নানু কিন্তু বংশের কোনো কৌলীন্যই পায়নি। নানু দেখতে তার মার মতো কিন্তু ভীষণ লম্বা এবং অল্প বয়সেই দাড়ি গোঁফ উঠে যাওয়ায়, তাকে এই আঠারো উনিশ বছরে একজন পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের যুবকের মতো লাগে। সে কখনও দাড়ি কামায়, কখনও কামায় না। কলেজে যায়, তবে কলেজ করে না। এবং যা খবর, তাতে দুশ্চিন্তা একমাত্র সার করে রাসবিহারীকে বেঁচে থাকতে হবে। নানু তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা একমাত্র তার ছোট মাসিকেই বলে। এবং কখনও কখনও এমন সব সাংঘাতিক কথাবার্তা কানে আসে যে রাসবিহারী নিজের মৃত্যু কামনা করতে বাধ্য হন।
এই যেমন এখন নানু একটা চেক কাটা লম্বা পাজামা পরে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বসে কাগজ পড়ছে। চশমা চোখে—খুব অল্প বয়সেই চোখ খারাপ হয়ে যাওয়ায় বাবা তাকে চশমা পরিয়ে গেছে। এখনও সেই চশমাটাই চোখে। চশমার পাওয়ার বদলানো দরকার—কিন্তু মানুষের মনে কী যে থাকে—নানু বাবার দেওয়া চশমা কিছুতেই চোখ ছাড়া করবে না। রাসবিহারী জানে নানুর ইচ্ছা না হলে এই পাওয়ার বদলানোর কম্ম তার কেন, তার প্রপিতামহেরও সাধ্য নেই। ওর মার স্বভাব ঠিক উলটো। যখন যেমন, অর্থাৎ নেই বলে বসে থেকে লাভ নেই, সময়ের সঙ্গে শরীরের সঙ্গে তাল দিয়ে চলার স্বভাব। হাহাকারের মধ্যে একজন মানুষ কতক্ষণই বা থাকতে পারে। তুই ছেলে হয়ে মার দুঃখটা বুঝবি না। অবুঝের মতো মাথা খারাপ করবি। আজকাল তোর মার বয়সে কত মেয়ের বিয়ে হয়—আকছার এ—বয়সটা আজকালকার মেয়েদের প্রায় বিয়ের বয়স। পঁয়ত্রিশ—ছত্রিশ একটা বয়স!
তখনও দুম করে নানু বলে ফেলল, আচ্ছা দাদু তোমার তো বয়েস হয়েছে।
রাসবিহারী বললেন, বয়েস ত হবেই।
এ বয়সে মানুষ কিছু সত্য কথা বলে থাকে।
মানুষ সব সময়ই সত্য কথা বলে।
তুমিও বলেছ?
যখন যেমন দরকার। মানুষের সত্যাসত্য সঠিক কি, মানুষ কখনও বলতে পারে না।
নানু তর্কে যেতে চাইল না। এখানে আসার পর থেকেই ভাবছে, কেবল ভাবছে—কাকে দিয়ে সে আরম্ভ করবে, মাকে দিয়ে, দাদুকে দিয়ে, জ্যাঠামণিকে দিয়ে, না অন্য কাউকে দিয়ে? কিন্তু আজ সকালে মনে হল, দাদুকে দিয়েই শুরু করা যাক। বলল, দাদু, তুমি অনেক বেশি জানো। কিন্তু এটা কি জানো বাবা কেন আত্মহত্যা করলেন?
রাসবিহারী চিৎকার করে উঠলেন, নানু কে বলেছে তোমার বাবা আত্মহত্যা করেছেন?
