দুপুরেই রাসবিহারী সব আত্মীয়স্বজনকে ফোনে জানালেন, নানু কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি। পুলিশে খবর দেওয়া হবে কিনা এটা যেন বসে সবাই ঠিক করে। কারণ রাসবিহারী এখন আর একজন উঠতি যুবকের দায় নিজের ঘাড়ে একা রাখতে সাহস পাচ্ছেন না। কোথাও গিয়ে নানু যদি আত্মহত্যাই করে বসে তবে আবার একটা কেলেঙ্কারি। এখন বসে ঠিক করা দরকার কী করা হবে।
প্রথমে তিন জামাইয়ের অফিসে ফোন, তারপর অবনীশের অফিসে। রাসবিহারী বললেন, আমি রাসবিহারী বলছি।
অঃ তাওইমশাই ভালো আছেন? নানুকে একবার দেখতে যাব ভাবছিলাম, কিন্তু আপনাদের মেয়ের শরীরটাতো ভালো না, রাস্তায় চলাও আজকাল ভেরি রিসক। কখন কোথায় কারা পুলিশ খুন করছে, স্কুলে আগুন দিচ্ছে, বিদ্যেসাগর মশাইর মুন্ডু উড়িয়ে দিচ্ছে—কী অরাজক অবস্থা—বাড়ি থেকে বের হতেই ভয় করে। ইয়েস অ্যানাদার কোয়েশ্চান হচ্ছে নানুর মা চিঠি দিয়েছে? আমরা তো অনেকদিন পাইনি। নানুর ব্রেন ভেরি ব্যাডলি অ্যাফেকটেড। ওটাও ওর মাকে জানানো দরকার। আপনার কী মনে হয়?
যাক তবু কথা শেষ করল। তিনি জানেন, তাঁর এই আত্মীয়টি হরবকত কেবল কথা বলে! কথা বলতে আরম্ভ করলে শেষ করতে চায় না। ভদ্রতা বোধটা পর্যন্ত গেছে। অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় রাসবিহারী বললেন, নানু কাল রাতে ফেরেনি।
মাই গড। হোয়াট হেপেনড!
কী হেপেনড আমি জানিনা। তোমাকে জানানো দরকার তাই জানালাম। ফোন নামিয়ে রাখবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু ও—প্রান্ত থেকে গলা সরু করে সে অজস্র কথা বলে যাচ্ছে—নাথিং কেন বি ডান। বলুন আপনি কী করতে পারেন। আমাদের সামাজিক স্ট্রাকচারটা ভেঙে না ফেললে কিছু করা যাবে না। নানু এই সামাজিক স্ট্রাকচারের এগজামপল।
রাসবিহারী অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন—কিন্তু কথা শেষ না হলে ছাড়েন কী করে!
আমরা ওকে সামারিলি ডিসমিস করে দিয়েছি। নো হোপ। যত পড়ান আই মিন, ডে বিফোর ইয়েসটারডে নানু কেম টু মাই হোম, অঃ হো নো নো, নট ডে বিফোর ইয়েসটারডে। ইট ইজ অন সিকসটিনথ। এসেই আমাদের মেড—সারভেন্টের ঠিকানা চাইল। সব তো বলা যায় না। স্ক্যান্ডাল। পারিবারিক স্ক্যান্ডাল।
রাসবিহারী যেন কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছেন—তিনি অধীর গলায় বললেন, বল বল তারপর কী!
তারপর স্ক্যান্ডাল! বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় এটা হবেই। ইট মাস্ট হেপেন।
রাসবিহারী জানেন, এখনই ঠিকমতো ধরিয়ে দিতে না পারলে, তাঁর এই পরম আত্মীয়টি কথার সূত্র হারিয়ে ফেলবে। তিনি বললেন, নানু কবে গেছিল তোমার ওখানে যেন?
সিকসটিনথ।
কী বলল নানু যেন?
বলল লীলা কোথায়?
লীলা।
আমাদের মেড—সারভেন্ট। আমরা বাড়ি থাকি না, নানু মাঝে মাঝে বাড়ি না থাকলে চলে আসত। তারপরই যেন দৃঢ়তার সঙ্গে বললে, আফটার অল উই লিভ ইন সোসাইটি। সব করা যায় কিন্তু সোসাইটির ভ্রূকুটিকে সামারিলি ডিসমিস করা যায় না।
রাসবিহারী ভাবলেন, এই রে আবার অন্য নৌকায় উঠে পড়তে চাইছে। প্রায় তিনি ঠ্যাং চেপে ধরার মতো বললেন,
নানু কী বলল?
