সে কুটুকে বলল, লীলা কোথায় গেছে জানিস?
কুটু বলল, না।
সে অবনীশকে বলল, লীলা কোথায় আছে তুমি জান?
অবনীশ তাকাতেই তার স্ত্রী চোখ টিপে দিল। অগত্যা সে বলল, কোথায় আর যাবে। কোথাও কাজটাজ আবার ঠিক করে নিয়েছে হয়তো।
ওর বাড়ির ঠিকানাটা দেবে?
অবনীশের স্ত্রী বলল, লাবণ্য জানে। লাবণ্যই ঠিক করে দিয়েছিল।
লাবণ্য কে? কোথায় থাকে?
সত্যি ফ্যাসাদে পড়া গেল। অবনীশের স্ত্রী বলল, মাথা খারাপ করিস না নানু। ঝি—মেয়ের জন্য তুই মাথা খারাপ করিস না।
নানু বলল, আমার মাথা খারাপ, ভালোই বলেছ। আমার মাথা খারাপ, বাবার মাথা খারাপ, বাবা মরে যাবার পর তো তোমরা পুলিশকে এমনই সব বলেছিলে। অথচ তোমরা বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। তুমি, তোমাকে আমি খুন করব।
ওগো, ও কী বলছে।
অবনীশ বলল, নানু, আয় ঘরে আয়।
কোথাও যাব না। বলো, লীলা কোথায় আছে?
খুন হওয়ার চেয়ে ঠিকানা দেওয়া অনেক সহজ। অবনীশের স্ত্রী একটা গাঁয়ের নাম বলল, একটা রেল স্টেশনের কথা বলল। চার ক্রোশ পথ হেঁটে যেতে হয় বলল। একটা বড় অশ্বত্থ গাছের নিচে নদী বয়ে গেছে বলল। এবং নদীটা পার হলেই মেঠো পথ ধরে গেলে লীলাদের বাড়ি দেখা যায়।
গাঁয়ের নাম, স্টেশনের নাম নিয়ে নানু বের হল। অশ্বত্থ গাছের নিচে নদী এবং নদী পার হয়ে মেঠো পথ খাঁ খাঁ মাঠ এবং শেষে কিছু গ্রাম গঞ্জ। গ্রাম গঞ্জ পার হলে আবার খাঁ খাঁ মাঠ তারপরই খড়ের বাড়ি—লীলা এমন একটা বাড়ি থেকেই এসেছে। সে আর দেরি করল না। বাইরে এসে সাইড ব্যাগের মধ্যে খাবার গুলি পুরে রাখল। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। গাছপালা সবুজ হয়ে আছে, এবং পাখিদের কলরব সবই আগের মতো। শুধু লীলা নেই। লীলা না থাকলে এইসব কত অর্থহীন। নানু টের পেল। সে হাঁটছে ঠিকই কিন্তু পায়ে জোর পাচ্ছে না। কতদূরে লীলা চলে গেছে। আর তারপর এক সকালে সেই স্টেশনে নেমে সে হাঁটা দিল। কথামতো অশ্বত্থ গাছ এবং নদী পেয়ে গেল। নদী পার হলে মেঠো পথ ধরে সে এগোতে থাকল। কথামতো সে খাঁ খাঁ মাঠও পেয়ে গেল। খড়ের মাঠ দিগন্ত বিস্তৃত রোদে সব যেন পুড়ে যাচ্ছে। সে হাঁটছে। সে হেঁটে যাচ্ছে। দুপুর গড়াতেই দূরে দেখতে পেল খড়ের ঘর। একটা পরিত্যক্ত গাঁ। মানুষজন সব কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
যত খড়ের বাড়িটা এগিয়ে আসছিল, তত বুক ধুকপুক করছিল নানুর। সে কত গ্রাম—মাঠ—গঞ্জ ভেঙে এসেছে, তার ব্যাগে এখনও খাবার রয়েছে। খাবারগুলো পচে যাচ্ছে। এগুলো খেলে লীলার অসুখ হতে পারে। এ কথাটা মনে হওয়ামাত্র সে খাবারগুলো ফেলে দিল। শূন্যদিগন্ত, চারপাশে, অন্য টিলার মতো উঁচু জায়গায় সেই খড়ের বাড়িঘর নিয়ে একটা গাঁ। লীলা এখানে বড় হয়েছে—এমন নীরস অনুর্বর ভূমিতে লীলার জীবন কেটে গেছে ভাবতেই সে দেখল, একটা লোক এক কাঠা ধান নিয়ে রাস্তায় বসে আছে নদী পার হয়ে যাবে বলে। নানু তাকে লীলার কথা বললে, সে চিনতে পারল না। নানু লীলার মার নাম বলল, লোকটা বলল, এগিয়ে যান, ধুলো দফাদারের বউয়ের হল গে এই বেটি।