আমি জানি দাদু, তোমরা যতই গোপন রাখো সব জানি। বাবা কুড়িটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছিলেন। বাবা লিখে রেখে গেছিলেন, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। তার আগের রাতে মা আমাকে নিয়ে তোমার কাছে চলে এসেছিল। ঠিক বলিনি? আমার সব মনে আছে। আমার বাবা, প্রিয় বাবা, আমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতেন। তিনি দুম করে মরে যাবেন কেন, তাঁকে তোমরা সবাই মিলে কিছু একটা করেছ—আমার কাজ সেই কিছুটা কী বের করা।
রাসবিহারী উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর হাত পা কাঁপছিল। তিনি ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। নানু চোখ তুলে দেখল, মানুষটা অনেক নুয়ে পড়েছে।
সে বলল, চলে যাচ্ছ কেন দাদু। আমার কথার জবাব দাও। এই আত্মহত্যায় কার হাত ছিল বলে যাও? তাদের সবাইকে আমি ফাঁসিকাঠে ঝোলাব।
দুই
তখন সকাল বেলা। সকালসকাল স্নান করে নেবার অভ্যাস রমার। তখনই কেউ এসে ডাকল, ‘রমা আছে!’
রমা বাথরুমে। রমা স্কুটারের শব্দে টের পায় সে এসে গেছে। রমা অনেক দূর থেকে শুনতে পায়, নীল রঙের স্কুটার চড়ে সে আসছে। অনেকদূর থেকে আওয়াজটা অতীব এক ভোমরার মতো শব্দ করতে থাকে। যেন দূরান্তে আছে লোকটা, স্কুটারে চাপলেই গড় গড় শব্দ, কোনো দূরবর্তী জায়গা থেকে শব্দটা ভেসে আসে। রমা তখন স্থির থাকতে পারে না।
দোতলায় বারান্দায় বোধহয় কেউ নেই। বাবা ঠিক কাগজ পড়ছে। মানুষটা নীচে দাঁড়িয়ে রোজকার মতো বলবে, রমা আছে। আশ্চর্য অভ্যাস মানুষটার। রমা যাবে কোথায়? রমা আছে কী নেই কথাটা অবান্তর। আসলে জানান দেওয়া, এলাম। স্কুটারের শব্দে টের পায় সবাই সে এসেছে। অধিকন্তু নীচে দাঁড়িয়ে বলা, রমা আছে? রমার ভারি হাসি পায় কথাটা ভেবে।
আজ ছুটির দিন। ছুটির দিন হলেই অরুণ সকালসকাল চলে আসে। রমা অন্য দিনকার চেয়ে ছুটির দিনে আরও একটু বেশি সময় নিয়ে বাথরুমে ঢোকে। যেন ছুটির দিনে সহজে সব কিছু সাফ—সোফ হতে চায় না।
আর গরমের দিনে কোথাও বের হতে হলে স্নান না করে বের হওয়াও যায় না। ফুরফুরে বাতাসে চুল উড়বে। শরীরে মেখে নিতে ভালো লাগে সব মনোরম গন্ধ। এবং লোকটার গায়ে মিশে থাকতে তখন কী যে আরাম লাগে! যথার্থ পুরুষমানুষের গন্ধ অরুণের শরীরে! কী সুন্দর গন্ধটা! ঠিক স্কুটারের মতই মনে হয়, যত সে বাতাসে ভর করে আসছে ততই গন্ধটা ক্রমে এগিয়ে আসে। এবং এভাবে নীচে এসে না ডাকলেও টের পায়, কোথায় কত দূরে আছে মানুষটা। রমা আছে, এমন প্রশ্নে সে অরুণের মধ্যে একজন কাপুরুষেরও গন্ধ পায়।
রমা জানে, অরুণকে দরজা খুলে দেবার লোকের অভাব নেই বাড়িতে। অরুণ সোজা বারান্দা ধরে সিঁড়িতে উঠে আসছে জুতোর শব্দে তাও সে টের পায়। এবং এমনই যখন সব কিছু তখন একটু দেরি করলেও ক্ষতি নেই। সে ঠিক উঠে আসবে ধীরে ধীরে। জুতোর শব্দ সিঁড়িতে। ওর উঠে আসা, বসা এবং প্রতিটি কথাবার্তা শোনার জন্যে তখন মাথায় জল ঢালে না রমা। কেমন গোপন এক অভিসার নিজের সঙ্গে নিজের।