একটু বাদেই সে সেজেগুজে বের হবে মানুষটার সঙ্গে। কখন ফিরবে ঠিক নেই। কোনো কোনোদিন অরুণ বড় ফাজিল হয়ে যায়। ফিরতে চায় না। রাত করে ফিরলে ঠান্ডা গলায় বাবা বলবে, ‘তোমরা বড় হয়েছ। সবই বোঝ। আমার বলার কিছু নেই।’
রমা তখন বাবাকে বলতে চায়, বাবা, আমি কী বড় হয়েছি! বড় হওয়াটা কী! আজকাল সে নিজের সঙ্গে দুষ্টু দুষ্টু খেলা যখন আরম্ভ করে দেয়, মনেই হয় না পৃথিবীতে কোনো দুঃখ আছে।
অরুণের নতুন স্কুটার কেনার পর এমন হয়েছে। ছুটির দিনগুলো ভারি মজার। সকাল হলেই অরুণ নীচে এসে ডাকবে—রমা, রমা। রমা তো তৈরি। তবু অরুণকে একটুক্ষণের জন্য ওপরে উঠে যেতে হয়। দোতলায় তিনখানা ঘরের একখানা বসার ঘর। সিঁড়ি দিয়ে ঠিক ঢোকার মুখে বাথরুম, তারপর সরু করিডোর। বাঁদিকে বসার ঘরের মুখেই রান্নাঘর। করিডোর দিয়ে ঢোকবার সময় প্রায় রান্নাঘরের সবই দেখা যায়। লোকজন এলে বাড়িটার কোনো আব্রু থাকে না।
সে উপরে এলেই দেখতে পাবে বাথরুমের দরজা বন্ধ। কেউ ভেতরে আছে। তখন জল ঢালার শব্দে, মগের ঠুংঠাং আওয়াজে সে টেরও পাবে বাথরুমে কে আছে, আর টের পেলেই যা হয়, সব কিছু তার চোখের ওপর তখন ভাসতে থাকবে। ভাবতেই রমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। নিজের শরীর বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার এক আশ্চর্য বাসনা জাগে।
রমার ছোট ভাই মানু তখন রেলিঙে ঝুঁকে পড়েছে। এই মানুষটি এলে ছোটখাটো দুঃখ আর সংসারে ভেসে থাকে না। যেন সব সময়ই মানুষটার এই পরিবারের জন্য কোনো না কোনো সুখবর বয়ে আনার কথা। মানুর তো খুব প্রত্যাশা, একদিন যেমন দিদির চাকরির খবর নিয়ে এসেছিল, তেমনি তারও চাকরির খবর আনবে। বোধহয় বেলায় ঘুমোয় বলে, টেরই পায়নি, নীচে অরুণদা দাঁড়িয়ে আছে। বাইকের শব্দ থেমে গেছে। সে স্বপ্নের ভেতর বাইকের একটা শব্দ শুনতে পেয়ে যেন জেগে উঠেছিল। তারপর রেলিঙের ধারে এসে দেখেছে ঠিক অরুণদা, পাশে তার নীল রঙের স্কুটার, সুন্দর ব্যাকব্রাশ করা চুল, লম্বা বেলবটস আর রংদার বুশ—শার্ট।
বিগলিত হাসি মানুর—অরুণদা যে কী দারুণ লাগছে তোমাকে! ঘড়ি? ব্যান্ডটা দেখি—কবে কিনলে—সব ম্যাচ করা। দিদি বাথরুমে।
এই বাইকের শব্দ তো এ—বাড়ির বুকে একটা ছোট রেলগাড়ি চালিয়ে দেয়। সবাই নড়েচড়ে বসে। মা ঘোমটা টেনে বলে, ‘দ্যাখ অরুণ বুঝি এল।’
বাবার আজকাল ভীষণ ভয়, আতঙ্ক, যেন সব জায়গাতেই গণ্ডগোল লেগে আছে। কারণ শহরের দিনগুলো কোনো না কোনো জায়গায় ভয়ংকর খবরের মতো কাগজের পাতায় ভেসে থাকছে। বাবার যা স্বভাব, ঠিক বলবে, ‘অরুণ, তোমাদের ওদিকটাতে কোনো গণ্ডগোল হয়নি তো আর।’
রমা শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে এমন ভাবছিল। সবাই একটা যেন কী ভেবে ফেলেছে। অরুণ ওর অফিসে রমাকে এত ভালো মাইনের একটা কাজ জোগাড় করে দিতেই সহসা সবার সে বড় নিজের মানুষ হয়ে গেছে। এবং অরুণের জন্য সংসারের সব মানুষদের একটা কৃতজ্ঞতাবোধ জন্মে গেছে। দাদা পর্যন্ত অরুণকে আজকাল সমীহ করে কথা বলে!
