লীলার পরের ভাইটা কোথা থেকে কলাপাতা কেটে নিয়ে এল। ধুলো দফাদারও কোত্থেকে খবর পেয়ে ভাত খাবার লোভে ছুটে এসেছে। লীলা এক হাতে খোলা আকাশের নিচে উনোনে রান্না করছিল। অদূরে একটা আসনে নানু বসে আছে। দু’গণ্ডা কাচ্চাবাচ্চা তাকে ঘিরে আছে। গাঁয়ের কেউ কেউ খোঁজখবর নিতে এল—নতুন মানুষটা কে? লীলা বলল, দাদাবাবু। এই পর্যন্ত। আর কিছু বলতে তার এই সময় ভারি সংকোচ হচ্ছিল।
নানু বলল, ও লীলা তোমার রান্নার আর কত দেরি? আমার খুব খিদে পেয়েছে।
তখন লীলা মুগের ডাল সম্ভার দিচ্ছে। মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, চাটনি। কলাপাতা সার সার পেতে দেওয়া—লীলার মুখ ঘামছে। উনুনের আলোতে লীলাকে কোনো সূদুর নীহারিকাপুঞ্জের মতো মনে হচ্ছিল, হাতে একগাছা করে কাচের চুড়ি। আহা লীলা জীবনে আর এত পবিত্রতা নিয়ে কখনও কিছু রাঁধেনি। মুগের ডালের চমৎকার গন্ধটা বাতাসে ম ম করছিল।
ধুলো বলল, তুমি এসেছ যখন দুদিন থেকে যাও। হাঁ আমাকে কাল এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দেবে কিন্তু।
নানু বলল, আর কী চাই তোমার?
আমার খুব বাসনা ছিল একটা শান্তিপুরী ধুতি পরি!
নানু বলল, হবে।
লীলার ভাইবোনগুলো সমস্বরে বলে উঠল, আমার জামা চাই, আমার প্যান্ট চাই।
নানু বলল, হবে। হবে।
লীলা তখন ধমক না দিয়ে পারল না। এই গোবড়া, সন্টি, মন্তি, কালো, এদিকে আয়। দাদাবাবু তুমি অত আসকারা দেবে না। সুখের গন্ধ বড় গন্ধ। তখন লীলার মা পর্যন্ত হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসে দরজায় বসে। চাঁদের হাট দেখছে। এবং বলছে, লীলা আমায় দুটো খেতে দিস।
নানু বলল, আজ না মা। কাল খাবেন। কাল মাগুর মাছ নিয়ে আসব। ঝোল ভাত। আজ আপনাকে বার্লিই খেতে হবে।
লীলার ভেতরে তখন ঝড় বইছিল। মানুষটার জন্য তার মায়ার শেষ নেই। অথচ সে বড়ই অভাগী। মনে হয় ছুঁয়ে দিলেই মানুষটার জীবনে তাদের মতো বিড়ম্বনা নেমে আসবে। সে ভাবল কাল যে করে হোক ঘরের ছেলেকে ঘরে পাঠিয়ে দেবে। এদের সে ভালো করেই জানে। দু’হাতে নানুবাবু টাকা ওড়ালে ধুলো দফাদারও বাড়ি থেকে আর বের হবার নাম করবে না। সংসারের এতবড় হাহাকারের জন্য দায়ী যারা তাদের সে ক্ষমা করতে পারে না। লীলা মনে মনে শান্ত হতে চাইল। স্বার্থপর কূট এই ধুলো দফাদার—মাকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে পাঁচ বাচ্চার জননী করে দিল। সে জানে বাবা বেঁচে থাকতে এত বিড়ম্বনা ছিল না তাদের জীবনে। বাবা বেঁচে থাকলে, তাকে একটা সুন্দর মানুষ দেখে বিয়েও দিয়ে দিত। এবং তখনই কেন যে মনে হল সুন্দর মানুষটা দেখতে ঠিক নানুবাবুর মতো হত। এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের আস্পর্ধার কথা ভেবে লীলা হতচকিত হয়ে গেল।
