আশ্চর্য এখন তাঁর এসব ভাববার সময় নয়। তিনি যে সারারাত ঘুমোননি, কেউ এটা টেরই পায়নি। ঘর বারান্দা লন এই সারারাত করেছেন। এখন তিনি ঢক ঢক করে জল খাচ্ছেন—যদি অবনীশের বাড়িতে নানু থেকে যায়, তবে ফিরতে সাতটা আটটা হবে। এই সময়টুকু তাঁকে অপেক্ষা করে দেখতে হবে। তারপরই কেমন তিনি সংসারের সবার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। যেন সবাই মিলে তাঁর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র করছে। ষড়যন্ত্রটা এই নানুকে কেন্দ্র করে মনে হল তাঁর। এই বয়সে এত ভাবনা তিনি আর বইতে পারছেন না।
অথচ রাসবিহারীকে দেখলে মনে হবে না ভিতরে ভিতরে এতটা বিচলিত তিনি। নিধু বারান্দায় এসে ডাকল, বাবু।
রাসবিহারী বাইরে বের হয়ে এলেন।
কিছু বলবি?
দড়ি কিনতে হবে। টেপি দড়ি ছিঁড়ে ফেলেছে।
কিনে আনবি।
নিধু চলে যাচ্ছিল। তিনি ফের ডাকলেন, কারণ কাল রাতে কেবল নিধুকেই বলা হয়নি। নিধু কাছে এলে বললেন, দাদাবাবু তোকে কাল কিছু বলে গেছে?
না ত।
ওতো রাতে ফিরে আসেনি।
কোথাও থেকে গেছে।
কোথায় থাকবে।
কেন তেনার জ্যাঠার বাড়িতে।
জানি না। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা। এত করে বলেছি পকেটে ঠিকানা রাখবি।
নিধু ঠিক বুঝতে পারছিল না, পকেটে ঠিকানা রাখলে কী হয়। সে চলে যাচ্ছিল।
রাসবিহারী বললেন, এই শোন।
নিধু কাছে এসে দাঁড়াল।
কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়েছে?
কীসের গণ্ডগোল।
এই মানে…তারপরই মনে হল কতটা বিচলিত হলে এমন হয় এই প্রথম তিনি টের পেলেন। যেন সারা কলকাতা শহরের কোথাও গণ্ডগোল হওয়ায় ট্রাম বা বাস বন্ধ ছিল এবং সেজন্য নানু ফিরতে পারেনি। রাতে অবশ্য নিধুকে একবার ডেকে তুলে বলেছিলেন, পঁয়তাল্লিশ নম্বর বাস চলছে কিনা দেখে আয় তো।
সে রাস্তা থেকে দেখে এসে বলেছিল, চলছে বাবু।
তারপর তিনি বলেছিলেন, ফোন করবেন। কিন্তু কাকে—তখন রাত বারোটা। সবাই ঘুমে মরে আছে। রিসিভার হাতে নিয়ে বসেছিলেন, পুলিশ বাদে আর কাকে এত রাতে ফোন করা যায়। তাঁর একবার মনে হয়েছিল, কাউকে করা যায় না। সবাই তাঁর উচাটনে বিরক্ত বোধ করবে। তিনি রিসিভার তুলে নামিয়ে রেখেছিলেন।
তাঁর মনে হয়েছিল, বেলঘরেতে মেজ—জামাইকে খবরটা দেওয়া দরকার। অরুণকে দেওয়া দরকার। এবং তাঁর মনে হয়েছিল, নানুর খুব রাত করে ফেরার অভ্যাস বলে মাঝে মাঝেই খুব বেশি বিচলিত হয়ে পড়লে এমন দরকারের কথা মনে পড়ছে তাঁর। এসব যখন ভাবতেন তখনই দেখতে পেতেন সদর খুলে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি লনে ঢুকছে। কালও ভেবেছিলেন, নানু ঠিক এসে যাবে। অনেক দূর পর্যন্ত তিনি অস্পষ্ট অন্ধকারে তাকিয়ে থেকেছেন—রাস্তায় কেউ ফিরলেই মনে হয়েছে, বোধহয় নানু আসছে। পাতা নড়লে মনে হয়েছে কারও ছায়া নড়ছে। কুকুর হেঁটে