কেমন বিরক্ত হলেন রাসবিহারী।
তোমরা কোনো খবরই রাখো না।
বীণার কাজ অনেক। এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুধু কথা বললে চলবে না। হেমর খুব পছন্দও নয় বাড়ির কর্তাব্যক্তি এভাবে সাতসকালে এত কথাবার্তা বলুক। রাসবিহারী বললেন, ঠিক আছে যাও।
আসলে রাসবিহারীর আশঙ্কা—যদি নানু গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে যায়, কিংবা জড়িয়ে যায়। যদি নানু আর না ফেরে—যদি নানু তার বাবার মতো কিছু একটা করে ফেলে। দুর্ঘটনার জন্য তিনি সবসময় নানুর পকেটে একটা ছোট চিরকুট রাখতে পছন্দ করেন। চিরকুটে ঠিকানাটা লেখা থাকে। যেখানেই দুর্ঘটনাটা ঘটুক খবর পেতে যেন দেরি না হয়। প্রথম প্রথম তিনি বলতেন, বুঝলে নানু, কলকাতার রাস্তাঘাট খুবই খারাপ। কাগজ খুললেই দেখতে পাবে দুর্ঘটনায় মৃত্যু। সঙ্গে একটা ঠিকানা রেখে দেবে সবসময়।
নানু হেসে বলেছিল, ওটা কী মৃতসঞ্জীবনী।
রাসবিহারীর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছিল, সবকিছু নিয়ে তোর ঠাট্টা।
তুমিই বল দাদু যদি ঘটেই যায়, ওটা আমার কতটা উপকারে আসবে।
আমাদের খবরাখবর পেতে হবে না। এমন বলতে গিয়ে সেদিন রাসবিহারীর মনে হয়েছিল—বড় স্বার্থপরের মতো কথাটা শোনাবে। তিনি আর তাকে কিছু বলেননি—শুধু বিকেলে তিনি সেদিন নানুর ঘরে বসে ওর বইখাতায় সর্বত্র এ—বাড়ির ঠিকানা লিখে রেখেছিলেন। অর্থাৎ কলেজ করে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে যেন ভাবনার নেই। খাতাটায় ঠিকানা লেখা আছে। পুলিশের চোখে, না হয় অন্য কারও চোখে এটা পড়বেই। এবং একটা সুন্দর ডায়েরিতে ঠিকানা লিখে নানুকে দিয়ে বলেছিলেন, ডায়েরি ব্যবহার করতে শেখো, সঙ্গে রাখতে শেখো। ভবিষ্যতে কাজে আসবে।
নানু কলেজে অথবা বাড়ির বাইরে বের হলেই রাসবিহারী ওর ঘরে ঢুকে দেখতেন, সঙ্গে ডায়েরিটা নিল কিনা। প্রশ্ন করলে এমন ট্যারা জবাব দেবে যে আর একটাও কথা বলতে ইচ্ছা হবে না। আসলে ওর মাথার মধ্যে সেই যে রেলগাড়িটা ঢুকে গেল আর বের হল না। নানুই বলেছিল, দাদু বিরক্ত করবে না। মগজের মধ্যে আস্ত একটা রেলগাড়ি ঢুকে আছে। রাসবিহারী ওর কথাবার্তার ধরন দেখেই বুঝতে পারেন কখন সেটা ঢুকে যায়, কখন সেটা বের হয়ে আসে। তিনি ওর টেবিল হাটকেই দেখতে পেতেন, লাল ডায়েরিটা টেবিলে পড়ে আছে। সঙ্গে নিচ্ছে না। মাঝে মাঝে সেজন্য চিরকূট রেখে দিতেন ওর জামা অথবা প্যান্টের পকেটে। একদিন নানু হেসে বলেছিল, দাদু তুমি বড় ভীতু স্বভাবের মানুষ। অথচ দাদু, তোমার মেয়েরা এক একজন কংকাবতী। এটা কেমন করে হয়।
রাসবিহারী ঢোক গিলে ফেলতেন। নানুর কথার জবাব দিতে পারতেন না। পারতেন না যে তা ঠিক নয়, পারতেন। তবে খুব রূঢ় শোনাত। এমনিতে মাথাটা গেছে, তার ওপর বাপের মৃত্যুর জন্য দায়ী আসামিদের এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে। কী যে হবে! এবং তখনই তিনি হেঁকে উঠলেন নিধু—নিধু, দেখত কাগজ দিতে এত দেরি করছে কেন!
