তুমি বুঝি খুব বুড়ি।
নানুর কথার কোনো জবাব না দিয়ে বলল, আমাকে আস্ত রাখবে না।
সাহস হবে না লীলা।
লীলা আর জোর পাচ্ছে না। সে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল। সমস্ত শরীর তার ভেঙে আসছে। কতকাল পর একজন ভালো মানুষের কাছ থেকে এই সহৃদয় ব্যবহার। সে বলল, দাদাবাবু কপালে আমার এত সুখ সইবে না।
নানু লীলাকে হাত ধরে টেনে তুলল—ওঠো। তুমি যাও। পরে এসো। আমি দেখব লীলা। তোমাকে শাড়ি পরে কেমন লাগে দেখব।
লীলা অগত্যা উঠে চলে গেল। এবং যখন শাড়ি পরে এসে সামনে দাঁড়াল, নানু প্রথমে তাকাতে পারল না। সে বলল, ন…ব…নী…তা।
লীলা কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, আমি যাব?
নানু ভারী আবেগে সেই কথাটাই শুধু বলল, ন…ব…নী…তা। গানের মতো করে বলল।
নানু আজকাল কোনো কারণে ভারী আবেগ বোধ করলে শিস দেবার মতো বলে ওঠে নবনীতা। তার সব আনন্দের প্রকাশ এই একটিমাত্র কথাতেই। সব দুঃখ এবং হতাশা থেকে আজকাল এই একটা মাত্র কথাই জীবনে তাকে মুক্তি এনে দেয়। সে বলল, নবনীতা আবার আমি আসব।
লীলা বলল, ওরা বাড়ি থাকলে আসবেন।
নানু বলল, আমার খুশিমতো আসব। আসলে নানু একটা কিছু করতে চায়। সেটা যে কী সে নিজেও জানে না। রোজই সকালে উঠে ভাবে, সে একটা ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে এবং সেই সিদ্ধান্তটা যে কী ঠিক কিছু তার কাছে স্পষ্ট নয়। ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতা দানা বাঁধছে। কলেজে যাচ্ছে না। মানুর সঙ্গে দেখা নেই। মানুর সঙ্গে দেখা হলে ভালো লাগত। কিন্তু তার এখন কোথাও যেতেও ইচ্ছে করছে না। একা এবং নিজের মধ্যে থাকার স্বভাব ধীরে ধীরে তার গড়ে উঠছে সে এটা ক্রমশ টের পাচ্ছে।
এবং সত্যি সে আর একদিন খুশিমতো চলে এল। যখন শহরে ঘুরে সিনেমা দেখে অথবা কোনো পার্কে চুপচাপ বসে থেকে তার কিছু ভালো লাগে না, তখনই মনে হয়, অসহায় সেই তরুণীর কাছে তার ভালো লাগবে।
একদিন কী হল, একটা বড় রেস্তোরাঁয় বসে ফ্রাইড রাইস, চিকেন কারি, এবং আইসক্রিম খেতে তার মনে হয়েছিল, লীলা জানে না, ফ্রাইড রাইস এবং চিকেন কারি বলে কোনো সুন্দর খাবার আছে। সে নিজে খেয়ে এক প্যাকেট ফ্রাইড রাইস এবং চিলি চিকেন নিয়ে সোজা সেই শহরতলির বাড়িটার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। সকালের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় বেশ ঠান্ডা আমেজ রয়েছে বাতাসে। এবং বর্ষা এবারে চলে আসবে বলে হাওয়ায় আর্দ্রতা অনুভব করা যাচ্ছে। শহরতলিতে নেমেই দেখল, গাছপালা সবুজ, ঝোপঝাড় জলের গন্ধ পেয়ে বেড়ে উঠেছে—পাশাপাশি অন্য সময়ের চেয়ে যেন বেশি উড়ছে। বলতে গেলে বেশ সুসময়। সে লীলার জন্য এক প্যাকেট ফ্রাইড রাইস নিয়ে আসতে পেরেছে। ভারি তৃপ্তি বোধ করছিল মনে মনে। এবং যখন দরজা ঠেলে বাড়িটায় ঢুকল, দেখল, জেঠু কলতলায় বসে চায়ের বাসন ধুচ্ছে।
দাদা এসেছে। দাদা এসেছে। কুটু এসে নানুকে জড়িয়ে ধরল। জেঠি অসময়ে শুয়ে আছে। ঘটর ঘটর টেবিল ফ্যানটা চলছে। তাকে দেখে জেঠি উঠে বসল, এলি? আমার শরীরটা ভালো নেই বাবা। শুয়ে আছি।
সে ভেবেছিল, সেদিনের মতো বাড়ি কেউ থাকবে না। সে এবং লীলা শুধু থাকবে। লীলাকে বলবে, তুমি আমার সামনে বসে খাও। লীলা যখন খাবে অথবা লজ্জায় লীলা যদি খেতে না পারে সামনে বসে তখন সে বলবে লজ্জা কী মানুষই তো খায়। না খেলে কেউ বাঁচে। কিন্তু সেই লীলাকেই দেখতে পাচ্ছে না। সে তখন সোজা বলল, লীলা কোথায় জেঠি?
