কিছুক্ষণের মধ্যে সেই নারী এসে হাজির। মলিন বসন। চোখে অপার বিস্ময়।—তুমি দাদাবাবু?
কোথায় ছিলে? কখন থেকে ডাকছি।
শেয়াল মুরগি ধরে নিয়ে গেছে। খুঁজতে গেছিলাম।
ওর চারপাশে সেই কাচ্চাবাচ্চা। প্রায় দু গন্ডা, লীলার কোলে একটা সাত আটমাসের বাচ্চা। এরা কারা? এই প্রশ্নটাই নানুর মাথায় বিজবিজ করছিল।
তখন সেই নারী সুধা পারাবার বলল, দাদাবাবু, কেন তুমি এলে?
বারে কতদিন তোমাকে দেখি না। এখন আমাকে আগে এক গেলাস জল খাওয়াও তো।
একটা নিকেলের তোবড়ানো গেলাসে নানুকে লীলা জল এনে দিল। তারপর বলল, একী চেহারা করেছ শরীরের।
সব ঠিক হয়ে যাবে।
লীলা হাসবে কী কাঁদবে ভেবে পেল না। বাড়িঘরের এই দশা, কোথায় এমন পাগল মানুষটাকে যে সে বসতে দেবে। ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় লেপ্টে আছে তার জননী। জ্বর কতদিন থেকে। লীলাকে বলছে কে রে লীলা।
লীলা শুধু বলল, দাদাবাবু।
কোথাকার দাদাবাবু?
আমি যেখানে ছিলাম মা।
সহসা আর্তচিৎকারে সেই জননীর গলা ভয়ংকর হয়ে উঠল! তোর মরণ হয় না কেন রে, তোরে যমে দেখে না কেন রে, তুই আবার মরতে ফিরে এলি, কটা তোর বাপ আছে যে খাওয়াবে? দাদাবাবুর সঙ্গে পীরিত করতে গিয়ে তোর কাজ গেল রে। লীলা বলল, মা চুপ চুপ। দাদাবাবু খুব ভালো মানুষ।
সঙ্গে সঙ্গে কেমন জল হয়ে গেল লীলার মা। সত্যি বলছিস ভালোমানুষ। ভালোমানুষের বংশ তবে মারধর করে তোকে তাড়িয়ে দেয় কেন?
নানু বুঝতে পারল অভাবে অনটনে লীলার মার মাথাটি গেছে। সে ঘরে ঢুকে বুঝল, আসলে এটা মানুষের আবাসই নয়। খড় বিচালী সরে গিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। একদিকের মাটির দেওয়াল ধসে পড়েছে। এক কোণায় একটা তালপাতার চাটাইয়ে এক অস্থিচর্মসার রমণী পড়ে আছে। শুধু গলার আর্ত চিৎকারই সম্বল। নানু শিয়রে বসে বলল, ধুলো দফাদার কোথায়?
পাত্তা নেই। কোথায় থাকে, কী খায়, কেউ জানে না বাবু। আমার গতরে আর রস নেই।
নানু বলল, তোমার কী হয়েছে মা?
আমার মরণ অসুখ ধরেছে বাবা।
কিছুই হয়নি। তুমি দেখো ভালো হয়ে যাবে। তারপর লীলার দিকে তাকিয়ে বলল, ডাক্তার পাওয়া যায় না এখানে?
স্টেশনে আছে, সে তো অনেক দূর।
গাঁয়ের কাউকে পাঠাবে? টাকা দিচ্ছি সাইকেলে যদি যায়।
লীলার মা উঠে বসল। বলল, তুমি সাক্ষাৎ দেবতা বাবা। ভগবান আমার কপালে এত সুখ।
নানু বলল, উঠে বসো না। খুবই দুর্বল দেখছি। এবং লীলার একটা ভাই কোথাকার একজন খাকি প্যান্ট পরা মানুষকে নিয়ে এসে বলল, শ্রীহরিদা এয়েচে।
সে শ্রীহরিকে বলল, এই টাকা নাও। লীলার দিকে তাকিয়ে বলল, কী কী আনতে হবে বলে দাও। ঘরে তো কিছুই নেই মনে হচ্ছে। তারপর নানু শ্রীহরির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিও রাতে এখানে খাবে।
সন্ধ্যার দিকে সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে ডাক্তার এল। অষুধ এবং পথ্যি দিয়ে নানুর দিকে তাকিয়ে বলল, মহাশয়ের কোথা থেকে আগমন?