নিধু রাস্তার দিকে চেয়ে বলল, আজ্ঞে আসবে। সময় হয়নি বাবু।
তিনি এখন কী যে করেন! বাথরুমেও ঢুকতে পারছেন না। যদি কাগজটা এসে যায়। কাগজটা পড়লে তিনি কিছুটা স্বস্তি পাবেন। কোনো গণ্ডগোলের খবর থাকলে কাগজে ঠিক থাকে। সে শহরের যেখানেই ঘটুক। এই কাগজটা পড়ার পর চিন্তা করবেন, কোথায় কীভাবে খোঁজখবর নেওয়া যায়।
এবং কাগজটা এলে প্রথমেই সারা পাতায় তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। কাগজে একটাও মৃত্যুর খবর নেই। শুধু কিছু নিরুদ্দেশের খবর আছে। এই কলমে নানুর একটা ছবি মাপতে হবে। যা একখানা বাড়ি, নানুর ছবিও হয়তো সময়কালে ঠিক হাতের কাছে পাওয়া যাবে না। আর তখনই মিতা হাই তুলতে তুলতে ঘর থেকে বের হয় আসছে। সামনে মিতাকে দেখেই তিনি কাগজটা সরিয়ে রেখে বললেন, হ্যাঁরে নানুর ছবি আছে বাড়িতে?
এই সাতসকালে বাবা নানুর ছবির কথা জিজ্ঞেস করায় খুব অবাক হয়ে গেল মিতা। সে বলল, কেন নাতির বিয়ে ঠিক করেছ নাকি।
রাসবিহারী বুঝতে পারেন সবকিছুর মূলে হেম। মেয়েরাও ঠিক তাকে সমীহ করে না। এ ছাড়া এই বাড়িতে নানুকে জায়গা দেবার পর থেকেই সবাই কেমন তাঁর ওপর বিরূপ হয়ে উঠেছে। তিনি বললেন, আছে কী না বলো। বিয়ে দেব কী দেব না সেটা আমি বুঝব।
তুমি রেগে যাচ্ছ কেন বাবা?
এমন কথা তোরা বলিস। জানিস কাল রাতে নানু ফেরেনি। কেমন ছেলেমানুষের মতো নালিশ জানালেন যেন রাসবিহারী।
মিতা দেখল তার বাবা, তার বাবা রাসবিহারী, শ্যামলা রঙের দোহারা চেহারার মানুষ। চোখে নিকেলের চশমা। হাতে কাগজ। দুশ্চিন্তায় চোখের নিচে কালি। তিনি ধুতি পাট করে পরে আছেন। তাই পরে থাকেন। এবং তাঁর দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন। বাবার জন্য বুকটা মিতার ভিতরে কেমন গুড় গুড় করে উঠল। এমন শূন্য দৃষ্টি সে বাবার চোখে কখনও দেখেনি। বলল, বাবা ও ফেরেনি, ফিরবে।
কখন আর ফিরবে।
মিতা খুব যেন বয়সি মেয়ে হয়ে যাচ্ছে। তার আর হাই উঠছিল না। সে বাবার পাশে বসে বলল, তুমি সেজদিকে বরং লিখে দাও, সে যেন তার ছেলেকে নিয়ে যায়। ওর জন্য তোমার আয়ুক্ষয় হচ্ছে বাবা।
রাসবিহারী মনে মনে এ—কথাটা সত্য ভাবেন। যদি বুড়ো বয়সে এই উটকো ঝামেলা ঘাড়ে এসে না চাপত তবে তিনি আরও কিছু বেশিদিন বাঁচতেন। হেমর নিষ্ঠুরতার জন্যও একসময় তাঁর এ কথাটা মনে হত। দীর্ঘদিন সয়ে সয়ে ওটা ভুলে গেছিলেন। নানু আসার পর থেকে আবার সেই আয়ুক্ষয়টা চলছে এমন মনে হল তাঁর।