বলল, লীলা কোথায়?
সে কোথায়?
ওকে তো আপনাদের মেয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। নানু ইজ আওয়ার কমপ্লিটলি লস্ট বয়। কী বলব, পারিবারিক কথা, মেয়েটা নেই জেনে নানু আপনাদের মেয়েকে খুন করবে বলে শাসিয়ে গেছে। বাট দিস মার্ডার ইউ থিংক হাউ আগলি টক। সমাজব্যবস্থা কতটা জাহান্নামে যেতে বসেছে ভাবুন। তুই তোর মাতৃসমাকে একথা বলতে পারলি। তোর কী এই শিক্ষা হল। তুই প্রীতিশের ছেলে, আর তুই আমার ভাইপো হয়ে জেঠিকে খুন করতে চাস!
রাসবিহারী এত সব কিছুই জানতে চান না। নাতির জন্য তাঁর মধ্যে যে উদ্বেগ ছিল, সেটা যেন কিছুটা প্রশমিত হচ্ছে। হয়তো নানুর আরও খবর ওর জেঠা এখন দেবে। তিনি বললেন, তারপর ও কোথায় গেছে জান?
কী হবে জেনে! হোয়াই আই স্যাল ফিল এনি ইনটারেস্ট—আপনি বলুন, ইফ ইট উড বি ইয়োর কেস আপনি কী করতেন!
রাসবিহারী বললেন, সত্যি। কী করব বলো কোথায় ফেলি! তোমাদের ওখান থেকে কোথাও যাবে কিছু বলেছে?
ইয়েস যাবে বলেই নানু ক্লাইমেকসে এসে গেল। বলল, ঠিকানা না দিলে খুন করব।
কার ঠিকানা?
আর কার সেই মেয়েটার।
তোমরা ওকে ঠিকানা দিয়েছ?
না দিয়ে উপায়। খুন হওয়ার চেয়ে ঠিকানা দেওয়া কত সহজ কাজ বলুন। এট লাস্ট উই গেভ দ্য অ্যাড্রেস।
ভালো করেছ।
ভালো করিনি বলুন। যদি খুন হয়ে যেত, তবে আবার পুলিশের ঝামেলা, কোর্ট কাছারি, উই হ্যাভ টু সুট এ কেস এগেইনস্ট হিম।
রাসবিহারী বুঝতে পারলেন, ফোনে এত কথা হয় না। তবে নানু মেয়েটির ঠিকানা নিয়ে চলে যেতে পারে কারণ সে তার টাকাপয়সাও বুঝে নিয়েছে, এ অবস্থায় রাসবিহারীর আপাতত কিছু করার নেই। এখন জামাইদের নিয়ে এ বিষয়ে কিছু একটা স্থির সিদ্ধান্তে আসা দরকার। এই বয়সে আর এত উদ্বেগ বয়ে বেড়াতে পারছেন না। তারপরই মনে তিনি কেমন প্রশান্তি বোধ করলেন। নানুর মধ্যে ভালোবাসার জন্ম হচ্ছে। ভালোবাসা শব্দটি কতদিন পর বড় প্রিয় শব্দ মনে হল তার। কাজ করতে করতে আর সংসার করতে করতে হেমর সঙ্গে একসময় সব মানুষের মতো ভালোবাসা শব্দটি তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। সব বিস্তারিত জানা দরকার। ফোনে সব শোনা যায় না ভালো করে। তিনি অবনীশকে বললেন, বিকেলে আমার তিন জামাই আসবে। বিষয় নানু। যদি তুমি আসো খুব ভালো হয়। তোমাদের পরামর্শ এখন আমার খুবই দরকার। যদিও রাসবিহারী জানেন, এই মানুষটির কাছে তার পরামর্শ চাইবার মতো কিছু নেই, কিন্তু নানুর জেঠু এই স্বত্বাধিকারে পরামর্শ করা বাঞ্ছনীয়। পরে যেন কোনো অনুযোগের ভাগী হতে না হয়। রাসবিহারী ফোন ছেড়ে দিতে যাচ্ছিলেন, তখনই আশ্চর্য কান্না কান্না গলা অবনীশের—আই ক্যান সেড টিয়ার্স ফর নানু বাট আই ক্যান ডু নাথিং মোর। সো হোপলেস আই অ্যাম তাওইমশাই।