গেলে মনে হয়েছে, হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে আসছে কেউ। এবং এসব করতে করতেই রাতটা কাবার হয়ে গেল। সদর খুলে একবার তিনি একা রাস্তায় গিয়েও দাঁড়িয়েছিলেন কিছুক্ষণ। কেউ আর ফিরছে না। সব বাড়িগুলির দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, বড়ই সৌভাগ্যবান এরা। এদের সবাই অন্তত আজকের রাতের মতো ফিরে এসেছে। তাঁর একজন এখনও আসেনি। তারপরই মনে হয়েছিল এত রাতে একা দরজা খোলা রেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না। তিনি নিধুকে সঙ্গে নিতে পারতেন। কিন্তু নিধু ঠিক পরদিন হেমকে বলবে এবং নাতির দুশ্চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না ভেবে মুখ বেঁকিয়ে হাসবে হেম। কারণ নানু ওদের কাছে জাহান্নামে যাওয়া ছেলে। ইদানীং ওটা নানুর আরও বেড়েছে। এই বাড়ার মূলেও আছেন তিনি। বড়ই উভয় সংকটে পড়ে গেছেন রাসবিহারী।
তখনই মনে হল হেম দরজা খুলে বের হয়ে এসেছে। হেম এই সময় ঈশ্বরের নাম করতে করতে বের হয়ে আসে। হেম যে কার মঙ্গল প্রার্থনা করে রাসবিহারী ঠিক বুঝতে পারেন না। আসলে হেম নিজেরই জন্য প্রার্থনা করে বোধহয়। পৃথিবীতে এমন স্বার্থপর এবং নিষ্ঠুর রমণীর হাতে তাঁর জীবনটা কেটে গেল। পরজন্মে বিশ্বাস আছে বলেই রক্ষে। কিন্তু এতসব কথা কী তখন আর মনে থাকবে।
রাসবিহারীর একবার ইচ্ছে হল বলে, নানু ফিরে আসেনি। কিন্তু কী হবে বলে। তিনি খৈনিটা ঠোঁটের ফাঁকে ফেলে দিলেন। তারপর দেখলেন বীণা সদর দরজা দিয়ে ঢুকছে। বীণাকে ঢুকতে দেখেই বললেন, তোমাদের নানুবাবু কাল ফেরেননি।
কোথায় গেছেন?
কোথায় গেছেন তিনিই জানেন। তারপরই একটু থেমে বললেন, তোমাদের ওদিকে কোনো গণ্ডগোল হয়েছে?
ন তো!
কিছুটা স্বস্তি। রাসবিহারী ফের বললেন, যা রাস্তাঘাট! রোজই কোথাও না কোথাও গণ্ডগোল।
বীণা বলল, কোথাও থেকে গেছে। বন্ধুবান্ধবের কাছে। খুব নিজের লোকের মতো কথাগুলো বলল বীণা।
ওরতো বন্ধুবান্ধবও নেই।
কেন ওই যে মানুবাবুর কথা বলে!
মানুবাবুরা কোথায় থাকে তুমি জানো?
এ বাড়িতে নানুবাবুর সঙ্গে বীণার তবু কিছু কথা হয়। রাসবিহারীর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা এবং মিতার সঙ্গে নানুবাবু খুব প্রয়োজনে কথা বলে থাকে। অথবা এক ধরনের জেদ দেখা দিলে মাথায় মিতাদির পেছনে লাগার স্বভাব নানুবাবুর। সে মাসে দু—মাসে এক আধবার। অন্যসময় নানুবাবু নিজের ঘরেই শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়। বই পড়ে, খবরের কাগজ পড়ে, কলেজ যায়, রাত করে ফেরে—জামাকাপড় কেচে দেয় বীণা, ঘর ঝাঁট দেয় বীণা, চা—জলখাবার দেয় বীণা—সুতরাং এ—বাড়িতে রাসবিহারীর পরই নানুর সঙ্গে বীণার সামান্য মধুর সম্পর্ক। সুতরাং মানুবাবুর কথাও তার জানার কথা থাকতে পারে। সে বলল, না বাবু।