জেঠির মুখ কুঁচকে গেল। বলল, আর বলিস না বাবা, এমন মেয়ে কোথায় কী কেলেঙ্কারি করবে, তাই ছাড়িয়ে দিয়েছি।
কীসের কেলেঙ্কারি জেঠি?
এই মানে, আমরা বাড়ি থাকি না, কিছু হলে কলঙ্কের ভাগী। মেয়েটার স্বভাব ভালো না বাবা।
নানুর মাথায় সেই যে বলে না, একটা রেলগাড়ি ঢুকে যায় মাঝে মাঝে, সেটা আবার ঢুকে যেতে থাকল। সে দাঁড়িয়ে প্রথমে মাথার মধ্যে গোটা রেলগাড়িটাকে ঢুকতে দিল। তারপর যখন রেলগাড়িটা মাথার মধ্যে ঢুকে চোখ তুলে লাল লাল হয়ে গেল, মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, পেশি ফুলে উঠতে থাকল, তখনই জেঠির চিৎকার, ও মা দ্যাখ এসে ও কুটু তোর বাবা কোথায়, তাড়াতাড়ি আসতে বল, নানুর চোখমুখ কেমন হয়ে যাচ্ছে।
কলতলা থেকে অবনীশ কাপ প্লেট ফেলে ছুটে এল, কী হয়েছে নানু? তোর কী হয়েছে?
নানু বলল, কিছু হয়নি তো।
জেঠি বলল, তোমার মরণ। দেখছ না নানুর চোখ কোথায় উঠে গেছে।
নানু বুঝতে পারছিল না, সে একটা অন্যরকমের মানুষ হয়ে যাচ্ছে। খবরটা শোনার পর সে কিছুতেই আর ধাতস্থ হতে পারছে না। সবকিছু তচনচ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তখন জেঠু সামনে দাঁড়িয়ে শুধু বলল, বোস। দাঁড়িয়ে রইলি কেন?
কুটু বলল, দাদা হাতে তোমার কী দেখি?
নানু হাত সরিয়ে নিল। কুটু আবার কোমর জড়িয়ে বলল, দাদা তুমি রাগ করেছ?
কুটু ফের বলল, না দাদা আমি তাড়াইনি। মা লীলাদিকে চুল ধরে বের করে দিয়েছে।
তখনই মহীয়সী বলল, কুটু চুউপ। তুমি আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে খাচ্ছ। কে বলেছে আমি বের করে দিইছি। নারে নানু কুটুর কথা তুই বিশ্বাস করিস না।
নানু কিছুই আর শুনতে পাচ্ছে না। কতদিন ধরে সে একটা অন্ধকার পথে হেঁটে যাচ্ছিল। কতদিন ধরে চারপাশে কেউ আলো জ্বেলে দেয়নি।
লীলাকে দেখার পর মনে হয়েছিল, ভারী অসহায় এই মেয়ে—আশ্চর্য আকর্ষণ রয়েছে লীলার চোখে মুখে—সে লীলার জন্য প্রাণপাত করতে পর্যন্ত পারে।