অথচ অরুণ এ—সংসারে এসে স্বস্তি পায় না। এই যে রমাকে নিয়ে ছুটির দিনগুলোতে বের হয়, সম্পর্কটা যে সত্যি কী, কখনও ভেবে সে অস্থির হয়ে ওঠে, অথচ না এসেও পারে না, যে সংসারের একটা বড় কর্তাগোছের মানুষ রমা, ওর ইচ্ছেতেই এখন সব হয়। রমার ইচ্ছে না থাকলে সে কখনও এতটা এগোতে পারত না। যেন রমাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমার নিজের মানুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াব, ভয়ের কি। আর এমন সুপুরুষ, ভালো মাইনের কাজ করা মানুষ, তোমরা যতই চেষ্টা কর, কিছুতেই আমার মতো মেয়ের জন্য আনতে পারতে না। সংসারে আমার ভার কত হালকা হয়ে গেছে, বুঝতেই পারছ তোমরা। তারপরই রমার মুখে কেমন দুঃখী দুঃখী দেখায়। আসলে ভেতরে অশুভ ছায়া তখন নড়েচড়ে বেড়ায়। সে জানে সেটা কী। সে বোঝে কতটা দূরে সে স্কুটারে উড়ে যেতে পারে।
আর তখনই বারান্দায় জুতোর শব্দ। রমা শাওয়ার বন্ধ করে জুতোর শব্দ শুনল। বসার ঘরের দিকে যাচ্ছে। ঠিক একজন বুড়ো মানুষের মতো মনে হয়। বারান্দা ধরে বসার ঘরে মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন কোনো রুগণ মানুষকে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এবং এত করেও এই ভারিক্কি রুগণ শব্দটা রমা দূর করতে পারেনি অরুণের। বাড়িতে অরুণের এতটা কাপুরুষের মতো স্বভাব রমার পছন্দ না। যেন বাড়িতে চোর ঢুকেছে। বাড়িতেই এমনটা। কিন্তু যখন স্কুটার চালিয়ে দেয়, নীল আকাশের নীচে ধাবমান স্কুটার আর সে, পাগলের মতো অরুণ কত দূরে যে যেতে চায়। সে মাঝে মাঝে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘এই পড়ে যাব। মরে যাব। আস্তে।’
অরুণ তখন আরও মজা পায়।
রমা যতটা পারে কোমর ধরে বসে থাকে। যত নীল আকাশ দুরন্ত ছেলের মতো দামাল হয়ে ওঠে, চারপাশের বাড়িঘর, গাছপালা যত দ্রুত ধাবমান দৃশ্যাবলি হয়ে যায় তত সে খামচে ধরে অরুণকে। যেন সে তখন পারলে অরুণের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চায়।
আর অরুণ এক উন্মুক্ত আকাশতলে প্রায় শক্ত বাহুতে ব্যালান্সের খেলা খেলতে খেলতে কোন এক সুদূর গোপন গহন অভ্যন্তরে প্রবেশ করে—রমা সত্যি থই পায় না। এমন একটা জীবন ছেড়ে দিতেও তার ভয় লাগে। সে তখন একা হয়ে যাবে। ভারি নিঃস্ব। পৃথিবীতে এমন কোনো নবীন যুবকের আর সন্ধান পাবে না, যে তাকে অরুণের মতো সুদূরে নিয়ে যেতে ভালোবাসে।