তখনই ধুলো মেটে হাঁড়িতে এক হাঁড়ি জল নিয়ে এল। গাঁয়ের শেষ মাথায় সরকারি নলকূপ থেকে ধুলো জল এনেছে। উৎসবে কেউ বসে থাকে না। সেজন্য জলটা কাঁধে করে নিয়ে এসেছে। এবং ভাঙা তোবড়ানো এনামেলের গেলাসে জল, কলাপাতায় গরম ভাত, এবং টুকরো কাগজি লেবু এবং বেগুন ভাজা। লীলা কোমরে আঁচল গুঁজে সবাইকে ভাত দেবার আগে নানুর পাতে সুন্দর করে ভাত বেড়ে দিল। সেই সময় নানু তাকাল লীলার দিকে, লীলা তাকাল নানুর দিকে—বড়ই সুখে নানুর বুক বেয়ে অজস্র কান্না অত্যধিক বেগে বের হয়ে আসতে চাইল। সে চোখ নামিয়ে নিল। ভাত মেখে খাবার সময় কেউ লক্ষ্য করল না—নানু গোপনে আজ কাঁদছে।
কুড়ি
সারারাত রাসবিহারী ভয়ংকর উচাটনের মধ্যে কাটিয়েছেন। নানু রাতে বাড়ি ফেরেনি। সকালে তিনি তবু একবার কী ভেবে দোতলায় নানুর ঘরে উঁকি দিয়েছিলেন, না নেই। দরজার শেকল তোলা। তিনি এখন কী করবেন বুঝতে পারছেন না। পুলিশে জানাবেন? অবনীশকে! আজকাল যত্রতত্র মানুষ খুন হচ্ছে। পুলিশ তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর মাঠে কিংবা নদীর পাড়ে লাশ ফেলে রেখে চলে আসছে। সারা পশ্চিমবঙ্গে নরমেধ যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। আর কার কাছে খবরটা দেওয়া যায়। ঘুম না হওয়ায় চোখ জ্বালা করছে। তিনি ধীরে ধীরে নেমে আসছেন সিঁড়ি ধরে। এখনও এ—বাড়ির কেউ জানেই না নানু রাতে বাড়ি ফেরেনি। কারণ নানুর ফেরার জন্য শেষ খাওয়ার পর কিছু কথাবার্তা থাকলে হেমর, অথবা হেম যদি প্রসন্ন থাকে, একটু পান জর্দা খাবার ফাঁকে পাড়ার কারও কারও বাড়ির গুপ্ত খবর দিতে যতটুকু দেরি কিংবা যাকে বলা যায় অপেক্ষা—ততটুকুই নানুর জন্য অন্য সবার চিন্তা। অন্য সব বলতে অবশ্য দু’জনই। হেম আর মিতা। এরা কেউ নানুর জন্য এর বেশি কোনো টান বোধ করে না।
হেমর ঘরের দরজা বন্ধ। ঘুম থেকে ওঠেনি। মিতার ঘুম ভাঙতে বেলা হয়। সবারই আলাদা ঘর। ঘরগুলির পাশ কাটিয়ে গেলেন—কাউকে ডাকলে না। খুব সকালে তিনি সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠেছেন—আকাশ ভালো ফর্সা হয়নি। সিঁড়ি ধরে নেমে করিডোর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় মনে হল, আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। ভিতর ঘরটা পার হলেই হেমর ঘর। তারপর তাঁর ঘর, শেষে বসার ঘর। হেঁটে যেতে যেতে তিনি বুঝতে পারছিলেন, আলাদা ঘরে থেকে সবাই ক্রমে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিনি কাচের জার থেকে খালি পেটে এক পেট জল খান। যৌবন থেকেই কনস্টিপেসান। যৌবন থেকেই এই জল খাবার অভ্যাস। ইদানীং তিনি সকালে পায়চারি করে ভালো ফল পেয়েছেন। জলটা খেয়েই পথে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ান এবং এক সময় তার ঠিক বাথরুমে যাবার সময় হয়ে যায়। তিনি আজকাল আরও একটি অভ্যাস গড়ে তুলেছেন। সকাল বিকাল বাথরুমে যাবার আগে সামান্য খৈনি মুখে দেন। এটি নিধুর দান। নিধুই তাঁকে শেষ বয়সে একটা নেশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তিনি হাতে সামান্য খৈনি পাতা এবং চুন কৌটা থেকে বের করে নিলেন।