নীরজা কাছে এলে ঠিক যেমন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, সেভাবে তাকিয়ে থাকলেন ভুবনবাবু। নীরজা তুমি বুঝছ আমি কী ভাবছি! নীরজা, আমার ছেলেরা বড় হয়ে গেছে কবে, মেয়ে বড় হয়ে গেছে কবে—ওদের শরীরে কবে বান এসে গেছে অথচ ওরা এতদিন ঠিক আছে কী করে—না কী কিছুই ঠিক নেই—সবাই গোপনে খাওয়া—দাওয়া ঠিকমতোই করে যাচ্ছে।
নীরজা বললেন, তোমার যে আজকাল কী হয়েছে!
কী হবে আবার?
ডাকলে কেন?
এতক্ষণে মনে হল, তিনি নীরজাকে আসলে একটা প্রশ্ন করতে চাইছিলেন। নীরজার বিয়ে হয়েছিল তেরো বছরে। নীরজার সঙ্গে তাঁর মনে আছে শুভ—রাত্রিতেই সবকিছু জানাজানি হয়ে গেছিল। এবং তেরো বছরের মেয়ের মনে যে ভয় থাকার কথা ছিল, অর্থাৎ তিনি ভাবছিলেন হাত দিলে মেয়েটা ঠান্ডা মেরে, অথবা ভয়ে সরে শোবে এমন সব কিছু ভেবে যখন হাত রাখতে গেলেন —তখন আশ্চর্য নীরজা চিত হয়ে শুয়েছিল। তিনি পাশে গিয়ে জড়িয়ে ধরলে নীরজা চোখ বুজেছিল। তিনি হাত দিলে নীরজা ভয়ংকর উদ্যমশীল হয়ে পড়েছিল। তেরো বছরটা কত মারাত্মক একজন মেয়ের পক্ষে ভুবনবাবু সেদিনই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন। এবং গভীরে প্রবেশ করতে যদিও দু’চারদিন সময় লেগে গেছিল—কিন্তু তেরো বছরের বালিকা হিক্কা—ধ্বনি তিনি যেন এখনও কান পাতলে শুনতে পান। রমার বয়স বাইশ। তেরো এবং বাইশের মধ্যে কত পার্থক্য। এই বয়সটা রমা পার করে দিয়েছে—বড়ই পবিত্র চোখ মুখ মেয়েটার অথচ শরীরে নীরজার মতো কষ্টটা তার যাবে কোথায়?
তিনি বললেন, মানু কোথায়?
মানু তো ঘরেই ছিল।
ভুবনবাবু ডাকলেন, মানু আছিস?
মানুর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
নীরজা বলল, আবার বোধহয় বের হয়েছে।
কোথায় যায়! তারপরই কী ভেবে বললেন, তুমি দেখেছ কী সব বই—টই ঘরে নিয়ে আসে মানু?
কী বই?
ওর ঘরে ঢুকে মাঝে মাঝে দেখো।
তুমিই তো দেখেছ।
তুমি মা। তোমার দেখা খুব দরকার।
নীরজা বলল, আমাকে এজন্য ডেকেছিলে?
ভুবনবাবু এবার যথার্থই যেন মনে করতে পারলেন না কীজন্য নীরজাকে ডেকেছিলেন। নীরজা চলে গেলেই মনে হল তিনি আজ জানতে চেয়েছিলেন নীরজা ঠিক কত বছরে একজন মানুষের সঙ্গ কামনা করেছিল। বয়েসটা কী আট সাত না দশ। কোনটা। মেয়েরা কত বয়সে একজন পুরুষকে ঠিক নিতে পারে। একজন পুরুষের কথা তিনি জানেন, সেটা তিনি নিজে। চোদ্দো থেকে পনেরোয় মনে হয়েছিল, একজন মেয়ের শরীরে আশ্চর্য সুঘ্রাণ। তিনি সে সুঘ্রাণ পাবার জন্য প্রায় ষোলোতেই পাগল পাগল বোধ করতেন।
তিনি এবার ঘরে ঢুকে বললেন, নীরজা আমাকে চাবিটা দেবে।
তিনি আলমারির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। নীরজা হয়তো শুনতে পায়নি। আবার ডাকলেন, নীরজা চাবিটা দেবে?