সেই উঁচু টিলার মতো জায়গাটা ক্রমে এগিয়ে আসতে থাকল। দু—পাশে শুধু ধু ধু প্রান্তরের মতো খড়ের মাঠ। কোথা কিছু ছাগল, রাখাল বালক এবং শীর্ণকায় গভীর দল চোখে পড়ল তার। দূর থেকে গাঁটা যতটা পরিত্যক্ত মনে হয়েছিল আসলে ততটা পরিত্যক্ত নয়। গরিব—দুঃখীদের বাস এই গাঁয়ে। কোনো বড় বাড়িঘর এখনও চোখে পড়ছে না।
বারবারই তার মনের মধ্যে একটা সংশয় পাক খাচ্ছে। লীলা আছে তো। লীলা যদি এখানে না এসে অভিমানে কোথাও চলে যায়! যদি লীলাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়! যদি লীলা নদীর জলে ডুবে মরে—অথবা সবসময় কেন জানি লীলার সেই বড় বড় চোখ তাকে বারবার তাড়া করে আসছিল। হয়তো লীলা একটা গঞ্জের মতো জায়গায় গাছের নিচে শুয়ে আছে। একটা পুঁটলি মাথায়। না খেয়ে না খেয়ে চোখে কালি পড়ে গেছে। চুল উসকোখুসকো। অথবা কোনো নির্জন নদীতীরে মেয়েটা আউল—বাউলের মতো কেবল হেঁটে যাচ্ছে। নানুর মনে কত রকমের যে কুচিন্তার উদয় হচ্ছে।
এবং তখনই সেই ঘরের সামনে সে হাজির। ভাঙা মাটির দেয়াল, খড়ের ছাউনি, কিছু কলাগাছ, একটা ছাগল খুঁটিতে বাঁধা, দুটো মোরগ ঘাড় বাঁকিয়ে ওকে দেখল, সে বাধ্য হয়ে গলাখাঁকারি দিল একটা। কেউ বের হচ্ছে না। সে এবার বলল, ধুলো দফাদার আছো? তবু সাড়া নেই। চারপাশে ঝোপ—জঙ্গল, পেছনে বাঁশের ঝাড় কেমন অত্যন্ত শ্রীহীন মানুষের আবাস। সে একটা গাছের গুঁড়িতে অগত্যা বসে পড়ে ডাকল লীলা, লীলা।
এবার কেউ যেন সাড়া দিল। ঘরের ভেতর থেকে কারও গোঙানি আসছে। তাহলে কেউ আসছে। আর তখনই সে দেখল জঙ্গলের ভিতর থেকে চার—পাঁচটা নগ্ন কচিকাচা ছেলেমেয়ে বের হয়ে আসছে। তাকে দেখেই চোখে ওদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। কলকাতায় নকশালবাবুরা সব গাঁয়ে গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি যদি তাঁদের কেউ হন। সে বলল, লীলা আছে? লীলা? ওর কথা শুনে ওরা যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে এসেছিল আবার তেমনি লাফিয়ে লাফিয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং তখনই মনে হল সে কোনো এক নারীকণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে বনের গভীরে। সে বুঝতে পারল, লীলার কণ্ঠস্বর। ওর ভিতর থেকে কে যেন বলল, তখন, ভগবান লীলাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। সে জোরে ডাকল, লীলা—লীলা।