার লাইন পড়তে পড়তে কিছুই ভালো লাগছে না—র মতো রেখে দিল কাগজটা। মানুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তা হলে কিছু একটা হবেই।’
হবে না বলছেন! পর পর হেরে যাওয়া কত আর সহ্য করা যায় বলুন।
শুনলাম ক্লাবের সেক্রেটারি বিলেত চলে যাচ্ছেন?
গুজব। কতরকম যে গুজব রটাচ্ছে শত্রু—পক্ষরা।
মানুষের এই স্বভাব। সে নিজেই কোনো না কোনো জটিল সমস্যা নিজের জন্য সৃষ্টি করে নেয়। মুখ চোখ দেখে অরুণ বুঝতে পারছিল, মানু রাতে ভালো ঘুমোতে পারেনি। সে কোনো ক্লাবের একনিষ্ঠ সমর্থক নয়। যে জেতে তার পক্ষ নিতে শুধু তার ভালো লাগে। বরং এই সকালে অদরকারি কিছু কথাবার্তা বলতে গিয়ে বুঝল, মানু ভীষণ সিরিয়াস হয়ে উঠছে। ওর হাসি পায়। সে মানুকে সামান্য উত্তপ্ত করতে পেরে বরং খুশিই। সারা সকালে ওই একটা বিষয়েই তর্ক করা যেতে পারে। খেলোয়াড়দের প্রশংসা, নিন্দা দুটোই এখন তর্কের বিষয়বস্তু হতে পারে। জার্সির রং দেখে ঘাবড়ে যায় সে বলতে পারত, যদিও কোনো কিছুই তার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না, বরং বাথরুমের দিকে চোখ—কখন খুট করে দরজা খোলার শব্দ হবে। কখন রমা বের হবে স্নান সেরে। দৃশ্যটা দেখার জন্যই সে একমাত্র উন্মুখ। পর্দায় প্রায় নগ্ন কোনো দৃশ্যের মতো তার কাছে অতীব প্রয়োজন রমার এই বের হওয়া। সে তবু বলল, মন খারাপ!
হবে না!
কেউ ডাকছে মনে হচ্ছে।
ওই তো ডেকে নিয়ে গিয়ে এখন লাগবে পেছনে।
যাবে না। তবে বল অন্তত বাড়িতেই আছ।
কিছু বলব না। আপনি একটু উঠে গিয়ে বলুন না অরুণদা, মানু নেই।
অরুণের উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। যদি রমা ঠিক তখনই বের হয়ে যায়। রমার স্নানের দৃশ্যটা সে আজকের দিনটায় দেখতে পাবে না! ওই যে কী হয়, একবার ডায়মন্ডহারবারে সাগরিকায় দুপুরবেলা খাওয়া—দাওয়া করে খাবার পর বাথরুমে হাতমুখ ধুতে গিয়ে রমা বেরই হচ্ছিল না। যখন বের হল, তখন একেবারে স্নিগ্ধ ছবি রমার। স্নানটান শেষে মেয়েদের এত কেন যে ভালো লাগে।
তার বলতে ইচ্ছে হল, মানুবাবু, তোমার এমন একটা দৃশ্য দেখার জন্য বসে থাকতে ইচ্ছে হয় না। অথচ নীচে ডাকছে, তখন গলা পাওয়া যাচ্ছে—মানু আছিস?—মানু?
অরুণ অগত্যা জানালার পর্দা সরিয়ে বলল, ও তো নেই। এলে কিছু বলব?
বলবেন এসেছিল। বললেই বুঝতে পারবে। আমার নাম নানু।
অরুণ ভাবল বেশ সময় এটা মানুষের। একটা কিছু নিয়ে থাকা। কোনো ব্যর্থতাই ব্যর্থতা নয়। ওদের সময় কত সহজে কেটে যায়। ওর সময় লম্বা, দীর্ঘ, এবং একমাত্র রমা কাছে থাকলে সময় কীভাবে কেটে যায় সে টের পায় না। সে মানুকে বলল তোমার বন্ধু নানু এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে মানুর মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল।