তুমি এসো।
যাব।
তারপরই রাসবিহারী মিতাকে ডেকে বললেন, নানুর কিছুটা খোঁজ পাওয়া গেছে। ওর জেঠু বলল সব। নানু আমাদের হাতের বাইরে চলে গেল। কিন্তু ঘটনাটা কী মেয়েকে বললেন না। লজ্জা বোধ করলেন। তারপরই মনে হল কলঙ্ক। একটা ঝি—মেয়ের জন্য নানুর মতিভ্রম হবে তিনি কখনও এমন ভাবেননি। কিন্তু ভালোবাসা শব্দটি কতদিন পর মাথায় এসেছে। এটা মাথায় এলে নানু কখনও আর আত্মহত্যা করতে পারে না। রাসবিহারী সহসা আশ্চর্য রকমের হালকা বোধ করলেন কথাটা ভেবে। তিনি প্রায় লাফিয়ে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে যেতে থাকলেন।
একুশ
দুপুরে প্রচণ্ড জোরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। ভুবনবাবু জানালা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লেন। দিবানিদ্রার অভ্যাসটি নীরজারই দান। খাওয়া হয়ে গেলেই নীরজাকে দেখা যাবে তার ঘরের বিছানার চাদর ঝেড়ে বিছানা ঠিক করে দিচ্ছে। মানুষটা শোবে। যত বিশ্রাম পাবে মানুষটা তত বেশিদিন বাঁচবে। তার শাঁখা সিঁদুর অক্ষয় থাকবে ততদিন। তাছাড়া ভুবনবাবুর আগে যাবারও একটা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছে নীরজার মনের মধ্যে রয়েছে। তালে কত সতী লক্ষ্মী প্রমাণের তার আর কিছু বাকি থাকে না। পাশ ফিরে শোবার সময় ভুবনবাবু মুচকি হাসলেন। মানুষের কত রকমের যে ইচ্ছে থাকে।
আর তখনই মনে হল রাসবিহারীবাবুর মেয়ের কোষ্ঠি নিয়ে যতীন সেন আজ আসবে। এই মানুষটি তাঁর দেশের মানুষ। যতীন সেনের বাবাও ভালো জ্যোতিষী জানতেন। ভুবনবাবুদের সব কোষ্ঠি ঠিকুজি তাঁরই করা। এ দেশে এসে যতীন সেন বাবার বিদ্যেটা তুলে দেয়নি। এল. আই. সি—তে ভালো কাজ করে। আর সকাল সন্ধ্যা এই পুণ্য কাজটাও সেরে বেড়ায়। যতীন সেন এ কাজটাকে ভারি পুণ্য কাজ ভেবে থাকে। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া গেলে খুব নিষ্ঠা আছে কাজে। যতীন সেনের কিছু কিছু কথা ফলেও ভুবনবাবুর জীবনে। বিশেষ করে নীরজা জ্যোতিষ বলতে এক যতীন সেনকেই বোঝে। সবরকমের কাজকর্মের পরামর্শে যতীন সেনকে প্রায়ই এ বাড়িতে আসতে হয়—তাছাড়া কিছুক্ষণ ফেলে আসা দেশ—বাড়ির গল্প করতেও ভালোবাসে যতীন সেন। এলে সহজে আর উঠতে চায় না। নীরজাকে সবসময় বউদি বউদি করে। আজ যতীন সেন আসবে বলেই নীরজা মানদাকে দিয়ে আলাদা মিষ্টি আনিয়ে রেখেছে। এই সব সাতপাঁচ ভেবে ভুবনবাবুর হাই উঠছিল, ঘুম এল না। উঠে বসলেন, বাইরে বের হয়ে দেখলেন বেলা বেশি গড়ায়নি। তিনটে বাজে। আর কী যে হয় আজকাল, কেউ আসার কথা থাকলেই ঘুমটুকু আর আসে না চোখে। আজকাল মাথাটাকে তিনি আর ফাঁকা রাখতে পারছেন না কিছুতেই। মানুটা সারাদিন বাড়িতেই থাকে না। কোনো দিন দুপুরে খেতেও আসে না। নানুর সঙ্গে আজকাল নতুন নতুন মুখ দেখা যায়। ওরা কারা! মানুকে বলে, এক কথা, ওরা বন্ধু। ব্যস ওই কথা—কেমন ছেলে, কোথাকার ছেলে, কার ছেলে, বংশমর্যাদা কী এসব আর তিনি জিজ্ঞেস করতেই সাহস পান না। যতীন সেন এলে এবারে সাফ সাফ বলবেন। দেখতো আর কত দেরি মানুর কাজের। একটা কাজটাজে ঢুকে গেলে বাঁচি যতীন। পড়াশুনা যখন হবে না তুমি গুণে বলে দাও না—এ বছরের মধ্যে ওর কোথাও কিছু হবে কিনা?
যতীন সেন এর আগেও বলেছে সময় হলেই হবে।
সময়টা কবে হবে আর। এবারে তিনি একটা নির্দিষ্ট সময় চান। তা ছাড়া আজকাল ভুবনবাবু পাথর—টাথরে বিশ্বাস জন্মে গেছে। রাহুর অবস্থান খারাপ বলে তিনি একটা বেশ বড় আকারের গোমেদ ধারণ করেছেন। রমাকে যতীন সেন একটি মুনস্টোন পরতে দিয়েছে। এতে ভুবনবাবুর মনে হয়েছে—সংসারে কিছু শান্তি ফিরে এসেছে এবং বেশ উন্নতিরও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ভানুকে অবশ্য কোনো আংটি ধারণ করার ব্যাপারে এখনও রাজি করতে পারেননি। পরস্ত্রীর প্রতি টানটা ক্রমশই মনে হচ্ছে বাড়ছে ভানুর। এজন্য তিনি নিজেই দায়ী। বয়েস হলে বিয়ে দিতে হয়। শরীর তো অবুঝ! তার একটা কিছু চাই।
এবং এ সময়েই তিনি নিচে সিঁড়িতে কারও শব্দ পেলেন। যতীন সেন হতে পারে ভেবে তিনি করিডোর ধরে হেঁটে গেলেন। তারপর সিঁড়ির দরজা খোলার মুখে দেখলেন অন্য একজন কেউ। লোকটাকে তিনি চেনেন না। শুধু বললেন, কী চাই?
ভুবনবাবু আছেন?
আমি ভুবনবাবু।
চিঠি দিয়েছে।
কে?
যতীন সেন।
দেখি।
ভুবনবাবু চিঠি না খুলেই বললেন, ভিতরে আসুন।
আমি আর বসব না। তিনি আসতে পারলেন না। কোথায় একটা তাঁর মিটিং আছে। বড় গোছের নেতা—তিনি ভোটে দাঁড়াবেন। মনোনয়নপত্র দাখিল করার জন্য দিন দেখবেন। যতীন সেন আজ সেখানেই গেছেন।
ভুবনবাবু বললেন, বেশ। কবে আসবে কিছু লিখেছে কিনা ভেবে তিনি চিঠিটা খুললেন। লোকটি দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, আচ্ছা যাই।
ভুবনবাবু এক হাতে চিঠিটা রেখে অন্য হাতে দরজা ঠেলে দিলেন। চশমা না হলে তিনি কিছুই দেখতে পান না। বারান্দায় এসে বসার আগে টেবিলের ওপর থেকে চশমা প্রথমে নিলেন।
তারপর বাইরে এসে চিঠি খুলতে অবাক। বিরাট একটা ফুলস্কেপ পাতায় মাত্র দুটো লাইন লেখা। রাজযোটক—আপনি এ—বিয়েতে অমত করবেন না। মেয়ের কর্মফল খুবই ভালো। এত ভালো রাশিফল আমি অনেকদিন হাতের কাছে পাইনি। বিশেষ অসুবিধা থাকায় যাওয়া হল না। ইতি—আপনার বিনীত যতীন সেন। সঙ্গে মেয়ের কোষ্ঠি ভাঁজ করা খামের মধ্যে। সেটা তিনি একবার খুলে দেখলেন। বয়স বাইশ। বাইশ বয়সটা এ—কালে মেয়েদের খুবই কম বয়েস। তাঁর মনে হল, বয়েসটা আরও বেশি হলেও ক্ষতি ছিল না। ভানু আগামী মাঘে ত্রিশ পার হয়ে যাবে। এবং তাঁর মনে হল, অনেকটা বয়েস ভানুকে তিনি আটকে রেখেছেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন, একুশে। চোদ্দ বছর বয়সে প্রথম তিনি টের পেয়েছিলেন, একজন বালিকার শরীরে আশ্চর্য সুঘ্রাণ। তাঁর বয়সে যদি ভানু এটা টের পায় তবে পাক্কা ষোলোটি বছর তিনি ভানুকে এভাবে বন্দি করে রেখে ভালো কাজ করেননি। জীবনে ষোলোটা বছর কম কথা না। মানুষ যদি সময়ে আহার না পায় তবে সে গোপনে কিছু করবেই। তিনি এজন্য ছেলেমেয়েদের খুবই কম বয়সে বিয়ের পক্ষপাতী। এবং এসব ভাবনার সময়ই সহসা দেখতে পেলেন, তাঁর আত্মজা কিশোরী রমা সবে তখন ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরেছে। শাড়ি পরছে কতকাল আগে থেকে যেন। সংসারে তিনি সবার সামনে বিরাট বাধা। তিনি নীরজা উভয়ে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন—কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। আসলে মেয়েদের এবং ছেলেদের সব গোপন ইচ্ছেগুলি তাঁদের চোখের ওপর নিদারুণ হয়ে দেখা দিলে তিনি ডাকলেন, নীরজা, নীরজা।