মানদা ঘরে ঢুকে বলল, মাকে কিছু বলছেন?
চাবিটা দিতে বল।
নীরজা এই অবেলায় চাবি দিয়ে কী হবে জিজ্ঞেস করলেন।
আমি বের হব নীরজা।
কোথায় যাবে?
রাসবিহারীবাবুর বাড়িতে।
সেটা কোথায়?
ঢাকুরিয়ার কাছে। ঠিকানা চিঠিতে আছে। কত নম্বর বাসে যেতে হবে তাও লেখা আছে।
সেই সম্বন্ধের ব্যাপারে?
হ্যাঁ।
বারে তুমি একা যাবে কেন। কী যে তোমার বাই। রমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও। প্রিয়নাথ ঠাকুরপো আছে তাকে সঙ্গে নাও। তা ছাড়া খবর দেবে তো দেখতে যাচ্ছ। খবর না দিয়ে যায় নাকি।
আমার অন্য কাজ আছে নীরজা।
নীরজা বললেন, জানিনা। যা খুশি করো।
সবই বড় দেরি করে ফেলেছি।
এতদিনে বোধোদয়। বলে ঠোঁট বাঁকাল নীরজা।
নীরজা, তুমি আমাকে একদম মান না।
মানার কাজটা সারাজীবন ধরে কতটা করেছ?
আমি কিছুই করিনি। তুমি আমাকে আর আগের মতো ভালোবাস না।
বুড়ো বয়সে ঢং হচ্ছে।
বুড়ো হলে কী মানুষের কোনো ইচ্ছে থাকতে নেই?
ইচ্ছে থাকবে না কেন। ইচ্ছের কী শেষ আছে।
ভুবনবাবু বললেন, আমি আজই যাব। যদি চাবি না দাও, এভাবেই চলে যাব।
নীরজা বাধ্য হয়ে একবার মানুর ঘরে উঁকি দিলেন। মানু বের হয়নি। আসলে সে দরজা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে। সে আজকাল কোথাও বের হলেও দরজায় তালা লাগিয়ে যায়। নীরজা জানালায় দাঁড়িয়ে ডাকলেন, মানু দেখ তোর বাবা কী আরম্ভ করেছে। কিন্তু মানু সাড়াশব্দ না করায় চেঁচিয়ে ডাকলেন, ও মানু তোর বাবা কী করছে উঠে দ্যাখ।
মানু পাশ ফিরে শুয়ে বলল, বাবার কী হয়েছে?
কী হবে আবার। উঠে দেখতে পারো না।
মানুর মনে হল বাবার কিছু একটা হয়েছে। বড় আর্ত গলা মার। সে দৌড়ে বের হয়ে এসে দেখল, বাবা আলমারির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।
সে মাকে বলল, কী হয়েছে?
কী জানি! এখন বলছে কোথায় মেয়ে দেখতে বের হবে।
ভুবনবাবু কেমন অপরাধীর গলায় বললেন, তোমাকে বলেছি আমি মেয়ে দেখতে যাচ্ছি?
তবে কী করতে যাচ্ছ?
আমার অনেক কথা আছে বুড়ো মানুষটার সঙ্গে। বলেই তিনি ফের চাবিটার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকলেন।
মানু ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। আজকাল প্রায়ই সে দেখছে মায়ের সঙ্গে বাবার খিটিমিটি চলছে। এসব সময়ে সে প্রায়ই চুপচাপ থাকে। আর দিদির জন্য মাথায় যে তার একটা শিরঃপীড়া আছে সেটা তখন কেন জানি চাগিয়ে ওঠে। সে গুম মেরে যায় তখন।
ভুবনবাবু বললেন, অনেকদিন আমার সঙ্গে কোনো বুড়ো মানুষের দেখা হয় না নীরজা। আজ আমি আমার সমবয়সি একজন মানুষের কাছে যাব। কথা বলব। কথা বললে বুঝতে পারছি মনটা হালকা হবে।