নানু বলল, কলকাতা থেকে।
সেই একবার কলকাতায় গেছিনু। কতকালের কথা! এখন চোখে ভালো দেখতে পাই নে। কোথাও যাই না।
নানু পাঁচটা টাকা দিলে অনন্ত মাঝি বলল, তিন পুরিয়া করে অষুধ থাকল। দিনে তিনবার। বার্লি আর কাগজি লেবু। ভালো খেলে শরীর সুস্থ হয়ে যাবে। সকালে ভাত দিতে পারেন কাল। শিঙি মাছের ঝোল হলে ভালো হয়। গাঁদাল পাতার ঝোলও দিতে পারেন।
তারপর ঘণ্টি বাজিয়ে চলে গেল ডাক্তার অনন্ত মাঝি। নানু উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল মাথার ওপরে আজ কতদিন পর মুক্ত আকাশ। লীলা চাল ডাল তেল বুঝে নিচ্ছে শ্রীহরির কাছ থেকে। শ্রীহরি বলল, বিড়ি আনলাম দাদাবাবু এক প্যাকেট। নানু বলল, বেশ করেছ। তোমার গাঁটা আমি দেখব শ্রীহরি। এবং তখনই লীলা বলল, দাদাবাবু তুমি থাকবে কোথায়?
নানু বলল, সে নিয়ে ভাববে না। উঠোনে একটা চাটাই পেতে দিয়ো। তাতেই হবে।
যেন কতদিন পরে নানু প্রবাস থেকে ফিরে এসেছে। আশ্চর্য মুক্তির স্বাদ। যেন নতুন জীবন শুরু হল। সে কোথাকার নানু, তার বাবা আত্মহত্যা করেছিল, মা একটা নতুন লাল বল পেয়ে তার কথা ভুলে গেল এবং সে কত যে অসহায় ছিল, এখন আর তা কিছুই মনে পড়ছে না। জীবন জুড়ে এক নতুন অস্তিত্বের আস্বাদ। লীলা এরই মধ্যে একটা ফুলতোলা আসন নিয়ে এল। নানুকে বারান্দায় বসতে দিল। এবং এত সংকোচ লীলার যে সে প্রায় সবসময়ই নির্বাক—নানুই যেমন একসময় বলল, আমি চান করব লীলা। অবশ্য এখানে আসার আগে তার মনে হয়নি রাতের পোশাক দরকার, জামাকাপড় আলাদা দরকার। সে এক জামাকাপড়ে এখানে চলে এসেছে। এখন এই রাতটা কাটাতে পারলে তার ভাবনা নেই। সকালে উঠে যেমন একজন গৃহীমানুষ সওদা করতে যায়, সে তেমনি কাল সওদা করতে যাবে। সঙ্গে লীলা থাকবে। এবং এমনই যখন ভাবছিল তখন লীলা বলল, দাদাবাবু পুকুরের জলে চান সইবে?
খুব সইবে। অর্থাৎ যেন বলার ইচ্ছা নানুর, তুমি এত সইতে পারো, আর আমি এটুকু সইতে পারব না।
লীলা বলল, তোমাকে কী পরতে দিই বলতো। কিছু নেই। আমার ধোওয়া শাড়িটা নাও। ওটা পরবে। নানু দেখল, তার দেওয়া একটা শাড়ি লীলা সুন্দর করে ভাঁজ করে রেখেছে সামনে। তারপর নানু চান করল পুকুরের জলে। ছোট ছোট দু’গণ্ডা ভাইবোন, কিছু লীলার বাবার, ধুলো দফাদারের—এ পঙ্গপাল বলা চলে, শহরের এমন ছিমছাম ভদ্রমানুষ দেখে সবসময় ব্যাকুল হয়ে আছে—কখন কী লাগবে এগিয়ে দেবার জন্য দু’গণ্ডা ভাইবোন মিলে নানুকে চান করাতে নিয়ে গেল। আকাশে তখন কিছু নক্ষত্র উঠে গেছে। পুকুরের জলে চান করে আশ্চর্য পবিত্র মনে হচ্ছে জগৎ সংসার।